সাত্তার বলল, তা আসফাক, ভুলুয়া লাগলে বসে পড়া লাগে। হাঁটা লাগে না।
নসির বলল, বুঝলা না, সাত্তার, আমার বড়চাচার একবার লাগছিল ভুলুয়া। তা সে অন্যখানে।
নসির আর কী বলল তা আসফাক শুনতে পেল না, কারণ প্রথমে সাত্তার, তার পিছনে নসির এবং সবশেষে ছমির হালের পিছন পিছন আবার দূরে চলে গেল গল্প করতে করতে। ভুলুয়া লাগার গল্পই।
দূর থেকেই সে দেখতে পেল ওরা যেন হাসছেও। বিমর্ষ মনে সে ভাবল–ওরা নিশ্চয়ই গল্পটাকে বিশ্বাস করেনি। মিথ্যাটা ওরা ধরে ফেলেছে। তাছাড়া সকলেই জানে ভুলুয়া পিছনে লাগে বোকাদেরই।
হঠাৎ আসফাক উঠে দাঁড়াল। কী সর্বনাশই সে করে ফেলেছে। সাত্তার আর নসির হয়তো জানত না তার দেরি করে ফেরার কথা। তারাও এখন . জেনে ফেলল। একা থাকাই ভালো ছিল। এই আর এক বোকামি হল তার।
কিন্তু কী করবে এখন সে? কোথায় যাবে? যা সত্যি তা সকলের সম্বন্ধেই খাটবে। একটা অন্যায় দিয়ে আর একটা ঢাকতে গেলে, তারপর সেটা ঢাকতে আর একটা–এমন করে অন্যায়ের জাল তৈরি হল, আর তাতে জড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়লে। অন্যদিন কত কাজ থাকে হাতে। আজ তাও নেই। কিছুই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
নিজের চারিদিকে তাকিয়ে দেখল আসফাক, সে তামাকের খেতের কাছে এসে পড়েছে। যতদূর চোখ যায় একখানা বাদামি কাগজ যেন বিছানো আর তার উপরে সমান দূরে দূরে সবুজের ছোপ। কিন্তু এখানে কেন এল সে? এখানে কী কাজ আছে? কথাটা চিন্তায় ফুটে ওঠার আগেই আবেগটা দেখা দিল। এই খেতেই, এই তামাকের খেতে কাজ করতে গিয়ে জাফরুল্লার কাছে থাপ্পড় খেয়েছিল আসফাক একদিন। কানের মধ্যে ঝা ঝা করে উঠল আসফাকের। সে মাথা কাত করে কানটাকে কাঁধের উপরে চেপে ধরল যেন শব্দটাকে থামাতে। কোনো দিকেই এখন তার যাওয়ার নেই। এখন শুধু অপেক্ষা করে থাকতে হবে। এখানে লোক নেই। এখানেই বসে ভেবে নেয়া যেতে পারে।
আলের উপরে বসল আসফাক।.চেষ্টা করে সান্ত্বনার মতো একটা চিন্তা নিজের মনে ফুটিয়ে তুলল সে। কানের মধ্যে আঁ আঁ করছিল–তা সে বোধহয় না খেয়ে থাকার জন্যে। কাল দুপুর থেকেই খাওয়া হয়নি তার। তারপর তামাকের খেতের খুঁটিনাটি লক্ষ করতে লাগল। তা এটা দেখার মতো কিছু বটে। তাকিয়ে দেখো, যতদূর চোখ যায় তাকিয়ে দেখো–একটা ঢিল দেখতে পাবে না, কিংবা একটা ঘাস। যে জমিতে গোবরসার দেয়ার জন্যই দুকুড়ি গোরুবাছুর আছে জাফরের। গর্ব করার মতো কিছু বটে। আসফাকের কৃষকমনে অকৃত্রিম প্রশংসার ভাবটাই দেখা দিল। সে নিজে বোধহয় এ জমির সব কাজ শিখতে পারেনি। এ জমির কাজ প্রকৃতপক্ষে কে-ই বা জানে? আর সেই কিনা গিয়েছিল তামাকের পাতা ঝুরতে। জল দেয়ার জন্য দহের মধ্যে যে টিউবকল, বসে তা পাম্প করো–আচ্ছা। জমির ঘাস তোলো খুঁটে খুঁটে–তাও খুব। কিন্তু পাতা ঝোরা? জাফর নিজে ছাতা মাথায় অষ্টপ্রহর, দাঁড়িয়ে থেকে মুনিষ দিয়ে পাতা ঝোরায়। আসফাক তাদের দেখাদেখি দা হাতে করে একটা গাছে কোপ দিতেই ছুটে এসে থাপ্পড় কষিয়ে দিয়েছিল জাফর।
স্বীকার করতেই হবে বুদ্ধি আছে জাফরের। সেই হেঁউতি বিছনের খেতটা ভাবো। আর কেউ কি ভাবতে পারে ডোঙা দিয়ে জল ঘেঁচে এই না-বৃষ্টির দিনে হেঁউতির বিছন বোনা যায়? আর এই তামাকের খেত? বুড়ো বুড়ো লোকেরাও তাকে জিজ্ঞাসা না করে এক পা এগোয় না এই তামাকের খেতে।
তা বুদ্ধি আছে বটে জাফরের। আটশো বিঘা জমি এখনো তার। নতুন। আইনে দুশো বিঘা খসেই নাকি এই। তখন ব্যাপারির বাড়িতে খুব গোলমাল লেগেছিল বটে। তারপর জাফর তা কাটিয়ে উঠল। চার বিবি তার, আর এক ছেলে। সকলের নামেই জমি লিখে দিল সে। শেষে বাড়ির পাঁচজন চাকরের নামে। আসফাকের নামেও জমি লেখা হয়েছিল তখন। তারপর জাফর সকলকেই একশো টাকা করে নগদ দিয়ে পাঁচহাজার টাকার খত লিখিয়ে নিয়েছে জমিগুলোকে খাই-খালাসি বন্দোবস্ত দেখিয়ে। বুদ্ধি আছে বটে। সেই জমিতে ধান হয়, আর তামাক।
আসফাক যেখানে বসেছিল সেখান থেকেই সে ছমিরদের আবার দেখতে পেল। তাদের একজন ছিলিম ধরাতে বসল। অন্য দুজন গেল জাফরুল্লার বাড়ির দিকে। আজই বোধহয় ওরা ধান ছিটোবে।
হ্যাঁ, ধান। শুধু এ শব্দদুটোই তার মনে এল পুর্বাপর বিচ্ছিন্ন হয়ে।
দু-তিনটে আল পার হলেই সেই আল যেখানে ওদের তিনজনের একজন ছিলিম ধরাতে বসেছে। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আসফাকের মনে হল–ও যদি ছমির না হয়ে সাত্তার কিংবা নসির হয় তবে কিছু খবর নেয়া যায় ওর কাছে। একটা প্রশ্ন হঠাৎ উঠল তার মনে–জানা দরকার জাফরুল্লা কখন ফিরবে। এটা ছমিরকেও জিজ্ঞাসা করা যেত। কিন্তু তা করা হয়নি। কিন্তু যদি ছমির হয়?
সে যেখানে বসেছিল তার কিছুদূরে একটুকরো জমি। দূর থেকে বাতাসে দোলা গাছগুলো দেখলে মনে হয় ধান। কিন্তু আউশ নয়। ছন বলে। ঘর ছাওয়ার ছন। কচি অবস্থায় বলদ খায়। কিন্তু বেশি খেলে সহ্য হয় না।
হঠাৎ ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল সে। তারপর সে কড়ে গুনল সালগুলো। চার সাল হল। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে হাসল খুঁতখুঁত করে। কেউ পারেনি ধান ফলাতে। ছনই হয়। তিন বছর প্রাণপাত করেছিল আসফাক। দশ বিঘায় আট-ন মণ ফললে খুব। চার সাল হল সে ওই জমি ছেড়েছে।
জমিটার দিকে অবাক হয়ে সে চেয়ে রইল। ওটার প্রায় চারিদিকেই জাফরুল্লার চৌরস সরস জমি। তার মধ্যে ওটা যে ওরকম তা কেউ ভাবতেই পারবে না। এত কচকচে বালিই বা কী করে এল এখানে তাও বোঝা যায়। না। কিন্তু তার চিন্তা ঘুরে গেল। জাফরুল্লা কখন ফিরবে এই ভাবতে ভাবতে এদিকে মন চলে এসেছিল।