আসফাকের মনে হল এরকম নামিয়ে আনা স্বর যেন কোথাও সে শুনেছে। সে বলল, তেল, টেমি আর শালাই লাগে।
ছোটবিবি কান পেতে শুনল। সে যেন আসফাকের এই অদ্ভুত প্রয়োজনের কথা শুনেই জোরে জোরে হাসল। আর সেই হাসিতে নিজেকে সামলে নিল।
সে গলা তুলে বলল : রইস, দেং।
তেল, টেমি, দেশলাই এনে দিল ছোটবিবি।
আসফাক নিজের ঘরের দিকে ফিরতে ফিরতে দেখল, ছোটবিবি দরজার পাল্লায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে কিছু ভাবছে। গা শিরশির করে উঠল তার। বনের মধ্যে ভুলুয়া ধরলে এমন কাউকে দেখে নাকি কেউ কেউ! আর তখন তার দিকে না এগিয়ে উপায় থাকে না। সে পথই হোক, আর বিপথই হোক। কিন্তু রসুইঘরের ঝগড়াটাও মনে হল তার। দশ সাল হয় এই রূপসী ছোটবিবি জাফরুল্লার ঘরে। অথচ এই পঁচিশ-ছাব্বিশে এসেও সে এখনো পতিত। ছাওয়া-পোওয়া কিছু হয়নি। হয়তো সেই কষ্টে ঘুম হয় না।
নিজের ঘরে ফিরে আসফাক বাঁশের আগালে কেরোসিন তেল ভরে, তাতে। পাটের পলতে ডুবিয়ে দুটো মশাল তৈরি করে রাখল। আলো দেখলে খারাপ মানুষ, বনুয়া জানোয়ার কিছুটা ভয় পাবেই।
শেষ মশালটা তৈরি করতে করতে তার মনে হল, তিন বিবির খবর পেলাম, কমরুনকে দেখা গেল না। সে তো সত্যই ব্যাপারির সঙ্গে যায়নি।
.
টেমিটায় তেল নেই। মিটমিট করছে। রাত্রির অন্ধকারটাও গম্ভীর হয়ে আসছে। বাঁশের চটি তুলতে তুলতে অন্ধকারের দিকে চাইছিল আসফাক। চারিদিক সুমসাম হয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে বলদদের নিঃশ্বাসের শব্দ কানে। আসছে, আর নিজের হাতের কাটারি বাঁশের উপরে যে মৃদু শব্দ করছে।
তখনো কিন্তু এমনই সুমসাম হয়ে যেত এই খামারবাড়ি। শুধু ব্যাপারি এবার তাকে দেখাশোনা করতে বলে যায়নি। তা হোক। কেমন একটা আলসেমি লাগছে। এবার সে শুতে যাবে। এই টুকরোটা শেষ হলেই হয়।
হঠাৎ সে থামল আর টেমির মিটমিটে আলোতে নিজেকে দেখে অবাক হয়ে গেল। দেখো কাণ্ড! সে না বলেছিল, এসব কাজ না করে কালকের জন্যে ফেলে রাখবে? বাঁশ আর কাটারি সরিয়ে রাখল সে। উঠে দাঁড়াল। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কী যেন লক্ষ করল। চিবুকে হাত রাখল। কী যেন একটা মনে আসছে! ঠিক ধরতে পারছে না কী সেটা।
সেবারও অন্দরবাড়ি এমন সুমসাম হয়ে যেত, আর সারা রাতে প্রহরে প্রহরে উঠে সে অন্দরের বন্ধ দরজার সামনে সামনে ঘুরে তদ্বির তদারক করত।
এবারেও তা সে করেছে একবার। কিন্তু কমরুনবিবিকে আজ রাতে সে দেখেনি। খবর নেয়া দরকার। ওরা যেমন বেহিসাবি বিবিরা-দরজা-টরজা। ঠিকঠাক দিল কিনা তা দেখবার জন্য অন্দরের দিকে পা বাড়াল আসফাক। কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ যেমন একটা আলসেমি লেগেছিল কাজ করতে করতে, তেমন কিছু অনুভব করল সে আবার। তারপর গা শিরশির করতে শুরু করল। গলার কাছে কী একটা দলার মতো ঠেলে উঠল। আবার তার মনে পড়ল, সেবারও এমন নিঃসঙ্গ ছিল ব্যাপারির বাড়ি। সে অন্দরের দিকে একটু তাড়াতাড়ি হেঁটে গেল। সে অনুভব করল, দেখো, এ ব্যাপারটাও সে আগে বুঝতে পারেনি অন্য সব ব্যাপারের মতোই। ভাবো তো, কতদিন দেখা হয় না কমরুনের সঙ্গে! সেবারের সেই সাঁকোর কাছে কথা হওয়ার পর আর কথাও হয়নি। অন্য বিবিদের তদারক না করে সে সোজা কমরুনের ঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তখন তার রক্ত ছলাৎ ছলাৎ করে গলায় ধাক্কা মারছে।
কমরুন, কমরুন, ঘুমাও? ওঠো। ফিসফিস করল আসফাক।
কমরুন তখনো ঘুমায়নি। ঘরের মেঝেতে পাটি পেতে বসে কী একটা সেলাই করছে।
ডাক শুনে কমরুন সেলাই নামাল হাত থেকে। উঠে এল জানালার কাছে।
কাঁয়? সব্বোনাশ! আসফাক? কমরুনের মুখ একেবারে রক্তহীন হয়ে গেল।
সে ফিসফিস করে বলল, ব্যাপারি ঘরৎ নাই।
জানং।
রাইত নিশুতি।
জানং।
তো? কমরুন যেন হাঁপাচ্ছে, আর তার দমকে তার মুখে একবার রক্ত আসছে, আবার সরে যাচ্ছে।
যন্ত্রচালিতের মতো কমরুন দরজা খুলে দিল। তা করে সে কয়েক পা পিছিয়ে ভয় ভয় মুখে ঘরের কোণ ঘেঁষে দাঁড়াল।
আসফাক! কমরুন কী বলবে খুঁজে পেল না।
আসফাক বলল, কুমর, কী খুবসুরত তো দেখায়।
কমরুন বলল, রাগ খাইস না, আসফাক। মুই খানেক ভাবি নেং। তুই কেনে আসলু, আসফাক কেনে আসলু? তোক ঠিক-এ ভুলুয়া ধরছে।
কথাগুলো বলতে বলতে থরথর করে কেঁপে উঠল কমরুন।
আসফাক কমরুনের দিকে চেয়ে রইল। হলদে-সাদায় ডুরি একটা খাটো শাড়ি পরনে তার। গলায় একেবারে নতুন একটা রুপোর চিকহার কমানো লণ্ঠনের মৃদু আলোয় ঝকঝক করছে। কমরুন যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তার কাছে তার সুদৃশ্য বিছানা। মশারিটা তোলা। সাদা ধবধবে বিছানায় দু-একটা মাত্র কোঁচকানো দাগ। আর কমরুনের এককুড়ির উপরে দশ পার হওয়া কিছু ভার মুখকে আলো করে নীল কাঁচের নাকফুল। ওটা সোনা না হয়ে যায় না।
কেন, কমরুন?
কী আসফাক?
আসফাক কথা খুঁজে পেল না।
কমরুন বলল, কেন আসলু আসফাক, এই রাইতৎ।
আসফাক হাসল। বলল, দেখেক কুমর, এলা মুই সিয়ানা হইছং। তোর মাথা ছাড়িয়া উঁচা।
জানং।
তো।
যেন তার দম আটকে আসছে এমন করে চাপা গলায় বলল কমরুন, আসছিস, আজ রাইৎ থাকি যা। কিন্তুক মোর গাও ছুঁয়্যা কথা কর, আর তুই আসবু না।
কমরুন কি কেঁদে ফেলবে-এমন ভয় হল আসফাকের। কী ওঠানামা করছে ওর সেই স্তনদুটি!
হঠাৎ আসফাক বলে বসল, ঠিক-এ তো। মুই যাং। তুই কেমন আছিস কুমর, তাই দেখির বাদে আসছং।
তুই রাগ না করিস, আসফাক, রাগ না খাইস।