এইসব ব্যস্ততা, তৎপরতা ও কাজ, দায়িত্ব ও কর্তব্য, চিন্তা ও দুশ্চিন্তা এবং উদ্বেগ ও উত্তেজনা নিয়ে নিরক্ষর ও কপর্দকশূন্য নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী একজন আস্ত মানুষ। আস্ত একজন। মানুষ কখনো সংস্কৃতিশূন্য জীবনযাপন করতে পারে না। যার চিন্তাভাবনা আছে, দুঃখ শোক, আনন্দ-বেদনা, ক্রোধ-বিরক্তি ও ক্ষোভপ্রকাশের জন্য যিনি ভাষা ব্যবহার করতে পারেন সংস্কৃতিচর্চা না-করে তার উপায় নাই। তার সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে পরিচিত হতে না পারলে তাকে অন্তরঙ্গভাবে চেনা খুব কঠিন, অসম্ভব বললেও চলে। কিন্তু শিক্ষিত বামপন্থি বেশির ভাগ সময় ব্যাপারটি খেয়াল করেন না। তারা মনে করেন যে, সংস্কৃতিচর্চা সীমাবদ্ধ কেবল মধ্যবিত্তের মধ্যে। বর্তমান সমাজব্যবস্থা ভেঙে ফেলবার পক্ষে একটি প্রধান যুক্তি হল এই যে, সমাজের অধিকাংশ মানুষ কেবল খাওয়া-পরা থেকে বঞ্চিত নন, সংস্কৃতিশূন্য একটি জীবনযাপন করতে তারা বাধ্য হচ্ছেন।
একথা ঠিক যে, নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর সংস্কৃতিচর্চায় বিকাশ ঘটছে না, একটি বিশেষ পর্যায়ে এসে তার বিবর্তন প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। দারিদ্র্য যেমন শতাব্দীর পর শতাব্দী তাঁদের একই মানের জীবনযাপন করতে বাধ্য করে, সংস্কৃতিচর্চাও তাদের একটি পর্যায়ে থেকে নতুন ধাপে উঠতে হোঁচট খাচ্ছে। কিন্তু নিম্নমানের জীবনযাপন সত্ত্বেও জীবনধারণ তো আটকে থাকে না, যে-করে হোক তারা বাঁচেন। তেমনি যে-মানেরই হোক বা একই জায়গায় স্থির হয়ে থাকুক, নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর সংস্কৃতিচর্চা তার জীবনে অনুপস্থিত নয়। বরং এই সংস্কৃতিচর্চা তার জীবনের সঙ্গে অনেক বেশি সম্পৃক্ত, বাঁচার জন্য এটা তার জীবনে অপরিহার্য।
পক্ষান্তরে, মধ্যবিত্তের সংগঠিত সংস্কৃতিচর্চা অনেকটাই শৌখিন। এখানে কবি বা শিল্পীর কথা বলা হচ্ছে না। একজন যথার্থ কবি কী গায়ক কী চিত্রশিল্পী কী অভিনেতা কী চলচ্চিত্রকার তার সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে সংস্কৃতিকে উত্তীর্ণ করেন শিল্পে। সৎ ও নিষ্ঠাবান শিল্পী তার শিল্পচর্চার মাধ্যমে মধ্যবিত্ত সংকীর্ণতা ও আড়ষ্টতাকে ঝেড়ে ফেলার সাধন করে। যান। সেটা মধ্যবিত্ত প্লানি ও ক্লেদ প্রকাশের মধ্যেও হতে পারে, নতুন সুস্থ জীবনের। সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত দিয়েও হতে পারে। কিন্তু গড়পড়তা মধ্যবিত্ত যে-সংস্কৃতিচর্চা করেন। তা তাঁর জীবিকা ও দৈনন্দিন জীবনযাপনের সঙ্গে সম্পর্কহীন। একই ব্যক্তির মধ্যে যখন ধ্রুপদ সংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, ডিসকো গান ও পপগানের প্রতি সমান ভক্তি দেখা যায় তখন বোঝা যায় যে সংগীত জিনিসটা তার ভেতরে ঢোকে না, গানের ব্যাপারে তার ভালোলাগা বলে কিছু নেই, এটার সাহায্যে সমাজে তিনি রুচিশীল ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত হতে চান। সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান বা বায়োনিক উওম্যান সিরিজের ছবি দেখার জন্য উগ্রীব ব্যক্তি একুশে ফেব্রুয়ারি কী পয়লা বৈশাখে কারুকাজ-করা-পাঞ্জাবি পরে বাংলা-প্রেম দেখাতে বের হন। অর্থাৎ, কোনোটাই তার স্বভাবের অন্তর্গত হতে পারেনি। কুলা, শিকা বা শীতলপাটি দিয়ে একজন আমলা কী ইঞ্জিনিয়ার কী অধ্যাপকের ড্রয়িংরুম সাজানো হলে বোঝা যায় যে তাঁর জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কহীন এইসব বন্ধু তার কাছে গৃহসজ্জার অতিরিক্ত কোনো মূল্য বহন করে না।
নিম্নবিত্ত শ্রমজ্জীবীর সংস্কৃতিচর্চার উৎস হল তাঁর জীবিকা। তার শ্রমের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন বলে তার সংস্কৃতিকে উপরিকাঠামোর পর্যায়ে ফেললে ভুল করা হবে। সংস্কৃতিচর্চা তাঁর কাছে কেবল মনোরঞ্জনের ব্যাপার নয়। কৃষক যখন গান করেন তখন মন হালকা করার উদ্দেশ্যে। করেন না। পান না-করলে তাঁর শ্রম অব্যাহত রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় বলেই তাকে গাইতে হয়। শরীরের সঙ্গে গানও তাকে জমিতে খাটতে সাহায্য করে। মাঝির গান তার নৌকা বাইবার প্রেরণা। শুধু প্রেরণা বললে কম বলা হয়। উত্তাল নদী অতিক্রম করার জন্য। তার হাত দুটোর সঙ্গে গানের ভূমিকাও কম নয়। তার কাজের সঙ্গে, পরিবেশের সঙ্গে সংগতি রেখে গানের বাণী ও সুর সৃষ্টি হয়েছে। এখানে তাকে কীর্তন কী রবীন্দ্রসংগীত কী নজরুলগীতি কী কাওয়ালি এমনকী ভাওয়াইয়া গাইতে হলেও নৌকা চালাবার কাজে তার বিঘ্ন ঘটবে। উত্তর বাংলার যে-মানুষ গোরুর গাড়ি চালিয়ে পাড়ি দেন বিশাল প্রান্তর, তার শরীরের শক্তি ভাওয়াইয়া। আধুনিক গান কী পপ তো দূরের কথা, ভাটিয়ালি গানও তাঁর জন্য অপ্রয়োজনীয় ও শৌখিন। ছাপেটার সময় শ্রমিক যে-গান করেন, ভারী কোনো জিনিস। ঠেলে তুলবার সময়কার গান থেকে তা আলাদা। উঠানে ধানঝাড়ার সময় চাষি মেয়েরা যে-গান করেন, কেঁকিতে ধান ভাবার সময় ঐ গান গাইতে গেলে তা ঐ সময় শিবের গীত। গাওয়ার মতো অপ্রাসঙ্গিক হবে। ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ কথাটা মিছেমিছি প্রচলিত হয়নি।
শুধু গান নয়, নৌকার গলুই, লাঙলের জোয়াল, দায়ের ফলা, কাস্তের গা প্রভৃতি জায়গায় যেসব কারুকাজ করা হয় তার প্রত্যেকটির উৎস কিন্তু শ্রম, জীবিকার শ্রমকে সহজ করে তোলা। এইসব কারুকাজ মধ্যবিত্তসমাজের নামকরা শিল্পীর দ্বারা সম্ভব নয়। মধ্যবিত্তসমাজে শিল্পীর প্রধান উদ্দেশ্য সৌন্দর্যটি। এমনকী অতিউৎসাহী বামপন্থি কোনো শিল্পী হয়তো কারুকাজের মধ্যে শ্রেণীসগ্রামের ছবি আঁকলেন। কিন্তু এর ফলে নানা ধরনের অসুবিধার সৃষ্টি হতে পারে। নৌকার গলুইতে এই ছবি খোদাইয়ের ফলে গলুই অতিরিক্ত ভারী বা পাতলা হয়ে যেতে পারে, যার ফলে নৌকার ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তখন নৌকা চালাতে মাঝি অসুবিধা বোধ করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, কারুকাজের মান ও নৈপুণ্য উন্নত হলেও মাঝির জীবিকার সঙ্গে তার সম্পর্ক না-থাকায় শ্রমসম্পাদনে তা তার কোনো কাজেই লাগবে না। তা হলে দুদিন পর এই কারুকাজের ব্যবহার উঠে যেতে বাধ্য।