ভাষা-ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর বৈশিষ্ট্য মনোযোগর সঙ্গে লক্ষ করা দরকার। বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে প্রধানত আঞ্চলিক ভাষাই ব্যবহার করা হয়, এমনকী বড় শহরগুলোতেও এর ব্যতিক্রম তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। আর নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর ভাষা তো অবশ্যই আঞ্চলিক। কিন্তু মধ্যবিত্তের প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে তার পার্থক্য অনেক। যতই দিন যাচ্ছে মধ্যবিত্তের শিক্ষা ও চির পরিবর্তনের সঙ্গে এই পার্থক্য ততই প্রকট হয়ে উঠছে। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণ মধ্যবিত্তের প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে গ্রামের এমনকী শহরের নিম্নবিত্তের প্রকাশভঙ্গি অনেকটা আলাদা।
নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীদের কথায় প্রবাদ ও উপমা ব্যবহার করার প্রবণতা অনেক বেশি। প্রবাদ, শ্লোক, ছড়া, আর্যা ও উপমার সাহায্যে তারা নিজেদের বাক্য অলংকৃত ও আকর্ষণীয়। করে তোলেন। সরাসরি সরলবাক্য দিয়েও বক্তব্য প্রকাশ করা চলে, কিন্তু প্রবাদ-শ্লোক-ছড়া-উপমা প্রভৃতি বক্তব্যকে একই সঙ্গে তীব্র ও আকর্ষণীয় করে। মধ্যবিত্তের চির সঙ্গে। এসব প্রায়ই খাপ খায় না, তাদের কাছে এইসব প্রবাদ বা শ্লোক বা ছড়া, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাচনভঙ্গি পর্যন্ত অশ্লীল বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু এই প্রকাশ তাদের জীবনযাপন ও চেতনার এত গভীর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে যে শ্রমজীবীদের কাছে এসবের গীল অশ্লীলতার প্রশ্নটি একেবারে গৌণ। আর মধ্যবিত্তের রুচিরও বলিহারি! টিভি ও সিনেমায় অভিনয়ের নামে স্বদেশি-বিদেশি মেয়ে-পুরুষদের চোখমুখ ও কণ্ঠের ন্যাকামি ও স্থাবলামি দেখে এরা অভিভূত, আর নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর মুখের ভাষা গুনে এদের কান একেবারে লাল হয়ে ওঠে। বুদ্ধিজীবীরা সেখানে ব্রাহ্মসমাজসুলত সুরুচি ও সুনীতির বচনে মুখর। এইসব ব্যাপারে বামপন্থি বুদ্ধিজীবীরাও শুচিবায়ুগ্রস্ত। শ্রমজীবীর জীবনযাপনের সঙ্গে তার ভাষা সামঞ্জস্যপূর্ণ। হাজার হাজার বছর ধরে প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ করার ফলে আবেগ অনুভূতির রাখোটাকো-মার্কা প্রকাশ তাদের স্বভাবের বাইরে। তাদের প্রেম-ভালোবাসা বা স্নেহ-বাসল্যের প্রকাশের ভাষাও মধ্যবত্তিসুলত তুলতুল মার্কা মিষ্টি হতে পারে না। ভাষাকে তারা অলংকৃত করেন, কিন্তু সঁতসেঁতে করেন না। নিরক্ষর শ্রমজীবীর হাতে সাহিত্যসৃষ্টি হয় না হওয়া সম্ভব নয়। ভাষায় অলংকার ব্যবহার করে এঁরা সাহিত্যচর্চার ক্ষুধা মেটান। এতে সাহিত্যসৃষ্টি হয় না, কিন্তু এটা তাদের সংস্কৃতিচর্চার অংশ।
লেখক ও শিল্পীর হাতে নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর সংস্কৃতি উঁচুদরের শিল্পে পরিণত হয়। উত্তর। ভারতের লোকগীতির সুর বড় বড় শিল্পীর হাতে বিবর্তিত হয়ে রাগ-রাগিণীর পর্যায়ে উঠেছে। লোকের মুখেমুখে প্রচলিত কাহিনী অবলম্বনে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যগুলো। আধুনিক কালে শিল্প ঠিক প্রাকৃতিক নিয়মে গড়ে ওঠে না, শিল্পীর সচেতন ভাবনা ও তৎপরতার ফল আধুনিক শিল্প-সাহিত্য। বিটোফেন, ভাগনার প্রমুখ শ্রেষ্ঠ পাশ্চাত্য সংগীতরচয়িতার শিল্পকর্মের উৎস হল ইউরোপের গ্রামের প্রকৃতি, গ্রামের লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতি। এঁদের শ্রেষ্ঠ কীর্তিসমূহ সচেতন প্রয়াসের ফল।
শ্রমজীবীর কাজের মধ্যে যে-ছন্দ ও গতি, নৃত্যে তারই মার্জিত ও সংগঠিত রূপ হল তাল ও মুদ্রা। শুধু তা-ই নয়, এই ছন্দ ও গতিকে একজন যথার্থ শিল্পী মানুষের মনোরঞ্জনে সীমাবদ্ধ রাখেন না। এর সাহায্যে তিনি তার উপলব্ধি ও বক্তব্যকে জ্ঞাপন করেন। নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর সংস্কৃতি শিল্পীর হাতে নতুন ব্যঞ্জনা পায়, এই সংস্কৃতি শিল্পে উত্তীর্ণ হয়ে সর্বজনীনতা লাভ করে। শ্রমজীবীর ব্যবহৃত গান ও ছড়া, প্রবাদ বা প্রবচনকে লেখক উঁচুস্তরের চিন্তাপ্রকাশের জন্য ব্যবহার করে তাকে নতুন মাত্রা দেন। কিন্তু আমাদের মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চায় এরকম পরিচয় প্রায় নেই বললেই চলে। মধ্যবিত্তের সৃষ্টিতে শ্রমজীবীর জীবন আজকাল প্রায়ই পাওয়া যায়। বাংলা নাটক ও চলচ্চিত্রে মাঝে মাঝে নিম্নবিত্তের জীবন প্রতিফলিত হয়। কিন্তু তাদের সাংস্কৃতিক জীবন সংগঠিত শিল্প-সাহিত্যে অনুপস্থিত বললেই চলে। যেটুকু আছে বাংলা ভাষার বিশাল ও সমৃদ্ধ সাহিত্য ও ব্যাপক সংস্কৃতিচর্চার তুলনায় তা একেবারেই কম ও তাৎপর্যহীন।
কয়েকটি সাম্প্রতিক বাংলা উপন্যাসের উপজীব্য নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী সম্প্রদায়। এদের দাবি ও বঞ্চনার কথাও কারও কারও লেখায় সার্থকভাবে এসেছে। কবিতায় নিম্নবিত্তের শোষণ ও শোষণমুক্তির সংগ্রামে অংশ নেওয়ার সংকল্প ঘোষিত হয়েছে। এইসব সাহিত্য ও শিল্পকর্ম নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক ছেলেকে উদ্বুদ্ধ করেছে মধ্যবিত্ত সংস্কার ও খাটো বাসনা ঝেড়ে ফেলে বামপন্থি রাজনীতির বন্ধুর পথে তাঁদের পদচারণা ঘটেছে। কিন্তু ঐসব সাহিত্য ও শিল্পকর্মে নিম্নবিত্তের সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয় না। তা হলে এসব ক্ষেত্রে প্রতিফলিত নিম্নবিত্তের জীবনকে স্থিরচিত্রের বেশি মর্যাদা দিই কী করে? শ্রমজীবীর জীবনযাপন, তাঁর ভুলভাল বা ঠিকঠাক বিশ্বাস, তার সংস্কার ও কুসংস্কার, তার পছন্দ-অপছন্দ, তার রুচি, তার ভাষা ও প্রকাশ, তার শক্তি ও দুর্বলতা, তার ভালোবাসা ও হিংসা–এসব নিয়েই তো তার সংস্কৃতিচর্চা, তার সংস্কৃতির এই পরিচয় বাংলা সাহিত্যে কোথায়?