পঞ্চায়েত পিধান কথাটা তার অজানা নয়। ভোটবাবুরা, এমনকী সেই হাকিমও আশ্বাস দিয়েছিল, এই নির্বাচন হলে গ্রামে আর জমিজিরাত নিয়ে অন্যায় থাকবে না।
আসফাক ট্রাকের আড়ালে দাঁড়িয়ে হেসে ফেলবে যেন! দেখো কাণ্ড, সেই জাফরই হল পঞ্চায়েত পিধান যার নামে সে হাকিমকে নালিশ করতে গিয়েছিল।
কিন্তু এটা তার চিন্তার বিষয় নয়।
এতক্ষণে কি জাফর স্নান-আহার শেষ করে ইচ্ছামতো বিবির ঘরে ঘুমিয়েছে? আসফাককে তো স্নান-আহার করতে হবে।
.
কেননা, এ তো বোঝা যাচ্ছে, সব বনই কারো না কারো, যেমন সব জমিই কারো না কারো। হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য তুমি বুনা ষাঁড়-মোষ হতে পারো, কিন্তু বন আর বনের নয়, তাও অন্য একজনের।
আর, এই কথাটাই মনে পড়ছে আসকাফের বলদগুলোকে খোঁটায় বাঁধতে বাঁধতে–সেই যে এক সাহেব গল্প করেছিল, কোচবিহার শহরে এক রাজা শেষ বাইসন-মোষটাকে গুলি করে মেরেছে। তারপর আর বুনো মর্দামোষ কারো চোখে পড়েনি। এদিকে বুনো মোষ নিশ্চিহ্ন। এ তো বোঝাই যাচ্ছে, শহরের রাজারা, যারা রাজ্য চালায়, তারা পোষ না-মানা কোনো মর্দা মোষকে নিজের ইচ্ছামতো বনে চরতে আর কোনোদিনই দেবে না। যদিও হঠাৎ তোমার রক্তের মধ্যে এক বুনা বাইসন আঁ-আঁ-ড় করে ডেকে ওঠে।
একটি খামারের গল্প
জাফরুল্লা ব্যাপারির খামারে এখন সকাল হচ্ছে। তার উঁচু ডারিঘরের ছাদের ওদিকে যদি আকাশে এখনো কোনো রং থাকে তবে এদিক থেকে তা দেখা যাচ্ছে না। এদিকে বড়জোর একফালি মরচে ধরা মেঘ দেখা যাচ্ছে।
আসফাক উঁকিঝুঁকি দিয়ে বলদগুলোর পিঠের উপর দিয়ে দিনের আলোর খোঁজ করছিল। আলো দেখতেই সে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল যেন ঘুম থেকে। তার এ চেষ্টা ব্যর্থ হল কারণ কেউ দেখল না, ছমির পর্যন্ত ধারেকাছে ছিল না। আসলে সে আদৌ ঘুমোয়নি, এবং তার রাত্রির আশ্রয় এই বলদদের ঘরে সে ভোর-ভোর সময়ে এসে ঢুকেছে।
এই বড় চালাঘরটার জাফরুল্লার ছ জোড়া বলদ থাকে। তার একপাশে এক মাচায় ঘুমোয় আসফাক। তাকে উঠতে দেখে বলদগুলোও উঠে দাঁড়াল। রাত্রির জড়তা কাটিয়ে তারা মলমূত্র ত্যাগ করল। বাষ্পে যেন ঘরটা ভরে গেল। আর তার মধ্যে দিয়ে মুখ বার করল আসফাক। বছর ত্রিশেক বয়স হবে তার। রোগা লম্বাটে চেহারা। চোখদুটো এত ভাসাভাসা যে মনে হয় ঠেলে বেরিয়ে আসছে। চিবুকে গোটা দশ-পনেরো চুল তার দাড়ির কাজ করছে।
আসফাক যেন অবাক হয়েই চারিদিকে চাইতে লাগল। ডারিঘরের একটা জানালা খোলা। তার সামনে ধানমাড়াইয়ের ঘাস-চাঁছা মাটি, যার বাঁদিকে ধানের মরাই আর ডানদিকে বলদদের ঘর যে ঘরে আসফাক শোয়। ধানের মরাইয়ের পিছনে খড়ের মঠ আকাশের গায়ে ঠেকেছে। মঠের মাথায় শিমুলগাছের ডাল। তার উপরে একটা পাখি বসে আছে। অত উঁচুতে, পাখিটাকে ছোট দেখাচ্ছে। তাদের দেশে এমন সব মঠের মাঝখানে থাকে বাঁশ। এখানে শিমুলগাছটা বাড়ছে, মঠও উঁচু হচ্ছে। ধানমাড়াইয়ের মাটির যে দিকে ডারিঘর তার বিপরীত দিকে টিনের দেয়ালের সেই ঘর যার একপাশে তামাকের গুদাম, অন্যপাশে জাফরুল্লার প্রকাণ্ড সেই সিন্দুক-খাট। এই খাটেই থাকে জাফরুল্লা। বিস্মিতের মতো দেখতে লাগল আসফাক। অথচ । এমন পরিচিতই বা কী তার–সাত বছর হল, দশ হতে তিন বাদ।
এমন সময়ে কে যেন খুক করে কাশল। আসফাক চমকে উঠে কাছিম যেমন খোলায় গলা ঢুকিয়ে নেয় তেমনি করে সরে গেল দরজা থেকে। জাফরুল্লার টিনের দেয়ালের শোয়ার ঘরের দিকে চাইল। না সেদিকে কোনো জানালা খোলেনি। বরং ছমিরই আসছে।
তখন তার মনে পড়ল এতক্ষণ সারারাত ঘুমিয়ে এইমাত্র ওঠার যে অভিনয় করার চেষ্টা করছিল সে তার কোনো মানে হয় না। কারণ ছমির দেখেছে তাকে ফিরে আসতে। সে যতই চেষ্টা করুক ছমিরের নিশ্চয়ই মনে থাকবে আসফাক সন্ধ্যায় না ফিরে রাত শেষ করে ফিরেছে।
ভোর-ভোর রাতের সেই দৃশ্যটা মনে পড়ল তার।
ডারিঘর পর্যন্ত এসে সে তখন থমকে দাঁড়িয়েছে। এতক্ষণ সে কোন সাহসে এগিয়েছে তা যেন খুঁজেই পেল না। অন্ধকার ছিল বলেই বোধহয় সাহস।
এগোবে, না পিছোবে ভাবছে সে, এমন সময়ে একজন বেরিয়ে এল অন্দরের দিক থেকে। হাতে পাটকাঠির মশাল।
আসফাক এগিয়ে গেল ধীরে ধীরে।
কে?
আসফাক।
আসফাক?
জে।
জে না। আমি ছমির। আসলা?
একটা অবসন্নতায় তার শরীর ঝিমঝিম করে উঠেছিল। টলতে টলতেই যেন সে বলদদের ঘরে গিয়ে ঢুকল।
ছমির ডারিঘরের ভিতরের দিকের বারান্দায় তামাক সাজতে বসল। কী করবে এখন আসফাক? রোজ সকালে যেমন বলদগুলোকে খুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে তেমন কিছু করবে!
এতে আর সন্দেহ নেই যে এবারেও ব্যাপারটা বোকামিই হয়ে গিয়েছে। অথচ তখন সেটাকেই একবার ঠিক কিছু বলে মনে হয়েছিল।
আর এ সবের জন্য সে হকিমবাবুই দায়ী। সরকারি কর্মচারী। রাজ বদলেছে। গল্পে শোনা রানীর আমল তো আর ফেরেনি। তাই বলে সরকারি কর্মচারীরা তো আর বদলায় না। বিশেষ করে তার হাকিমের মতো পোশাক। টুপি পর্যন্ত ছিল।
সেই হাকিমই দায়ী কিন্তু, এই স্থির করল আসফাক। জাফরুল্লা ব্যাপারির দ্বারিঘরে সে বসেছিল দপ্তর বিছিয়ে। গ্রামের অনেক লোকই গিয়েছিল তার সঙ্গে দরবার করতে। দুদিন ধরেই চলছে। অন্তত তাই ধারণা হয়েছিল আসফাকের। তাদের অনেকের অনেক অভিযোগ কর্মচারীটি শুনেছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাগজেও টুকে নিচ্ছিল। আর এসবই শুনতে পেয়েছিল আসফাক সেই ঘরের দাওয়ায় বসে তামাকের গুঁড়োয় গুড় মিশিয়ে ছিলিমের উপযুক্ত তামাক বানাতে বানাতে। তারপর অবশেষে জাফর খেতে গেল। এমনকী তার অন্য চাকররাও। তখন এদিক ওদিক চেয়ে আসফাক হাকিমের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার পরনে নেংটি। হাত দুখানা চিটেগুড় আর তামাকের গুঁড়োয় কালো।