যাক, এখন তো সব মিটে গেল। দুদিনের মাথায় পেটে ভাত পড়েছে। শরীর মনকে পরোয়া না করে স্নিগ্ধ হতে চাইছে, বাইরে স্নিগ্ধ অন্ধকারের সঙ্গে মিলে যেতে চাইছে। ছিলিম ঢেলে সে উঠে দাঁড়াল। যেন রোজকার মতো এখন সে তার বলদের ঘরে শুতে যাবে। যেন সে কৌতুকবোধও করতে পারবে। বিবিদের ঝগড়ার কথা মনে হল। সে হাসল মিটমিট করে।
মেজবিবি বলল, নুরীক কনু পা দাবাবার।
এদিকেও আনাজ কোটা খায়।
মানষির তো ব্যথাবিষ হবার পায়।
বাব্বা। এক আইৎ ঘরৎ নাই তাও এত্ত গায়ে বিষ।
সে বিষ তোমার।
হয় তো হয়। নছিব করা লাগে।
অত্ত দেমাক না দেখাইস। নছিব! ত্যাও যদি খ্যামতা থাকি হয়!
খ্যামতা?
না তো কী? কমরুনক লাগে কেনে? মুই আর বড়বিবি নাই তো পতিত থাকলং। তুই পতিত কেনে, সোহাগি?
আসফাক ভাবল তা এটা এক মজাক দেখং। বলদের ঘরে এসে সে দাঁড়াল আগড়ের পাশে। আর একটু ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগলে হয়। সে ভাবল, এটা বেশ মজার ব্যাপার যে, বড়বিবি, মেজবিবি, ছোটবিবি সবাই নিঃসন্তান। বড়বিবি এসেছে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে আর ছোটবিবিরও বছর দশেক হল আসা হয়েছে । এর মধ্যে তিনবিবির কারো সন্তান হয়নি। কমরুনবিবি নিকার আট-ন মাসের মধ্যে সন্তান দিয়েছে ব্যাপারিকে। বাড়ির গুণ বোধহয়-সাত সাল আগে মুন্নাফ, কিন্তু তারপরে কমরুনও দ্বিতীয় সন্তান দেয়নি ব্যাপারিকে!
এত বড় বাইরের চত্বরে এখন কিন্তু আর আলো নেই। দ্বারিঘর, মোষের বাথান, পোয়লের পুঁজ, গুদামের ঘর সব এক-একটা কালো কালো আকার মাত্র অন্ধকারে। একেবারে আলো নেই তা নয়। ধানমাড়াইয়ের নিকানো চত্বরে বসে তামাক খেয়ে সে ছিলিম ঢেলেছিল। বাতাসে সেই চত্বরের উপর দিয়ে সে আগুনের লাল লাল ছোট গুলি গড়াচ্ছে এদিকে ওদিকে। না, ওতে আগুন লাগে না। যেটা গড়াচ্ছে, একটু ফুলকি ছড়িয়েই নিবে যাচ্ছে।
একটা লম্বা শ্বাস ফেলে আসফাক অন্ধকারকে বলল, তো, ব্যাপারি, তোমরা থাপ্পড় মারছেন, দশ বিঘা ভূঁই দিছেন, মুইও চাষ দেং নাই। মুই ওষুধ আনং নাই, তোমরাও না-মরেন। তামাম শুধ।
কিন্তু এখন কি তার শোয়া হবে? তার মনে পড়ল, কিছু কাজ তার বাকি আছে। জাফরুল্লা বলেছিল বটে, কয়েকদিনের মধ্যে তামাক বাঁধার চটি বাঁশ লাগবে। সোজা নয় প্রয়োজনটা। দু-তিনটে আস্ত বাঁশকে চটি করতে হবে। তাও আবার মাপমতো হওয়া চাই-লম্বায় পোন হাত, চওড়ায় দুই সুত, আর পাতলা কাগজের মতো। কাঁচা বাঁশ কেটে টুকরো করা আছে। এটা তারই কাজ। গতবার যখন ব্যাপারি ছিল না তখন থেকেই সে এ কাজটা নিজে গুছিয়ে রাখে। এখনো দুঘণ্টা কাজ করা যায় অন্দর থেকে টেমি চেয়ে এনে।
আসফাক খুঁতখুঁত করে হাসল। অন্ধকারকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, আজ থাউক, কালি করা যাইবে। ইয়াকও তোমার শোধবোধের হিসাবৎ ধরি নেন, ব্যাপারি।
সে ভাবল, শোধবোধ যখন হলই তখন সেই হিসাব শেষ করার আগে এইসব ছোটখাট অবহেলা ও অমনোযোগও ধরে নিও। যেমন এই বাঁশের চটি না তোলা, যেমন গরু-মোষ ঠিকঠাক উঠল কিনা তা না দেখা, যেমন না ঘুমিয়ে সারারাত উঠে উঠে তোমার অলর পাহারা না দেয়া।
কোনো কোনো রাতে ঘুম সহজে হয় না। যেমন ধরো, অন্ধকারকে অন্ধকার মাত্র মনে না হয়ে অন্য কিছু মনে হতে থাকে। আসফাক স্থির করল, একটা কাজ তাকে করতেই হবে। গোটা দুয়েক মশাল তৈরি করে রাখা দরকার। যদি কোনো বিপদ হয় রাতে, আর যদি সে সাড়া দেয়ই তা হলে মশাল ছাড়া চলবে না। বাঁশের আগাল, কাটারি, পাট এই ঘরেই আছে। তেল আর দেশলাই যোগাড় করতে হবে।
একটা টেমি না হলে কি করা যাবে? উঠে দাঁড়িয়ে সে অলরের দিকে গেল। বড়বিবির ঘরেই থাকে তেল। কিন্তু ভেতর থেকে খুব মৃদু ফুরসির শব্দ পাওয়া গেলেও ঘরের দরজা বন্ধ। ওদিকের ঘরটায় আলোর ইশারা। মেজবিবির গলার সাড়া পাওয়া গেল।
কে? কাঁয়?
আসফাক।
কী চাও?
না। একটা টেমি।
ছোটবিবির দুয়ারৎ দেখ।
ছোটবিবির দুয়োরে টেমি পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু লজ্জাও পেতে হল। মেজবিবির ঘরের জানালা খোলা ছিল। আর সেই খোলা জানালা দিয়ে সে মেজবিবির বিছানায় নুরী ঝিকেও দেখতে পেল। নুরী হয়ত মেয়েমানুষই, যদি তাকে এখন আরো বেশি মাদি মোষের মতো মনে হচ্ছে। মেজবিবির হয়তো সারা গায়ে বিষ, কিন্তু আবরু থাকা দরকার।
ছোটবিবির ঘরে আলোটা জোরদার ছিল।
কাঁয়?
আসফাক।
রইস।
ফিসফিস করে এই বলে ছোটবিবি উঠে এসে দরজা খুলল। আর চোখে ধাঁধা লাগল আসফাকের।
ছোটবিবি গলা নামিয়ে বলল, বইসেক। তোর গল্প শোনং।
জে?
ঠিক করি ক। পরী ধরছিল তো?
আসফাক লজ্জিত হয়ে মুখ নামাল।
একেই তো পরী বলে বোধহয়। তা, পরীর মতোই দেখায় বটে ছোটবিবিকে, শালবাড়ির জঙ্গলে তাকে পরী নাই ধরে থাকে। ছোটবিবি রাতের ঘুমের জন্য তৈরি হয়েছিল। পরনে একটা পাতলা শাড়ি আলগা করে পরা। জলে ভিজলে যেমন হতে পারে, কোথাও কোথাও গায়ের রং আর বাঁক চোখে পড়ছে। চোখের কী জেল্লা! নাকফুল আর কানফুলের কাঁচগুলোর চাইতে সুর্মার টানের মধ্যে বসানো চোখের মণিদুটো বেশি ঝকঝকে।
এই সময়েই মেজবিবির জানলায় চোখ পড়েছিল আবার আসফাকের। আর তা লক্ষ করে ছোটবিবি অদ্ভুত এক স্বরে বলেছিল, উয়ার গাওৎ বিষ ধরে। উদিক না দেখিস।
তারপর সে আরো অদ্ভুতভাবে গলা নামিয়ে এনে বলল, আইসেক, খানেক গল্প করং।