আসফাক তখন দ্বারিঘরের আর বাথানের মাঝের মাঠটায় এক ছোকরার সঙ্গে হাত লাগিয়ে পাটের সুতলি পাকিয়ে গোরুমোষ বাঁধার দড়িদড়া তৈরি করছিল। মোষের মতো অনেক গরুও আছে জাফরুল্লার। সংখ্যায় বরং গরুই বেশি। চল্লিশ-পঞ্চাশটা তো বটেই। এই অঞ্চলে এই গরুগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য আছে। পূর্ণবয়স্ক হলেও আকারে এত ছোট যে দূর থেকে তাদের চলতে দেখলে রামছাগলের দল বলে ভুল হয়। তাহলেও এগুলোর মধ্যে ষাঁড়, বলদ, গাভী আছে। গাভীগুলোর এক-আধপোয়া দুধ হয়। বলদগুলো দরকার হয় তামাকের খেতে চাষ দিতে, যেখানে মোষ দিয়ে চাষ চলে না। ষাঁড়গুলো দলের শোভা বৃদ্ধি করে, গাভীদের শান্ত রাখে, আর মাঝে মাঝে তাদের দু-একটাকে খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়। গাভীগুলোর দুধের একটা গুণ আছে। জাফরুল্লার এখন মোষের দুধ সহ্য হয় না, মুন্নাফ আরো কিছু বয়স না হলে মোষের দুধ ধরবে না। গাভীর দুধ তাদের জন্য আলাদা করে দুইয়ে দেয় আসফাক। কিন্তু এই গোরুর পালের আসল উপকারিতা গোবর–যা তামাকের খেতের পক্ষে অপরিহার্য। সেই খেতের জন্যই গোরু পোষা। মোষের গোবরে কেন তামাকের সার হয় না-এ সব নির্বোধ ছাড়া কেউ আলোচনা করে না।
তা, মুন্নাফ বললে, এই যে মিঞাসাহেব শোনেন, আব্বাজানের ওষুধ ফুরাই গেইছে, শহরৎ যাওয়া লাগে।
আসফাক ধীরে ধীরে বলেছিল, শহর?
হ্যাঁ, পিরহান পিন্ধি আসেন তোমরা।
আসফাক সেই বলদদের ঘরে গিয়ে দেওয়ালে গোঁজা জামাটা ঝেড়েঝুড়ে গায়ে দিয়ে এসেছিল। আর মুন্নাফ তাকে খুচরোয় নোটে মিলিয়ে আট-দশটা টাকা এনে দিয়েছিল আর একখানা কাগজ। শহরের দোকানটা আসফাকের চেনা। কাগজ দেখালেই ওষুধ দেবে।
মুন্নাফকে কে না চেনে এ গেদে? জাফরুল্লা ব্যাপারির একমাত্র ছেলে। তার চার নম্বর বিবির দরুন চার বিবি মিলে ওই এক সন্তান।
আসফাক হাঁটতে শুরু করেছিল।
আসফাক কেন? আসফাককেই কেন ওষুধ এনে দিতে হবে? তার অবশ্য; কারণ আছে। জাফরুল্লার খামারে কে কী কাজ করবে, তা ঠিকঠাক বলে দেয়া আছে। যেমন মোষের বাথানের কঠিন কাজগুলোর ভার চাউটিয়ার উপরে। দুধও দোয়ায় সে। আর দুধ দোয়ানো হলে সেই দেড়-দুইমণ দুধ বাঁকে নিয়ে শহরের দিকে যায়। রোজ সে শহরে ঢোকে না; শহরের তিন মাইলের মধ্যে দুই পিচের সড়কের মিল পর্যন্ত যায়; যেখানে এখন শহরের গোয়ালারা এদিকের সব বাথানের দুধ কিনতে আসে। সেখানে উনুন জ্বেলে ছানাও তৈরি করে। তাতে দুধ পচার ভয় এড়ানো যায়। আর মোষের দুধের ছানা গরু-দুধের ছানা বলে শহরে ঢোকে। চাউটিয়া তাদের চাইতেও তরখর। দুধ দোয়ানো হলে সে অনেক সময়েই মাখন তুলে নেয় এক সের, দুধ বেচতে যাওয়ার আগে।
ছমিরের কাজ খড়ি ফাড়া, তরকারি-বাগান তদ্বির করা, হাঁসমুরগি দেখে রাখা। তার একটা বিশেষ কাজ আছে। খাসি হোক, এঁড়ে হোক, তার জবেহ করা, ছাল ছাড়ানো। আর বছরে একবার সেই দৃশ্যটা দেখা যায়–মোষ, গরু, পাঁঠাকে খাসি করা। এ ব্যাপারে অন্য লোকের সাহায্য দরকার হয়, পশুগুলোকে মাটিতে চেপে ধরে রাখতে হয়। তারা রাগ প্রকাশ করে, আর্তনাদ করে, পা ছোঁড়ে, ছটফট করে যন্ত্রণায়। ভয়ঙ্কর দৃশ্য। কিন্তু বোধহয় তার আকর্ষণও আছে। কাছাকাছি যারা অন্য কাজে থাকে, তারাও কাজ ফেলে কাছে এসে দাঁড়ায়। ঝিদের দেখতে দেখা গিয়েছে আড়াল থেকে। এমনকী জাফরুল্লার তিসরা বিবিকেও সেই ভিড়ে কিছুক্ষণের জন্য একবার দেখা গিয়েছিল। এ ব্যাপারে আসফাক বাঁশের একমাথা মাটিতে চেপে ধরে রাখা ছাড়া কিছুই করেনি এ। পর্যন্ত। ছমির কিন্তু এতটুকু বিচলিত হয় না, তার হাত কাঁপে না। কী কী করতে হবে, তা যেন তার মুখস্থ। একবার তো সে আসফাককে বলেছিল-নাও, মিঞা, চোখ খুলি ফেল। হয়া গেইছে।আসফাক চোখ খুলেছিল কিন্তু পশুটার অন্তরঙ্গ দিকে না চেয়ে বরং তার চোয়ালের দিকে চেয়েছিল, আর তার মনে হয়েছিল, সেই মোষের এঁড়ের বড় বড় চোখ দিয়ে জল পড়ে সর্দির মতো শুকিয়ে আছে চোয়ালে। ছমির কিন্তু এই পরবটার জন্যই যেন উৎসুক হয়ে থাকে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সেদিন তার এবং যাদের সে সঙ্গী করে তাদের আর কোনো কাজ থাকে না, একের পর এক পশুকে, ছমিরের ইয়ারকি, সুন্নৎ করে।
নসির আর সাত্তারকে লাঙলদার মনে হবে। লাঙলদার এখানে কে নয়? সেরকম চাপের তাড়া পড়লে, প্রকৃতির খেয়ালে তা পড়েও, এমনকী জাফরুল্লাও পাঁচ-সাত বছর আগে পর্যন্ত নিজেই লাঙল ধরেছে। কিন্তু সাত্তার আর নসিরের কাজ তামাকের খেতে। অনেক সময়ে তাদের সাহায্য করতে দিন-হাজিরায় লোক রাখতে হয়, কিন্তু জমি চষা থেকে শুরু করে পাতাকেটে তোলা পর্যন্ত সে খেতগুলোতে তারাই ওস্তাদ। কী আদরতু সেইসব জমির আর তার ফসলের, ধান তার অর্ধেক পেলে ধন্য হয়। সারা বছরই যেন নসির আর সাত্তার সেই জমিতে লেগে আছে। চাষ দিচ্ছে, খড়কুটো জড়ো করে পোড়াচ্ছে, সার দিচ্ছে, আল বাঁধছে। আর পাতা কাটা? তখন তো তাদের সেরা ওস্তাদি। তখন সেসব খেতে কারো নামাই বারণ। একবার আসফাক একটা তামাকগাছে কাস্তে বসিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে জাফরুল্লা ছুটে এসে এমন এক থাপ্পড় কষিয়েছিল যে সারা জীবনে তা ভুলতে পারা যাবে না। তামাক নাকি বিষ! তারই যত্ন-দেখো। বিষের জ্বালা মুখ থেকে ফেলতে থু থু করে থুক ফেলল আসফাক।