সে স্থির করল আর দেরি করা উচিত হবে না। হয়তো ও ছমির নয়। আর–আর সেই ভুলুয়া লাগার গল্পটাকেও হেসে উড়িয়ে দিতে হবে। দেরি করে ফিরেছে সে, কিন্তু খুব দেরি হয়েছে একথা স্বীকারই বা করবে কেন।
আল কয়েকটি পার হয়ে ধানবীজের জমিটার কাছে গেল আসফাক। ছমির নয়, সাত্তার।
কথা বলার আগেই আসফাক হাসল খুঁতখুঁত করে।
সাত্তার বলল, ছিলিম?
আসফাক হাত বাড়াল। ছিলিমটা দিল সাত্তার।
সাত্তার বলল, পিঁপড়ে চলতেছে। বৃষ্টি হতে পারে কিন্তুক।
আসফাক বেশ খানিকটা ধোঁয়া গিলে কাশল। ছিলিমটা সাত্তারের হাতে ফিরিয়ে দিল।
বলল, পারে বোধহয়।
হলে হেঁউতির চাষ আগুই হবে মনে কয়। বলল সাত্তার।
আসফাক বলল, কী যেন বলব মনে হল।
কী বলবা, সেই ভুলুয়া সাত্তার হাসল।
আরে না–কী কও। আসফাক গড়গড় করে হাসল।
তারপর সে বলল, ব্যাপারি গেল কখন দেখছ না?
কেন সেই হাকিমের সঙ্গে। সন্ধের পর ভকভকি আসছিল তার। তারই সঙ্গে ব্যাপারি গেল। আর মুন্নাফও। হাকিমই পেড়াপিড়ি করল।
অ।
ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় লাগল আসফাকের। তার পরে সে আবার হাসল। ভারমুক্ত বোধ হল যেন হঠাৎ নিজেকে। সে একটু জোরে জোরেই হেসে উঠল দ্বিতীয়বার।
একটু পরে সে বলল, বুঝলা না, আচ্ছা, ও কীসের হাকিম কও তো।
কেন, শোন নাই? ডিস্টি বোডের। সড়ক নাকি হবে একটা তারই মাপজোখ।
তা– একটু ভাবল আসফাক, আচ্ছা—
কী?
লোকে কিন্তু দুঃখকষ্টের কথাও বলতেছে।
জমির উপর দিয়ে সড়ক যাবে। সে সম্বন্ধে দু-এক কথা হইছে।
ছিলিমটা সাত্তারের হাতে দিয়ে উঠে দাঁড়াল আসফাক। নিঃশব্দে সে হাঁটতে শুরু করল। এ সব ক্ষেত্রে কাজ করতে করতে এসে ধরানো ছিলিমে টান দিয়ে আবার কাজের দিকেই ফিরে যাওয়াই প্রথা। বিদায় দেয়া-নেয়ার জন্য বাক্যব্যয় করতে হয় না। অন্তত এখন প্রথার এই নিঃশব্দ দিকটা আসফাককে সুবিধা দিল। আশ্চর্য লাগছে। কাল বিকেল থেকে কী হয়েছে তার, একটার পর একটা জালেই যেন জড়িয়ে পড়ছে। কে জানত যে হাকিমটাও এমন? সে ভেবেছিল ম্যাজিস্টর!
আলের উপর দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করল সে। খুব একটা দরকারি কাজই যেন মনে পড়েছে। সেই ভঙ্গিতে চলতে চলতেই সে যেখানে বলগুলোকে বেঁধে রেখে এসেছিল সেখানে গিয়ে উপস্থিত হল। এটার পিঠ চাপড়াল, ওটাকে ধাক্কা দিয়ে রোদ থেকে ছায়ার দিকে সরিয়ে দিল। যেন সব কয়েকটি ঠিক খাচ্ছে কিনা দেখল। তারপর তাদের কাছাকাছিই একটা গাছের ছায়ায় বসে পড়ল। এখন ওরা সব খেতে গেল।
জাল ছাড়া আর কী? বিস্ময়ের জাল। এটাই তার সব বোকামির শেষ বোকামি–ডিস্টি বোডের হাকিমকে ম্যাজিস্টর ভাবা। বালি চিবিয়েছে সে। আর তাও কিনা এমন হাকিম যে হয়তো সে সব কথা জাফরুল্লাকে বলেও দিয়েছে।
সব কথার সার কথা সে এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে। উৎকণ্ঠায় ঢোক গিলল। আসফাক। কিন্তু এমন ঠকাই বোধহয় তার নসিব। চিরকালই ঠকতেও হবে।
ধীরে ধীরে একটা উদাসীনতায় তার মন ভরে গেল। এমন ঠকার পরে বোধহয় কিছুতেই কিছু এসে-যায় না। গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসল সে। তার অনুভূতি হল সে যেন কথা বলছে জাফরুল্লার সঙ্গে। হ্যাঁ, শোধবোধ, ব্যাপারি, তোমার আমার শোধবোধ; না কথাটা বোধহয় তামাম শুধ। কী জানি। মোট কথা শেষ পর্যন্ত ওষুধ আনলেও আমিও খুব দেরি করেছি। অসম্ভব দেরি। কবুল। তা তুমিও মরো নাই।
হাকিমের কাছে থেকে সরে আসতে আসতে তার মন অস্পষ্ট ভাবে যেন একটা পুরনো পরিচয়ের সম্বন্ধই অনুভব করল জাফরের সঙ্গে। তা সাত সাল হল।
ধরতে গেলে ধীরে ধীরে জাফর তাকে অন্য চাকরদের থেকে আলাদা করে নিয়েছে। সেই থাপ্পড়ের ঘটনাটা ঘটলেও। তামাকের খেতে তাকে যেতে হয় না। ধানের খেতে বেচাল বর্ষায় ঘাস বেশি হলে দু-একদিন নিড়ানি নিয়ে বসতে হয়। কিন্তু ভারি পরিশ্রমের কাজ ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছে। বলদদের দেখাশোনা, দড়ি পাকানো, রাখালদের খবরদারি করা, তামাক বানানো, বাজারসওদা করা–এসবই তার কাজের ফিরিস্তি। আর মুন্নাফ-তাও দেখো–জাফরুল্লা ব্যাপারির চার বিবির ঘরের এক ছেলে তার উত্তরাধিকারী, দশ বছরের সে ফুটফুটে ছেলেটার ডাক শোনো। কী, না, মিঞাসাহেব। কখনো সে আসফাক বলে না।
আর এ ছাড়াও প্রমাণ আছে। প্রায় তিন সাল পুরনো হল ব্যাপারটা।
জমি নিয়ে কাজিয়া। যদিও জাফরুল্লার বাড়িটা তখনই সবটুকু সাদা, তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। সঙ্গে সঙ্গে তার আট-দশজন চাকর-আধিয়ারকেও।
সে যখন যাচ্ছে আসফাককে ডেকে বলেছিল–আসফাক, বাপজান, ইদিক শোনো। সব দেখে শুনে রাখবা কেমন? আসফাক বড় ভালো ছাওয়াল। সেই দশবিঘা জমির কথা। ঘুষ?
এই শুনে, তাকে নিয়ে যেতে দেখে, আর জাফরের চার বিবি আর মুন্নাফের কান্নার সামনে আসফাকের চোখেও জল এসে গিয়েছিল।
সেবার প্রায় পনেরোদিন জাফর অনুপস্থিত ছিল। সে সময়ে আসফাক কী না করেছে। ধান তামাকের খেত-খন্দ দেখাশোনা তো বটেই জাফরের বিবিদের তদবির-তদারক পর্যন্ত। আর বলদ কটি, যা তার আসল জিম্মি, তাদের চেহারা তেমন কোনোদিনই আর হবে না, যা সেই পনেরোদিন আসফাকের কাছে আদরযত্ন পেয়ে।
অবশ্য জাফর যখন ফিরে এসেছিল তখন তেমন খোঁজ নেয়নি তার। জাফরকে কোনোদিক দিয়ে ক্লিষ্ট দেখায়নি। বরং তারপর থেকে তার সাদা দাড়ি মেহেদি দিয়ে রাঙাতে শুরু করেছে।