.
চাকররা সারাদিন কাজ করে। সন্ধ্যা লাগতে লাগতেই তাদের খাবার দেয়ার নিয়ম। আজও কিছুক্ষণের মধ্যেই ছমির এসে খেতে ডাকল। আসফাককে। কিন্তু নিজে সে খাবে না। বাড়ি যাবে। সে কথাটাই আবার মনে করিয়ে দিল। কিন্তু ছমিরদের দিনের কাজ শেষ হয়েছে। তাকে এখন কতগুলো কাজ করতে হবে। আসফাক বড়বিবির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
বড়বিবি যথারীতি মোড়ায় বসে ফুরসি টানছে। তার সামনে গিয়ে ওষুধের শিশি আর পয়সা নামিয়ে রাখল আসফাক।
কে, আসফাক?
জে।
বড়বিবি হাসল। নিঃশব্দ হাসি কিন্তু তার মুখের পেশীগুলোর মধ্যে চোখদুটো ডুবে গেল হাসির দমকে।
হাসি থামলে বড়বিবি বলল, কেন, পথ হারাইছিলা?
জে।
আবার ফুরসিতে মন দিল বড়বিবি।
মেজবিবি আজ খাবারঘরের মালিক। কথা সে কার সঙ্গেই বা বলে? আসফাক আর তার মতো দুজন বারান্দায় উঠে বসতেই সানকি করে ভাত দিয়ে গেল মেজবিবি। একবারও সে কিছু জিজ্ঞাসা করল না আসফাককে। যেন এরকম কাণ্ড রোজই করছে সে।
খাওয়া যখন মাঝামাঝি হঠাৎ দমাদম পা ফেলে রসুইঘরে এল ছোটবিবি। তার পায়ের মল ঝমঝম করে বাজল। তার ভাব দেখেই বোঝা যায় এবার কী হবে। চাকররাও এ ওর দিকে চেয়ে চোখ টিপল। মাঝে মাঝে যা হয়। ঘরের মধ্যে কথাগুলো চাপা গলায় হচ্ছে কিন্তু অন্যদিনের মতো বাইরে থেকেই কানে যাচ্ছে। মেজবিবির দিকে ছোটবিবি যদি অমন ছুটে আসে বুঝতে হবে ঝগড়া হবেই। এ ঝগড়ায় কে-ই বা দৃপাত করে এখন? আসফাকের কিন্তু কানে গেল কথাগুলো। আর তখন তার অনুভব হল সবই ঠিক আগের মতোই। মাঝখানে তার দেরির ব্যাপারটা। আর তাও এরই মধ্যে লোকে ভুলে যেতে বসেছে।
অবশ্য অতটা বলা ঠিক হয়নি। ঝি নিয়ে ঝগড়া শেষ করে ছোটবিবি আবার বার হল রসুইঘর থেকে। তখন আসফাকদের খাওয়া প্রায় হয়ে গিয়েছে। ধাপ বেয়ে নামতে নামতে থামল ছোটবিবি।
বলল, আসফাক?
জে।
পরী ধরছিল?
আসফাক লজ্জিত হয়ে মুখ নামাল।
অন্য চাকররা অস্ফুট শব্দ করে হাসল।
অন্য চাকরদের বাড়ি যাওয়ার তাগাদা ছিল। ছিলিমে দুটান দিয়ে চলে গেল তারা। তখন আসফাক খুঁতখুঁত করে হাসল ছিলিম টানতে টানতে। পরী ধরার কথা বলেছে ছোটবিবি।
ছিলিমটা ঢেলে নতুন করে ছিলিম ভরল আসফাক। তা পরীর মতোই দেখতে বটে ছোটবিবি, সলসলাবাড়ির পথে আসফাককে পরী ধরুক আর নাই ধরুক। চোখের কী জেল্লা, নাকফুল আর কানফুলের কাঁচগুলোর চাইতে যেন সুর্মার টানের মধ্যে বসানো চোখের মণিদুটো বেশি ঝকঝকে। আর ঝগড়া–কী ঝগড়াই না করতে পারে। অমন যে আদরের মেজবিবি সেও পালাতে পথ পায় না। আজ রসুইঘরেও চুপ মেরে গিয়েছিল ছোটবিবির মুখের সামনে।
অন্ধকারে পা ছড়িয়ে বসল আসফাক। আরাম করে বসে ছিলিমে আগুন ধরাল। সবই ঠিক দেখো আগের মতোই। মাঝখানে হাকিম সাহেবের পাগলামি। অন্ধকারে স্নিগ্ধতায় তার শরীর জড়িয়ে আসতে লাগল। ছিলিম ঢেলে সে হাসিমুখে উঠে দাঁড়াল। ছোটবিবির ঝগড়াটায় যে কৌতুক তাই যেন দিনশেষের রসিকতা যা ভাবতে ভাবতে ঘুমাতে যাওয়া যায়।
আসফাক ঝগড়াটা যেন আবার শুনতে পেল।
ছোটবিবি বলল, নুরীকে বলছিলাম পা দাবাতে।
এদিকেও তরকারি কোটা লাগে।
মানুষের তো ব্যথাবিষও হতে পারে।
বাব্বা! একরাত বাড়ি নাই তাতেই এত গায়ে ব্যথা।
সে বিষ হয় তোমার।
বেশ, হয়। নছিব করা লাগে।
অত দেমাক দেখায়ো না। নছিব? তবু যদি খ্যামতা থাকত।
খ্যামতা?
তা না? তা না হলে কমরুনবিবিকে আনা লাগে না। আমি আর বড়বিবি না হয় বাদ, তুমি কেন পতিত থাকলে?
বলদের ঘরে ঢুকে আসফাক শোয়ার যোগাড় করে নিল। কিন্তু তখনই শোয়া হল না তার। তার মনে পড়ল কিছু কাজ বাকি আছে। জাফরুল্লা বলেছিল কয়দিনের মধ্যেই তামাক বাঁধার চটি বাঁশ লাগবে। সোজা নয় প্রয়োজনটা। পাঁচ-ছয়টা আস্ত বাঁশের চটি করতে হবে। তাও আবার মাপ মতো হওয়া চাই–লম্বায় পোন হাত, চওড়ায় দুই সুত, আর মোটা কাগজের মতো। তামাকের ডাটা একহাতে ধরে অন্যহাতে ভঁটাগুলোর উপরে তিন পাক বেঁধে দিতে হবে। কাল সকালে বাঁশ কাটা হয়েছে। শুকিয়ে গেলে চটি উঠবে না। আর ব্যাপারি ফিরে এসে যদি দেখে।
আসফাক তার মাচা থেকে উঠে দাঁড়াল। সে ঠিক করল দু-তিন ঘণ্টা কাজ করা যাবে এখন। আর তা করাও দরকার।
কিন্তু একটা টেমি না হলে কী করা যাবে? উঠে দাঁড়িয়ে সে অন্দরের দিকে গেল। বড়বিবির ঘরেই থাকে তেল। কিন্তু ভিতর থেকে ফুরসির শব্দ পাওয়া গেলেও ঘরের দরজা বন্ধ। রসুইঘরের দিকে আলো চোখে পড়ল। সেদিকে এগোতেই মেজবিবির গলার সাড়া পাওয়া গেল।
কে?
আসফাক।
কী চাই?
না। একটি টেমি।
ছোটবিবির দুয়ারে দেখো।
ছোটবিবির দুয়ারে টেমি পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু একটু লজ্জাও পেতে হল। চাকর হলেও পুরুষ তো। বাড়িতে পুরুষ নাই, আর নুরীও পুরুষ নয়, কিন্তু আবরু থাকা দরকার।
কাটারি দিয়ে বাঁশ থেকে চটি তুলতে বসল আসফাক টেমির আলোয়। একবার তার মনে হল–আচ্ছা, তিন বিবিকে দেখলাম কিন্তু কমরুনকে দেখা গেল না। সে কি ব্যাপারির সঙ্গে গেছে?
তারপর সে কাজ করতে বসল।
টেমিটায় তেল নাই। মিটমিট করছে। রাত্রির অন্ধকারটাও গম্ভীর হয়ে আসছে। চটি তুলতে তুলতে অন্ধকারের দিকেও চাইছিল আসফাক। চারিদিক সুমসাম হয়ে গিয়েছে। বলদের ঘর থেকে মাঝে মাঝে বলদের নিঃশ্বাসের কানে আসছে। আর নিজের হাতের কাটারি বাঁশের উপরে যে মৃদু শব্দ করছে।