কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের যারা বিশুদ্ধ কিংবা সংস্কৃতিচর্চার জন্য প্রাণপাত করে চলেছেন, নিম্নবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী তো দূরের কথা, সাধারণ ও আরোগ্যপিপাসু মধ্যবিত্তের মধ্যে তারাও কি কোনোরকম সাড়া জাড়াতে পারছেন। সৃজনশীল শিল্পীর হাতে সংস্কৃতির সৌন্দর্যময় ও উদ্দীপ্ত প্রকাশ ঘটবার কথা। কিন্তু সংস্কৃতিচর্চার যে-সংগঠিত প্রকাশ শিল্প সাহিত্যের মাধ্যমগুলোতে দেখি তা দিনদিন নির্জীব ও একঘেয়ে অত্যাসে পরিণত হচ্ছে; কী সাহিত্যে কী চলচ্চিত্রে কী সংগীতে কেবল পানসে ও নিষ্প্রাণ পুনরাবৃত্তি চলছে।
একথা ঠিক যে আমাদের কথাসাহিত্যে আঙ্গিক আগের চেয়ে মার্জিত ও পরিণত রূপ লাভ করেছে। সুখপাঠ্য গল্প-উপন্যাস অনেক লেখা হচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগ গল্প-উপন্যাস পড়ে মনে হয় যে একই ব্যক্তি বিভিন্ন নামে নানা কায়দায় একটিমাত্র কাহিনী বয়ান করছেন। সেই কাহিনীও আবার নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা নয়, তিরিশের দশকের কোনো প্রতিভাবান বা চল্লিশের কোনো বুদ্ধিমান লেখকের অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণের তরল ও বিকৃত সংস্করণ। ঢাকার রম্য সাপ্তাহিকগুলোতে বিভিন্ন পালাপার্বণে বছরে কম করে ডজন দেড়েক উপন্যাস বেরোয়। ঈদের জুতো-কাপড়ের সঙ্গে মধ্যবিত্ত ঐসব পত্রিকার একটি কেনে এবং কয়েকদিনের মধ্যে সব লেখা পড়েও ফেলে। একটু তদন্ত করলে দেখা যায় যে এগুলোর বিষয়বস্তু প্রায় একই ধরনের ছিচকাঁদুনে প্রেম ও ধরি-মাছ-না-ই-পানি মার্কা সেক্সের সঙ্গে উদ্ভট ও অভিনব বিপ্লবী প্রসঙ্গ চটকাবার ফলে এগুলো বেশ আঠালো হয় এবং পাঠক একনাগাড়ে কয়েক ঘণ্টা এর সঙ্গে সেঁটে থাকেন। পাঠকদের সেঁটে রাখার কায়দা। লেখকদের বেশ ভালোই রপ্ত হয়েছে। এজন্য এদের জাদুগিরি বলে হাততালি দেওয়া যায়, কিন্তু শিল্প বলে মেনে নেওয়া মুশকিল। মানুষের প্রতিদিনকার জীবনযাপনে কোনো গভীর সত্য বা প্রশ্নের উন্মোচন সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যে অনুপস্থিত। পাঠককে প্রচলিত মূল্যবোধ বা সমাজব্যবস্থা সম্বন্ধে কোনো জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করাতে সাম্প্রতিক কথাসাহিত্য ব্যর্থ।
আঙ্গিকের দিক থেকে আমাদের এখানে সবচেয়ে পরিণতি ঘটেছে কবিতায়। এখন পাঠযোপ্য কবিতার সংখ্যা অনেক। কিন্তু কবিতা লেখাও এখন খুব সহজ অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। ছন্দ, উপ, রূপক, প্রতীক, চিত্রকল্প সব তৈরি হয়ে আছে; এমনকী প্রতিবাদ ও সংকল্পের ভাষা পর্যন্ত সুলত। এগুলো একসঙ্গে অ্যাসেম্বল করতে পারলেই একটি কবিতা খাড়া করা যায়। ফলে কবিতা জীবনের স্পন্দন ও প্রেরণা থেকে বঞ্চিত।
সংগীত ও নৃত্যকলার চর্চা আজ অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু এই দুই ক্ষেত্রেই সৃজনশীলতার পরিচয় পাওয়া খুব দুরূহ। সঙ্গীতের যা-কিছু আজও মানুষকে, অবশ্যই মধ্যবিত্তসমাজের মানুষকে গভীরভাবে স্পর্শ করে তার প্রায় সবটাই আগেকার রচনা। এমনকী আধুনিক কালে শহরের সম্প্রসারণের ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতাবোধজনিত যে-নিঃসঙ্গতার অনুভূতি–তারও সফল অনুরণন সাম্প্রতিক সংগীতে পাওয়া যায় না, এজন্যও ধরনা দিতে হয় পুরনো কর্তাদের দুয়ারে। নৃত্যকলায় আজ শিল্পীর প্রচণ্ড, তীব্র ও গভীর অনুভূতি একেবারেই তরঙ্গায়িত হয় না বললে কি বাড়িয়ে বলা হয়? মুদ্রার কসরত দেখাবার মধ্যে নৃত্যের নৈপুণ্য আজ সীমাবদ্ধ।
সফল শিল্পকর্ম মানুষের আনন্দ ও বেদনাকে অমূল্য করে তোলে, বাচাকে করে তোলে অর্থবহ এবং জীবনকে তাৎপর্যময় করে গড়ে তোলার জন্য মানুষকে প্রেরণা জোগায়; সাম্প্রতিক শিল্পচর্চা এইসব শক্তির সবগুলো হারিয়ে ফেলেছে। বিদেশি কিংবা অপরিচিত উচ্চবিত্তের জীবনযাপনে হাস্যকর অনুকরণেকে বলি অপসংস্কৃতি। এর উটকো চেহারা এত উৎট, এত কিভূতকিমাকার যে একে সহজেই কষে গাল দেওয়া যায়। কিন্তু যাকে ‘রুচিশীল বাঙালি শিল্পচর্চা’ বলা হয় যা মধ্যবিত্তের কর্তৃত্বে, মধ্যবিত্তের দ্বারা এবং মধ্যবিত্তের জন্য রচিত–তাও তো মধ্যবিত্তকে উদ্দীপ্ত করতে অক্ষম। শিল্পচর্চার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মেধা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, কিংবা শিল্পচর্চায় তারা যথেষ্ট নিবেদিতপ্রাণ নন–এসব কথা তো বিশ্বাসযোগ্য নয়। তা হলে?
প্রকৃতপক্ষে মধ্যবিত্ত বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে যে-বিচ্ছিন্নতার ফলে অপসংস্কৃতির বিকাশ ঘটে, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবিত্ত বাঙালির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা তেমনি আজ মধ্যবিত্ত বাঙালি সংস্কৃতি ও শিল্পচর্চাকে পরিণত করেছে একঘেঁয়ে ও প্রাণহীন নিস্পন্দ অভ্যাসে। কারও কারও মনে হতে পারে যে, এতে দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবিত্তের কী এসে যায়? অপসংস্কৃতির চর্চা যতই বাড়ক তাতে তাদের কী? টিভি বা ভিসিআর-এর সম্প্রসারণশীল থাবাবিস্তার সঙ্গেও নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী ওসবের স্পর্শ থেকে মুক্ত। ওপরে উঠবার স্বপ্নসাধ লালন করা তো। দূরের কথা, একমাত্র সম্পত্তি সবেধন নীলমণি প্রাণটি টিকিয়ে রাখতেই এদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। অন্যদিকে মধ্যবিত্তের রুচি ও মেজাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েও মধ্যবিত্তের বুদ্ধি ও আবেগের কাছে সাড়া-তুলতে-না-পারা সাম্প্রতিককালের ‘রুচিশীল বাঙালি সংস্কৃতি’র ব্যর্থতায় নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর কিছু এসে যায় না। সুতরাং মধ্যবিত্তের যে-ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবিত্তের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রামে নিবেদিতচিত্ত, তারাই-বা এসব নিয়ে মাথা ঘামাবে কেন?