কিন্তু আসল কথা, সেই সেবার মাংস কাটা হয়েছিল দ্বারিঘরের কাছে। জাফরুল্লার গোরুর দলে দু-একটা ষাঁড় সবসময়েই থাকে। এ ষাঁড়টার মাত্র মাসতিনেক হয়, মাথার লোমা ছাড়িয়ে শিঙের মোচা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে, ঘটনার দিন তিন-চারেক আগে গাভীর দরুন পাকা ষাঁড়টার সঙ্গে গুঁতোগুতিও করেছে। ইতিমধ্যে দেড়-হাত পৌনে দু-হাত হয়েছে খাড়াইয়ে। আসফাক দেখল, গোরুর দলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে ছমির কিছু করছে। তারপর দেখলে, একটা গাভীকে তাড়িয়ে আনছে সে দ্বারিঘরের দিকে, আর তার পিছন পিছন সেই নতুন, হরিণের রঙের ষাঁড়টা ছুটে আসছে। দ্বারিঘরের কাছাকাছি আসতে ছমির তার নিজের পিঠের দিকে কোমরে গোঁজা রশিটা হঠাৎ পরিয়ে দিল ষাঁড়টার গলায়। এখন, এই গোরুর দলের গলায় দড়ি পরানো তেমন হয় না। রাতে তারা খোঁয়াড়ে থাকে, সকালে খুলে ছাড়া হয়। দুধ দোয়ানোর সময়ে গাভীদের বাঁধা হয়। তামাকের খেতের লাঙলে বলদ জোড়া হয়, তখন তাদের গলায় দড়ি ওঠে। কিন্তু এঁড়ে যাঁড়, বকনা এরা দড়ি চেনে না। কাজেই দড়ির বাঁধনে পড়তেই, বিশেষ সেই সুযোগে গাভীটা সরে যেতেই, ষাঁড়টা পাগলের মতো লাফাতে শুরু করল। একবার তো ফেলেই দিল ছমিরকে হ্যাঁচকা টানে। উঠে ছমির এদিক-ওদিক চাইল, ততক্ষণে দ্বারিঘরের বারান্দা ভরে গেছে, যেন তারা এক খেলা দেখতে উৎসাহিত, সেই বাবুরা। বনের ছায়ায় ষাঁড়টাকে মদ্দা হরিণও ভাবা যায়। ছমির দেখলে, গাভীটা দ্বারিঘরের কাছে গাবগাছটার নীচে দাঁড়িয়েছে, ষাঁড়টাকে পিছনে নিয়ে আর একবার ছুটবার আগে। ছমির বুদ্ধি খুঁজে পেল যেন। হাতের দড়িতে ঢিল দিতেই ষাঁড়টা গাবগাছের দিকে ছুটল। এখানেই ছমিরের ওস্তাদি। ষাঁড়টা ছুটল গাছটার ডানদিকে, ছমির দৌড়াল বাঁদিকে। দড়িটা ছিঁড়ল না ষাঁড়টা, গলার দড়ির টানে বে-দম হয়ে জিভ বার করে থেমে গেল। এই খেলার এই যেন নিয়ম। ছমির দড়ি হাতে দৌড়ে গাছটাকে ঘুরে এল। ততক্ষণে গাভীটা পালিয়েছে, ষাঁড়টা গাছের গায়ে গলার দড়িতে বাঁধা পড়েছে। এইবার ছমির আরো ওস্তাদি দেখাল। ষাঁড়টা বুঝতে না বুঝতে তার হাতের দড়িটাতে ষাঁড়টার পিছনের পাদুটোকে পাকিয়ে নিয়ে গাছটার গোড়ায় টেনে বেঁধে দিল। আসফাক ভেবেছিল, এতক্ষণে বোঝা যাচ্ছে, এটা ছমিরের সেই কাজই, ষাঁড়টাকে খাসি করবে। এখন সময় নয়। ওটা শীতকালেই হয়। একটু অবাক লাগল আসফাকের। তারপরে সে স্থির করল, শহরের বাবুরা দেখতে চেয়েছে হয়তো। এটা খুব মজার ব্যাপারের মতো এখানকার লোকদেরও টানে। আর এটা হয়তো ছমিরের নতুন কায়দা। একাজে অন্য সময়ে পায়ে দড়ি বেঁধে, সেই পা বাঁশ দিয়ে মাটিতে চেপে ধরে রাখার জন্য আরো দু-একজন লোক লাগে। এবার ছমির একাই কেরানি দেখাবে।
আসফাক তাড়াতাড়ি অন্যদিকে চলে গিয়েছিল। এটা তার একটা দুর্বলতা। কিছুদিন থেকে এসময়ে সে পালায়। অন্য কাজের ছুতো থাকলে তো কথাই নেই, না থাকলেও যতদুর সেই গরু-মোষের চিৎকার শোনা যাবে, তার বাইরে কোথাও গিয়ে বসে থাকে। কেমন যেন ভয় করে তার। তিনমাস আগে, সেই যে জাফর যখন তিনমাস খামারে ছিল না, তখন এক দুপুরে এক স্বপ্ন দেখেছিল আসফাক। যেন সে নিজেই একটা এঁড়ে মোষ। ছমির তার হাত-পা বেঁধেছে, বাঁশ দিয়ে উঁইয়ে চেপে ধরেছে আর তার সেই বিশেষ ছুরি নিয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠে তার ঘুম ভেঙেছিল। সেই থেকে দুপুরে সে ঘুমোয় না, জাফর বাড়িতে না থাকলেও। সেদিনও সে তাই করেছিল। জাফরুল্লার বাড়ির পিছন দিকে যে দহ, তার পারে সেই কুলগাছের নীচে সে ঘণ্টাখানেক পালিয়েছিল। কিন্তু এদিকেও তো তার কাজ। বাবুদের মধ্যে যারা দহে নেমে স্নান করবে না, তাদের জন্য জল যোগাতে হবে বাঁকে করে জল বয়ে।
প্রথম বাঁক জল নিয়ে এসে–একেবারে অবাক হয়েছিল সে। গাবগাছের একটা মোটা নীচু ডাল ছিল। তা থেকে একটা হরিণ যেন ঝুলছে। পিছনের পাদুটো ডালের গায়ে, মাথাটা মাটির কাছে। এগিয়ে এসে বুঝেছিল যে, এটা সেই ষাঁড়টাই। চামড়া ছুলছে ছমির।
বাবুরা চলে গেলে আসফাক জিজ্ঞাসা করেছিল একদিন ছমিরকে, অমন করি জবেহ করলু আড়িয়াটা!
অন্য কাজে ব্যস্ত ছমির বললে, করলং তো। কেমন যেন একটা সহানুভূতির মতো কিছু অনুভব করছিল আসফাক ষাঁড়টার জন্য। সে আবার বলল, কী ফায়দা? কাঁয় খায়?,
কেনে, ওই না ভোটবাবুর দল।
সহানুভূতি জাতীয় মনোভাব মানুষকে নানা কথা অহেতুক বলায়। আসফাক আবার বলল, উমরা না সগায় হিন্দু!
ছমির যা বললে তার সারমর্ম এই : ওরা সকলেই হিন্দু। কিন্তু চারটে ঠ্যাং-ই ওদের ভোগে লেগেছে। মুসলমানরাই রান্না করেছে : ওরা তাদের সঙ্গে বসেই খেয়েছে।
অবশ্য আসফাক এই আধুনিকতার হেতু খুঁজে পায়নি, এমনকী একে আধুনিকতা বলেও বুঝতে পারেনি। জাত, ধর্ম কিছু নয়, তা ওরা বোঝাল।
এটা ছমিরের বৈশিষ্ট্য, ধান-চাল ছিটিয়ে মুরগি ধরা আর গাভীর ফাঁদে এঁড়ে ধরা জবেহর জন্য।
মৃদু মৃদু হাঁপাচ্ছে আসফাকের বুকের মধ্যে।
.
আসফাক উঁকিঝুঁকি দিয়ে বলদগুলোর পিঠের উপর দিয়ে দিনের আলোর খোঁজ করছিল। আলো দেখতেই সে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল যেন ঘুম থেকে। তার এই কেরানি ব্যর্থ হল, কারণ কেউ দেখল না। ছমির পর্যন্ত ধারেকাছে ছিল না। আসলে সে আদৌ ঘুমোয়নি, বরং তার রাত্রির আশ্রয় এই বলদের ঘরে সে ভোর-ভোর সময়ে এসে ঢুকেছে।