- বইয়ের নামঃ সংস্কৃতির ভাঙা সেতু
- লেখকের নামঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
সংস্কৃতির ভাঙা সেতু
সংস্কৃতি নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ‘আজকালি বড়ো গোল’ দেখা যায়। প্রতিপক্ষ ছাড়া কোনো তর্ক তেমন জমে না, সংস্কৃতি-বিষয়ে কথাবার্তায় একটি শত্রুপক্ষ জুটে গেছে, এই শত্রুবরের নাম ‘অপসংস্কৃতি’। শহর এলাকায় তো বটেই, নিম-শহরে জায়গাগুলোতেও সচ্ছল, এমনকী নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা রংবেরঙের নানারকম রম্য পত্রিকা, টিভি, ফিল্ম ও ভিসিআরের কল্যাণে অপসংস্কৃতির চর্চা প্রাণভরে দেখে এবং নিজেদের জীবনে তার যথাযথ প্রয়োগের জন্য একনিষ্ঠ সাধনা চালায়। এই সাধনা আবার বিনা খরচায় হয় না, এর জন্য পয়সার দরকার। সদাপরিবর্তনশীল কাটছাঁটের কাপড়চোপড়, ষ্টিকার, চেন ইত্যাদি তো বটেই, কোকাকোলা থেকে শুরু করে মদ, গাঁজা, চরস, ক্যামেরা, টেপরেকর্ডার, টিভি, ভিসিআর, হোন্ডা, গাড়ি-যে যেমন পারে-প্রভৃতি উপাদান ছাড়া এই সাধনা অব্যাহত রাখা বড় কঠিন। এখানে ক’টা বাপ-মা আছে যারা নিয়মিত এসবের জোগান দিতে পারে? তা সে-ব্যাপারেও সাহায্য করার জন্য আমাদের টিভি ও সিনেমাওয়ালারা সদাপ্রস্তুত। হাইজ্যাক, চুরি, ডাকাতি, মারামারি, লক্ষঝম্প প্রভৃতির ছবি দেখিয়ে যুবসম্প্রদায়কে এরা অর্ধসংগ্রহের শর্টকাট পথ রপ্ত করার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এতে পয়সা কামানো চলে, অন্যদিকে পয়সা কামাবার পদ্ধতিটাও ঐ ধরনের সংস্কৃতিচর্চার অবিচ্ছিন্ন অংশ। এইভাবে earn while you learn-কর্মযোগে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুবসম্প্রদায়ের একটি অংশ একই সঙ্গে অর্থোপার্জন ও সংস্কৃতিচর্চা দুটোতেই সমান পারঙ্গম হয়ে উঠেছে। অর্থাগম হচ্ছে দেখে এদের ‘রক্ষণশীল’ বা ‘রুচিশীল’ বাপ-মাও চুপচাপ থাকাটাকে বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেন। কারণ কোনো কোনো কর্তব্যপ্ৰায়ণ পুত্র তাদের উপার্জিত অর্থের খানিকটা বাড়িতেও ঢালে। এ ছাড়া, এইসব যুবকের অনেকের মধ্যে আজকাল ধর্মচর্চার প্রবণতাও দেখা যায়। সব ওয়াক্ত নামাজ পড়ার সময় না-পেলেও শুক্রবার এরা মসজিদে যায়, মহা ধুমধাম করে ঈদ-শবেবরাত করে, পিরের পেছনে অকাতরে টাকা ঢালে, তাবিজ নেয়, সুলক্ষণ পাথর কেনে এবং মাজার দেখলেই সেজদা দেয়। এইসব দেখে পরহেজগার বাপ মা বেশ তৃপ্ত না, যে যা-ই বলুক, চুরি-চরামি, হাইজ্যাক, ডাকাতি যা-ই করুক, মদ-গাঁজা যতই টানুক, কিন্তু ছেলের আমার ধর্মে মতি আছে; পিরের তেজে এইসব উপসর্গ একদিন ঝরে পড়বে, ততদিনে ঘরে দুটো পয়সা আসছে আসুক, ছেলের কল্যাণে বাপ-মাও জাতে উঠতে পারে, এটাই-বা কম কী?
সমাজের অগ্রসর অংশ বলে এই নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের অনুশোচনার অন্ত নেই। অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাঁরা এতই সোচ্চার যে এটাকে তারা বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির পবিত্র গোদুগ্ধের ভাঁড়ে বিপুল পরিমাণ গোচোনা বলে ঠাহর করে ফেলছেন। তাঁদের কাছে আমাদের সংস্কৃতিচর্চার প্রহাদকুলে একমাত্র দৈত্য হল অপসংস্কৃতি। অপসংস্কৃতি প্রচারের দুর্জয় ঘাঁটি টেলিভিশন পর্যন্ত এই নিয়ে আফশোস করার জন্য তাদের হায়ার করতে শুরু করেছে। আমাদের কোনো কোনো বীরপুরুষ বুদ্ধিজীবী টেলিভিশনের পর্দায় অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে চাপাবাজি করে দুটো পয়সা ও নাম কামাতে এতটুকু পেছপা হচ্ছেন না। এখন ক্যান্টনমেন্ট যেমন গণতন্ত্র বিতরণের দাতব্য কেন্দ্র, দরিদ্র ও শূদ্র দেশবাসীকে খাঁটি নির্জলা গণতন্ত্র সরবরাহের হুংকার শোনা যায় সেখানে থেকেই নানারকম লম্প, ঘাবলামো, ভাঁড়ামো ও ইয়ার্কি ফাঁকে ফাঁকে, টেলিভিশনে তেমনি ঘোষিত হয় সুস্থ সংস্কৃতিপ্রচারের সংকল্প। তো সিনেমাই-বা বাদ থাকে কেন? ঢাকায় এখন ধর্মভাবদীপ্ত ফাইটিং ছবি তৈরির মড়ক চলছে। ভরসা করি, এমন ছবির মহড়া নিশ্চয়ই চলছে যেখানে কুম্ফু বা কারাতে-পটু বাঙালি সংস্কৃতিচর্চায় নিবেদিতপ্রাণ কোনো বাহাদুর পিরের পড়া-পানি সেবন করে তার আঁটোসাটো প্যান্ট-গেঞ্জি-পরা প্রেমিকাকে বুকে জড়িয়ে ‘দম-মওলা’ বলে একটা হাঁক ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে ‘অপসংস্কৃতি’-নামক দানবের ওপর।
এই ধরনের সংস্কৃতিচর্চা, এর অনুকরণ, এর নানারকম ওঠানামা–সবই চলে মধ্যবিত্তসমাজে। মধ্যবিত্তসমাজের একটি বড় অংশ নিজেদের সামাজিক ও শ্রেণীগত অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত নয়। একজনের অবস্থান সমাজের কোন স্তরে, তিনি কি মধ্যবিত্ত না উচ্চবিত্তের অন্তর্ভুক্ত, মধ্যবিত্তের বিভিন্ন উপ-বিভাগগুলোর মধ্যে কোনটিতে তিনি বিরাজ করেন–এ-সম্বন্ধে তার স্পষ্ট বা অস্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। এখন এখানে টাকাপয়সা রোজগারের চোরাগোপ্তা অলিগলি এত বেশি যে, যে-কোনো লোক একদিন বিত্তবান হবার স্বপ্ন দেখতে পারে। পয়সার জোরে সমাজের যে-কোনো স্তরে উঠার বাসনা যে সকলের জীবনেই সফল হবে–তা নয়। বরং সিঁড়ির আকাঙ্ক্ষিত ধাপটি বেশির ভাগ লোকেরই নাগালের বাইরে থেকে যায়, কেউ-কেউ হোঁচট খেয়ে নিচেও গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বাসনা পুষতে বাধা কোথায়? পোষা বাসনাটি দিনদিন ফাঁপে এবং কেউ-কেউ ভাবতে শুরু করে যে গন্তব্যে পৌঁছতে আর দেরি নাই। সুতরাং জীবনযাপনের মান ও পদ্ধতি এবার পালটানো। দরকার। পাশ্চাত্য কায়দায় ওপরতলার জীবনযাপন অনুসরণ করার রেওয়াজ আমাদের। এখানে তেমন পরিচিত নয়। বুর্জোয়া দেশগুলোর উচ্চবিত্তের জীবনযাপনকে আদর্শ ধরে। নিয়ে মধ্যবিত্ত সেটাকেই অন্ধভাবে অনুসরণ করতে শুরু করে। কিন্তু বুর্জোয়া মূল্যবোধ ও মানসিকতা তার ধরাছোঁয়ার বাইরে। ওদিকে ওপরের ধাপে ওঠার জন্য মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত এতই উষ্মীব ও অস্থির যে এজন্য হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তা-ই সে আঁকড়ে ধরে। ঐ ধাপে পৌঁছবার জন্য মাজারে বা পিরের কাছে ধরনা দিতেও তার বাধে না। অথচ পাশ্চাত্য বুর্জোয়া মানসিকতা এই ধরনের ধর্মান্ধতাকে অস্বীকার করে। আমাদের মধ্যবিত্তের। জীবনযাপন কিংবা ঈন্ধিত জীবনযাপন এবং মূলবোধ পরস্পরবিরোধী। এদের জীবন তাই নিরাল, এই জীবনের ভিত্তি, বিন্যাস ও তাৎপর্য খুঁজে বের করা খুব কঠিন। এদের সংস্কৃতিও যে নিরালম্ব ও উটকো ধরনের হবে এতে আর সন্দেহ কী? সামন্ত ও গ্রাম্য মূল্যবোধের সঙ্গে বুর্জোয়া জীবনযাপনের এই উকট মাখামাখির ফলে যে-সংস্কৃতি গজিয়ে ওঠে তাও অনেকের চোখে উটকো ঠেকে এবং তখন তাকে অপসংস্কৃতি বলে গাল দেওয়া হয়।