হাকিম বলেছিল, কী চাও?
জে। আসফাক ঘরের আসবাব পর্যবেক্ষণ করল যেন।
কী দরকার তাই জিজ্ঞাসা করলাম।
জে।
আসফাক বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না।
হাকিম উঠে দাঁড়াল। তার তখন বিশ্রামের সময়। সেই ঘরেই তার বিছানা পাতা। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এদিকে দশখানা গাঁয়ের মধ্যে জাফর ব্যাপারির মতো ধনী কেউ নেই, লোকে অবশ্য বলে অমন মেহেদি-রাঙানো দাড়িও না, শহরের হাকিমরা এলে জাফর ব্যাপারির এ দ্বারিঘরেই থাকে। টিনের ছাদ কাঠের দেয়াল। যেন ডাকবাংলোর মতোই সাজানো।
হাকিম চেয়ারে শুয়ে সিগারেট ধরাল। কিছুক্ষণ ধোঁয়া ছাড়ল। যেন ঘরে আর কেউই নেই। তারপর পাশ ফিরে যেন আসফাককে দেখতে পেল।
কী, যাওনি? এখানেই চাকরি করো?
জে।
কত টাকা পাও?
তিনটাকা।
বলো কী! খেতে পরতে দেয়?
জে।
তিনটাকা। হাকিম হাসল। বলি মাইনা টাইনা পাচ্ছ তো?
না।
না?
জে।
হাকিম আবার হাসল। কতদিন পাও না?
দশ সাল।
হাকিম হো হো করে হেসে উঠল। এই অদ্ভুত কথা শুনে এবং আসফাককে দেখে তার খুব মজা লেগেছে সন্দেহ নেই। সে আবার জিজ্ঞাসা করল, কার চাকর? জাফর ব্যাপারির?
আসফাকের মুখে তখন হাসি ফুটে উঠেছে। সে নিজের বুদ্ধিমত্তায় আশ্চর্যও কম হয়নি। সে ভেবে উঠতেই পারল না এমন নালিশ সে কী করে সাজিয়ে গুছিয়ে করতে পারল। কারণ হাকিমের সম্মুখে দাঁড়িয়ে কতটুকু উচ্চারণ করেছিল আর কতটুকু চিন্তা করেছিল সে হিসেব করার চাইতে অনেক উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল সে তখন। বরং যা উচ্চারণ করেনি সে কথাগুলোকেই স্পষ্ট করে বলেছে এমন অনুভব করছিল সে তখন। নতুবা তিনটাকা মাইনা দশ বছর না পাওয়াটা কথা নয়। বরং শুধু সেটা বললে মিথ্যা নালিশ হয়ে যাবে। মাইনা বন্ধ আছে হয়তো তিন সাল এবং তা আসফাক চায়নি বলেই। নালিশ হল অব্যক্ত মনের কথা, অনেক কথা। প্রথম এসে দশবিঘা জমি পেয়েছিল সে চাষ করতে। কিন্তু সে জমিতে খোরাকির ধান ফলাতে পারত না। সে জমি কি ধান ফলানোর? জাফরুল্লাকে বখরা দেওয়ার পর যা থাকত তাতে ছমাসের খোরাক হত। বাকি ছ মাসের ধান সে ধার নিত আর ধান উঠলে ন মণ দিয়ে ধার শোধ করত। কিন্তু নমণ দিলে ছ মাসের খোরাকও থাকে না। ডাঙা জমি। জমির বিরুদ্ধেও নালিশ করেছে সে মনে মনে। তারপর একদিন জাফরুল্লা তার খাওয়াপরার ভার নিল। কেমন যেন কিসের একটা টানে টানে সেখানে পৌঁছাল আসফাক। আর খাওয়াপরা ছাড়া তিনটাকা মাসমাইনার কথা নিজেই প্রস্তাব করেছিল সে। হাকিমকে কি এসব কথাও সাজিয়ে গুছিয়ে সে বলেনি!
হাকিমের সম্মুখ থেকে চলে আসতে আসতে আসফাক নিজেকে অদ্ভুত রকমে ভারমুক্ত মনে করল। এসব নালিশ শুনলে গ্রামের লোকে ঠাট্টা করতে পারে। অবশ্য গত দশ বছরে কি একবারও সে নালিশ করেছে? হাকিমও হেসেছে বলতে পারো। তা হলেও
কী অদ্ভুত কাণ্ড! দুপুরে আসফাক সেদিন খেতেই পারল না। তারও আগে ঝোরায় স্নান করতে গিয়ে উত্তেজনায় যেন তার দম বন্ধ হয়ে এসেছিল। স্নান করে ভিজে গায়েই খানিকটা সময় সে ঝোরার পার ধরে দুপুর-রোদ মাথায় ঘুরে বেড়াল। অদ্ভুত একটা শক্ত কাজ করে বসেছে। তার মুখে একটা হাসি ফুটে উঠেছিল তখন। হাকিমকে কিনা সব বলে দিয়েছে।
কিন্তু হঠাৎ তার গা ছমছম করে উঠেছিল। হাকিম সাহেব কি ব্যাপারিকে সব বলে দেবে? এতক্ষণ বলেও দিয়েছে হয়তো। তা হলে?
প্রায় বিকেল হলে আসফাক ফিরেছিল ব্যাপারির বাড়িতে সেদিন। তখন আগুই ধান মাড়াই করছে ব্যাপারির অন্য চাকররা দ্বারিঘরের সামনের চত্বরে। তারা যেন আসফাককে দেখেও দেখতে পেল না। আসফাক এদিক ওদিক চেয়ে ব্যাপারিকে খুঁজল। তাকেও দেখতে পেল না। একথা সব চাকরই জানে যে আসফাক বিকেলে যদি কিছু কাজ করে তবে তা জাফরুল্লার তামাক সাজা আর দড়ি পাকানো। তখন চাকররাও ছিলিম পেয়ে থাকে তার কাছে চাইলে। কিন্তু সেদিন যেন কেউ তা চাইছে না। চারিদিক থমথম করছে। বাতাসও চলছে না। খড়ের উপরে বলদগুলো চলছে তারই শব্দ কানে আসছে। আর মাথার উপরে মশা ওড়ার শব্দ।
এমন সময়ে মুন্নাফ বেরিয়ে এসেছিল অন্দর থেকে। মুন্নাফকে কে না চেনে এ গেৰ্দে? জাফরুল্লা ব্যাপারির একমাত্র ছেলে। তার চার নম্বর বিবির। দরুন চার বিবির ওই এক সন্তান।
সে এসে খুঁজল এদিক ওদিক চেয়ে। তারপর আসফাককে দেখে তার দিকে এগিয়ে এল। আর তখন দু পা পিছিয়ে সরে পড়ার চেষ্টা করেছিল আসফাক।
এই যে মিঞাসাহেব, শোনো। আব্বাজানের ওষুধ ফুরায়ে গিছে, সলসবাড়ি যাওয়া লাগে।
আসফাক ধীরে ধীরে বলেছিল, সল্লাবাড়ি?
হ্যাঁ, পিরহান পরে আসো।
আসফাক সেই বলদদের ঘরে গিয়ে দেয়ালে গোঁজা জামাটা ঝেড়েঝুড়ে গায়ে দিয়ে এসেছিল। আর মুন্নাফ তাকে খুচরোয় আর নোটে মিলিয়ে আট-দশটা টাকা এনে দিয়েছিল আর একখানা কাগজ। সলসলাবাড়ির দোকানটাও চেনা। কাগজ দেখালেই ওষুধ দেবে।
আসফাক হাঁটতে শুরু করেছিল।
ব্যাপারির বাড়ি থেকে বেরিয়ে খানিকটা পথ খুব তাড়াতাড়ি এসেছিল আসফাক। ওষুধ যা কিনা মানুষের চূড়ান্ত বিপদের সময় লাগে। ব্যাপারির বয়স হয়েছে, তিন কুড়ির কম নয়। আজকাল কঠিন কঠিন অসুখ হয়। কয়েকমাস আগেই একবার শহর থেকে ডাক্তার এসেছিল। যাওয়া-আসার। মোটরভাভা দুশো টাকা নিয়ে গিয়েছিল ডাক্তার। তা এমনটাই মানায় জাফরকে। এখনো আটশো বিঘা জমি তার–তার পাঁচশো বিঘাই একলপ্তে শালমারির বনের সীমা পর্যন্ত।