আর এ ঘাসও খুব মিষ্টি। লটা বলে। গোড়ার কাছে একরকম মিষ্টি রস থাকে। মানুষই ভালবাসে, মোষের তো কথাই নেই। একছড়া ঘাস উপড়ে নিল আসফাক। অন্যমনস্কের মতো গোড়াটাকে মুখে দিল। চুষে মিষ্টি বোধ হওয়াতেই যেন খুঁতখুঁত করে হাসল।
আরউ, এ দেখং ভইষার গোবর!
ঘাসবনের ধারে মোষের শুকনো গোবর দেখে আসফাক হতবাক। সে চারিদিকে তাকাল। এদিকে তাহলে মোষ আসে! বুনো মোষ নাকি? কয়েক পা গিয়ে সে আবার দাঁড়াল। তার গা ছমছম করে উঠল। আবার সে চলতে লাগল। এখানে কি কোনো বাথান থেকে মোষ আসে? আবার সে খুঁতখুঁত করে হাসল। পরমুহূর্তেই তার গা ছমছম করে উঠল। এ তো সত্য কথাই যে সে তার পরিচিত ঝোপঝাড় একটাও দেখতে পাচ্ছে না। সে অবাক হয়ে থেমে দাঁড়াল। তাই তো, সে কোথায় এসেছে? নিজের হাতে ঘাসের ছড়া চোখে পড়ল। ঘাস খায় কেন সে? সে আর একটা ঘাস মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে আবার হাঁটা শুরু করল। তা হলে ওটা কি, এসবই কি বুনো মোষের চিহ্ন!
অজ্ঞাত একটা ভয়ে শিউরে উঠল সে, আর তার ফলেই যেন ছলাৎ ছলাৎ করে খানিকটা কালো কালো সাহস তার বুকের মধ্যে পড়ে গরম করে তুলল সেই জায়গাটাকে।
ঘাসবনটাকে ঘুরলে চলবে কেন? কতদূরে শেষ-কে বলবে? এর মধ্যে দিয়েই পথ করে নিতে হবে। সে ঘাসবনের ভিতরে ঢুকে পড়ল। সরসর করে ঘাসের ঢেউ তুলে তুলে সে চলতে লাগল। ঘাসবনের মধ্যে কাঁটাগাছ থাকে, মরা মরা ঝোপঝাড়ের শুকনো ডালপালাও কাঁটার মতো ধারালো হয়। একটায় লেগে তার পিরহান বেশ খানিকটা ছিঁড়ে গেল। দ্বিতীয়বার পিরহানে টান পড়তেই সে সেটাকে গা থেকে খুলে ফেলে দিল। খুঁতখুঁত করে হাসল সে। তার শেষবারের মতো মনে হল, এ পথে কি শহরে যাওয়া যায়? সে কি পথ হারিয়ে ফেলেছে? এখন সে যতই হাঁটবে, ততই বনের গভীরে ঢুকবে? সে আবার থমকে দাঁড়াল। দেখলে, ঘাসবনের উপরে উপরে এখন গাছের মাথাগুলো এক হয়ে হয়ে ক্রমশ ঘন ছায়া করছে। সে দেখল, তার নিজের গায়ে গাছের পাতার ছায়া। এদিকে মোষ থাকতেই পারে, কারণ পায়ের তলার মাটি ঠান্ডা, কেমন। জল-জল ভাব আছে। সে হঠাৎ মাথা তুলে ডাকল, আঁ-আঁ-ড়। যেন সে তার মোষদের ডাকছে।
সে তাড়াতাড়ি চলতে লাগল। আর সেই অবস্থায় গাছের পাতার ছায়া যেমন তার গায়ের উপরে ছায়ার ছবি আঁকছিল, তার মধ্যেও ভয় আর সাহস, আনন্দ আর উত্তেজনা, নানা রেখা এঁকে নাচতে থাকল। সে এবার আরো জোরে আরো টেনে আঁ-আঁ-আঁ-ড়শব্দ করে উঠল। কান পেতে শুনল, প্রতিধ্বনি যেন একটা উঠছে। আর সেই মুহূর্তে সে অনুভব করল, সে মোষ হয়ে গিয়েছে। একটা বুনো মোষ সে নিজেই, এই ভেবে তার নিঃশ্বাস গরম হয়ে ফোঁসফোঁস করতে লাগল। সে প্রাণভরে ডেকে উঠল, আঁ-আঁ-ড়।
.
জাফরুল্লা ব্যাপারির খামারে এখন সকাল হচ্ছে। আর উঁচু দ্বারিঘরের খড়ের ছাদের ওদিকে যদি আকাশে এখনো কোনো রং থাকে, তবে এদিক থেকে, তা দেখা যাচ্ছে না। এদিকে বড়জোর একফালি ধারে মরচেধরা কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে।
দ্বারিঘরটা ক্রমশ দর্শনীয় হয়ে উঠেছে। খড়ের চালই, এখন যেন তা আগের চাইতে পুরু। আগে ধারার বেড়া ছিল, এখন কাঠের মসৃণ দেয়াল। যার বাইরেটা সবুজ আর ভিতরটা উজ্জ্বল সাদা রং করা। শুধু তাই নয়, এখন ওটা যেন একটা পৃথক বাড়ি হয়ে উঠেছে। আগেকার চাইতে লম্বা হয়েছে ছাদ। আর তার নীচে পাশাপাশি তিনখানা ঘর। ঘরের সামনে টানা বারান্দা। মেঝেও কাঠের। মোটা মোটা কাঠের গুঁড়ি, তার উপরে কাঠের মেঝে।
এ রকম না করেই বা কী উপায়? এ অঞ্চলে শহরের সাহেবরা এলে এই ঘরের টানেই তো মহিষকুড়ায় আসে। থাকেও দু-একদিন করে! আগেও আসত, এখন বেড়েছে। এমন হয় যে মনে হরে, যেন শহরের কোর্ট বসে। এটাই চাউটিয়ার মত। চাউটিয়া, যে নাকি দু-একবার শহরের কোর্ট পর্যন্ত গিয়েছে। আর ফুর্তিও হয়। ফুর্তি তখনই বেশি হয় যখন কোনো সাহেব থাকতে থাকতে জাফরুল্লার কোনো শালা-সম্বন্ধী আসে। বিশেষ করে মেজবিবির দরুন শালা। তার নিজেরই করাতকল একটা আছে। সেই যেবার সেই ম্যাজিস্টরকে হরিণের মাংস খাইয়েছিল। যাই বলো, ওটা কিন্তু বে-আইনি, ওই হরিণ মারা। জাফরুল্লার শালা ম্যাজিস্টরকে সঙ্গে নিয়ে ধানখেতের মধ্যে লুকিয়ে থেকে মেরেছিল হরিণ। আসফাক জেনেছিল পরে সাত্তারের কাছে। ছাল ছাড়িয়ে কাটাকুটি করে সেই মাংস দ্বারিঘরের রসুইখানায় কখন পৌঁছে দিল-তাও আসফাক জানত না, এমনকী ছমিরও না। পরের দিন ম্যাজিস্টর যখন তার জিপে উঠছে তখন এক টিন মাংস উঠতে দেখে আসফাক অবাক হয়েছিল। সে মাংস সেদিন জাফরুল্লার বাড়িতেও রান্না হয়েছিল! আসফাক খেয়ে থাকবে নিশ্চয়, কিন্তু মনে রাখবার মতো কোনো সোয়াদ পায়নি।
সবই তো চোখের উপরে ঘটে কিন্তু কোনো-কোনোটা এমন করে ঘটে যে মনে থেকে যায়। খাসি বলো, বকরি পাঁঠা বলো–সেসব জবাই করার ভার ছমিরের। মাস ছয়েক আগে শহর থেকে আট-দশ জনের এক দল এসেছিল। তারা এদিককার গ্রামগুলোতে মিটিন করে বেড়াচ্ছিল। লাঠির ডগায়, দুই লাঠির মধ্যে, লাল ফালি কাপড়, এসব নিয়ে চেঁচিয়ে গ্রামের মধ্যে ঘুরল এবেলা ওবেলা। কী কাণ্ড! ছমির, সাত্তার, নসির, আসফাক, চাউটিয়া, মোটকথা জাফরুল্লার যত লোক, গ্রামের অন্য পাঁচজনও জানতে পারল, নাকি আইন হয়েছে প্রতিদিনের কাজের জন্য সাড়ে-আট টাকা করে পাওয়া যাবে। গ্রামের যত জমি দেখো, গরিবদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হবে। তার চাইতেও মজার কথা, গিরিগৃহস্থ আর আধিয়ার–এরা নাকি দুই জাত! তাদের মধ্যে গিরিরাই আধিয়ারদের সঙ্গে শত্রুতা করে। আর, যারা এসেছিল সকলেই নাকি এক জাত-আধিয়ারদের দলের তারা। অথচ চাউটিয়া বলেছিল, সেই দলে জাফরুল্লার বড়বিবির ভাতিজা খলিল ছাড়া আর কেউ মুসলমান ছিল না। অন্যদিকে আধিয়ারদের মধ্যে হিন্দুও আছে, মুসলমান আছে, গিরিদের মধ্যে হিন্দুও আছে, মুসলমানও আছে। হিন্দু আর মুসলমানে মারামারি এদিকে এই জঙ্গলে রাজ্যে, এমনকী এদিকের এই শহরে কোনো দিন হয় না। কিন্তু কোন হিন্দু বা কোন মুসলমান আছে যে দূরে দূরে শহরের সেইসব মারামারির গল্প শুনেছে? আর জাফরুল্লার ছোটবিবির ঘরেও এডিও যাতে গান হয়, খবর বাঁটে। শহরের সেই দলবেঁধে আসা ছোকরাবাবুদের একজনকে আসফাক জিজ্ঞাসা করেছিল ভয়ে ভয়ে, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে, এদিকে আধিয়ার আর গিরিদের দলে মারামারি হতে পারে কি না। কলেজে পড়া সেই ছোকরাবাবু আসফাককে বুঝিয়েছিল সেটাই শেষ জিহাদ।