বিস্ময়ের মতো শোনালেও জন্মদরিদ্র আসফাক সেই প্রথম এক রত্ন দেখেছিল। নীলাভ বেগুনি রঙের মতো মেঘ-মেঘ পাহাড়ের কোলে সবুজ মেঘ-মেঘ বনের মাথা। বাদামি রঙের সমান্তরাল সরলরেখার মতো গাছের গুঁড়ি, তার কোলে হালকা নীল নদীর জল। সেই নদী যেখানে সবুজে-নীলে মিশানো, কখনো বা মোষ-রঙের পাথরের আড়ালে বাঁক নিয়েছে, সেখানে সকালের চকচকে আলোয় নিরাবরণ এক বাঁকে ভরা জলে চকচকে মেয়েমানুষের শরীর। তা এখন শাড়িতে ঢাকা আছে বটে। কিন্তু কী এক সর্বগ্রাসী মাধুর্য কমরুনের মুখে, তার কপালে, একটু খোলা ঠোঁটদুটিতে, নীল মীনা-করা পিতলের নাকফুলে, আধবোজা চোখদুটিতে, যার কোণে হাসি জড়ানো মনে হয়। কেমন যেন অদ্ভুত শক্তিশালী টানে টানতে থাকে মানুষকে! আসফাক এখনো ভেবে পায় না কী করে তেমন সাহস হয়েছিল তার সেই দুপুরে!
কমরুন তাকে চড়-থাপ্পড় কিছু মেরে থাকবে। কিন্তু সেই প্রথম আসফাক, তার সেই রোগা রোগা আঠারো-উনিশ বছরের বুকে, দারুণ সাহস আর শক্তি পেয়েছিল। তাঁবুর দরজার কাছে বসে, তার একটা চোখে তখন সে কম দেখছে, নাক দিয়ে কিছু গড়াচ্ছে ভেবে হাত দিয়ে দেখেছিল রক্ত। কিন্তু তখন তার যে ভয় হয়েছিল তা এই যে-সে কমরুনকে মেরে ফেলেনি তো?
কিছু পরে কেউ তার নাম ধরে ডাকছে শুনে, সে অবাক হয়েছিল। কমরুন বলেছিল, পানি ধরো, মুখ ধও, নাকৎ অক্ত দেখং। তখন আসফাকের মনে হয়েছিল, কমরুন মিটমিট করে হাসছে। না ঠোঁটে নয়, চোখের মধ্যে হাসি।
এরপর মোষের পিঠে তাঁবু চড়িয়ে কমরুন একদিন হাঁটতে শুরু করেছিল। পিছন পিছন আসফাক। দু-তিন দিনে দলটা বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে। কমরুন জানত, সাধারণভাবে উত্তর-পশ্চিম দিকে যাবে দলটা।
দলকে পাওয়া সহজ নয়। সেই গহন বনের মধ্যে তারা কোথায় গিয়েছে মোষগুলো তাড়াতে তাড়াতে, কে বলে দিতে পারে? বিশেষ করে যে দলের কোনো গন্তব্যস্থল নেই, জন্ম থেকে মৃত্যু যারা কেবল চলেই বেড়ায়। আসাম বলে নাকি এক দেশ আছে। তার উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে বছরখানেক আগে রওনা হয়েছে। পাহাড় আর তার কোলঘেঁষা বনের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে হয়তো চেনা পৃথিবীর শেষপ্রান্ত পর্যন্ত এরা চলে যাবে। বন থাকলেই হল। সন্ধ্যায় যেখানে মানুষের চোখে পড়ে না, এমন জায়গায় তাঁবু ফেলে সারাদিনের সংগ্রহ আগুনে ঝলসে খেয়ে রাত কাটত আসফাক আর কমরুনের। সকালে তাঁবু গুটিয়ে মোষের পিঠে তুলে দিয়ে হাঁটা, আর হাঁটতে হাঁটতে চারিদিকে চোখ রাখা, বনমোরগ, তিতির, ডাহুক, বক, মেটে আলু, চই, চ্যাং, শাটি, কুচলা, গজার সংগ্রহ করার দিকে। মেটেআলুর লতা দেখে আসফাক একবার প্রায় দশসের আলু সংগ্রহ করেছিল। কিন্তু ঝালের জন্য চই খুঁজে বার করতে কমরুনই পেরেছিল। কমরুন শুধু বয়সে বড় নয় (কমরুনের তখন এককুড়ি পাঁচ-ছয়, আর আসফাকের এককুড়ি হয়নি), অনেক বিষয়েই আসফাকের তুলনায় অভিজ্ঞ। পাখি শিকার, সেই মাংসকে খাদ্যে পরিণত করা, এমনকী লোহা আর পাথর ঠুকে আগুন জ্বালানো, মাছমাংস না পুড়িয়ে তাকে সুস্বাদু করা সেই আগুনে, কলাগাছের ডোঙা পুড়িয়ে ছাই তৈরি করে নুনের অভাব, আর চই দিয়ে ঝালের অভাব পূরণ–সব বুদ্ধিই কমরুনের।
একদিন আসফাক জিজ্ঞাসা করেছিল, বনে তারা ভাত, রুটি এসব খায় কিনা, খেলে কোথায় পায়। তা থেকে সে এই দলটার জীবনযাত্রার পদ্ধতি আরো খানিকটা জানতে পেরেছিল। এরা লুকিয়ে-চুরিয়ে বন থেকে মধু সংগ্রহ করে, বছরে কোনো কোনো সময়ে এদের মোষ এত দুধ দেয় যে তখন তা থেকে মাখন তৈরি করে, ধনেশ পাখি পেলে তার চর্বি সংগ্রহ করে রাখে, বনে অনেক সময় হরিতকি, বহেড়া ইত্যাদি ফল সংগ্রহ করে, প্রতি বছরই কয়েকটা করে মোষের। বাচ্চা বিক্রি করে–এসবে টাকা হয়, সেই টাকা থেকে চাল, আটা, কাপড় কেনা হয়। এসব ব্যাপারে দলের যে কর্তা সেই সর্বেসর্বা। তার কথা সকলকেই মেনে চলতে হয়। কারণ সে দলের ইতিহাস জানে, পশ্চিমাভাষায় কথা বলতে পারে, অসম্ভব সাহস তার, সে কখনো ঠকে না, বরং বনের কোলঘেঁষা কোন গ্রামের হাটে কী বিক্রি করা যাবে, কী কেনা যাবে তা যেমন জানে, তেমন জানে কোন অসুখে কোন লতা-পাতা লাগে। সে শুধু বসন্তের ওষুধ জানে না। হ্যাঁ, তাকে দলের স্বার্থে নির্দয় হতে হয়। যাকে বসন্ত ধরে ফেলেছে, তাকে তার মুখেই ছেড়ে দেওয়া উচিত। এ তো বাঘ নয় যে মোষ সাজিয়ে, আগুন জ্বালিয়ে, হাঁড়ি-হাঁড়া পিটিয়ে চিৎকার করে মোষের বাচ্চাকে বাঁচানো যাবে।
তখন বনের পথে চলা মাসদুয়েক হয়ে গিয়েছে। শীতটা পড়ে যেতে শুরু করেছে। বনে ঘাসের মধ্যে ফুল ফুটতে শুরু করেছে। কোনো কোনো গাছে নতুন পাতা, কোনো কোনো গাছে ফুলের কুঁড়ি। বনে পাখির সাড়া বেশি পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় শুকিয়ে ওঠা এক ছোট ঝোরার কাছাকাছি অপেক্ষাকৃত শুকনো জায়গায় তাঁবু খাঁটিয়েছৈ কমরুন। এখন এ কাজে আসফাক তাকে সাহায্য করতে শিখেছে। সেদিন মোষটাকে তাঁবুর কাছাকাছি বেঁধে রেখে মাছের খোঁজে বেরিয়েছিল দুজনে। মাছ পাওয়ার আগে একটা মোটাসোটা তিতির পড়েছিল কমরুনের কাঠিতে। পরে ঝোরার কাদা খুঁচিয়ে দু-দুটো কুচলা মাছ। এত বড়, ধরার পরেও এমন কিলবিল করছিল তারা, যে মনে হবে ছোবল কাটতে পারে। তিতির রাতের জন্য থাকবে ঠিক করে, মাছদুটোকে পাকাতে বসেছিল কমরুন। ছুরির লম্বা টানে মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত চিরে, ভিতরের নাড়িভুঁড়ি ফেলে দিয়ে ঝোরার দিকে গেল কমরুন। জল দিয়ে না ধুয়ে বরং শুকনো শুকনো এঁটেল কাদা দিয়ে মাছদুটোকে এমন করে লেপে দিল, সে দুটো যেন মাটির তৈরি লতা। তারপর পাথরে লোহা ঠুকে শুকনো ঘাসে আগুন জ্বেলে সে দুটোকে আগুনে ফেলে দিয়েছিল। ঘণ্টাখানেক পরে আগুন নিবে গেলে, সে দুটোকে বার করে টোকা দিয়ে দিয়ে পোড়ামাটি ভেঙে ধোঁয়া-ওঠা গরম গোলাপি মাংস নতুন শালপাতায় রেখে কমরুন আসফাককে খেতে দিয়েছিল। সুস্বাদু সেই মাছ খাওয়া হলে তারা ঝোরায় গিয়েছিল জল খেতে। ঝোরায় না নেমে জলের উপরে ফুঁ দিয়ে ভেসে আসা পাতাটাতা সরিয়ে পশুর কায়দায় জল খেয়েছিল!