বিস্ময়ের মতো শোনালেও জন্মদরিদ্র আসফাক সেই প্রথম নারীদেহ দেখেছিল। তখন ঘাগরায় জামায় ঢাকা আছে বটে। আসফাক এখন ভেবে পায় না কী করে অমন সাহস হল তার। কমরুন তাকে ঘুসি মেরেছিল। সেই শক্ত ঘুসি কানে লেগে অন্য সময় হলে আসফাক অজ্ঞান হয়ে যেত কিন্তু সেই প্রথম আসফাক যেন আকাশের কোনো শক্তির সন্ধান পেয়েছিল বুকের মধ্যে। আর কী সর্বগ্রাসী মাধুর্য! কমরুনের মুখে, তার একটু খোলা ঠোঁটদুটিতে, নীল মীনা করা পিতলের নাকফুলে, আধবোজা চোখদুটোতেও একটা হাসি তারপরে ফুটে উঠেছিল।
এরপর মোষের পিঠে তাঁবু চড়িয়ে কমরুন একদিন হাঁটতে শুরু করেছিল। আর তার পিছন পিছন আসফাক।
কমরুনই বা কী করবে? দলের সন্ধান পাওয়া গেলে আসফাক তার সঙ্গে। থাকত কিনা তা ভেবে লাভ নেই, হয়তো থাকত না। কিন্তু জাফর ব্যাপারির গ্রামে এসে অন্য একটা ব্যাপারও ঘটল। মোষটা যে বুড়ো তা কমরুনের কাছেই শুনেছিল আসফাক। তার একটা চোখের মণিও সাদা হয়ে গিয়েছিল বয়সের জন্য। কিন্তু সে বার্ধক্য যে এমন তা বোঝা যায়নি। একদিন সেটা কাদার মধ্যে বসে পড়ল। দুদিন ধরে মোষের তদবির চলল। গাছগাছড়ার দাওয়াই যা জানা ছিল কমরুনের সে সব প্রয়োগ করা হল। কিন্তু তৃতীয় দিনের সকালে এসে দেখা গেল শেয়াল খেতে আরম্ভ করেছে। সেই কমরুন এখন জাফরুল্লার চার নম্বর বিবি।
তা বুদ্ধি আছে জাফরুল্লা ব্যাপারির। এখানে আসার মাস পাঁচ-ছয় পর থেকেই ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল, যদিও আসফাক তা তখন ধরতে পারেনি। কবেই বা সে ঠিক সময়ে ধরতে পারবে? তখন সেই বেলে ডাঙা জমি চষত আসফাক। কমরুন যেত জাফরের অন্দরে কাজ করতে। তারপর বন্দোবস্ত উলটে গেল। আসফাক সারাদিন জমিতে কাজ করত, আর কমরুন রাতভোর ব্যাপারির বাড়িতে ধান ভানত, চিড়ে কুটত। এই কৌশলে তফাত করে রাখল দুমাস। তারপর নিকা করেছিল কমরুনকে। জাফরুল্লার চার নম্বর বিবি–তার একমাত্র উত্তরাধিকারীর মা।
কিন্তু, আসফাক নিজের অবস্থিতিটা বুঝবার জন্য এদিক ওদিক চাইল, কিন্তু–। পিছন দিকে জাফরুল্লার বাড়ি চোখে পড়ল। চোখ মিটমিট করল সে। যেন দেখতে চায় না।
.
আসফাককে এখন কেউ দেখলে বলত পক্ষাঘাত হয়েছে। চোয়ালটা অবশ হয়ে গিয়েছে। মুখটা হাঁ করা।
.
সেই সেবার যখন জাফরুল্লাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
.
তখন একদিন বলদ বাঁধতে গিয়েছিল আসফাক দহের ধারে। বলদদের যখন সে বাঁধছে কেউ যেন মৃদুস্বরে ডেকেছিল আসফাক, ও আসফাক। বাতাসটায় জোর ছিল, শব্দটা ঠিক এল না। একবার সে মাথা তুলে শুনতে পেল কে যেন কুই করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। বাতাসটা আরো জোরে উঠে পড়েছিল। পথের পাশের বড়-বড় ঘাস। সেগুলো বাতাসের তোড়ে ছপছপ করে গায়ে লাগছে। আসফাক পশ্চিম আকাশের দিকে তাকাল। ফাঁক খাওয়া এই ঝোড়ো বাতাসে ঝড় উঠবে কিনা তা বোঝার চেষ্টা করল। এমন সময়ে বাতাসে ভেসে কী যেন একটা তার গায়ে এসে পড়ল। সেটা গড়িয়ে পায়ের কাছে পড়লে আসফাক দেখল টোপাকুল। সে বিস্মিত হল। এদিকে টোপাকুলের গাছ কোথায়? দহের ওপারে একটা আছে বটে। ওপারের টোপাকুল এপারে এসে পড়বে এত জোর বাতাসে? কাজেই সে ওপারের দিকে ফিরে তাকাল। আর তখন সে দেখতে পেল। সাঁকোর উপরে, সাঁকোটা প্রায় পার হয়ে এসে, দাঁড়িয়ে আছে কমরুন। বাতাসে তার চুল উড়ছে। মাথার কাপড় খসে গিয়েছে। পায়ের কাছে এলোমেলো কাপড়ের ঢেউ ওঠানামা করছে। আঁচলে তার টোপাকুল। আঁচল সামলে, শাড়ি সামলে সে আর এগোতে পারছে না।
ও আসফাক, আসফাক।
কী?
নামায়ে দাও।
কমরুন। জাফরুল্লা ব্যাপারির চার নম্বর বিবি কমরুন।
আসফাক এগিয়ে গিয়ে কাছে দাঁড়াল। আর তখন ছোট ছেলেমেয়েরা যেমন কোলে ওঠে তেমন করে আসফাকের গলা জড়িয়ে ধরে কমরুন সাঁকো থেকে নামল। কেমন যেন লজ্জা পেয়ে হাসল সে। সাঁকো থেকে নেমেছে বটে কিন্তু তখনো পায়ে মাটি ছুঁলেও, কমরুন তার দুহাত দিয়ে আসফাকের গলা জড়িয়ে ধরে আছে। একবার সে মুখ তুলল, আসফাকের মুখটা দেখল, তারপরে আসফাকের কাঁধের উপরেই মুখ রাখল। যেন তখনো সাঁকোটা পার হচ্ছে ।
তারপরে মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়াল সে আসফাকের মুখোমুখি। বাতাস আর একপাক খেলে গেল। খানিকটা ধুলো উড়িয়েও গেল। বাতাসের জন্যই কমরুনের পদক্ষেপগুলো অসমান হচ্ছে। কয়েক পা গিয়ে পথের ধারে বড়-বড় ঘাসগুলো যেখানে বাতাসে কাত হয়ে পড়েছে শুয়ে পড়ল কমরুন, যেন হঠাৎ পড়ে গিয়েছে। বাতাস যেমন শব্দ করছে তেমন যেন খিলখিল করে হাসল সে।
আসফাক বলল, পড়ে গেলা?
কমরুন হাসল। তার চোখদুটো (তার চোখে সুর্মার টান ছিল) ঝিকমিক করল। মুখটা গাঢ় বাদামি হয়ে উঠল। আসফাক অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল একটা মুহূর্ত। আর তখন ধনুকের ছিলার মতো উঠে পড়ল কমরুন। হাসল সে। তারপর দৌড়ে পালাল।
কমরুনের অমন ভালো হয়নি। বিশেষ যখন জাফরুল্লা বিদেশে। তা ছাড়া সেখানে কেউ ছিল না। সেই বাতাসের মতোই তার রক্তের মধ্যে কী একটা চঞ্চলতা দেখা দিয়েছিল। তাতে যেন দম বন্ধ হয়ে যায়। তার চাপে কী হয়? সব নিষেধ, সব বাধা ভেঙে মানুষকে একটা দিশেহারা গতির মতো কিছুতে পরিণত করে। তার টান আর বাধার টান এই দুই রশির টানে দম ফেটে যায়। চোখের সম্মুখে সব অন্ধকার হয়ে যায় আর সে অন্ধকার যেন রক্তের মধ্যে এলোমেলো চঞ্চলতা তারই ঢেউ। দহের জল যেমন লাফাচ্ছিল তখন।