অনেকদিন আগেকার কথা। তা সাত সাল হবে।
চালার নীচের লুকানো জায়গা থেকে নেমেই আসফাক হাঁটতে শুরু করেছিল। অবশেষে এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছিল সে যেখানে উত্তর আকাশের গায়ে নীল মেঘের মতো পাহাড় সব সময়েই চোখে পড়ে। আর দেশের চেহারাও বদলে গিয়েছিল। শালের জঙ্গল। তারপর কৃষকদের ঘরবাড়ি জোতজমা। হলুদ ফসল। তারপর আবার সবুজ বন। এমন করে বন আর কৃষকের জমি পর পর। সাধারণত মানুষ দিনে হাঁটে রাত্রিতে বিশ্রাম করে। আসফাক তখন উলটোটাই করছিল। কিন্তু চতুর্থ দিনে ব্যাপারটা অন্যরকম হল। আগের দিন সন্ধ্যায় পথের ধারের একটা জমি থেকে শসা চুরি করেছিল সে। কিন্তু আজ কী হবে এই ভাবতে হঠাৎ সে থমকে দাঁড়িয়েছিল। অদ্ভুত দৃশ্য তার সামনে। জঙ্গলের মধ্যে নীল-নীল আলোর চোখ। আরো দুরে দপদপ করে মেটে-মেটে আলো জ্বলছে। তার কাছাকাছি সাদা-সাদা যেন কী সব। আর দু-এক পা এগিয়ে গিয়েছিল আসফাক আর তখন সে আবিষ্কার করেছিল অস্পষ্ট আলোতে আট-দশটা মোষ চরছে। আর সেগুলোর পিছনেই চার-পাঁচটা তাঁবু। হাত তিনেক উঁচু একটা বাঁশের আড়ের উপর দিয়ে একটা করে রং করা কাপড় দুদিকে নামিয়ে এনে চারটে খোঁটায় কাপড়ের চার কোনা বাঁধা। সেই তাঁবুর মধ্যে পুরুষ মেয়ে শিশু। রান্না হচ্ছে। সকলে একই সঙ্গে কথাও বলছে, যেন ঝগড়া লেগেছে। কিংবা ভয় পেয়েছে।
এই তাঁবুর বস্তির কাছাকাছিই কমরুনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার। আর ক্ষুধাই ফিরিয়ে এনেছিল তাকে। চেয়েচিন্তে কিছু পাওয়া যাবে না?
আসফাক লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছিল তাঁবু খুলে নিয়ে লোকগুলো কোথাও যাওয়ার যোগাড় করছে। একটা করে তাঁবু ওঠে আর মোষের পিঠে তাঁবু আর অন্যান্য সরঞ্জাম চাপিয়ে একটা করে দল রওনা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব তাঁবু উঠে গেল, সব দল রওনা হয়ে গেল। আর তখনই সে দেখতে পেয়েছিল খানিকটা দূরে যেন একটা মোষ তখনো বাঁধা আছে। হ্যাঁ, অন্য সব মোষ যেমন করে বাঁধা ছিল–একটা পা লম্বা দড়ি দিয়ে বাঁধা। আর একটা ঝোপের আড়ালে, অন্য তাঁবুগুলো যেখানে ছিল তার থেকে কিছু দূরে একটা ঘেঁছে তবুও যেন। আশ্চর্য, ভুলে গেল নাকি?
ঝোপের আড়ালে আড়ালে চলে তাঁবুটার একেবারে কাছে গিয়ে চমকে উঠেছিল আসফাক। সেই তাঁবু ছিল কমরুন আর তার স্বামীর। স্বামীর বসন্ত হয়েছিল, রাত্রিতেই তার মৃত্যু হয়েছে। কমরুন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সে সময়ের কথা সব মনে আসে না। আসফাক মনে। করতে পারে না, কেন সে না পালিয়ে কমরুনের কান্না শুনতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। অনেকক্ষণ সে নিজের চিবুকে হাত দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়েছিল। কমরুন কাঁদতে কাঁদতে মুখ তুলে নাক ঝেড়ে আর একবার কাঁদতে শুরু করার আগে আসফাককে দেখে থাকবে।
তারপর কবর দেয়া হয়েছিল কমরুনের স্বামীকে। একটা সুবিধাও জুটে গিয়েছিল। বর্ষার শেষে মাছ ধরার জন্য কারা একটা গর্ত করে রেখেছিল। সেই গর্তেই মৃতদেহটাকে রেখে নদীর চরার পাথরকুচি মিশানো বালি আঁজলা আঁজলা তুলে গর্তটাকে বুজিয়ে দেওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এদিক ওদিক থেকে বড় বড় পাথর গড়িয়ে এনে আসফাক যখন সেই গর্তটার উপরে রাখছিল, বালিতে আছড়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করেছিল কমরুন।
বিকেলের দিকে কমরুন যখন তার তাঁবুর কাছে ফিরে এল তখনো আসফাক তার সঙ্গেই আছে।
কমরুন নতুন করে তাঁবু খাঁটিয়ে বসলে আসফাক বলল, খাবার নাই?–
আশ্চর্য ক্ষুধার কথাটা সে এতক্ষণ ভুলেই ছিল। এটা তার বোকামির লক্ষণ। যে আসল কথাটাই সে ভুলে গিয়েছিল। এর আগেও এমন হয়েছে দু-দুবার। যে দুদিন তার বাপ-মাকে কবর দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু খাওয়াটা অত সোজা ব্যাপার নয়। কমরুনই বরং কতগুলো সরু সরু বাঁশের টুকরো নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল সন্ধ্যার একটু আগে। আসফাককে একটু দুরে থাকতে বলে সে নদীর ধারে ধারে এগিয়ে গিয়েছিল। বক সাবধানী শিকারি, কিন্তু বকের চাইতেও সাবধানে কমরুন একটা বাঁশের টুকরোয় আর একটাকে লাগিয়ে সরু লম্বা একটা নল তৈরি করে তাই দিয়ে একটা বককে ঠুকে দিয়েছিল। সেই বকটাকে পুড়িয়ে খেয়েছিল কমরুন, আসফাককেও দিয়েছিল খেতে।
কিন্তু স্বামীকে কবর দেয়ার পরের দিনে যে অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটে গেল তার মতো আশ্চর্য ব্যাপার আর কিছু নেই। এমনকী কমরুনের তাঁবুর কাছে দুই হাঁটুর উপরে হাত দিয়ে ঘের তৈরি করে তার মধ্যে আসফাকের মাথা গুঁজে বসে থাকাও তার তুলনায় কিছু নয়। খুব ভোর থাকতে উঠেই নদীর দিকে গিয়ে থাকবে কমরুন। মোষটাকে দড়ি ধরে খানিকটা দূরে নিয়ে গিয়ে বেঁধে দিল আসফাক। তারপর কমরুনকে খুঁজতে বেরুল! নদীর ধারে ধারে কিছুদূর গিয়ে কমরুনের বাঁশের টুকরো কটিকে দেখতে পেল সে। তার পাশে দুটো ডাহুক দড়িতে বাঁধা। একটা তখনো নড়ছে। কিন্তু কমরুন কোথায়? অবশেষে দেখা গেল তাকে। ঘাগরা জামা পাথরে রেখে সে স্নান করছে। পাহাড়ি নদী। স্বচ্ছ জল স্নানের উপযুক্তই বটে, কিন্তু এক হাঁটুর বেশি নয়। গলা পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে রাখবে কমরুন এমন সুযোগ কোথায়?
সকালেই একটা ডাহুক পুড়িয়ে খাওয়া হয়েছে। আর একটা বাঁধা আছে। কাল চলবে। কমরুন এতক্ষণ কী সেলাই করছিল। এখন শুয়ে পড়েছে তাঁবুর ছায়ায়। দুপুরে এখন কাজ নেই।