তবু শ্রমজীবীদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে স্থায়ীভাবে সংগঠিত করা বামপন্থি কর্মীদের আয়ত্তের বাইরে রয়ে যায়। অন্তত এখন পর্যন্ত অবস্থাটা তা-ই। ১৯৬৯ সালের ব্যাপক গণআন্দোলনকেও বামপন্থি ফাগণ সমাজ-পরিবর্তনের লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারেননি। অথচ এই আন্দোলনের সূত্রপাত ও বিকাশ ঘটে তাদের হাতেই। আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও সংকল্প নিয়েও বামপন্থি কর্মীগণ শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে পারছেন না কেন? পার্লামেন্টারি রাজনীতির টাউট নেতাদের ওপর বীতশ্রদ্ধ শ্রমজীবীগণ বামপন্থি কর্মীদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ না কেন? এর প্রধান কারণ শ্রমজীবীদের সঙ্গে বামপন্থি কমাদের সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা। এই বিচ্ছিন্নতা দূর করতে না পারলে শ্রমজীবী মানুষের আস্থা ও আত্মীয়তা লাভ করা অসম্ভব।
নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের অধিকাংশই শহরবাসী। বামপন্থি কর্মীদের কাজ করতে হয় গ্রামে, কিন্তু তারা মানুষ হয়েছেন শহরে। এই শহর প্রকৃত শহরও হতে পারে আবার নিমশহরও হতে পারে। রাজধানী বা জেলাশহর বা মহকুমা-শহর তো হতে পারে, আবার থানা বা শিল্পএলাকা বা ছোট বাণিজ্যকেন্দ্র বা রেলওয়ে জংশনকে কেন্দ্র করে গড়ে-ওঠা নিমশহরও কিন্তু শহর। একটি শহর যত হোট হোক, সেখানকার মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন আশেপাশের গ্রামের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন এমনকী নিজেদের গ্রামের জমির ওপর নির্ভরশীল বা আধা-নির্ভরশীল পরিবারের স্কুল-কলেজে পড়া ছেলেমেয়েরা ছোটখাটো জীবনযাপন সম্পর্কে প্রায় সম্পূর্ণ অজ্ঞ। এই ছেলেমেয়েদের ছোটখাটো চাকরি করা বা ছোটখাটো ব্যবসা-করা বাপচাচার জীবনের পরম সাধ এই যে, ছেলেরা ভালো চাকরি নিয়ে বড় শহরে যাক, ব্যবসা যদি করে তো বড় শহরে গিয়েই করুক। মেয়েদের বিয়ের জন্য তারা শহরবাসী বর খোঁজেন। শহরের প্রতি এই টান গ্রাম সম্বন্ধে তাঁদের উদাসীন করে তোলে এবং পরিবারের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই উদাসীনতা ক্রমে পরিণত হয় অবজ্ঞায়।
উদাসীনতা ও অবজ্ঞার এই মনোভাবকে ঝেড়ে ফেলেই একজন তরুণ বামপন্থি রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু যে-শ্রমজীবীর শাসনপ্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর সগ্রামে নামা, তাদের জীবনযাপন সম্পর্কে অজ্ঞতা কাটানো সহজ কাজ নয়। বই পড়ে, নিজেদের দেখাশোনা ও বুদ্ধিবিবেচনার সাহায্যে নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর নিদারুণ অভাব সম্বন্ধে তার ধারণা মোটামুটি স্পষ্ট। তিনি জানেন যে, আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যা খেয়ে প্রাণধারণ করেন, আমাদের এই দেশের অতি অল্প কিছু লোকের কুকুরও এর চেয়ে পুষ্টিকর খাবার খায়। তিনি জানেন যে, আমাদের দেশের কৃষিশ্রমিকদের অধিকাংশই বছরের দীর্ঘ একটি সময় প্রায় অনাহারে দিন কাটান এবং না-খেয়ে না খেয়ে তার পাকস্থলীর কাঠামো এমন দুর্বল হয়ে পড়ে যে হঠাৎ একটু বেশি খেলে পেটে অসুখ হয়ে তিনি মারা পড়েন। তিনি জানেন যে চিকিৎসা হল তাদের কাছে পরম বিলাসের বন্ধু। আমাদের এই নদীমাতৃক দেশে গ্রামের শ্রমজীবীরা গ্রীষ্মকালে যে-পানি খান, এই সোনার দেশেরই ভদ্রলোকেরা তা-ই দিয়ে শৌচকার্য করার কথাও কল্পনা করতে পারেন না। বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মী এসব কথা জানেন। কেবল জানেন না, মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারেন বলে উঁচু জাতে ওঠার দৌড়ে -নেমে রাজনৈতিক সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেন।
শ্রমজীবী মানুষের দারিদ্র বহু শতাব্দীর নিদারুণ শোষণের ফল। ইতিহাসের যতদূর দেখা যায়, বাংলার নিম্নবিত্তের সচ্ছল ছবি পাই না। এক হাজার বছর আগেকার বাংলা কবিতায় মানুষের নিত্যউপবাসের খবর আছে।
কিন্তু এই পারি দিয়েই নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীকে সম্পূর্ণ চেনা যায় না। তার জীবনযাপনে মানবিক মূল্যবোধসমূহের বিকাশ আছে এবং হাজার হাজার বছরের শোষণ তার সুকুমার বৃত্তিকে উপড়ে ফেলতে পারেনি। তাই তার যথার্থ পরিচয়লাভের জন্য তার সংস্কৃতিকে জানা একেবারে প্রথম ও প্রধান শর্ত।
মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আসা রাজনৈতিক কর্মীর কাছে নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর প্রধান ও একমাত্র পরিচয় এই যে, লোকটি অসম্ভব রকমের গরিব। একথা ঠিক যে, দারিদ্র্য যে-জীবনযাপন করতে তাঁকে বাধ্য করে তা মানবেতর। কিন্তু পত্র মতো জীবনযাপন করলেও তিনি যে মানুষ এই সত্যটি উপলব্ধি করা দরকার। নইলে শ্রমজীবীর মানবোচিত জীবনের মান অর্জন করার সংগ্রামে সর্বশক্তি প্রয়োগ করা রাজনৈতিক কর্মীর পক্ষে সম্ভব নয়।
দারিদ্র্য যতই ভয়াবহ ও প্রকট হোক, কেবল তা-ই দিয়ে কাউকে শনাক্ত করা হলে তাকে মর্যাদা দেওয়া হল না। যাকে সম্মান করতে পারি না, তার সমস্যাকে অনুভব করতে পারব না। নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী যত গরিব হোন না, তিনি একজন মানুষ। তিনি একজন ব্যক্তি, একটি পরিবারের প্রধান, কারও স্বামী, কারও ভাই, কারও ছেলে এবং নিজের ছেলেমেয়ের বাপ। পরিবারের যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাকেই। তার মতো না খাওয়া ও আধপেটা-খাওয়া মানুষের সমাজ আছে, সেখানেও তার কিছু-কিছু দায়িত্ব থাকে। দারিদ্রের সঙ্গে একটি ধর্মবিশ্বাসও তিনি বাপ-দাদার কাছ থেকে বহন করে এনেছেন, যদিও ধর্মচর্চার ব্যাপারে ভদ্রলোকদের সঙ্গে তার সম্পূর্ণ মিল নেই। ঈদে-পার্বণে নতুন জামাকাপড়ের খোঁজে তাকে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে হয়। বেশির ভাগ সময় কিছুই। মেলে না, তবু তৎপর তো হতেই হয়। পাড়ার বা সমাজের লোকের জন্ম-মৃত্যু-বিবাহেও তার ভূমিকা থাকে। সর্বোপরি তার পেশা বা জীবিকা তাঁকে ব্যস্ত রাখে। কাজ যখন থাকে না কাজ দেওয়ার মালিকদের কাছে পাত্তা না-পেলেও পরিবারের দায়িত্ব থেকে তিনি রেহাই পান না। তখন নিজের এবং ঝে-ছেলেমেয়ের পেট ঠাণ্ডা রাখার চিন্তায় মাথাটা তার গরম হয়ে থাকে।