সে তাঁবুর অবস্থানে পৌঁছে দেখল কমরুন তাঁবু খুলছে। আসফাক এখন বুঝতে পারে, তখন কমরুনকে আগুনের কথা বলা, মাছপোড়ানোর কথা বলা খুব বোকামি হয়েছিল। কমরুন বলেছিল, মড়া ছোঁয়ার পর স্নান না করে কেউ খায় না। বিশেষ করে সেই বসন্তের মড়া। তারপর তাঁবুতে যা কিছু ছিল, বেত-বাঁশের দুটি চুপড়ি, সরু সরু বাঁশের কয়েকটা লাঠি, খানকয়েক শাড়ি, লুঙ্গি, এমনকী তাঁবুর কাপড়, তাঁবু খাটানোর বাঁশ সব না ধুয়ে বাউদিয়ারা খায় না। কমরুন খাবে না। তখনই আসফাক জেনেছিল, যাকে কবর দেয়া হল সে কমরুনের স্বামী। তার বসন্ত হয়েছিল। কমরুন গোপন রাখতে চেষ্টা করেছিল। কাল বিকেলে অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। সন্ধ্যায় জানাজানি হয়। তাদের দলের অন্য লোকেরা বলেছিল, কমরুন ইচ্ছা করলে তাঁবু আর মোষ নিয়ে তাদের সঙ্গে চলে যেতে পারে। এখানে থাকলে সকলে মরবে। তারপর আজ ভোর হতে না হতে সকলে চলে গিয়েছে। যে লোকটা মরছে তাকে ফেলে কমরুন কী করে যাবে? এখন সে দেখছে, তারা যাওয়ার সময়ে তার তাঁবুর মূল্যবান জিনিস কিছু কিছু নিয়ে গিয়েছে।
খাওয়াটা অত সহজ ব্যাপার নয়। সে মাছগুলো সেদিন খাওয়া হয়নি। কমরুন তার তাঁবুর সব কিছু নদীর জলের ধারে নিয়ে এক এক করে ধুতে শুরু করল। এককে আসফাককে বলল, তোমরাও গাও ধোয়া করেন।
আসফাকের মনে ততক্ষণে এই অজানা রোগের আতঙ্ক এসেছিল। সে ঝোরায় স্নান করতে নেমেছিল।
খাওয়ার ব্যাপারটা সোজা নয়। কমরুনই বরং কতগুলো সরু সরু বাঁশের টুকরো নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল সন্ধ্যার আগে। আসফাককে দূরে থাকতে বলে সে নদীর ধারে ধারে এগিয়ে গিয়েছিল। বক সাবধানী শিকারি কিন্তু বকের চাইতেও সাবধানী কমরুন, একটা বাঁশের টুকরোয় আর একটাকে লাগিয়ে সরু লম্বা একটা নল তৈরি করে তাই দিয়ে গাছের উপর বসা একটা বককে ঠুকে দিয়েছিল। সেই বকটাকে পুড়িয়ে খেয়েছিল কমরুন, আর আসফাককেও দিয়েছিল খেতে।
কমরুন বলেছিল, সে রাতটা নাকি খুব ভয়ের। তবু দেয়া হলেও তাঁবুতে থাকা যাবে না। কমরুন বনে কোথাও গিয়ে ঘুমাবে। আসফাকের অনেক দূরে কোথাও চলে যেতে বাধা কোথায়?
মৃত সম্বন্ধে একটা ভয় মানুষ মাত্রেরই আছে। আসফাক বনে ঢুকে দেখেছিল, মোষটা সারা দিন ধারেকাছের সব ঘাস খেয়ে ফেলেছে। সে সেটার দড়ি খুলে নিয়ে একটা ঝোপের পাশে বেঁধে দিল। সে জানত, এই ঝোপের পাতা খেতে মোষরা ভালোবাসে। সে মোষের কাছাকাছি শুয়ে পড়েছিল। বনে পোষা মোষ মস্ত সহায়। জন্তু-জানোয়ারের আসা-যাওয়া বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করতে পারে। সে ঘুমানোর আগে একবার ভেবেছিল কমরুনের কথা। মোটা কমরুনের। সে রাত কাটাতে কোথায় বা আশ্রয় পেল!
কমরুনের স্বামীকে কবর দেয়ার পরের দিন যা ঘটেছিল, তার মতো আশ্চর্য ব্যাপার আর কিছু নেই।
প্রথম ঘুমের পর আসফাক একবার উঠেছিল। অন্যদিন যেরকম হয় না, তেমন একটা ভয় ভয় করছিল। শালগাছের ফাঁক দিয়ে আবছা এক রকমের আলো। তাতে গাছপালার আকার বোঝা যায়, চেনা যায় না। সে দেখেছিল, মোষটা একটা ঝাকড়া গাছের তলায় কয়েক হাত দুরে শুয়ে আছে। সে উঠে গিয়ে মোষটার কাছাকাছি তার পিঠ ঘেঁষে শুয়েছিল। ভোর রাতে পাশ ফিরতে গিয়ে সে চমকে উঠেছিল। কিছুক্ষণ থেকেই তার ঘুমটা হালকা হয়ে এসেছিল। এতক্ষণ সে অনুভব করছিল, মোষের গা-ই তার গায়ে লাগছে। বুকের কাছে হাত দিয়ে চমকে উঠে বসল। কারণ তার হাতে যা লেগেছে, তা হয় মানুষের। মাথা কিংবা অন্য কোনো জন্তুর পশম-ঢাকা শরীর। সে ভোর ভোর আলোতে দেখতে পেয়েছিল, তার আর মোষটার পিঠের মধ্যে যে হাতখানেক ফাঁক সেখানে শুয়ে ঘুমাচ্ছে কমরুন। তা, সেদিন কমরুনের ঘুম তখন খুবই গভীর ছিল বলতে হবে। আসফাকের চমকানি, ওঠাবসা, নড়াচড়া কিছু টের পেল না। শোক-তাপ, হয়তো কয়েকদিনের না-ঘুমানো, উদ্বেগের শান্তি, এসবই তাকে সেদিন নেশার মতো বিবশ করেছিল।
কিন্তু কী আশ্চর্য! ভোরে উঠে দেখল আসফাক, কোথায় বাইদানি, কোথায় তার মোষ! যে জায়গায় ভিজে তাঁবুটা বাঁশের আড়ে টাঙিয়ে দিয়েছিল শুকাতে, যে জায়গায় বকটাকে পুড়িয়েছিল, নদীর ধারের সেই উঁচু পারটায় দুই হাঁটুর উপরে হাত দিয়ে ঘের তৈরি করে তার মধ্যে আসফাকের মাথা গুঁজে বসে থাকাও তার তুলনায় কিছু আশ্চর্য নয়। খুব ভোর থাকতে উঠেই তা হলে কমরুন রওনা হয়ে গিয়েছে।
কী ভেবে আসফাক ঝোরার পার দিয়ে হেঁটে চলল। তাকে কি কমরুনকে খুঁজতে যাওয়া বলা চলে?
নদীর ধারে ধারে এক প্রহর চলে কমরুনের বাঁশের টুকরোটিকে দেখতে পেল আসফাক। তার পাশে দুটো ডাহুক দড়িতে বাঁধা। একটা তখনো নড়ছে। কিছু দূরে বনের ধারে পিঠের দুপাশে বোঝা-ঝোলানো মোষটাকেও দেখা গেল। সেটা গলা বাড়িয়ে ঘাস খেয়ে চলেছে। কিন্তু কমরুন কোথায়?
অবশেষে তাকে দেখা গেল। একটা বড় পাথরের আড়ালে শাড়ি পাথরে রেখে সে স্নান করছে। পাহাড়ি নদী, ঝোরা বলা চলে না আর। স্বচ্ছ জল, স্নানের উপযুক্তই বটে, নদীর আসল স্রোত নয়, বরং তিরতির করে স্রোত চলছে এমন একটা বাঁক, কিন্তু গভীরতা একহাঁটুর বেশি নয়। গলা পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে রাখবে কমরুন তার উপায় নেই।
কমরুন স্নান করে উঠে এসে আসফাককে দেখে হেসে ফেলেছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাহুকদুটোকে পুড়িয়ে খাওয়া হয়েছিল। কমরুন এতক্ষণ কী সেলাই করছিল। এখন শুয়ে পড়েছে তাঁবুর ছায়ায়। দুপুরে এখন আর কী কাজ?