আসফাক তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করেছিল কিন্তু সলসলাবাড়ি যখন কাছে এসে পড়েছে পথের উপরে হঠাৎ সে থেমে দাঁড়াল। অভ্যাসমতো কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করার দিকে মন চলে গিয়েছিল। হঠাৎ একটা অস্বস্তির মতো কিছু মনে দেখা দিল। কিছু ভুলে গেলে যেমন হয়। তারপর সেই অস্বস্তিটাই যেন উষ্ণ হয়ে উঠল। আর আসফাকের মনে পড়ল হাকিমঘটিত ব্যাপারটা। আজ যা সে করে ফেলেছে তার তুলনা তার নিজের জীবনে নেই। কিন্তু ঠিক সে কথাই নয়। অন্য আরো কিছু, যা আরো উষ্ণ। এই চিন্তাগুলোই যেন তার গতিকে শ্লথ করে দিল। যেখানে সে তখন পৌঁছেছিল সেখান থেকে দুটো পথে সলসলাবাড়ি যাওয়া যায়। একটা পথ সোজা গিয়ে উঠেছে। হাটখোলায় যেখানে ওষুধের দোকান। অন্যটা সলসলাবাড়ির পশ্চিমে গিয়ে উঠেছে। প্রথমটি আলের পথ, দ্বিতীয়টি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের। আসফাক নিজেকে যুক্তি দিয়েছিল–পথ তো ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের, আলের পথ তো গ্রামের লোকের মনগড়া কিছু। ও পথেই যেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সেবার যে ডাক্তার এসেছিল সেও ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের পথে।
আসফাকের মনে হল একবার একটু জিরিয়ে নিলে হয়। ওষুধ আনতে বলেছে তাই কি মানুষ জিরোবে না। প্রায় পাঁচ মাইল পথ সে হেঁটে এসেছে। আলোর পথে তিন মাইল হত হয়তো। জিরিয়ে নিতে তখন সে একটা গাছতলায় বসেছিল। সলসলাবাড়ির বন্দরে যখন সে ঢুকল তারপরে তখন সন্ধ্যা পার হয়েছে। এরকম সময়ে তার মনে একটা কথা উঠল : দেরি হয়ে যাচ্ছে না? ওষুধ আনার ব্যাপার তো। আসফাক এই কথাটা শুনেই ওষুধের দোকানের দিকে না গিয়ে অন্য এক দোকানের সামনে বসে পড়েছিল। সেখানে বসেও অনেক দেরি করে ফেলেছিল। আর দেরি করতে পারার আনন্দেই খুঁতখুঁত করে হেসেছিল সে।
আসফাক দেরি করে ফেলেছে। কাজের ভার নিয়ে এমন দেরি করতে পারে সে–এ তার সম্বন্ধে কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু এটা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। ফিরেই তো এসেছে সে। এরকম বোকামি তার নতুনও নয়।
সেই সেবারের কথা। ব্যাপারটা ঘটবে আগেই জানা ছিল। অনেকেই বলেছিল তাকে। সংসারে থাকার মধ্যে ছিল তার বাবা আর মা। মার বয়স অনেক হয়েছিল। চুলগুলো ছিল শণের নুড়ি, আর চোখেও সে ঝাপসা দেখত। কাজেই তার মৃত্যু ঘটার মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন। কিন্তু তার বাবা জোয়ানই ছিল বলতে হবে। চুলও পাকেনি। অথচ মায়ের মৃত্যুর দু-চার সপ্তাহের মধ্যেই তারও মৃত্যু হল। তখনই বুঝতে পারা গিয়েছিল অঘটন কিছু ঘটবেই। বাড়ি বলতে একখানা চৌরী খড়ের ঘর যার বারান্দায় রান্না হত; অন্য আর একখানা ঘর ছিল যার বেড়া ছিল ফাটানো বাঁশের, আর ছাদ ছিল খড়ের চালা। এই ঘরে একটা নড়বড়ে মই, একটা লাঙল থাকত এক কোণে। কিছু দড়িদড়া থাকত। অন্যদিকে থাকত একটি বুড়ো বলদ যার পিঠে একটা পাকাঁপোক্ত রকমের ঘা হয়েছিল। ছবিঘা জমি চষত আসফাকের বাবা। জমির মালিক বুধাই রায়। বাবার মৃত্যুর পরই আসফাক শুনতে পাচ্ছিল এবার নতুন আধিয়ার আসবে। এই ছবিঘা জমিতে সে সোনা ফলার্বে। ও আর আসফাকের কর্ম নয়। কী বলিস আসফাক? আসফাক হেসে বলত–হেঁ। আসফাক নিজেই জানত সে বোকা। লোকের মুখে শুনে শুনে এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহের কারণই দেখতে পেত না সে। কাজেই খড়ের ওই চৌরীখানা যে ছাড়তে হবে এ বিষয়েও সে নিঃসন্দেহ ছিল। কিন্তু এত সব জেনেও কী হল। সেই সকালে নতুন চাষি যখন বাড়ি দখল নিতে এল তখন কার কাছে দখল নেবে তা খুঁজে পেল না। কারণ গোয়ালঘরের চালার নীচে পাট-তামাক রাখার জন্য আসফাকের বাবা যে বাঁশের টোং-মাচা বেঁধেছিল সেখানে লুকিয়ে আসফাক তখন ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। গরমে যত ঘামছে তার চাইতে ভয়েই বেশি। চোখ বন্ধ করে সে সেখানে পড়েছিল একটা দিন একটা রাত্রি। অথচ কী ছিল ভয়ের? নতুন বর্গাদার তো আদালতের পেয়াদা নয়, পুলিশও নয়।
আসফাক এখন চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখল। এটাই তার রোগ; পরে সে ঠিক বুঝতে পারে, কিন্তু যখন বোঝা দরকার তখন যেন সব গুলিয়ে যায়। সে লোকের মুখেও শুনেছে যেটা আগে হওয়া দরকার সেটা তার বেলায় সময় পার করে দিয়ে–যেমন কথা বলতে শেখা।
এখন ছমিরের মনোভাবটা বোঝা দরকার। ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে তার এই দেরি করার ফলে তা কিছুটা বোঝা যাবে। সে ছমিরের দিকে এগোতে যাচ্ছিল। পিছিয়ে আসতে হল তাকে, কে যেন জাফরুল্লার ঘরের জানালাটা খুলছে। জানালাটা খুলল কিন্তু কিছুই ঘটল না।
এমন বিস্ময় কেউ কল্পনাও করতে পারবে না, এই কিছু না ঘটা। আসফাক এবার সত্যি বিস্মিত হল। এতক্ষণেও এটা তার নজরে পড়েনি! এর মধ্যে জাফরুল্লার দুছিলিম তামাক পুড়ে যায়। আসফাককেই দিতে হয় ঠিক করে। সে না থাকলে ছমির দিতে পারত। কিন্তু দেখো ছিলিম ধরিয়ে নিজেই টানছে ছমির।
তাহলে? তা হলে কি ব্যারামের মুখে ওষুধ না পেয়ে জাফরুল্লা–(বাক্যটা চিন্তাতেও শেষ করতে পারল না সে)। স্তম্ভিত আসফাক চিবুকে হাত রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল তার দেরি করার এই ফল দেখে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সে ছমিরের দিকে।
মৃদু স্বরে সে বলল, তা, ছমির, ব্যাপারি?
ব্যাপারি শহরে, মুন্নাফও।
ছমির ছিলিমে সুখটান দিয়ে উঠে দাঁড়াল। চলেও গেল।
আসফাক বসে পড়ল। অবসন্নতায় শরীর যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। রাত্রিতে ঘুম হয়নি। কাল দুপুর থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। আর ভয়–যা এইমাত্র চূড়ান্ত একটা ধাক্কা দিয়েছে তাকে।