শুধু পুরুষদুটো নয়, বনে স্বচ্ছন্দ বিহারের ফলে জাফরুল্লার বাথানের সব মোষের স্বাস্থ্য ভালো, যেন আকারেও বড়; শহরের ধারে কাছে দেখা মোষদের সঙ্গে তাদের তুলনাই হয় না। কিন্তু তাই বলে বন থেকে ধরে আনা মোষদের মতোও নয় তারা। তাদের বনের মধ্যে দেখে পোষমানা বলেই চিনতে পারা যায়। বুনো মোষ এ দিকে আর আসে না। যদি বছর দশেক আগেকার সেই ঘটনাটা, যার অনেকটাই ইতিমধ্যে অস্পষ্ট, তাকে গণনায় না আনা হয়।
.
রূপকথার মতো লাগে শুনতে। আসফাক শুনেছিল চাউটিয়ার কাছে। ভোটমারির এক গৃহস্থ তার মাদি মোষকে এনেছিল জাফরুল্লার বাথানে। এসব ব্যাপারে, যেমন বাথানের দুধ দোহার ব্যাপারে, কিংবা প্রাণীগুলোর কোনোটিকে রোগে ধরলেও চাউটিয়াই কর্তা। এমনকী বীজের দাম বাবদ দু-এক টাকা মাদি মোষের মালিকরা যা দেয়, তাও চাউটিয়ার প্রাপ্য।
চাউটিয়া প্রথমে ভোটমারির সেই গৃহস্থকে জাফরুল্লার মোষদুটির মধ্যে একটাকে পছন্দ করতে বলেছিল। আকারে-প্রকারে, বলবীর্যে দুটো প্রায় একই রকম। বয়সে ছ-সাত বছরের তফাত। সম্বন্ধে পিতাপুত্র বলতে পারো। বুনো অবস্থা হলে দলপতি কে হবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব হওয়ার সময় হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কোনটি হারত, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এসব শুনে সেই গৃহস্থ তরুণতরটিকেই পছন্দ করবে মনে হয়েছিল, কিন্তু চাউটিয়া পরামর্শ দিয়েছিল বয়স্কটাকে নিতে।
সেই সূত্রেই এই গল্পটা বলেছিল চাউটিয়া : তখন আশ্বিনের শেষ রাতে গা শিনশিন করতে শুরু করেছে। সকালে বনের গায়ে কিছু কুয়াশা দেখা দিতে শুরু করেছে। বছর দশেক আগের কথা। জাফরুল্লার বাপ ফয়েজুল্লা তখনো বেঁচে। চাউটিয়ার বয়স তখন চল্লিশের কাছাকাছি। তখনো সে এই বাথানেই কাজ করে। চাউটিয়ার বাপ নাকি মোষধরা ফালি ছিল। যাক সে কথা, আশ্বিনের ভোরের প্রথম শীতের আমেজে অন্য লোকে যখন কাঁথা টেনে নিয়ে পাশ ফেরে, বুড়ো ফয়েজুল্লা তখনই উঠে পড়ত। আর তার দিনের প্রথম কাজই ছিল দ্বারিঘরে এসে বসে বেশ বড় এক কলকে তামাক প্রাণভরে টানা। দিনের আলো তখন অস্পষ্ট, ছায়া ছায়া। ফয়েজুল্লা অলর থেকে তার হুঁকা হাতে দ্বারিঘরের কাছে প্রায় এসে পড়েছে, হঠাৎ মোষের ডাকাডাকি তার কানে গেল। সাধারণ ডাকাডাকি নয়, অস্বস্তিতে সে থেমে দাঁড়াল। কিন্তু নেশার টান। সে দেখতে পেল, চাউটিয়া দ্বারিঘরের কাছে খড়ের বোঁদায় আগুন দিয়ে ফুঁ দিচ্ছে, তামাকের আগুন। সুতরাং সে দ্বারিঘরের দিকেই হেঁটে চলল।
কিন্তু অস্বস্তিটা যাওয়ার নয়। কলকে হুঁকায় চড়াতে গিয়ে সে থমকে গেল। বাথানটা দ্বারিঘর থেকে উত্তর-পূর্বে পঞ্চাশ হাত দূরে। প্রায় মানুষসমান উঁচু, দোলা বাঁশের চেকোয়ার, শালকাঠের খুঁটি দিয়ে শক্ত করা। কিছু কুয়াশা সেদিকে। সেই কুয়াশার মধ্যে সেই মানুষসমান উঁচু বেড়ার মাথার উপর দিয়ে একটা মোষের কাধ আর উঁচু করা শিংসমেত মাথা। অভ্যস্ত চোখের এক পলকেই সে বুঝতে পারল, সাধারণ মোষ নয় সেটা। অপরিচিত তো বটেই আর সেজন্যই বাথানের ভিতরের মোষগুলোর ডাকাডাকি। তাদের ফোঁস ফোঁস শব্দও যেন এত দূর থেকে শোনা যাচ্ছে। বাইরের মোষটা বেড়ার মাঝামাঝি জায়গায় সামনের দু-পা বাধিয়ে খাড়া হয়ে উঠল একবার। কী তার মাথা, আর কী তার শিং! ফয়েজুল্লা বলল, বুনা?
মনৎ খায়।
মোষটা সেদিক দিয়ে বাথানে ঢুকতে না পেরে আরো উত্তেজিত হয়ে পুব দিকে ঘুরে এল। তখন তাকে সবটা দেখা গেল; উত্তেজিত ক্রুদ্ধ একটা পাহাড়। দুটো শিং যেন দেড়গজ করে, মাথাটা সাধারণ মোষের সোয়াগুণ, কাঁধের কাছে মানুষের মাথা ছাড়িয়ে উঁচু, সেখানে আবার ঝকড়া ঝকড়া পশম। মনে হল বাথানের বেড়া ভেঙে ফেলবে এবার। আর তাও যদি না করে, বাড়ির ভেতরে ঢোকে যদি, কিংবা গোয়ালঘরে, মানুষ মারতে পারে, গোরু জখম হতে পারে।
ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল চাউটিয়া আর ফয়েজুল্লা। এদিকে তখন বাথানের ভিতরে মোষের ডাকাডাকি, আর বাইরে সেই যমদূতের আস্ফালন। বেড়ার ফাঁক পেতে ঘুরছে সে। মাথা নামিয়ে আক্রমণের ভঙ্গিতে ফোঁস ফোঁস করছে। খুর দিয়ে মাটিতে গর্ত করছে। ভয়েই বুদ্ধি যোগাল প্রথম। তারপর বুদ্ধিটাকে ফয়েজুল্লার পছন্দই হল।
জানোয়ারটা মানুষের গলা না শোনে এমন ভাবে গলা নামিয়ে ফয়েজুল্লা বলল, ডাকপাড়া মাদিটাক ছাড়ি দেও।
যে মাদি মোটা ডাকছে। ভোরের অন্ধকারে যার ভাক এই বুনোটাকে টেনে এনেছে, সেটাকে ছেড়ে দিলে অন্য মোষগুলো-সমেত বাথান নিরাপদ হবে; মহিষকুড়ার উপকথা কারণ দুটোই সে ক্ষেত্রে বনের দিকে চলে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, যদি মাদিটা বুনোটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ঠাণ্ডা করে ফিরিয়ে আনতে পারে, একটা ভালো মোষ লাভ হয়ে যায়। এই শেষের যুক্তিটা মনে হতেই ফয়েজুল্লার চোখের কোণে হাসি দেখা দিয়েছিল। এরকম একটা কথা আছে বটে, যদিও ফয়েজুল্লার মুখের সামনে কেউ বলে না, যে, তার বাবা নাকি ভৈষ-বাউদিয়াদের দলপতি ছিল এক সময়ে, যদিও ফয়েজুল্লার এখন অনেক জমিজিরাত।
কিন্তু মাদিটাকে বাথানের বাইরে বের করে দেয়া সোজা কথা নয়। বাথানের ভিতর ঢুকতে হবে। বাইরের ওই খেপে যাওয়া বুনোটাকে এড়িয়ে বাথানের বিশহাতের মধ্যে যাওয়া মানে নিজেকে খুন করা! ভাবতেও গলার ভিতরটার শুকিয়ে যায়।