এই তাঁবুর বস্তির কাছেই কমরুনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার। আর ক্ষুধাই তাকে বস্তির কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। চেয়ে-চিন্তে ভিক্ষা করে কিছু কি পাওয়া যাবে না?
ক্ষুধা সম্বন্ধে সে প্রায় সাত সাল ভুলে আছে, কিন্তু ক্ষুধা সম্বন্ধে জানতে তার বাকি নেই। খেতে যেসব ফসল থাকে, তার সব খাওয়া যায় না। ফলের খেত আর কয়টা? মানুষ শুধু ফল খেয়েও বাঁচে না। কঠিন অসুখ করে, আর তখন মনে হয় চুরি করে কাঁচা-কাঁচা শুটি আর ফল খাওয়ার পাপেই অসুখ। শহরে তৈরি করা খাবার পাওয়া যায়। কিন্তুক পাইসা লাগে। চেয়ে-চিন্তে খাওয়ার জায়গা সেটা নয়। তা হলে আর ই মাথায় উ মাথায় সড়কৎ মানুষ পড়ি থাকে কেনে?আর তা ছাড়া শহরের পথই তখন সে চিনত না। অন্য কথায়, হয়তো, হয়তো, শহরের পথ খুঁজতেই সে এই বনের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। বনে পাখপাখালি আছে, খরগোশ লাফারু থাকে। ঝোরায় মাছ থাকে। সে সব ধরতে পারলে খাওয়া যায়। কিন্তু আগুন লাগে, লোহা লাগে। লোহা ছাড়া পাখপাখালি ধরা যায় না। খাওয়ার উপযুক্ত করা যায় না। আগুন দিয়ে না ঝলসালে তা মুখেও তোলা যায় না। আর এখন তো সে জানে, সব খেত যেমন কারো না কারো, সব বনই তেমন কারো না কারো। ইচ্ছামতো তুমি বনের পাখপাখালিও ধরতে পারো না। লুকিয়ে চুরিয়ে মানুষের চোখ এড়িয়ে মাত্র তা করা যায়। আর তখন তার পিছন ফিরে আবার গ্রামের দিকে যাওয়ারও উপায় ছিল না। পথের ধারের অনেক খেত থেকেই সে ফুটি, শসা, ছোলা-মটরের শুটি চুরি করেছে। সে সব মাঠের ধারে তার পদচিহ্ন। এখন সে পদচিহ্নর রেখাকেই এড়িয়ে যেতে হবে।
সে সময়কার ক্ষুধার কথা ভাবলে শরীর আনচান করে। আর সেই মোরগের মতো টিপি খাবলানো হাকিমই এসব কথা তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে। সেবার যখন জাফর তিনমাস খামারে ছিল না, তখন কিন্তু বেশ একটা মোরগের মতোই ঝুঁটি ফুলিয়ে বেড়াত আসফাক।
ক্ষুধাই ফিরিয়ে এনেছিল তাকে সেই তাঁবুর বস্তির কাছে।
একটু চমকে উঠল আসফাক। আধরশি দূরে পথের ধারের ঝোপটার আড়াল থেকে প্রকাণ্ড শিংওয়ালা একটা প্রকাণ্ড মাথা বেরোচ্ছে। না, ওটা আর কিছু নয়। মোষ ফিরছে বাথানের দিকে। তার হিসাব মতে, সকলের আগে চাউটিয়ার গল্পের সেই মর্দা মোষটাই। আসফাক অনুভব করল, এবার তার ওঠা দরকার। রাখালরা বাথানে ঠিকঠাক সব কটাকে ঢোকাল কিনা তা দেখা দরকার। বলদগুলো বাঁধা আছে, সেগুলোকে ঘরে আনা দরকার। সেবার এসব ব্যাপারে সে উৎসাহিত ছিল। এবার—
সেই মোরগটা-ওটা কিন্তু জাফরুল্লার মতোই বরং। নতুন মুরগি দেখা মাত্ৰ-চার বিবি জাফরুল্লার। তিন বিবি তো ছিল, কিন্তু—
এসব ডিঙিয়ে তার মন আরো অনেক দূরে চলে গেল। যেন বনের মধ্যে যেখানে কালো আর লালচে আলো তার মধ্যেও তার চোখ আছে।
.
আসফাক লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছিল, তাঁবু খুলে নিয়ে লোকগুলো কোথাও যাওয়ার যোগাড় করছে। একটা করে তাঁবু ওঠে আর মোষের পিঠে তাঁবু আর অন্যান্য সরঞ্জাম চাপিয়ে দুজন তিনজন প্রাণীর একটা করে দল রওনা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব তাঁবু উঠে গেল, সব পরিবারই রওনা হয়ে গেল। আর তখনই সে দেখতে পেল, খানিকটা দূরে একটা মোষ তখনো বাঁধা। অন্য সব মোষ যেমন করে বাঁধা ছিল, একটা পা লম্বা দড়ি দিয়ে বাঁধা। আর একটা ঝোপের। আড়ালে অন্য তাঁবুগুলো যেখানে ছিল, তার থেকে কিছুদূরে একটা তাঁবু যেন, অন্য তাঁবুগুলোর মতোই পুরনো, খানিকটা ছেঁড়া-ছেঁড়া। আশ্চর্য, ভুলে গেল নাকি এটাকে নিতে?
ঝোপের আড়ালে আড়ালে চলে তাঁবুটার কাছাকাছি গিয়ে আসফাক চমকে উঠল। সেই তাঁবু ছিল কমরুন আর তার স্বামীর। স্বামীর বসন্ত। কিছুক্ষণ আগে তার মৃত্যু হয়েছে। এসব আসফাক পরে জেনেছিল। সে তখন দেখল, তাঁবুর নীচে মাটিতে একটা চটের বিছানায় এক পুরুষের মৃতদেহ, সারা গায়ে ঘা আর ফোস্কা। সে সময়ের কথা সব মনে আসে না। যেমন আসফাক মনে করতে পারে না, কেন সে না পালিয়ে কমরুনের কান্না শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। কিছু খেতে পাওয়ার আশা নিশ্চয়ই ছিল না। অনেকক্ষণ সে নিজের চিবুকে হাত দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়েছিল। কমরুন কাঁদতে কাঁদতে মুখ তুলে নাক ঝেড়ে আর একবার কাঁদতে শুরু করার আগে আসফাককে দেখতে পেল।
তারপর কবর দেয়া হয়েছিল কমরুনের স্বামীকে। একটা সুবিধা জুটে, গিয়েছিল। কাছেই একটা ঝোরা। বর্ষার শেষে নাতিগভীর সেই ঝোরাটার কাকর-পাথর মেশানো মাটির পার ঘেঁষে মাছ ধরার জন্য কেউ গর্ত করে থাকবে। সেই গর্তে তার চটের বিছানা সমেত মৃতদেহটাকে রেখে চারিদিক থেকে পাথরকুচি মিশানো বালি-মাটি আঁজলা আঁজলা তুলে এনে গর্তটাকে বুজিয়ে দেয়া হয়েছিল। এদিক ওদিক থেকে বড় বড় পাথর গড়িয়ে এনে আসফাক যখন সেই গর্তটার উপরে রাখছিল, তখন বালিতে আছড়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করেছিল আবার কমরুন। আসফাক কিছুক্ষণ সেদিকে চেয়ে থেকে সেই ঝোরার প্রায় শুকিয়ে আসা খাদে নেমে গিয়েছিল, কারণ গর্তটার সঙ্গে ঝোরার জলের সংযোগ আটকানো পাথরগুলোর একটাকে সরাতে গিয়ে সে যা দেখেছে, তা যদি সাপের মাথা না হয়ে থাকে তবে সেটা প্রকাণ্ড একটা চ্যাং মাছ। মাছের সন্ধানে প্রায় আধঘণ্টা কাটল আসফাকের। সেখানে তো ঝোরাটা একটা নদী হয়ে উঠেছে। নদীটার মাঝখানে জল। তাতে তেও আছে, কোথাও বড় বড় পাথরও, অন্য কোথাও পাথুরে মাটির চরা। সেই চরার কোনো কোনো জায়গা নীচু, সেখানে মাটি ভিজে ভিজে, জলও দু-এক আঙুল কোথাও। এইসব জায়গায় কুচকুচে কালো, সাপের মতো চেহারার কুচলা মাছ থাকে গর্ত করে। সারা গায়ে কাদা মেখে আধ-হাত পৌনে-একহাত কয়েকটা চ্যাং, গজার, একটা হাত-দেড়েক লম্বা কুচলা মাছ ধরে ঘণ্টাখানেক পরে আসফাক তাঁবুর দিকে ফিরল। তার একটা কথাই মনে ছিল, এখন আগুন দরকার। মাছগুলো রান্না করতে পারলে ভালো ছিল, আর তা না হলে অন্তত পোড়াতে তো হবে। আর আগুন এই মেয়েমানুষটার কাছে থাকতে পারে।