আসফাকের মনে কথা তৈরি হচ্ছে না। আর কথা তৈরি না হলে চিন্তাও করা যায় না।
.
ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল আসফাকের। ধড়মড় করে সে উঠে বসল। তার আদৌভালো ঘুম হয়নি। একবার তার মনে হয়েছিল, হাঁক মারতে মারতে একটা কালো মোেষ এসে দাঁড়িয়েছে দ্বারিঘরের সামনে। দ্বারিঘরের চাল ছেয়ে এত উঁচু, আর আগুনের মালসার মতো চোখ। আর তখন সে যেন নতুন এঁড়ে মোষের, মতো ভয়ে ভয়ে এই ঘরের কোণে আশ্রয় নিয়েছিল। সেটা কি স্বপ্ন? না চোখেও দেখেছিল সে?
সজাগ হল আসফাক। এখন দিনের আলোই চারিদিকে। এটা সেই বলদের ঘরই। ঘুম ভাঙতে খুব দেরি হয়েছে তার। এমন আলো ফোঁটার আগেই বলদ ছেড়ে দেয়ার কথা।
তা, কমরুন, ভাবল আসফাক, আসল কথা বাথানে গাবতান মোষ থাকতে পারে কিন্তু বন কোথায় আর? চাউটিয়া যা বলে, বড়বিবি যা বলে, তা মানাই ভালো। এখন এক ছটাক জমি নাই যা কারো না কারো, একহাত বন নাই যা কারো না কারো। বনে যে হারিয়ে যাবে তার উপায় কী? এখন বোঝা যাচ্ছে, গাবতান মোষ আর গাবতান কুমরকে নিয়ে বনে গিয়েও কিছু হত না।
.
বলদগুলোকে এক এক করে খুলে দিল আসফাক।বলদের ঘরের দরজা দিয়ে মুখ বার করে শুনল, অনেক লোক কথা বলছে, হাঁকডাক উঠেছে। একজন কে তার নাম ধরে ডাকল।
ঠিক যেন জাফরুল্লাই, তেমন কর্কশ করে কেউ তাকে ডাকছে। মাচার উপরে খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে সকালের দিকে বোধহয় তন্দ্রা এসেছিল তার। এই হাঁকডাক, ডাকাডাকিতেই তার ঘুম ভেঙেছে। অনেক বেলা হয়ে গেলে চাকররা যেমন করে, তেমন চোখ ডলতে ডলতে সে বলদঘরের দরজার কাছে এল।
কিন্তু জাফরুল্লা নয়। মুন্নাফ ডাকছে। তাকে খুঁজছে বোধহয় অন্য চাকরদের মধ্যে। না পেয়ে এদিকে আসছে। বেলা একটু হয়েছে। কিন্তু যতটা আশঙ্কা করেছিল তা নয়।
মুন্নাফ বলল, উঠছ আসফাক?
উঠলাম। কখন আইসলেন তোমরা? আসফাক বিবর্ণ মুখে হাসল।
ভোর-রাইতৎ।
কেন, শহর থাকি রাইতৎ রওনা দিছিলেন? অন্ধকারের পথ তো!
লরিৎ আসলাম। তা দেখো নাই? আব্বাজান লরি কিনছে একখান। তারই বাদে শহরৎ গেইছং।
অ।
এখন থাকি গরুগাড়ি তামাক পাট যাইবে না বন্দর। লরিৎ যাইবে। কী ভকং ভকং হরন, আর কত্ত বড় বড় চাকা। ডারাইবারও আসছে।
অ। তা, মুন্নাফ—
শোনো, তোমাক এক কথা কই, আসফাক। বলদ এড়ে দ্যাও। আব্বাজানের ঘুম ভাঙার আগৎ বলদ ধরি দূরৎ যান। আম্মা কয়া দিছে।
বলদের পিছনে বেরিয়ে যেতে যেতে পেন্টি লাঠি হাতে নিল আসফাক, গামছাটা কাঁধে ফেলল।
মুন্নাফ দরজার কাছ থেকে কিছু দূরে সরে গিয়েছিল। সেখান থেকে ডেকে বলল, শোনো, আসফাক, আর এক কথা কই।
আসফাক এগিয়ে গেল। তার বুকের মধ্যে কী একটা ধকধক করছে, উথাল-পাথাল করছে। জাফরুল্লা এসে গেছে, জাফরুল্লা এসে গেছে। নাকি এটা আবার সেই ভুলুয়ার হাতে পড়ার অবস্থা হতে চলেছে? কেমন যেন জটিল লাগছে নিজের মনকে তার। আর মুন্নাফের সুন্দর মুখটাকে দেখো।
আম্মা কইছে, মুন্নাফ বলল, আব্বাজান খাওয়া-লওয়া করি শুতি না গেইলে তুমি বাড়ি আসবা না।
আসফাকের মনে একটা প্রশ্ন দেখা দিল। একটু ইতস্তত করল সে। কথাটা কী ভাবে আরম্ভ করা যায় তা খুঁজতে দেরি হল।
কেন, মুন্নাফ তোমরা নোক্ আর মিঞাসাহেব না কন?
মুন্নাফের মুখে লজ্জার মতো কিছু একটা দেখা দিল। না, আব্বা কয়, চাকরক তা কওয়া লাগে না।
ঠিক এমন সময়ে কে যেন ডাকল-আসফাক।
কে যেন কয়? চিনতে কি ভুল হয়? এই বজ্রগর্জনের মতো স্বর! খোলা জানালায় মেহেদি-রাঙানো দাড়ির খানিকটা দেখা গেল।
আসফাক দ্বারিঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করল, দৌড়ে চলার মতো হাত পা নেড়ে। বজ্রটা ফাটল না। হাসির মতো লাগল শুনতে, আকাশের চেহারা ভাল নোয়ায়, আসফাক। বলক দূরৎ না-নিস। হেই বলদ।
আকাশের দিকে তাকাল আসফাক। আকাশে কালো মেঘ নেই। দিনের আলোয় যে আকাশ ঝকমক করে, তাও নয়। এমন নোংরা আকাশ সে কোনোদিনই দেখেনি।
দ্বারিঘরের কাছে এসে সে থমকে দাঁড়াল। বাপ্প! বলল সে মনে মনে। আর অবাক হয়ে থেমে গেল। চাকর, আধিয়ার, গ্রামের মানুষদের ভিড়ের মধ্যে সে এক প্রকাণ্ড গাড়ি। মানুষের কাধ সমান উঁচু উঁচু চাকা। কুচকুচে কালো রং।
চিবুকে হাত দিয়ে সে ভাবল এটাকেই কি তা হলে সে বুনো মর্দা ভেবেছিল রাত্রিতে! নাকি স্বপ্নই ছিল সেটা?
আসফাক অবশ্যই জানত না, ঘুমের ঘোরে দেখা বস্তু স্বপ্নে অন্য রূপ নিতে পারে যদি চিন্তার যোগ থাকে।
সে বলদের পিছনে যেতে যেতে মন্তব্য করল, বাব্বা ইয়ার সাথৎ কাঁউ পারে?
সে বলতে চায়, এই কলের মোষের সঙ্গে কোনো মোষেরই লড়াই জেতার ক্ষমতা হবে না। সে যত দেখল, তত অবাক হয়ে গেল।
.
অনেক বেলায় সে খামারমুখো হল। পথে দেখা হল সাত্তারের সঙ্গে, সে স্নান করে খেতে যাবে বলে খামারে চলেছে। আসফাক জিজ্ঞাসা করল, এত্ত দেরি?
সাত্তার বলল, শহর থেকে সেই ভোটবাবু পাট্টির লোকরা ফিরছে অনেক। খুব খাওয়া-দাওয়া ধুম-ধাড়ো । রাত্তিরেই হরিণ মারছে একটা।
কেন সাত্তার?
তোমরা শোনো নাই? ব্যাপারি পঞ্চায়েত পিধান হইছে।
সাত্তার চলে গেল।
আসফাক ট্রাকটার সামনে দাঁড়াল। লেল্যান্ডের ট্রাক। চারিদিকেই একমানুষ দেয়াল তোলা। সে জন্যই সাধারণ ট্রাকের দ্বিগুণ দেখায়। দ্বারিঘরে অনেক লোকের ভিড়। কিন্তু এপাশে দাঁড়ালে চোখে পড়বে না বোধহয়-এই ভেবে ট্রাকের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে ভয়ে ভয়ে ট্রাকটার গায়ে একবার হাত ছোঁয়াল।