ও আসফাক, আসফাক।
কী?
নামায়ে দাও?
কমরুন, জাফরুল্লার চার নম্বর বিবি কমরুন।
তিন সাল আগে তখন আসফাকের বয়স এককুড়ি পার হয়েছে। কমরুনের এককুড়ি দশ হয়তো, তা হলেও কমরুনকে সে মাথায় ছাড়িয়ে গিয়েছে।
আসফাক এগিয়ে গিয়ে কাছে দাঁড়াল। আর তখন ছোট ছেলেমেয়েরা যেমন কোলে ওঠে, তেমন করে আসফাকের গলা জড়িয়ে ধরে সেই টালমাটাল বাঁশের সাঁকো থেকে নামল কমরুন । কেমন যেন লজ্জা পেয়ে হাসল। সাঁকো থেকে নেমেছে তখন, পায়ে মাটি ছুঁলেও কিন্তু কমরুন দু-হাতে আসফাকের গলা জড়িয়ে ধরে আছে। একবার সে মুখ তুলল, আসফাকের মুখটা দেখল, তার পরে আসফাকের কাঁধের উপরেই মুখ রাখল। যেন তখনো সাঁকোটা পার হচ্ছে।
তারপর মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়াল সে আসফাকের মুখোমুখি। বাতাস আর এক পাক খেলে গেল। খানিকটা ধুলো উড়িয়েও গেল। বাতাসের জন্যই যেন কমরুনের পদক্ষেপগুলো অসমান হচ্ছে। কয়েক পা গিয়ে পথের ধারে বড় বড় ঘাসগুলো যেখানে বাতাসে নুয়ে নুয়ে যাচ্ছে সেখানে কমরুন যেন হঠাৎ পড়ে গেল। বাতাস যেমন শব্দ করছে তেমন রিনরিন করে করে হাসল সে।
আসফাক বলল, পড়ি গেইছ?
কমরুন হাসল। তার চোখদুটো, যাতে সুর্মার টান ছিল, ঝিকমিক করল। মুখটা গাঢ় রঙের দেখাল। আসফাক অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল এক মুহূর্ত। আর তখন ধনুকের ছিলার মতো উঠে পড়ল কমরুন। হাসল। দৌড়ে পালাল। আসফাক তার গোড়ালির কাছে রুপোর বেঁকি মলের ঝলকানি দেখতে পেল। হয়, হয়, ঠিক-এ তো, তখন আসফাক এক সুগন্ধ পেয়েছিল, যে সুগন্ধ আজ ছোটবিবির গামছায়।
কমরুনের তেমন করা ভালো হয়নি। বিশেষ যখন জাফরুল্লা বিদেশে। তা ছাড়া সেখানে আর কেউ ছিল না। সেই বাতাসের মতোই আসফাকের রক্তে কী একটা চঞ্চলতা দেখা দিয়েছিল। তাতে যেন দম বন্ধ হয়ে যায়। তার চাপে কী হয়? সব নিষেধ সব বাধা ভেঙে মানুষকে একটা দিশেহারা শক্তিতে পরিণত করে। কিংবা কেউ যেন দারুণভাবে টানে, সেই টান আর বাধার টানে দম ফেটে যায়। চোখের সম্মুখে অন্ধকার হয়ে যায় আর সে অন্ধকার যেন রক্তের মধ্যে উথাল-পাথাল করে। হের জল যেমন লাফাচ্ছিল তখন।
একমুহূর্ত অবাক হয়ে গিয়েছিল আসফাক। আশ্চর্য, এই সুগন্ধটা কিন্তু সেদিন ধরতে পারেনি আসফাক। হ্যাঁ, এরকম অবাক সে আগেও হয়েছে। তখনই কি বলেছিল কথাটা কমরুন, নাকি সেদিনই রাতে, আবার দেখা হলে? কমরুন বলেছিল : আ আসফাক, ব্যাপারির এক গাবতান ভৈষী ধরি না পলান কেনে? এ তো বোঝাই যাচ্ছে, সেটা বর্তমানের অনুরোধ ছিল না। তারও চার বছর আগে আসফাক যা করতে পারেনি, সেজন্য অনুযোগ। কমরুন জাফরুল্লার বিবি হওয়ার আগে আসফাক খেত-নিড়ানো শেষ করার পর মোষ চরাত তখন। তখন যদি সে সেই সুযোগে একটা গাবতান ভৈষী নিয়ে পালাতে পারত, তাহলে হয়তো সে আর কমরুন হারানো দলটাকে খুঁজে বার করার জন্য আবার বনের পথে চলে যেতে পারত। নতুবা সেই গর্ভবতী ভৈষীর সাহায্যে নিজেরাই একটা দল তৈরি করে নিতে পারত।
.
ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে গেল। নিজের চিন্তায় সে এত দূরে চলে গিয়েছিল যে বাইরে মন দিতেই তার মনে হল, একটা কালো পাখি যেন তার মাথা ছুঁয়ে নেমে এল দুই ডানা নেড়ে। কমরুনের সেই বুড়ি মোযটার দিকে যেমন শকুন নেমেছিল।
সে চমকে উঠল। গা শিরশির করে উঠল। হাতের সেই তাগা চোখে পড়ল না। হাতড়িয়ে দেখল আছে কিনা। সে যেন অন্ধকারের মধ্যে হেসে উঠবে নিজের এই ভয় লক্ষ করে। কিন্তু হঠাৎ তার একটা সন্দেহ হল, ওরা কি সকলে ভুল বলছে? তেমন একটা ব্যাপার হয়নি সেই ঘাসবনে? তার কি মনে আছে, কেন তেমন হয়েছিল?
চাকররা সারাদিন কাজ করে, সন্ধ্যা লাগতে লাগতেই তাদের খেতে দেয়ার নিয়ম। তারা খেয়ে যার যার বাড়িতে যাবে। আজও কিছুক্ষণের মধ্যে ছমির এসে খেতে ডাকল আসফাককে। কিন্তু সে নিজে এখানে খাবে না। খাবার নিয়ে বাড়ি যাবে। সে কথাটাই আবার মনে করিয়ে দিল।
ছোটবিবি এবেলাতে খাবার ঘরের মালিক। কথা সে ছমিরদের কারো সঙ্গেই বলে না। আসফাক আর তার মতো যারা, তারা বারান্দায় উঠে বসতেই নুরী এসে ভাত দিয়ে যেতে লাগল সানকি করে। তা চাকর-রাখাল ধরে সাত-আটজন হবে। ছোটবিবি কখনো সামনে আসে না এ সময়ে। নুরী তদবির করছে আজ।
খাওয়া যখন মাঝামাঝি হঠাৎ দমদম পা ফেলে রসুইঘরে এল মেজবিবি। তার পায়ের মল ঝমঝম করে বাজল। ভারি শরীর, ভারি পায়ের চাল। তা, আসফাকরা জানে দুকুড়ি বয়স হল তার। তার ভাব দেখেই বোঝা যায়, এবার কিছু হবে। চাকররাও এ-ওর দিকে চেয়ে চোখ টিপল! মাঝে মাঝে হয়! ঘরের মধ্যে কথাগুলো চাপা গলায় হচ্ছে, কিন্তু অন্যদিনের মতো বাইরে থেকেও কানে যাচ্ছে। ছোটবিবির দিকে মেজবিবি যদি তেমন করে ছুটে আসে, বুঝতে হবে ঝগড়া হবেই। এ ঝগড়ায় কেই বা দৃকপাত করে এখন? আসফাকের কিন্তু কানে গেল কথাগুলো। আর তখন তার অনুভব হল, সবই ঠিক আগের মতোই। মাঝখানে তার ওষুধ আনতে দেরি করে ফেলার ব্যাপারটা, আর তাও এর মধ্যে লোকে ভুলে যেতে শুরু করেছে। অন্তত এখন খেতে বসে সে বিষয়ে একটা কথাও কেউ বলছে না।
অন্ধকারে পা ছড়িয়ে বসল আসফাক। সব চাকরই বাড়ি চলে গিয়েছে। রাখাল-ছোকরা কজন আজ দ্বারিঘরের বারান্দায় ঘুমাবে। আসফাক আরাম করে বসে ছিলিম ধরাল আবার। সবই, ঠিক দেখো, আগেকার মতো। মাঝখানে হাকিম সাহেবের পাগলামি। কী? না, মানুষের দুঃখ দেখতে এসেছে। জমিজিরাত, হাজিরা নিয়ে কোনো অন্যায় নাকি থাকবে না। সব অন্যায়, সব অন্যায় নাকি দূর করবে!