কিন্তু এটার একটা ভালো দিকও আছে। খানিকটা সময় পাওয়া গেল। বসে থাকতে থাকতে বুদ্ধি এল আসফাকের মাথায়। বুদ্ধিটাকে আর একটু পাকা করে নেয়ার জন্য নতুন করে ছিলিম ধরিয়ে নিল সে। অবশেষে স্থির করল–ছমির বা অন্য কোনো চাকর হয়তো এখনো ব্যাপারটা সবটুকু বোঝেনি। সময়মতো ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে এটা কৈফিয়ত হিসেবে দাঁড় করানো যায় কিনা দেখতে হবে। দেরি হয়নি ফিরতে, ঘুমই দায়ী।
রোজকার মতো কাজ শুরু করল সে। সেটাই কৌশল হিসাবে ভালো হবে। বলদগুলোকে ছেড়ে দিল। অন্যান্য দিনের মতো হেইহাই করে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে চলল। না তাড়ালে খড়ের মঠে মুখ দেবে।
.
খামার থেকে কিছু দূরে এক চিলতে বন আছে। এক চিলতে বনই বটে, ত্রিশ-চল্লিশটা শালগাছ। এই বনের পাশ দিয়ে নদী। নদীর ওপারে কাশের ঝোপ একেবারে জলের ধার ঘেঁষে। নদীতে একহাঁটু জল। এপার থেকে ঢিল ছুঁড়লে ওপারে গিয়ে পড়ে। কিন্তু স্রোত আছে। জলটাও ঘোলা। এই নদীর জল সব জায়গাতে একরকম নয়। সলসলাবাড়ির পশ্চিমে এর জল স্বচ্ছ। পাথরের কুচি মিশানো বালির খাত–অনেকটা চওড়া কিন্তু শুকনো। তার উপর দিয়ে অনেকগুলো ধারায় তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যেখানে দাঁড়িয়ে আছে আসফাক সেখান থেকে সিকি মাইল গেলে ব্যাপারির দহজাফরুল্লার নাম থেকেই নাম। সেখানে জলটা বেশ গভীর। জলের রংও প্রায় নীল। আর তার পাশেই জাফরুল্লার খামারবাড়ি। নদী সম্বন্ধে এই দার্শনিক আলোচনা করে আসফাক আবার খামারের দিকে ফিরে গেল।
তার তখন মনে হল–যাই হোক, ছমির কী ভাবছে তা এখনো বোঝা যায়নি। এবং এটা মনে হতেই তার মুখটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। ঠোকটা পার হতেই সে দেখতে পেল ঝোরার ধার ঘেঁষে একটা জমিতে চাষ দিচ্ছে। কয়েকজন কৃষাণ। জলবৃষ্টি নেই অথচ জমিটা যেন জলে টইটম্বুর। আসফাক বুঝতে পারল হেঁউতির বীজ দেয়া হবে। হ্যাঁ, ছমিরও আছে ওদের মধ্যে। কিন্তু এত লোকের মধ্যে কি কথাটা বলা যাবে? বরং অন্য সময়ে। বলদগুলোর ঘরটা এখনো সাফ করা হয়নি। আসফাক ফিরে গিয়ে ঝুড়ি করে গোবর ফেলতে শুরু করল। যেখানে সেখানে ফেললে চলবে না। হয় খামারের পিছনে উঁইতে জমা করতে হবে, কিংবা তামাকের খেতে। অন্যদিনের চাইতে বেশি মন দিয়ে সাফ করলেও ঘরটা সাফ করতে খুব সময় লাগল না। আর তারপরেই আবার তার ছমিরের কথা মনে হল। আশ্চর্য, ছমির নিজে থেকে কিছুই বলছে না।
ডারিঘরের বারান্দা থেকে ছিলিম নিল আসফাক, বেশ বড় একদল তামাক। খড়ের নুড়ো পাকানো ছিল। তাতে আগুন ধরিয়ে নিয়ে কৃষাণরা যেখানে চাষ দিচ্ছে সেদিকে গেল সে।
সেখানে পৌঁছে আলের উপরে বসে ছিলিম ভরল আসফাক। নুড়ো ভেঙে আগুন ধরাল তামাকে। তখন একজন করে কৃষাণ আসতে লাগল হাল ছেড়ে রেখে। তিনটে হাল চলছে। ছমির ছাড়া আরো দুজন। নসির আর সাত্তার। সবশেষে ছমির এল। ছিলিম নতুন করে ভরল আসফাক। তার হাতে ছিলিম তুলে দিয়ে সে নিঃশব্দে ছমিরের দিকে চেয়ে রইল। ছমিরও নিঃশব্দে তামাক টানতে লাগল।
অবশেষে আসফাক বলল, কেন, জমির হেঁউতি?
তা না তো কী?
আর কেউ চাষ দেয় না কিন্তুক। জল ঝরি নাই।
ছমির ছিলিমটা ফিরিয়ে দিল আসফাককে।
কেন, ছমির–?
কী?
না। তাই কই।
ছমির আল থেকে নেমে গিয়ে আবার লাঙল ধরল। চাষিদের পা কাদায় ডুবে যাচ্ছে। বলদগুলোরও সেই অবস্থা। নদী থেকে জল তুলে এই কাদা করা হয়েছে।
কিন্তু ছমির এবারও কথা বলল না। তা হলে তার ফিরতে কত দেরি হয়েছে তা কি জানে না ছমির?
জানে, নিশ্চয়ই জানে। দম মেরে আছে। ব্যাপারি ফিরলে লাগাবে। সাতখানা করে।
আসফাকের হাতে তামাকটা বৃথা পুড়তে লাগল। লাগাবেই বা কী ছমির? ব্যাপারি শহরে যাওয়ার আগে কি জেনে যায়নি নিজেই।
হঠাৎ কথাটা মনে এল। সে কি ইতিমধ্যে এদের কাছে অচ্ছুৎ হয়ে গিয়েছে? সে একটা গল্প শুনেছে ইতিপূর্বে দাগি আসামীদের নাকি এরকম হয়। তার নিজের গ্রামের লোকরাও কথা বলে না। বললেও তা না-বলার শামিল। অথচ দেখো ওরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে পর পর একই রেখায় হাল চালাতে চালাতে। সাত্তার হাসলও যেন একবার কিছু বলে। আসফাক কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করল।
কিন্তু কি আশ্চর্য দেখো, সে যে বসে আছে এখানে তা যেন ওরা দেখছে না। অনেকক্ষণ ধরে আসফাক ওদের আলাপের পরিধিতে ঘুরে ঘুরে বেড়াল যেন। সে যেন দলে ঢুকে পড়তে চায়, আর ওরা তাকে দলে নেবে না স্থির করেছে।
শেষে আসফাক বলল, বুঝলা না?
কিন্তু ওরা যেন শুনতেই পেল না।
দ্বিতীয়বারও সে প্রায় চিৎকার করেই বলল, বুঝলা না?
এবার সাত্তার বলল, কও?
হ্যাঁ। বুঝলা না, আসফাক বলল, কাল ভুলুয়া না কী বলে তাই লাগছিল।
সাত্তার হাল ধরে ততক্ষণে কিছুটা দূরে চলে গিয়েছে। সেখান থেকেই বলল, তা লাগে অনেক সময়।
আসফাক বলল, সন্ধে থেকে দুপুররাত–শেষে দেখি শালমারির বনে চলে গেছি।
এবার নসির দাঁড়িয়ে পড়ল। ভুলুয়া অপদেবতা, যে নাকি মানুষকে পথ ভুলিয়ে মারে। নসিরের বয়স হয়েছে। শুনে সে অবাকও হল। নসির বলল, শুনছ না, সাত্তার! আসফাক কয় ভুলুয়া লাগছিল পাছে। কোথায় গিছলা, আসফাক?
সল্লাবাড়ি।
সলসলাবাড়ি? নসির কথাটা যেন ভালো করে জেনে নিল।
সলসলাবাড়ি? সাত্তার বলল, ও সেই, ব্যাপারির ওষুধ আনতে!
আসফাকের বুকের মধ্যে ধকধক করে উঠল–জানে, এরা সবই জানে তা হলে!