না। রাগ কী!
দরজার কাছে ফিরে গেল আসফাক। কমরুন এগিয়ে এল দরজার কাছে। আসফাক দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলল, দুয়ার দেও, কমরুনবিবি।
.
কমরুনের ঘরের ডোয়া ঘুরে বাইরে যাওয়ার পথ। সে পথে যেতে যেতে কমরুনের জানালা। চোখ তুলল আসফাক। সে দেখল, ইতিমধ্যে কমরুন জানালায় এসে দাঁড়িয়েছে। সে দেখল, কমরুনের গালে কী চকচক করছে, তাতে, চকচকে নাকফুলটা জল লেগে আরো চকচকে। তার মধ্যে হাসল করুন। অসম্ভব রকমের মিষ্টি সেই হাসি। আসফাক দাঁড়িয়ে পড়ল। কমরুন দুহাতে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়েছিল, এখন একটা হাত শিক গলিয়ে লম্বা করে দিয়ে আসফাকের মাথায় রাখল। কিছুক্ষণ কোনো কথা বলা যায় না। আসফাক সরে জানালার গোড়ায়, আর তার ফলে কমরুনের আঙুলগুলো আসফাকের চুলের মধ্যে খেলা করতে পারল। কমরুম এবার হাসল, সেই হাসির মধ্যে বলল, তোক ভুলুয়া ধরছে আসফাক। ঠিক-এ। তুই কেনে হাকিমক নালিশ জানালু ব্যাপারির বাদে?
তো?
আচ্ছা এলা যা।
আসফাক রওয়ানা হয়েছিল, কমরুন আবার ডাকল। একেবারে গলা নামিয়ে দারুণ গোপন কথা বলার ভঙ্গিতে বলল, মুন্নাফ।
মুন্নাফ!
মুন্নাফ—
হ্যাঁ মুন্নাফ, তার পাছৎ কী?
শোনেক।
তারপর ফিসফিস করে কমরুন যা বলেছিল, তার অর্থ এই হয় যে সে মুন্নাফকে শিখিয়ে দিয়েছে, যতদিন কমরুন বাঁচবে সে আসফাককে মিঞাসাহেব বলে ডাকবে।
হ্যাঁ, তাই কয়। বলে আসফাক চলে এসেছিল।
নিজের শোবার মাচায় বসে তার যে অনুভূতি হল, তা কথায় দাঁড় করালে তার অর্থ হয়, এ কমরুন সে কমরুন নয়। দেখেছ তো, তার পোশাক, তার গহনা, তার সুস্বাস্থ্যে ডাগর হয়ে ওঠা শরীর, তার ঘর, তার বিছানা। তখন সেই তাঁবুর নীচে ছেঁড়া শাড়ি-পরা কমরুন, রোগা-রোগা পঁচিশ-ছাব্বিশের কমরুন এত সুন্দর ছিল না। না, না। সুন্দর ছিল বইকি। ছেঁড়া ময়লা কাপড় ফেলে রেখেছে, এমন সদ্যস্নাত দুইজনের অনাহার-কৃশ কিন্তু নীরোগ অবয়বে সৌন্দর্য নিশ্চয়ই থাকে। বনের গভীরে সেই তাঁবুর নীচে নতুন সংগ্রহ করা সেই ঘাসের উপরে নিশ্চয়ই তেমন সুন্দর ছিল কমরুনও।
কোনো কোনো কথা আছে উচ্চারণের সময়ে তার যতটা অর্থবোধ হয়, পরে সেটাকে গভীরতর মনে হতে থাকে। মিঞাসাহেবই বলে মুন্নাফ। কিন্তু আজ রাত্রিতে ঠিক ওভাবে বলল কেন কথাটা কমরুন! ওদিকে দেখো, এখন কমরুনের কথাবার্তা কেমন বিবিসাহেবাদের মতোই।
এই কথাটাই ভাবল আসফাক কিছুক্ষণ। বিবিসাহেবাদের মতো হয়ে গিয়েছে কমরুন। এও একরকমের সৌন্দর্য। কিন্তু বনে একদিন হরিণ-হরিণী দেখেছিল তারা। মসৃণ উজ্জ্বল রং আর কী হালকা সুঠাম চেহারা। কমরুনকে যেরকম দেখাত স্নান করে উঠলে সেই সব গাছের ছায়ায় ঢাকা অল্প আলোর ঝোরার ধারে–এখনো কি তেমন দেখায়?
তো, বিবিসাহেবা কমরুনও বলেছিল, তাকে ভুলুয়া ধরেছে। এখন কি সে সব ব্যাপারটা ভেবে দেখবে? হঠাৎ মনে হল ভুলুয়াই ঠিক! আর এই মনে হওয়ার ফলে তার হৃৎপিণ্ড গরম হল, ধকধক করতে লাগল। নতুবা কেন সে হঠাৎ মনে করেছিল, সে নিজেই একটা মর্দামোষ হয়ে গিয়েছে? মদামোষের মতো ডাক দিতে দিতে বনবাদাড় ভেঙে ছুটেছিল সে। ভুলুয়া না হলে কি তেমন হয়? তখন খুব ফুর্তি লাগছিল, রক্তের চাপে হাত-পায়ের শিরা ফেটে যাচ্ছিল যেন। মাচায় শুয়ে সে ভাবল-কমরুন বলেছিল, তাদের বাউদিয়াদলের কর্তা মোষের মতো ডাকতে পারত। আর তার সেই আঁ-আঁ-ড় ডাক শুনে অন্য বাথানের মাদিমোষ, বাচ্চামোষ, এমনকী বুনোমমাষের বাচ্চাও তাদের দলের কাছে আসত। আর কখনো কখনো তাদের গলায় দড়ি দিয়ে সরে পড়ত তাদের দল।
তা, দেখো কমরুন, আসফাক মনে মনে বলল যেন, এখনো জাফরুল্লার বাথানে গর্ভবতী মোষ আছে। সে রকম একটাকে পেলে ধীরে ধীরে একটা মোষের দল গড়ে তোলা যায় বটে। আর তাহলে সেই মোষের দলকে অবলম্বন করে দুটো মানুষ থেকে ক্রমশ এক ঝাক বাউদিয়ার এক দলও হয়ে ওঠে। কিন্তু সেকথা তুমি তখন বলোনি। বললে তিন সাল বাদে। তখন, যখন বুড়ি মোষটা মরল আর আমরা মহিষকুড়ার খামারে, আর বৃষ্টিবাদলে বন ভিজে গিয়েছে, আর জাফরুল্লার মধ্যে তুমি তোমার পুরনো দলপতিকে খুঁজে পেয়েছিলে, বোধহয় আমিও ভেবেছিলাম এটাই ঠিক হল।
আসফাকের বাইরের অন্ধকার যেন একই সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকানিতে চিড় খেল। আর সেই চিড়-খাওয়া ফাটল দিয়ে বিবিদের ঝগড়ার কথাগুলো ভেসে উঠল। মেজবিবির সঙ্গে ছোটবিবির ঝগড়া। ঝগড়াটা ঠিক নয়। ঝগড়ায় সংবাদ ছিল। ছোটবিবি, মেজবিবি, বড়বিবি, এমনকী মুন্নাফের পর থেকে কমরুনবিবিও পতিত থাকে কেন?
আর তা যদি হয়? সে জন্যই কি মুন্নাফ তার নাম ধরে ডাকে না? আর কমরুন তাকে শিখিয়ে দিয়েছে সম্মান করতে?
অদ্ভুত কথা তো! ভারি অদ্ভুত কথা। এ ছাড়া কোনো কথাই আসফাকের মন। তৈরি করতে পারল না। কমরুন কি বুঝেছিল সেই বর্ষায় ক্রমশ তার বিপদ বাড়বে, যে বিপদে তখনকার সেই এককুড়িতে না-পৌঁছানো আসফাক থই পেত না? বরং বুড়ো, হেঁড়েমাথা একবুক-দাড়ি জাফরকে ভরসা করা যায়? আর চালাক, হাড়-চাল্লাক জাফরও কি কমরুনের অবস্থা ধরতে পেরেছিল? অদ্ভুত কথা তো! আসফাক অনেকদূর থেকে ভেসে আসা কমরুনের কথা শুনতে পেল। এখন মনে হচ্ছে কথাটা দামি। তখন নিজের মনের দুঃখে দামই দেয়নি সে। কমরুন বলেছিল বোধহয়, এ ভালোই হয়।