মাথা থাকলে একটু ঘামাতে হয় বইকী! বিষয়টি যদি রাজনৈতিক কর্মীর মাথায় কামড় না দেয় তো বুঝতে হবে যে সেই মাথায় কামড়াবার মতো কস্তুর অভাব ঘটেছে। আমাদের এখানে সচেতন ও সংগঠিত সংস্কৃতিচর্চা প্রচলিত কেবল মধ্যবিত্তের মধ্যেই। আজ মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এর ফল কারও জন্য ভালো হয়নি। নিম্নবিত্তের মধ্যে শিক্ষার প্রসার একেবারেই নেই। সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার ফলে দেশের শিক্ষিত অংশের সঙ্গে নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর মানসিক ব্যবধান ক্রমে বেড়ে চলেছে। শিক্ষিত মানুষের প্রত্যেকেই হল এক-একটি বদমাইশ ও শয়তান–একথা ঠিক নয়। শিক্ষিত মানুষের একটি ছোট অংশ নিম্নবিত্তের মুক্তির জন্য স্থিরসংকল্প। এই অংশটির সঙ্গেও নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর পূর্ণ যোগাযোগ স্থাপিত হয় না। তাদের কথাবার্তা, তাদের চিন্তাভাবনা, তাদের আচরণ ও ব্যবহার বুঝে ওঠা নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর আয়ত্তের বাইরে।
মধ্যবিত্তের জন্য এই বিচ্ছিন্নতা মারাত্মক বিপর্যয় টেনে আনছে। যাকে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ বলে ঢাক পেটানো হয় তা যদি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কর্মপ্রবাহ ও জীবনযাপন থেকে প্রেরণা নিতে না পারে তো তাও অপসংস্কৃতির মতো উটকো ও ভিত্তিহীন হতে বাধ্য। তার বাইরের চেহারা যতই ‘রুচিশীল রুচিশীল’ হোক, তাতে ঘষামাজাভাব যতই থাকুক, তা রক্তহীন হতে বাধ্য। সংখ্যাগরিষ্ঠের রক্তধারাকে ধারণ না-করে কোনো দেশের সংগঠিত সংস্কৃতিচর্চা কখনো প্রাণবন্ত হতে পারে না। এই বিচ্ছিন্নতার ফলে আজ আমাদের সংস্কৃতি রুগ্নদেহ তার দৃষ্টি ফ্যাকাশে, তার স্বর ন্যাকা এবং নিশ্বাসে প্যানপ্যানানি। যার সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চা মানুষের জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে পারে না, তার রাজনীতির ফলপ্রসূ হবার সম্ভাবনা কম। আজ অনেক রাজনৈতিক কর্মী নিজেদের সগ্রামী তৎপরতাকে নিষ্ফল ভাবতে ক্ষ করেছেন। বামপন্থি কর্মীদের অনেকেই আজ হতাশ ও বিচলিত। বিভিন্ন বামপন্থি সংগঠনের অধঃপতন যে কোথায় নেমেছে তা বোঝা যায় যখন দেখি যে এরা আজ যে-কোনো ডানপন্থি, প্রতিক্রিয়াশীল ও গণশত্রু দলগুলোর সঙ্গে জোট পাকাতে এতটুকু ইতস্তত করে না। জাতীয় সংহতি, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা রক্ষা এবং গণতন্ত্র উদ্ধারের নামে এরা প্রমাণিত–জনদ্রোহী শিবিরে ভিড়ে যায়। কিছুদিন আগে নিজেদের সীমাবদ্ধ শক্তিসামর্থ্যের ওপর আস্থা নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় যারা আত্মনিয়োগ করেছিলেন শ্ৰেণীসগ্রামে, স্বাধীনতা ও সংহতি’-রক্ষার দাবিত্নে কিত্ত্বা গণতন্ত্রের দামি পাথরটি খোজার। জন্য এঁরা আজ ক্যান্টনমেন্টের নরঘাতকদের কাছে ধরনা দেন। এই অবস্থায় সৎ ও নিষ্ঠাবান বামপন্থি কর্মীর হতাশ না হয়ে উপায় কী? বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী নিম্নবিত্তের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারলে এই হতাশা এঁদের আচ্ছন্ন করতে পারত না। মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক সংকট থেকে এরা মুক্ত নন। যে-জনসমষ্টির মুক্তির জন্য এঁরা সগ্রামে নামেন তাদের জীবনযাপন ও সংস্কৃতি এঁদের নাগালের বাইরে। যে-সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা সাহিত্য শিল্পের দেহকে রক্তহীন ও চেতনাকে নিস্পন্দ করে তোলে, রাজনীতিকেও তা নিস্তেজ ও তাৎপর্যহীন করতে বাধ্য।
বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মীদের অধিকাংশই আসেন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। ছেলেবেলা থেকে বাড়িতে এরা কিছু-না-কিছু লেখাপড়ার সুযোগ পান। গল্প উপন্যাস তো পড়েনই, কেউ-কেউ কবিতাও পড়েন। একটু বয়স হলে নিজেদের বুদ্ধি ও বিবেচনার সাহায্যে চারপাশের জগতের সঙ্গে পড়াশোনা ও নিজেদের চিন্তাভাবনা মিলিয়ে দেখেন। এরা স্পর্শকাতর ও অনুভূতিপ্রবণ নিজেদের শ্রেণীতে, এমনকী নিজেদের বাপ-চাচা কী ভাইবোনদের মধ্যে উচ্চমধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তসমাজে ওঠার দৌড়ে শামিল হওয়ার আহ্বান এরা প্রত্যাখ্যান করেন, সেই দৌড়ে প্রতিযোগী হওয়ার জন্য যেরকম চুরি-চিরামি, বদমাইশি ও জালিয়াতি করা দরকার, তা এদের স্বভাবে নেই। চারপাশে দেখাশোনা এবং স্পর্শকাতর চেতনার সাহায্যে সমাজে শোষণের রূপ সম্পর্কে একটা ধারণা হয়। রাজনৈতিক বই পড়ে সেই ধারণার সঙ্গে যোগ হয় সংকল্প-শোষণমুক্ত ও সাম্যবাদী সমাজগঠনের সংকল্প। নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের থেকে অতিরিক্ত সুযোগ ভোগ করার সুযোগ পান বলে কারও কারও মধ্যে অপরাধবোধ কখনো মনে কাঁটার মতো বেঁধে। সুবিধাভোগ তখন তার কাছে ভার বলে মনে হয় এবং এই ভাব বেড়ে ফেলার প্রবণতাও সাম্যবাদী সমাজগঠনের আন্দোলনে যোগ দিতে তাকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
কিন্তু সৎ ও নিষ্ঠাবান দৃঢ়চেতা ও সংকল্পবদ্ধ রাজনৈতিক কর্মী শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে নানারকম অসুবিধার সম্মুখীন হন। শ্রমজীবীদের শতকরা ৯০ ভাগ বাস করেন গ্রামে, তারা প্রায় সবাই নিরক্ষর। সৎ ও নিষ্ঠাবান শিক্ষিত মানুষের সঙ্গে তাদের পরিচয় একেবারে নেই বললেই চলে। কিন্তু শৈশবকাল থেকে তারা বড় হন কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে। নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও ঘোরর প্রতিকূলতার মধ্যে মানুষ হওয়ায় বুদ্ধিশুদ্ধি তাদের কম নয়, বামপন্থি কর্মী-ছেলেদের ঠিকভাবে শনাক্ত করতে তাদের ভুল হয় না। শ্রমজীবী মানুষ বোঝেন যে লেখাপড়া শিখেও এই ছেলেগুলো টাউট হয়নি এবং ধর্ম বা জাতীয়তাবাদ বা গণতন্ত্রের বুলি কপচানো ও ভোট বাগানো তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। বামপন্থি কর্মীদের নিষ্ঠা ও সততা সম্পর্কে তারা নিঃসন্দেহ।