আর তা হয়তো যুক্তিযুক্তই। বনের কি চেতনা আছে যে তাকে সহৃদয় কিংবা হিংস্র বলা যাবে? সমুদ্র, হিমালয়, কালবৈশাখী, কাকেই বা সহৃদয় কিংবা হিংস্র বলি?
বনে ক্রীড়াশীল হরিণ-হরিণী যেমন আছে, তেমন, মুহূর্তে সে ক্রীড়াকে বিভীষিকায় পরিণত করে যে গ্রীবা কয়নের আদর আনত, তাকে তীক্ষ্ণ দাঁতে চিরে রক্তপান করে এমন বাঘও আছে, বাস-ট্রাকের শব্দে অপমানিত বোধ করে ডালপালা ভেঙে শুড় তুলে ছুটে চলা হাতির দল আছে, আগুনের গোলার মতো লাফিয়ে পড়া বাঘকে দ্বন্দ্বে আহ্বান করে রক্তচক্ষু মহিষরাজ তার কালো, ছড়ানো, প্রকাণ্ড শিংজোড়া মেলে দাঁড়িয়ে পড়েছে এমন হতে পারে, অযুত বিচিত্র চিত্র-দেহ পাখপাখালি আছে, তেমন আছে, বিষথলিযুক্ত ফণা তুলে খরিশ-গোখরো।কিন্তু সেই বাঘ, সেই হাতি, সেই মোষ, কিংবা সেই ফণী, এরাই কি কেউ হিংস্র?
বোধহয় তুলনাটাই বদলানো ভালো। অরণ্য সম্বন্ধে নানারকম কথা যে মনে হয়, যার কোনো একটাকেই যথার্থ যে মনে হয় না, তার কারণ বোধহয় এই যে, সে বরং অবচেতন মনের মতো। যেন করাতের কলের শান দেয়া ধার, ইলেকট্রিকের উজ্জ্বল তার, বাস-ট্রাকের দ্রুত গতিতে উচ্ছ্বসিত পিচ-সড়ক, এদিক ওদিক বনের গভীরে ডুবে থাকা গ্রাম, আর তাদের ঘিরে থাকা প্রাণীদের নিঃশব্দ, কখনো বা চাপা তর্জন-গর্জনযুক্ত পদসঞ্চারস্পন্দিত বন–এসব মিলে যেন একটাই মন, বন যে মনের অবচেতন অংশ। আর তা যদি হয়, তবে মহিষকুড়ার মতো গ্রামগুলি অস্ফুট আবেগের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে।
আমরা মহিষকুড়া গ্রামের কথাই বলছি, কিন্তু বনের কথা এসে গেল, কারণ বন থেকে এই সব গ্রামকে আলাদা করা যায় না।
এইসব গ্রামের নামের মধ্যে ছোট ছোট ইতিহাস লুকানো আছে মনে হয়। ভোটমারিতে নাকি স্থানীয় শাসকদের সঙ্গে ভুটিয়া দস্যুদের যুদ্ধ হয়েছিল। তুরুককাটায় নাকি মুঘলদের একটা ছোট বাহিনী ধ্বংস হয়েছিল। মহিষকুড়া নাকি প্রথমে বুনো মোষদের বিচরণস্থান ছিল, পরে বুনো মোষ ধরে যারা বিক্রি করে তাদের আড্ডা।
কুড়া ডোবা, জলা জমি এমনকী দহ হতে পারে, নদীখাতের গভীরতর অংশ। এ অঞ্চলের বড় নদীটা মহিষকুড়া গ্রাম থেকে এখন বেশ কিছু দূরে বনের আড়ালে। তখন মহিষকুড়া ছিল নদীর নাম। এখন সেই পুরনো খাতের চিহ্ন মহিষকুড়া গ্রামের প্রায় মাঝ-বরাবর ক্ষীণভাবে পরস্পর সংযুক্ত কয়েকটি ছোটবড় খাদ! এক দহের সঙ্গে অন্য দহের প্রণালী সংযোগের নাম ঝোরা। বর্ষার জলে ভরে ওঠে সেগুলি, অন্য সময়ে দু-একটি ছাড়া অন্যগুলি শুকিয়ে যায়। খুব ভারি বর্ষায় যখন কুড়াগুলোর মধ্যেকার সংযোগ বেয়েও জল চলে, আবার নদীর মতো দেখায়। নদী যখন বহতা ছিল, তখন এই নদীতে বারবার বুনো মোষের আড্ডা জমত। কিছু দূরে দূরে যেন নিজ-নিজ-চারণভূমির সীমার মধ্যে পঁচিশ-ত্রিশটি করে মোষের এক-একটি দল। কোনো কোনো দলে নাকি শতাধিক মোষও থাকত। শীত পড়লে নদীর জল শুকিয়ে উঠতে থাকলে এই মোষগুলি ধরতে একদল বেদিয়ার মতো মানুষ আসত এই অঞ্চলে। আমরা হাতি ধরার খেদার কথা জানি। সে কাজের বিপদ আন্দাজ করতে পারি। এই মোষ ধরার ব্যাপারও কম বিপজ্জনক ছিল না। মনে রাখতে হবে, দলবদ্ধ বুনো মোষকে বনের হিংস্র পশুরাও সমীহ করে চলে। জলের ধারে, আধডোবা চর ও ঘাসবনে এই বুনো মোষদের আড্ডা। এই বেদিয়াদের সেই আড্ডায় ঢুকতে হত। কখনো খোলা আকাশের নীচে, কখনো চরের উপরে বসানো খড়ের ছোট ছোট নড়বড়ে চালার তলে তাদের মূল ঘাঁটি বসত। এসব ঘাঁটি ক্রুদ্ধ ধাবমান মোষের ধাক্কায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত কখনো কখনো। শিঙের গুঁতোয়, পায়ের চাপে, প্রকাণ্ড শরীরের ধাক্কায় মানুষের মৃত্যুও ঘটত। সেই ঘাঁটি থেকে ছোট ছোট নৌকা নিয়ে জলে নেমে, মোষদের ভয় দেখিয়ে, দড়িদড়ার ফাঁদে দমিয়ে ধরে ফেলার মধ্যে কৌশল ও বুদ্ধি যতটা লাগত, সাহসও তার চাইতে কম লাগত না। ক্লেশ তো প্রতিপদেই, কখনো মৃত্যুও ঘটে যেত। শিঙের ধাক্কায় নৌকা উল্টে যেতে পারত, ফাঁদে ফেলা মোষের দলের মধ্যে জলে পড়ে গিয়ে মৃত্যুও ঘটেছে দু-একবার। লাভের লোভে যেমন, নিজেদের পৌরুষকে কাজে লাগানোর নেশায় তেমন, এই বেদিয়ারা এই বিপজ্জনক ব্যাপারে নিজেদের নিযুক্ত করত। মোষ ব্রার তোড়জোড় করা থেকে শুরু করে তাদের কিছুটা পোষ মানিয়ে বিক্রি করা পর্যন্ত তিন-চার মাস তারা কাটাত এই অঞ্চলে। তখন থেকে এর নাম হয়েছে মহিষকুড়া।
.
সেই মোষগুলি কিংবা সেই মানুষগুলি কোথায় গেল, কেউ জানে না। এখনো এ অঞ্চলে কিছু মোষ আছে, তবে তা কারো-না-কারো বাথানের, অথবা কারো-না-কারো গাড়ি টানে, লাঙলটানা মোষ। বাথানের মোষগুলোর চেহারা ভালো। সেগুলোর বেশির ভাগই দুধেলা মোষ। বাচ্চা, মাঝবয়সি মোষও থাকে কয়েকটি করে। কোনো কোনো বড় বাথানে একটি-দুটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ মোষও থাকে, যেমন মহিষকুড়ার জাফরুল্লা ব্যাপারির বাথানে। অধিকাংশ বাথানেই দুধেলা মোষের সংখ্যা চার-পাঁচটি। বাথানের মালিক অনেক সময়ে সে সব মোষ দিয়েও লাঙল চষায়। জাফরুল্লার বাথানে কিছুদিন আগেও ছোটবড় মাদি, মর্দা, বল-করা মিলে পঁচিশটা মোষ ছিল। তার মোষগুলোর চেহারাও ভালো। মোষগুলো সকাল থেকে সন্ধ্যা রিজার্ভ ফরেস্টের পাশে পাশে, অনেক সময় ফরেস্টের ভিতরে ঢুকে গিয়েও চরে বেড়ায়। মা আর বাচ্চাগুলো তো সারা বছরই। চাষের সময়ে বলদ-করা মোষগুলো চরে খেতে পায় না। আর সে সময়ে দুধ বন্ধ করেছে এমন গাবতান মানিগুলোকেও লাঙলে যেতে হয় দরকার হলে। অন্য সময়ে বলব-করা মোষগুলোও দুধেলা মোষগুলোর সঙ্গে বনে চরে। সউটিয়া বর্মন দুধ দুয়ে নেবার পরই তাদের ছেড়ে দেয় আজিজ আর সোভানের খবরদারিতে। মা মোদুটোই তাদের বাহন। যে দুটোকে বাগে রাখতে পারলে অন্য সবগুলো তাদের গলার ছোট ঘণ্টার শব্দ অনুসারে তাদের অনুসরণ করে। দশ-বারো বছরের সেই ছোকরাদুটো গভীর বনে ঢুকেও নির্ভয়। অনুমান হয়, তার অনেকখানি মোদুটোর আকৃতি ও চালচলন থেকে পাওয়া। বনের মধ্যে সে দুটির ব্যবহার যেন দলপতির মতো। যতক্ষণ গ্রামের মধ্যে বাথানে, একবারও ভাকে কি না সন্দেহ-বনের মধ্যে থেকে থেকেই আঁ-আঁ-ড় করে ডেকে ওঠে। সে ডাকে বলল মোষগুলো, মালি, বাচ্চাগুলো দূর দূর থেকে তাদের দিকে এগিয়ে আসে।