এই বড় চালাঘরটায় জাফরুল্লার ছ-জোড়া বাছাই করা বলদ থাকছে। আর এক পাশে এক মাচায় আসফাক। তাকে উঠতে দেখে বলদগুলো উঠে দাঁড়াল, গরু-মোষ দুই-ই। রাত্রির জড়তা কাটিয়ে তারা মলমূত্র ত্যাগ করল। বাষ্পে ঘরটা ভরে গেল। আর তার মধ্যে দিয়ে মুখ বার করল আসফাক। বছর ছাব্বিশ-সাতাশ বয়স হবে। রোগা লম্বাটে হলুদ হলুদ চেহারা, আর সকলের মতো কালো চেহারা নয়। চোখ দুটো টেরচা, উপরের পাতাদুটো বড় বলে মনে হয়। চিবুকে গোটা । দশ-পনেরো চুল তার দাড়ির কাজ করছে।
সে যেন অবাক হয়েই চারিদিকে চাইতে লাগল। দ্বারিঘরের একটা জানালা খোলা। তার সামনে ধানমাড়াইয়ের ঘাস-চাঁছা মাটি। তার বাঁদিকে ধানের দুটো মরাই, আর ডানদিকে বলদদের ঘর, যে ঘরে আসফাক শোয়। ধানের মরাইয়ের পিছনে খড়ের মঠ আকাশের গায়ে ঠেকেছে। মঠের মাথায় শিমুলগাছের ডাগর ডালপালা। তার উপরে একটা পাখি বসে আছে ভোরের আকাশের মধ্যে। অত উঁচুতে পাখিটাকে ছোট দেখাচ্ছে। দ্বারিঘরের বিপরীত দিকে ধানমাড়াই আখড়ার অন্যপারে টিনের দেয়ালের টিনের ছাদের সেই ঘর যার একপাশে তামাকের গুদাম, অন্যদিকে প্রকাণ্ড সেই সিন্দুক-খাট যার উপরে দুপুরে ঘুমায় জাফরুল্লা। বিস্মিতের মতো এই সব দেখতে লাগল আসফাক। অথচ এমন পরিচিতই বা কী? সাত বছর হল। দশ হতে তিন বাদ।
এমন সময় খুক করে কাশল যেন কেউ। আসফাক চমকে উঠে, কাছিম যেমন খোলায় গলা ঢুকিয়ে নেয়, তেমন করে সরে গেল দরজা থেকে। জাফরুল্লার টিনের দেয়ালের দিনমানের শোয়া-বসার ঘরের দিকে চাইল সে। না, সেদিকে কোনো জানালা খোলা হয়নি।
বরং ছমিরই আসছে আবার।
তখন সে বুঝতে পারল, সারারাত ঘুমিয়ে এইমাত্র ওঠার যে অভিনয় করছিল সে নিজের কাছেই, দর্শক তো ছিল না, তার কোনো মানে হয় না। ছমির তো তাকে ফিরে আসতেই দেখেছে। হায়, হায় সে যতই চেষ্টা করুক, ছমিরের নিশ্চয়ই মনে থাকবে আসফাক সন্ধ্যায় না ফিরে রাত শেষ করে ফিরেছে।
ভোর-ভোর রাতের সেই দৃশ্যটা মনে পড়ল। দ্বারিঘর পর্যন্ত এসে সে তখন থমকে দাঁড়িয়েছে। এতক্ষণ সে কোন সাহসে এগিয়েছে, তা যেন খুঁজেই পেল না। অন্ধকারের আড়াল ছিল বলেই বোধহয় সাহস।
এগোবে, না, পিছোবে–ভাবছে সে, এমন সময় কে একজন অন্দরের দিক থেকে বেরিয়ে এল-হাতে পাটকাঠির মশাল।
আসফাক যেন আলোর অনিবার্য টানে এগিয়ে গিয়েছিল।
কে? কাঁয়?
আসফাক।
আসফাক!
জে।
জে না। আমি ছমির। ফিরলু ত্যা?
একটা অবসন্নতায় আসফাকের শরীর ঝিমঝিম করে উঠেছিল। টলতে টলতে সে বলদদের ঘরে গিয়ে ঢুকেছিল।
এখন ছমির দ্বারিঘরের বারান্দায় উঠে তামাক সাজতে বসল। কী করবে এখন আসফাক? দিনের আলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রোজ যেমন বলদগুলোকে খুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, তাই করবে?
এতে আর সন্দেহ নেই, এবারেও ব্যাপারটা বোকামিই হয়ে গিয়েছে। অথচ তখন সেটাকেই একমাত্র ঠিকঠাক বলে মনে হয়েছিল।
আর এ সবের জন্য সেই হাকিমবাবুই দায়ী। সরকারি কর্মচারী। রাজ বদলেছে। গল্পে শোনা সেই রানীর আমল তো ফিরবে না। তাই বলে সরকারি কর্মচারী তো সব বদলায় না। বিশেষ করে যার হাকিমের মতো পোশাক।
সেই হাকিমই দায়ী কিন্তু, এই স্থির করল আসফাক। জাফরুল্লার দ্বারিঘরে সে বসেছিল তার দপ্তর বিছিয়ে। গ্রামের অনেক লোকই যাওয়া-আসা করছিল। তাদের অনেক অভিযোগ কর্মচারীটি শুনছিল। কোনো কোনো সময়ে সে কাগজেও কিছু লিখে নিচ্ছিল! আর এসবই শুনতে পেরেছিল আসফাক দ্বারিঘরের বারান্দার নীচে বসে পাট থেকে সুতলি তৈরি করতে করতে। অবশেষে জাফরুল্লা খেতে গেল। তার অন্য চাকররাও তার পরে। চারিদিকে আর কেউ নেই। তখন এদিক ওদিক চেয়ে আসফাক হাকিমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার নালিশ আছে। কঠিন নালিশ।
হাকিম বলল, কী চাও?
জে। আসফাক ঘরের আসবাব পর্যবেক্ষণ করল যেন।
কী দরকার, তাই জিজ্ঞাসা করলাম।
জে। আসফাক ঘরের ছাদ পরীক্ষা করে দেখতে লাগল।
হাকিম চেয়ার থেকে উঠল। তখন তার বিশ্রামের সময়। সেই ঘরেই তার বিছানা পাতা। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এদিকের দশখানা গাঁয়ের মধ্যে ব্যাপারির মতো ধনী কেউ নেই। টিনের ছাদ, কাঠের দেয়াল–এমন দ্বারিঘরই বা কার?
হাকিম সোজাপিঠের চেয়ার থেকে উঠে ঢালুপিঠের এক চেয়ারে শুয়ে সিগারেট ধরাল। কিছুক্ষণ ধোঁয়া ছাড়ল। যেন ঘরে আর কেউ নেই। তারপর পাশ ফিরে আসফাককে দেখতে পেল।
কী, যাওনি? এখানেই চাকরি করো?
জে।
কত টাকা পাও? খেতে-পরতে দেয়? বলি, মাইনা-টাইনা পাচ্ছ তো?
না।
না?
হাকিম অবাক হল। কতদিন পাও না?
ছ-সাত মাস।
হাকিম হো হো করে হেসে উঠল। এই অদ্ভুত কথা শুনে আর আসফাককে দেখে তার খুব মজা লেগেছে সন্দেহ নেই। সে অবার জিজ্ঞাসা করল, কার চাকর?
জাফর ব্যাপারির।
জাফর কি খুব ধনী? তার কি অনেক জমি?
জে, জি বলতে বলতে আসফাকের মুখে তখন হাসি ফুটে উঠেছে। নিজের বুদ্ধিমত্তায় আশ্চর্যও কম হয়নি। সে ভেবে উঠতেই পারল না, এমন একটা নালিশ সে কী করে সাজিয়ে-গুছিয়ে করতে পারল। কারণ হাকিমের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তার নালিশের কতটুকু উচ্চারণ করেছিল আর কতটুকু চিন্তা করেছিল, সে হিসাব রাখার পক্ষে অনেক উত্তেজিত ছিল তার মন। বরং যা উচ্চারণ করেনি, সে কথাগুলোই স্পষ্ট করে বলেছে, এমন অনুভব করছিল সে। নতুবা মাইনা কত, মাইনা সে পায় কিনা, এসব কিছুই নয়। নালিশ হল অব্যক্ত মনের কথা, অনেক কথা। প্রথমে সে দশবিঘা জমি পেয়েছিল চাষ করতে। কিন্তু সে জমিতে ধান ফলানো সহজ কথা? জংলা ভাঙা জমি। জাফরুল্লাকে ধানের ভাগ দিলে যা থাকবে, তাতে ছ-মাস চলা সম্ভব। জমির বিরুদ্ধেও তার নালিশ ছিল। জাফরুল্লা বরং তার খাওয়া-পরার ভার নিল। একটা জমি এখনো তার নামে আছে। এখনো ধান হয়। খাওয়া-পরার উপরে যে মাইনার কথা, মাইনার পরিমাণ, এসবই তো আসফাকের নিজেরই প্রস্তাব। হাকিমকে এসব কথাও কি সে সাজিয়ে-গুছিয়ে বলেনি!