আর জাফর কি জানত? জেনেই, কমরুনকে দেখে তার অবস্থা বুঝতে পেরেই তাকে নিকা করেছিল?
.
অদ্ভুত কথা তো! ভারি অদ্ভুত কথা! এছাড়া কোনো কথাই তার মন তৈরি করতে পারল না। আর কথা তৈরি না হলে কি চিন্তা করা যায়? কিন্তু চিন্তা কখনো কখনো বুকের একটা কোণও ভরতে পারে না। সেই খালি অংশগুলোতে যেন এই রাত্রির অন্ধকারও ধূসর হয়ে উঠতে লাগল, কখনো যেন সেই আকাশে চোখে দেখা যায় এমন মেটে রঙের বাতাস বয়ে গেল, কখনো গোটা আকাশটাও গলে গলে ধরা হয়ে নেমে এল কোনো কালো রঙের ধানখেতের উপরে, যার বুকে একটা কাঠি পোঁতা অনেক স্রোতকে বিভক্ত করে। হাকিম সাহেবের কথা নয়। আরো গভীর আরো ব্যাপক কিছু। এমন টান এই স্রোতের।
ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল আসফাকের। ধড়মড় করে সে সজাগ হল। ঠিকই শুনেছে যেন সে, জাফরুল্লা ব্যাপারি তাকে ডাকছে। মাচার উপরে খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে সকালের দিকে বোধহয় তন্দ্রা এসেছিল তার। অনেক বেলা হয়ে গেলে যেমন করে চাকররা তেমন করে চোখ ডলে মাচা থেকে নামল সে।
কিন্তু জাফরুল্লা নয়। মুন্নাফ ডাকছিল। বেলা একটু হয়েছে। কিন্তু যতটা আশঙ্কা করেছিল তা নয়।
.
মুন্নাফ বলল, উঠছ আসফাক!
উঠলাম। কখন আসলে? আসফাক হাসল বিবর্ণ মুখে।
ভোরে।
কেন, শহর থেকে রাত্তিরে রওনা দিছলে? আন্ধারের পথ তো।
লরিতে আসলাম যে। তা দেখো নাই! আব্বাজান লরি কিনছে একখানা। সে জন্যেই তো শহরে যাওয়া।
ও।
এখন থেকে আর গোরুগাড়িতে তামাক পাট যাবে না বন্দরে। লরিতে যাবে। কী ভকভক হরন। আর কত বড় বড় চাকা। ডারাইবারও আসছে।
ও। তা মুন্নাফ।
আর মুন্নাফ না। শোন তোমাকে এক কথা কই, আসফাক। বলদ এড়ে দাও। আব্বাজানের ঘুম ভাঙার আগেই বলদ নিয়ে দূরে চলে যায়ো। আম্মা কয়ে দিয়েছে।
আসফাক বলদের গলার দড়ি খুলে দিতে লাগল। বারোটা বলদই বেরিয়ে পড়ল দিনের আলোয়।
মুন্নাফ দরজার কাছ থেকে কিছুদূরে সরে গিয়েছিল।
সেখান থেকে সে ডাকল, শোনো, আসফাক, আর এক কথা কই।
আসফাক এগিয়ে গেল। তার বুকের ভিতরে ভয় ধকধক করতে লাগল। সেই গল্প জানো তো? খুরপি চুরির জন্য চোরকে ধরলে খুঁজে খুঁজে তার সব পুরনো চুরি ধরা পড়ে। কিন্তু কী আর গোপন থাকবে? সে তো নিজেই নিজের কাছে ঢাকতে পারছে না। দেরি তো দেরি, হাকিমসাহেবকে যা বলেছে তা নিজেও সে ভুলতে পারছে না। গোপন করাও যাবে না। জাফরুল্লা এসে গেছে, জাফরুল্লা এসে গেছে। সেবার তবু সেই দহের ধারে উশকোখুশকো চুল ছিল কমরুনের, সাদামাটা শাড়ি ছিল পরনে।
আম্মা বলেছে আব্বা খাওয়া-লওয়া করে না শুলে তুমি বাড়িতে আসবা ।
আসফাকের মনে একটা প্রশ্ন দেখা দিল। একটু ইতস্তত করল সে, কী ভাবে আরম্ভ করা যায় তা খুঁজতে দেরি হল।
কেন, মুন্নাফ, তুমি আর মিঞাসাহেব বলবা না আমাকে?
মুন্নাফের মুখে লজ্জার মতো কিছু একটা ভাব দেখা দিল, না। আব্বা বলছে চাকরকে তা বলা লাগে না।
ঠিক এমন সময়ে কে যেন ডাকল–আসফাক।
কে যেন কয়? চিনতে কি ভুল হয়? এই বজ্রগর্জনের মতো স্বর। টিনের দেয়ালের ঘরের জানালা খোলা। সেই খোলা জানালায় মেহেদি-রাঙানো দাড়ির খানিকটা দেখা গেল।
আসফাক বলদগুলোর পিছনে দৌড়ে চলার মতো হাঁটতে শুরু করল।
আকাশের চেহারা ভালো নয়, আসফাক। বলদ দূরে নিস না।
আকাশের দিকে তাকালো আসফাক। আকাশে কালো মেঘ নেই। দিনের আলোয় যে আকাশ ঝকঝক করে তাও নয়। এমন নোংরা আকাশ আর কোনোদিনই দেখেনি সে। বলদদের ঘরের মেঝের মতো কাদামাখা যেন। আর রাত্রিতে ঘুম না হলে যেমন হতে পারে তেমন ফ্যাসকা। মোটকথা এমন রংচটা আকাশ সে আর কখনো দেখেনি।