চাউটিয়া উবু হয়ে বসেছিল। নিজের দুই হাঁটুর পাশ দিয়ে হাতদুটোকে সামনে এনে আঙুলে জড়িয়ে এহাতে ওহাতে ধরল। যেন আড়মোড়া ভাঙল। এমন শক্ত করে এহাতে ওহাতের চাপ যে আঙুলের গাঁটগুলো পটপট করে ফুটল। আলসেমি তাড়ানোর ভঙ্গিই যেন, কিন্তু এ আলসেমি ত্রিশ বছরের। তার বাপ ফান্দির কাজ ছেড়ে দেয়ার পরে যে দশ বছর বেঁচেছিল, তার বাপের মরার পর থেকে তখন পর্যন্ত তার নিজের জীবনের বিশ বছর, একুনে যে ত্রিশ বছর ফালির দড়িতে হাত পড়েনি, সেই ত্রিশ বছরের আলসেমি ভাঙতে চেষ্টা করছে যেন চাউটিয়া।
বাথান আর দ্বারিঘরের মাঝখানে যে পঞ্চাশ হাত, তাতে আড়াল আবডাল খুবই কম। দুটো আশশেওড়া আর একটা বুনো কুলের ঝোপ। ছোট ঝোপ, এপারে দাঁড়ালে ওপার দেখা যায়। মাঝে মাঝে ঘাস আছে এক-দেড়-হাত উঁচু, কিন্তু বেশির ভাগ জমি দূর্বা ঢাকা। সব চাইতে বিপদের এই, বাথানের বেড়ার কাছে চারপাত জমি একেবারে ফাঁকা! বাথানের দরজার দিকে যাওয়াই যাবে না। তার কাছাকাছিই বুনোটা। একেবারে উলটো দিক দিয়ে বাথানের বেড়া বেয়ে উঠে বাথানের ভিতরে নেমে ডাকপাড়া মাদিটাকে আলাদা করে দরজার কাছে নিয়ে এসে সেটাকে বার করে দিতে হবে; এক হাতে হুড়কো তুলতে হবে, অন্য হাতে তাড়াতে হবে মাদিটাকে। যদি বুনোটা টের পেয়ে যায়, বেরনোর পথে মাদিটাকে যদি দেখে ফেলে, তবে সেটা তেড়ে আসবেই। তখন মাদিটাও বাথানে পিছিয়ে আসতে চেষ্টা করবে। বুয়ের ধাক্কায় শিঙের গুঁতোয় প্রাণ যাওয়াটাই স্বাভাবিক হবে।
গামছাটাকে লেংটির মতো করে পরে, লম্বা সরুগোছের একটা পেন্টি পিঠের উপরে নেংটির ফাঁদে গুঁজে, বুকে হেঁটে চাউটিয়া বাথানের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। বুনোটা তখন বাথানের পূর্ব দিকে। দক্ষিণঘেঁষা পশ্চিমে বাথানের গা-ঘেঁষা জামরুল গাছটায় উঠে, তার ডাল বেয়ে এগিয়ে, তা থেকে ঝুল খেয়ে বাথানের ভিতরে নেমেছিল চাউটিয়া। ডাকপাড়া মাদিটাকে খুঁজে নিয়ে দরজা খুলে বের করে দিয়েছিল। মাদিটা মুখ বার করতে না করতে আর একবার ডেকে উঠল, আর একই সঙ্গে ঝড় আর ভূমিকম্পের মতো তেড়ে এল বুনো। ভাগ্য ভালো, মাদিটা বাথানের দিকে না ফিরে বাইরের দিকে ছুটল।
সেই সময় চাউটিয়া বুনোকে ভালো করে দেখেছিল। সামনার ঠ্যাং দুনা পিছলা ঠ্যাং দুনার চায়া আধা হাত উঁচা। সিংঅর ছবি দেখছেন তোমরা? কান্ধতে তেমন চুল।
ভোটমারির সেই গৃহস্থ বলেছিল, থ্রুস, তোমরা দেখি মস্করা করেন।
তার বিস্ময় ও অবিশ্বাস স্বাভাবিক। মোষ সে অনেক দেখেছে, তার নিজেরও গোটাকয়েক আছে। হতে পারে সেই বুনোটা প্রকাণ্ড ছিল, তাই বলে ওরকম অদ্ভুত গড়ন হয় না।
কিন্তু আগ্রহভরে আসফাকও শুনছিল গল্পটা। সে নড়ে বসে বলল, তার পাছৎ?
গল্পটার শেষটুকু এই রকম : ঘণ্টাখানেক পরে ভালো রকম নাস্তা মেরে মজবুত হাত-ত্রিশেক লম্বা দড়ি, হালকা দা, বেতের পেন্টি (লম্বা সরু মজবুত লাঠি), কয়েক দিনের মতো চিড়া-গুড়-লঙ্কা-নুন নিয়ে নেংটিপরা চাউটিয়া মোষের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিল।
ভোটমারির লোকটি জিজ্ঞাসা করল, চাউটিয়া এই বড় মদ্দাটাকেই সেই বুনো বলে বোঝাতে চাচ্ছে কিনা।
চাউটিয়া বলল, সে মোষ ব্রা যায়নি। সেটা মোষ কিনা তাও সন্দেহ আছে। মাদিটাকে অনেক কষ্টে খুঁজে পেয়ে তাকে ফিরিয়ে এনেছিল সাতদিন পরে। ফয়েজুল্লা খুব ঠাট্টা করবে ভেবেছিল। কিন্তু করেনি। সেও মোষটাকে দেখেছিল। কিছুদিন পরে দেখা গেল, মাদিটা গাবতান। এই মদ্দাটা সেই বাচ্চা। আর ছোটটা সেই বাচ্চার বাচ্চা।
সেই দশ বছর আগে একবারই বুনো মোষের দেখা পাওয়া গিয়েছিল মহিষকুড়ায়। তবে সে মোষও অদ্ভুত। চাউটিয়া তো বলে, জাতেই খানিকটা আলাদা। গায়ের রং কালোয় খয়েরি মেশানো। তাকে কি ধরা যায়? খানিকটা দেয়াসী নয়? দেয়াসী মানে দেবাংশী। দেবতার অংশে যে জাত। তা, সেই সাহেব বলেছিল, ওটা মোষই নয় হয়তো-বাইসন ছিল।
সাহেব বলতে তারা নয়, যারা বিলেত থেকে এদেশে আসত আগে। এদেশেরই কালো-কোলো মানুষ, জিপগাড়িটাড়িতে যায় আসে, নাকি মাজিস্টর, খুব পায়োর।
পায়ের শব্দটা আসফাক শিখেছে কিছুদিন আগে। ইংরেজি পাওয়ার শব্দটাই। আসফাক যতদূর পেরেছে উচ্চারণ করতে, এর বেশি তার কাছে আশা করা যায় না। আর কী আজব এই শব্দ! জাফরুল্লার চশমার পায়োর বদলানোর সেই গল্প কে না জানে? ছমির বলে, পায়োর বদলাতে গঞ্জে গিয়েই জাফরুল্লা তিসরা বিবিকে দেখতে পেয়েছিল। জাফরুল্লা নাকি এতদিন বুঝতে পারেনি, তার বড় আর মেজ বিবির বয়স হয়েছে। আবার দেখো, জাফরুল্লার সেই বন্দুকের পায়োর। সরু লাঠির মতো কালো চকচকে সেই নলটা থেকে যা বের হয় তা নাকি জমানো জমাট পায়োর, যার এক ফুলকিতে আকাশে ছোটা হরিণ। নিথর হয়ে যায়। মাজিস্টরদের তো বটেই, এমনকী যারা মাজিস্টর নয় অথচ তার মতো পোশাক পরে!-পোশাকের কী পায়োর দেখো। আর দেখো, সেই বুনোটা যে দশ বছর আগে একবার এসেছিল তার কী পায়োর, এ অঞ্চলের অনেক মোষ আকারে-প্রকারে এখন অন্য মোষ থেকে পৃথক হয়ে যাচ্ছে তার পায়োরের ফলে।
আসফাক পথে পথে চলতে চলতে এসব কথাই ভাবছিল। সে জাফরুল্লার জন্য ওষুধ আনতে যাচ্ছে। মহিষকুড়ায় ডাক্তার নেই। একজন আছে বটে, যে অন্যান্যদের মতো খেতখামারের কাজ করে, দরকার হলে এগাছ ওগাছের ছালকলাশিকড় জ্বাল দিয়ে কিংবা তাদের পাতার রস দিয়ে বড়িটড়ি তৈরি করে দেয়। কিন্তু জাফরুল্লার এখন শহরের ডাক্তারের ওষুধ ছাড়া চলে না। রোজই নাকি তাকে ওষুধ খেতে হয়। তা জাফরুল্লার বয়স ষাট তো হলই। ওষুধগুলো যতক্ষণ হাতের কাছে থাকে ততক্ষণ জাফরুল্লাকে শক্তসমর্থই মনে হয়, ওষুধের অভাব হলে হাত-পা অবশ হয়ে আসে। শেষ হতে কতক্ষণ?