জাফর কি তবে ঠাট্টা করেছিল তাকে? অমন অবস্থায় কেউ ঠাট্টা করে না।
না–তখন সে-ই বরং পালিয়ে বেড়িয়েছিল। আর তার কারণ ছিল। সে কথাটাই আবার মনে আসতে চাচ্ছে। গৃহপালিত পশু যেমন লাঠি দেখে শরীর গুটিয়ে নেয় তেমন যেন কথাগুলো তার মনের মধ্যে লুকিয়ে পড়তে চাইল। উদাসীনতাটা ফেটে ফেটে যাবে মনে হল। তামাম শুধ বলে যে ঔদাস্যটা এসেছিল মনে।
বলদগুলোকে গাছের ছায়া দেখে বেঁধে দিয়ে আসফাক ফিরে চলল জাফরুল্লার বাড়ির দিকে। যেতে যেতে ভাবল–কী করা যায় এখন? তার মনে হল দড়ি পাকালে হয়। কাল সারাদিনই তা হয়নি। কিন্তু এখন তো ঠিক কাজের সময় নয়। দুপুর হয়েছে। কাল থেকে খাওয়া নেই। ক্ষুধা বোধ হচ্ছে। রাত্রিতে ঘুম হয়নি।
সেই ফেরাই তো ফিরে এসেছে সে। এখন সব চুকে যাবে। এইরকম একটা মনোভাব হল তার।
দুপুরটা কাটল। খানিকটা ঝিমিয়ে, খানিকটা উদাসীনতায়। ছমির এসেছিল, চলেও গিয়েছে। সে চলে গেলে আসফাকের মনে পড়ল ছমির হাটে যাচ্ছে। সপ্তাহের হাট।
আসফাক ভারিঘরের বারান্দায় বসেই দড়ি পাকায়। সেখানেই উঁচু বাঁশের আড়াটায় পাট আছে, আর তার কাছে লাটাই। লাটাই ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ দড়ি পাকাল আসফাক। তারপর তার বলদদের কথা মনে পড়ল।
সে যখন বলদদের খোঁজে যাচ্ছে, ছমিরের সঙ্গে আবার দেখা হল। ছমির তাহলে হাটে যায়নি। টাকাপয়সা ধামা আনতে অন্দরে গিয়েছিল।
মুখোমুখি দেখা হতে আসফাক বলল, হাটে যাও একা?
একা না। রাখালও যাবে।
ও, আচ্ছা। এই বলে আসফাক পা বাড়াল।
ছমির বলল, এক কথা–
কী?
আজ তো তুমি আছ। তা আমি আজ বাড়ি যাব। কী কও?
আর কে থাকবে?
কেউ না।
কেন ব্যাপারি?
আজ রাত্তিরে আসবে না।
ছমির চাকর বটে কিন্তু এই গ্রামেই তার বাড়ি আছে। কাল রাত্রিতে সে বাড়ি যায়নি। জাফরুল্লার বাড়িতে পাহারা দিয়েছে। আজ আসফাককে সে কাজের ভার দিয়ে সে বাড়ি যেতে চায়।
আসফাক বলল, আচ্ছা যায়ো।
এই বলে সে হাঁটতে শুরু করল।
সে হাকিমও কিনা ম্যাজিস্টর না। এই কথাটাই আবার মনে হল তার।
খানিকটা দূর গিয়ে সে ভাবল : ছমির আজ থাকবে না। তা হলে সেই যে আসফাক জাফরুল্লার ঘরবাড়ি পনেরোদিন পাহারা দিয়েছিল আজও তেমন হল।
কিন্তু তফাতও দেখো। সেবার সে বুক ফুলিয়ে বেড়াত। আর এবার?
ঘাড় কাত করে থুথু ফেলল আসফাক।
ঝোরার পাশ দিয়েই তার পথ। পথের ধারে একজায়গায় দু-তিনটে পিটুলিগাছ। আসফাকের মনে পড়ল জাফর একদিন বলেছিল–বড় গাছটাকে খড়ির জন্য কাটলে হয়। আসফাক স্থির করল এবারও যদি জাফরের দু-চারদিন দেরি হয় ফিরতে গাছটাকে সে কাটবে।
কিন্তু তফাত দেখো। সেবার যা ছিল এবার তা নয়। আর এসব কিছুর জন্যই দায়ী সেই হাকিম।
পিটুলিগাছটার নীচে একটা পুরনো গোবরের স্তূপ। অনেকটা উঁচু। উপরটা শুকিয়ে কালো হয়ে গিয়েছে। ঢিপিটার পাশে একটা বড় মোরগ চরছে। প্রকাণ্ড খয়েরি রঙের মোরগ। মাথার ঝুঁটি টকটকে লাল। আধা-ওড়া আধা-ছোটার ভঙ্গিতে সে ঢিপিটার উপরে লাফ দিয়ে উঠল। তারপর পাঁয়তারা করার ভঙ্গিতে একবার ডান একবার বাঁ পা দিয়ে গোবরের শুকনো আবরণটা সরাতে লাগল। আর তখন আসফাক তার পায়ের বড় বড় নখগুলোও দেখতে পেল। পুরনো, সার হয়ে যাওয়া কিন্তু উপরের স্তরের চাইতে নরম গোবর বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু ঠোঁট না নামিয়ে নিজের এই আবিষ্কারের গর্বে গলা ফুলিয়ে মোগরটা কক কক কক করে ডাকল। ঝপ করে একটা শব্দ হল। আসফাক দেখল মোরগটার কাছে একটা মোটাসোটা তার মতোই বড় মুরগি উড়ে এসে পড়ল। কিন্তু মোরগটা এক ধাক্কা দিয়ে সেটাকে সরিয়ে দিল। সেটা ঢিপির একটু নীচে পা দিয়ে গোবরের স্তরটাকে খাবলাতে লাগল। মোরগটাও আবার বড় বড় নখওয়ালা পা দিয়ে গোবরের আবরণটাকে ভাঙতে শুরু করল। ঝুপ করে আর একটা শব্দ হল। আর একটা মুরগি এসে পড়ল। আর তা দেখে মোরগটা অত্যন্ত বিরক্ত হয়েই যেন তার গোবরশৃঙ্গ থেকে নেমে পড়ল। যেন তার পুরুষোচিত পরিশ্রমের পথে এরা বাধাস্বরূপ। কিন্তু ঠিক তা নয়। গোবরের আড়াল থেকে আর একটি মুরগি আসছিল সেটিকেই পছন্দ হল তার। তার দিকে তেড়ে গেল।
আসফাক ঢিপিটার পাশ দিয়ে গেল। মোরগটা তাকে গ্রাহ্য করল না।
হাকিম তার মনের উপরে যে শক্ত স্তরটা জমেছিল সেটাকে ওই মোরগটার মতো খাবলে দিয়েছে। নীচের নরম কিছু বেরিয়ে পড়েছে।
কিন্তু কয়েক পা যেতে না যেতেই থমকে দাঁড়াল আসফাক। সেই পুরনো কথাটাই যেন আবার মনে পড়ল। সেবার যখন জাফর ফিরে এসেছিল আসফাক বেশ কিছুদিন পালিয়ে বেড়াত।
সারাদিন তার মনে যে উদাসীনতার ভাবটা ছিল সেটার চাপেই যেন সে ক্লান্ত হয়ে উঠল। যে বোঝা প্রথমে তোলার সময়ে হালকা থাকে অনেকক্ষণ বয়ে নিয়ে গেলে সেটাই সহ্যের বাইরে চলে যায়। হাঁপাতে লাগল আসফাক। বলদ যেমন স্তব্ধদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে নিঃশব্দে হাঁপায়–তেমন করেই যেন হাঁপাতে লাগল সে।
বুদ্ধি আছে জাফরের। জমি রাখার মতো অন্য অনেক ব্যাপারেই তার বুদ্ধির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এটাই যেন চিন্তা তার। কিন্তু অসংলগ্ন হয়ে গেল। সে হাসল খিকখিক করে–ওই মোরগটাই জাফরুল্লা। তারপর একটা উষ্ণতা তার মনে ঢুকে পড়ল এদিক ওদিক থেকে। ক্লান্তির মতোই সেই উষ্ণতা কিংবা ভয়ের মতো। ভয়েই যেন বিনবিন করে ঘাম ফুটল তার মুখে।