তারপর বিশ্রামের সময়।
তখন আসফাক বোকার মতো বলেছিল, এখানে চিরজীবন থাকলে চলে কিনা। কমরুন মাথা কঁকিয়ে বলেছিল, দুজনে দল হয় না, আসফাক। আসফাক, তার পক্ষে যতদূর তা সম্ভব, তেমন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছিল, কমরুনের অনেক বাচ্চা হলে দলটা ক্রমশ বাড়বে। তখন কমরুন বলেছিল, তা হলেও মোষ কোথায়? এই বুড়ি মোষের আর বাচ্চা হবে না। কী বিক্রী করবে যে কাপড় শাড়ি কিনবে, চাল, নুন, আটা কিনবে? তুমি কি বনের মোষ ধরতে জানো? তাদের দলের কর্তা যেমন মোষের ডাক ডেকে বনে-চরা অন্যের বাথানের মোষকে বিপথে টেনে নিয়ে ধরে ফেলে, তাই কি আসফাক পারে? না, এসব কিছুই সম্ভব নয়। আসফাক কি দু-তিনটে ভাষায় কথা বলতে পারে যে, দলকে শোনপুরের মেলায় নিয়ে যাবে, আসফাক কি পুলিশের হাতে ধরা না পড়ে দল নিয়ে রাতের অন্ধকারে ভাগতে পারে? আসফাক সেসবের পক্ষে একেবারেই বাচ্চা, কমরুনের চাইতেও ছ-সাত সালের ছোট। আসফাক নিজের অযোগ্যতার এই তালিকা শুনে মলিনমুখে বনের দিকে চেয়ে বসেছিল। কমরুন শুকনো নরম সবুজ ঘাসে শুয়ে একটু হেসে আসফাককে নিজের স্তনে টেনে নিয়েছিল।
কমরুনই বা কী করবে? দলের সন্ধান পাওয়া গেলে আসফাক তার সঙ্গে থাকত কিনা ভেবে লাভ নেই। হয়তো থাকত।
এদিকে বনের ক্ষণস্থায়ী বসন্ত শেষ হয়ে প্রবল বর্ষা নেমে গেল। ঐ বর্ষা বাউদিয়ার কাছে ভয়ের ব্যাপার। তাঁবু খাটানোর মতো শুকনো মাটি পাওয়া যায় না। খাটালেও তাঁবুতে জল মানে না। পাখিরা পালায়। তিন-চারদিন চলে যায় একটা শিকার ধরতে। নদী ঝোরা ফেঁপে ফুলে প্রতি পদে পথ আটকায়। সে জলে মাছ ধরাও যায় না। বরং সে জল পেটে গেলে সেই ভয়ঙ্কর আমাশা ধরে যার ওষুধই হয় না। এই বন থেকে এখন উর্বশ্বাসে পালাতে হবে। গতবারের বর্ষার সময় বনের বাইরে এক রেল ইস্টিশনের পাশে বটতলায় তাঁবু ফেলে থেকেছিল বাউদিয়ারা। চারটে মোষ বিক্রি করে দলের খাওয়া-পরা চালিয়েছিল দলের কর্তা কান্টু বর্মন। ভাগ্যও কাজ করে। ভাগ্য না হলে আসফাকই কি কমরুনের দেখা পেত? কমরুনের মতে যোগাযোগ অবিরত ঘটছে, তুমি সেটাকে কাজে লাগাবে কি না লাগাবে, সেটা তোমার বুদ্ধি।
মোষের নতুন গোবর দেখে এদিকে একদল মোষ গিয়েছে, এই আশা নিয়ে তারা যেদিকে রওয়ানা হয়েছিল, সেটা যে মহিষকুড়ার পথ তা তারা জানত না। মহিষকুড়া বলে যে একটা গ্রাম থাকতে পারে, তাই বা জানবে কী করে? অন্য একটা ব্যাপারও ঘটল। মোষটা যে বুড়ি তা কমরুনের কাছেই শুনেছিল আসফাক। তার চোখের একটা মণিও সাদা হয়ে গিয়েছিল বয়সের জন্য। ইদানীং সারা গায়ের হাড় চোখে পড়ত। বোধহয় সব দাঁত ক্ষয়ে যাওয়ায় নরম ঘাস ছাড়া কিছু খেতে পারত না। কিন্তু সে যে এমন বার্ধক্য তা বোঝা যায়নি। একদিন সেটা কাদার মধ্যে বসে পড়ল। দেখো, মোষ বলে কথা, একহাঁটু কাদাতেই আটকে গেল। দুদিন ধরে মোষের তদবির চলল। গাছ-গাছড়ার দাওয়াই কমরুন যা জানত, সব প্রয়োগ করা হল। কিন্তু তৃতীয় দিনের সকালে দেখা গেল শেয়াল খেতে আরম্ভ করেছে।
.
সেই কমরুন এখন জাফরুল্লার চার নম্বর বিবি। তা বুদ্ধি আছে জাফরুল্লার। এখানে আসার মাসখানেক পর থেকেই ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল। যদিও আসফাক তখন তা ধরতে পারেনি। কবেই বা সে ঠিক সময়ে ধরতে পারে? তখন সে একবেলা খাওয়া আর দিন একটাকা কিংবা একসের চালের বদলে ঘাস নিড়াচ্ছে জাফরের জমিতে। কমরুনও কাজ করে জাফরুল্লার অন্দরে। দুবেলা নাকি পেটপুরে খায়। আর ইতিমধ্যে দুখানা আধা-পুরনো শাড়িও পেয়েছে। তা, ভাবল আসফাক, জাফরুল্লার হাসি নাকি কমরুনের দলের সেই কর্তা কান্টু বর্মনের মতো। তেমন করেই প্রায় কামিয়ে ফেলা হেঁড়ে মাথা। কমরুনই বলেছিল একদিন, মহিষকুড়ার বাইরে তখনো সে তাঁবুটাতে আসফাকের পাশে শুয়ে। হঠাৎ এক সন্ধ্যা থেকে কমরুন আর এল না। তারপর সেই দারুণ বর্ষায়, জাফরুল্লা চুপচাপ নিকা করেছিল কমরুনকে। জাফরুল্লার চার নম্বর বিবি। তার একমাত্র উত্তরাধিকারীর মা।
কিন্তু, আসফাক নিজের অবস্থিতিটা বুঝবার জন্য এদিক ওদিক চাইল, কিন্তু পিছন দিকে জাফরুল্লার বাড়ি চোখে পড়ল। এখান থেকে পশ্চিম দিকে সেই পিঠুলিগাছ, আর তার কিছু দূরে ঝোরা। সেখানে আকাশ এখন লাল হয়ে উঠছে। চোখ মিটমিট করল সে। যেন দেখতে চায় না। আসফাককে এখন কেউ দেখলে বলত, লোকটা হাঁপাচ্ছে। চোয়ালটা অবশ হয়ে গিয়েছে নাকি? মুখটা হাঁ করা। সেবার, সেই তিন মাস আগে, জাফরুল্লা যখন বাড়ি ছিল না কিন্তু তফাত আছে…সেই সেবার যখন জাফরুল্লাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
.
তখন একদিন বলদ আনতে গিয়েছিল আসফাক দহের ধারে। যখন সে বলদগুলোকে খোঁটা উপড়ে ছেড়ে দিয়েছে, কেউ যেন মৃদুস্বরে ডেকেছিল, আসফাক, ও আসফাক। বাতাসটায় জোর ছিল, শব্দটা ঠিক এল না। এরকম সময়েই, তখন বোধহয় দিন বড় ছিল। সেজন্য আলোটা একটু কম লাল। কিন্তু রোদ পড়ে গিয়েছিল। একবার সে মাথা তুলে শুনতে পেল, কে যেন কুই করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। বাতাসটা আরো জোরে উঠে পড়েছিল। পথের পাশে বড় বড় ঘাস। সেগুলো বাতাসের তোড়ে ছপছপ করে গায়ে লাগছে। আসফাক পশ্চিম আকাশের দিকে তাকাল। পাক-খাওয়া এই ঝোড়ো বাতাস শেষ পর্যন্ত ঝড় হয়ে উঠবে কিনা তা বোঝার চেষ্টা করল। এমন সময়ে বাতাসে ভেসে আসা কী একটা তার গায়ে পড়ল। সেটা গড়িয়ে পায়ের কাছে পড়লে আসফাক দেখল টোপাকুল। সে বিস্মিত হল। এদিকে টোপাকুলের গাছ কোথায়? দহের ওপারে একটা আছে বটে। ওপারের টোপাকুল এপারে এসে পড়বে এত জোর বাতাসে? কাজেই সে ওপারের দিকে তাকাল। আর তখন সে দেখতে পেল, দহের গলার কাছে যে সাঁকো তার উপরে সাঁকোটা অর্ধেক পার হয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে কমরুন। বাতাসে তার চুল উড়ছে, মাথার কাপড় খসে গিয়েছে। পায়ের কাছে এলোমেলো কাপড়ের ঢেউ ওঠানামা করছে। আঁচলে টোপাকুল! আঁচল সামলে, শাড়ি সামলে সে আর এগোতে পারছে না। নীচের দহের জল আথাল-পাথাল।