সেবার কিন্তু দড়ি পাকিয়েছিল আসফাক। সেবার মানে ওই যে পনেরো দিনের জন্য যখন জাফরুল্লাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। তখন কিন্তু এমন সুমসাম হয়ে যেত বাড়িটা। আজও তেমনি। শুধু ব্যাপারি এবার তাকে দেখাশোনা করতে বলে যায়নি। তা হোক। কেমন একটা আলসেমি লাগছে। এবার সে শুতে যাবে। এই টুকরো কটা শেষ হলেই হয়।
কাজ করতে করতে হঠাৎ সে থামল। সেবার কিন্তু শোওয়ার আগে বাড়ির চারিদিকটা দেখে আসত। বিবিরা ঘরের দরজা দিল কিনা খোঁজ নিত। শুধু দহের পারের সেই ঘটনার পরের তিন-চারদিন সে শুধু বড়বিবির ঘরের সামনেই দাঁড়াত।
বাঁশ আর কাটারি সরিয়ে রাখল সে। উঠে দাঁড়াল। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কী যেন লক্ষ করল। চিবুকে হাত রাখল। কিছু যেন একটা মনে আসছে, কিন্তু ঠিক ধরতে পারছে না কী সেটা। সে ঘরের দিকে চলল। শোবে এখন সে।
কিন্তু এবারেও তার শুতে যাওয়া হল না। তার মনে হল কমরুনবিবিকে আজ সে দেখেনি। খবর নেয়া দরকার। সত্যি কি জাফর তাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে? নিতে হলে মেজবিবিকেই নিত। খুবসুরত ছোটবিবিরও সে সুবিধে নেই। ওরা যেমন বেহিসেবি-বিবিরা দরজাটরজা ঠিকঠাক দিল কি তা দেখবার জন্য অন্দরের দিকে পা বাড়াল আসফাক। আর কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ যেমন একটা আলসেমি লেগেছিল কাজ করতে করতে তেমন কিছু একটা অনুভব করল সে আবার। তারপর গা শিরশির করে উঠল। গলার কাছে উৎকণ্ঠা যেন একটা দলার মতো ঠেলে উঠল। আবার তার মনে পড়ল সেবারেও এমন নিঃসঙ্গ ছিল ব্যাপারির বাড়ি।
সে অন্দরের দিকে একটু তাড়াতাড়ি হেঁটে গেল। সে অনুভব। করল–দেখো এ ব্যাপারটাও সে আগে বুঝতে পারেনি, অন্য সব ব্যাপারের মতো। ভাবো তো কতদিন দেখা হয় না কমরুনের সঙ্গে। সেবারের সেই সাঁকোর কাছে কথা হওয়ার পর আর কথাও হয়নি। অন্য বিবিদের তদারক না করে সে সোজা কমরুনের ঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তখন তার রক্ত পাগল হয়ে উঠেছে।
কমরুন, কমরুন, ঘুমাও? ওঠো। ফিসফিস করল আসফাক।
কমরুন তখনো ঘুমোয়নি। ঘরের মেঝেতে পাটি পেতে বসে কী একটা সেলাই করছে সে।
ভাক শুনে কমরুন সেলাই নামাল হাত থেকে। উঠে এল জানালার কাছে।
কে! সর্বনাশ! আসফাক? কমরুনের মুখ, একেবারে রক্তহীন হয়ে গেল।
সে ফিসফিস করে বলল, ব্যাপারি বাড়ি নাই।
জানি।
তা হলে। কমরুন যেন হাঁপাচ্ছে।
যন্ত্রলিতের মতো কমরুন দরজা খুলে দিল। দরজা খুলে দিয়ে ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল সে।
আসফাক কমরুন কী বলবে খুঁজে পেল না।
আসফাক বলল, কমরুন, কী খুবসুরত দেখায় তোমাকে।
কমরুন বলল, রাগ করো না, আসফাক, আমি একটু ভেবে নিই। তুমি বোসো।
আসফাক কমরুনের দিকে চেয়ে রইল। হলদে সাদায় ডুরি একটা শাড়ি পরনে তার। গলায় একেবারে নতুন একটা রুপোর চিকহার লণ্ঠনের আলোয় চিকচিক করছে। আসফাকের বাঁদিকে কমরুনের বিছানা। মশারিটা তোলা। সাদা ধবধবে বিছানায় দু-একটা মাত্র কোচকানো দাগ।
কেন কমরুন—
কী আসফাক?
তুমি কেমন আছো তাই খোঁজ নিতে আসছিলাম।
তুমি রাগ কোরো না আসফাক।
না। রাগ কী!
দরজার কাছে ফিরে গেল আসফাক।
কমরুন এগিয়ে এল।
আসফাক দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলল, দুয়ার দেও কমরুনবিবি।
যন্ত্রচালিতের মতো দরজা দিতে গিয়ে থামল কমরুন। ফিসফিস করে বলল, শোনো। আমি মুন্নাফকে শিখায়ে দিছি। আমি যতদিন বাঁচব সে তোমাকে মিঞাসাহেব কয়ে ডাকবে।
আসফাক ফিরে গেল বিবিদের তদারক করে।
নিজের শোবার মাচাটায় গিয়ে বসে তার যে অনুভূতি হল কথায় দাঁড় করালে তার অর্থ হয়–এ কমরুন সে কমরুন নয়।
কোনো কোনো কথা আছে উচ্চারণের সময়ে তার যতটা অর্থবোধ হয়। পরে তার চাইতে বেশি গভীর মনে হতে থাকে।
কথাটা তো ঠিকই–এই ভাবল আসফাক–জাফরুল্লা ব্যাপারি তাকে অন্য চাকরদের চাইতে আলাদা দেখে। তা না হলে, সেবার তাকেই বা সব কিছুর ভার দিয়ে যাবে কেন? আজ কমরুনও বলছে সে মুন্নাফকে শিখিয়ে দিয়েছে। যাতে সে আসফাককে মিঞাসাহেব বলে ডাকে। একে যদি খাতির না বলে কাকে বলবে?
মিঞাসাহেব, মিঞাসাহেব না? এই বলল আসফাক মনে মনে হাসলও সে।
কিন্তু ঠিক ওভাবে বলল কেন কথাটা কমরুন? অবাক কাণ্ড দেখো, কমরুনের কথাবার্তা কেমন বিবিসাহেবদের মতো। হঠাৎ যেন চিড় খেল তার সামনের অন্ধকারটা। এদিক ওদিক তাকাল সে। আসলে তা তো নয়। আসফাকের মনেই কথাটা বিদ্যুতের মতো চমকে উঠেছে। কেন, কারুনবিবি ওভাবে ওকথা বলে কেন? রাগ করতে নিষেধ করে সে তা না হয় বোঝা যায়। কিন্তু তার সঙ্গে ওকথা কেন? এমন ঠাট্টা জাফরুল্লার অসাক্ষাতে চাকররা করে বটে। তা দু-একবার শুনেছে আসফাক। কিন্তু তারা তো কত কী-ই বলে– বড়বিবির নাকি রোজ এক বস্তা চিড়ে লাগে নাস্তায়। ছোটবিবি নাকি রাত্রিতে উড়ে কোথায় যায় সে জন্যেই তার চোখদুটো অমন ধারালো। মেজবিবি নাকি মন্তরে বশ করেছে ব্যাপারিকে। দাড়িতে যে রং দেখো সেটাই ওষুধ মেজবিবির। তেমনি মুন্নাফ সম্বন্ধেও একটা ঠাট্টা আছে তাদের।
আসফাকের মনের এই চিড়খাওয়া ফাটল দিয়ে বিবিদের ঝগড়ার কথাগুলো ভেসে উঠল। মেজবিবির সঙ্গে ছোটবিবির ঝগড়া। ঝগড়াটা ঠিক নয়। ঝগড়ায় যে সংবাদ ছিল। মেজবিবিও তা হলে পতিত থাকল কেন? কমরুনবিবি কি তা হলে মুন্নাফকে কোমরে নিয়েই ঢুকেছিল ব্যাপারির ঘরে? আর তা যদি হয়, তবে মুন্নাফ কি? সে জন্যই কি মুন্নাফ তাকে নাম ধরে : ডাকে না, আর তার মা তাকে শিখিয়ে দিয়েছে আসফাককে সম্মান করতে।