কাজ তত ভাগ করাই আছে, কিন্তু শহরে যাওয়াই যদি কাজ হয়, তবে চাউটিয়া নয় কেন? সে তো রোজকার মতো আজও শহরের তিন মাইলের মধ্যে সেই সলসলাবাড়িতে গিয়েছে দুধ নিয়ে। সে অনায়াসেই আরো তিন মাইল এগিয়ে শহরের দোকান থেকে ওষুধ এনে দিতে পারত। আর কোনো কোনো দিন সে ওই তিনমাইল পথ পার হয়ও। সরষের তেল, কেরোসিন তেলের টিন, দুধের খালি টিনগুলো বাঁকে বসিয়ে নিয়ে আসে। মশলাপাতির জন্যও সেই শহরে যায়। কিন্তু ওষুধের বেলায় আসফাক কেন? ছমিরের ঠাট্টা মনে পড়ল আসফাকের-নাকি তিসরা আর বিশেষ করে চৌঠা বিবির ঘরে এই ওষুধ মুখে যাওয়া লাগে। ছমির বলে আর হাসে।
শহরে যাওয়ার দুটো পথ আছে। উত্তর আর পশ্চিমের ঠিক মাঝামাঝি দিক ধরে গিয়ে পাকা পিচ সড়ক। সেই সড়ক ধরে দক্ষিণ-পূর্বের চাইতে বরং পূর্ব ঘেঁষে পাঁচ-সাড়েপাঁচ মাইল নামলে শহর। দ্বিতীয় পথ, তাকে অবশ্য পথ বলা হবে কি না সন্দেহ, মহিষকুড়া থেকে যে পায়ে-চলা পথ দক্ষিণে গিয়ে বনে ঢুকেছে, সেই পথে গিয়ে বনে ঢুকতে হবে, আর তারপর বনের মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিমে চারমাইল গেলেই শহর। বনের এই পথ আদৌ নির্দিষ্টনয়। এমন হতে পারে, এই চারমাইল যেতে দ্বিতীয় মানুষের সঙ্গে দেখা হবে না। বর্ষাকালের ছোট ছোট নদী, ঝর্না, ঝোরা পড়ে সে পথে। একটু বেহিসেবি হলেই দিক ভুল হতে পারে। গাছের নীচে নীচে চলতে চলতে একমানুষ সমান কোনো ঘাসের জঙ্গলে পৌঁছাতে পারো যার মধ্যে দিয়ে চলা যায় না, আর তাকে ঘুরে চলতে গিয়ে এমন বনে পৌঁছানো সম্ভব যা হয়তো শহর থেকে সাত-আট মাইল দূরে নিয়ে যাবে।
চাউটিয়া এই বনের পথ ধরেও শহরে যায়। আসফাকও কয়েকবার গিয়েছে। কিন্তু এমন নয় যে পায়ে পায়ে ঘাস মরে গিয়ে পথ হয়েছে। প্রত্যেককেই প্রতিবারে নিজের আন্দাজ মতো চলতে হয়। ঝোপঝাড়ের চেহারা দেখেই পথ ধরতে হয়। অথচ বনে এই ঝোপঝাড়ের চেহারা রোজ বদলায়, ঋতু অনুসারে তারা বাড়ে কমে। এক কথায়, সেই বনের সংজ্ঞা যাকে অবচেতন মনের সঙ্গে তুলনা দেয়া হয়েছে।
তা হলেও অষুধ বলে কথা। যার অভাবে অমন যে দারুণ জাফরুল্লা তার মরণও ধরা কথা । আসফাক গ্রাম থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ তাড়াতাড়ি হেঁটেছিল। তারপর একটা ধীর নির্দিষ্ট গতিতে চলছে। এই গতিটার এক বৈশিষ্ট্য আছে। দেখলে মনে হবে, অলস উদ্যমহীন। আসলে কিন্তু সহিষ্ণু আর অচঞ্চল। গাড়ির আগে মোষের চলার ভঙ্গির সঙ্গে মেলে। শিংদুটোকে পিছন দিকে হেলিয়ে মুখটা একটু তুলে, সে চলেছে তো চলেছেই। যেন সে জেনে ফেলেছে, যে অস্বাভাবিক কষ্টদায়ক ব্যাপারটা তার কাঁধের থেকে ঝুলতে ঝুলতে তার পিছন পিছন চলছে-যত জোরেই যাও সে কাঁধ ছাড়বে না, পিছনে আসাও বন্ধ করবে না। বরং জোরে গেলে সে আরো জোরে পিছনে আসে, তখন হঠাৎ থামতে গেলে সে পিছন থেকে এমন ধাক্কা দেয় যেন পড়ে যেতে হবে। আবার যদি আস্তে আস্তে চলা যায়, তবে পিছনের সেই বোঝার ধারালো গায়ে লেগে পিছনের পাদুটোয় ঘা হয়ে যাবে।
আসফাক ভাবল : সেই বুনো মোষটার কিন্তু জোড়া নেই যে তাকে লাঙলে কিংবা গাড়িতে লাগাবে। সে মাথাটাকে একটু পিছনে হেলিয়ে মুখটাকে একটু তুলে হাঁটতে লাগল। শিং দোলানোর মতো একবার সে মাথা দোলাল।
সেই বুনো মোষ যখন এসেছিল তখন আসফাক খামারে আসেনি। কিন্তু সেই সাহেবকে যখন চাউটিয়া গল্পটা বলেছিল, তখন আসফাক দ্বারিঘরের বারান্দার নীচে বসে পাট থেকে সুতলি তৈরি করতে করতে শুনেছিল। এ তো বোঝাই যাচ্ছে, চাউটিয়া সুযোগ পেলেই সেই খয়রা রঙের পিঠ-উঁচু বুনোটার কথা বলে। তা, সে সাহেব শুনে বলেছিল ওটা বাইসনই ছিল। এদিকের জঙ্গলে বাইসন থাকা অসম্ভব নয়। কোচবিহার রাজবাড়ির বাইরের করিডরে সারি সারি বাইসনের মাথা সাজানো। কোন জঙ্গলে কোন তারিখে মারা, রুপোর ফলকে তাও লেখা আছে। আর ১৯৫০-৫২-তে কোচবিহার শহরেই এক বাইসন এসেছিল। আর রাজামশাই তাকে গুলি করে মেরেছিল। কিছুক্ষণ পরে সাহেব চাউটিয়ার মন রাখতে বলেছিল, তো, বুনো মোষও হতে পারে। মানুষে মানুষে চেহারার পার্থক্য থাকে। যেমন দেখো আসফাককে, ওর গায়ের রং মুখের চেহারা এখানকার অন্য সকলের থেকে আলাদা। জন্মের সময় ধাক্কাধুক্তি লেগে হয়তো মোষটার কাঁধের হাড় উঁচু হয়ে গিয়ে থাকবে।
আসফাক ভাবল : ফান্দি কিন্তুক সে ভইষাক বান্ধির পায় না।
চাউটিয়া হয়তো ফান্দি হিসাবে তার বাপের মতো ওস্তাদ নয়, তাহলেও এ-অঞ্চলে চাউটিয়াই একমাত্র ফান্দি। সেও ব্যর্থ হয়েছে সেই মোষকে ধরতে। আসফাক দেখল, তার সামনে একটা ঘাসবন। বনটা নতুন হয়েছে। কুশের জাত। এক কোমর উঁচু হবে। সেই ঘাসের গোড়ায় এক রকমের লতা। তাতে নাকছাবির মতো ছোট ছোট নীল ফুল। আসফাকের মনে পড়ল, এই ঘাস মোষেরা খুব পছন্দ করে। গরু খায় বটে, তা উপরের নরম নরম অংশ। মোষ শক্ত গোড়া পর্যন্ত। ছাড়ে না। ঘাসবনটাকে ঘুরে যেতে হবে। আসফাক বাঁয়ের দিকে সরল। খুব বড় নয় এই নতুন গজিয়ে ওঠা বনটা; এখনো সব ঘাসই কচি। মোষের দল এখানে এলে নড়তে চাইত না।
কিছুদূর গিয়ে আসফাকের মনে হল, সে যেন একটা মাদি মোষের পিঠে শুয়ে, আছে আর মোযটা ঘাস খেতে খেতে হাঁটছে। তা মাদি মোষের পিঠে শুতে প্রথম ভয় করেই। পরে অভ্যাস হয়ে যায় আর তখন মোষের গলার দুদিকে পা নামিয়ে তার পিঠ বরাবর শুয়ে পড়লেই হল। কখনো গান গাওয়া যায়, কখনো ঘুমের ভাব আসে।