পিঠুলিগাছটার নীচে একটা পুরনো গোবরের স্তূপ। অনেকটা উঁচু। উপরটা শুকিয়ে কালো হয়ে গিয়েছে। ঢিপিটার পাশে একটা বড় মোরগ চরছে। প্রকাণ্ড কালচে খয়েরি রঙের, মাথার ঝুঁটি টকটকে লাল। আধা-ওড়া আধা-ছোটার ভঙ্গিতে সেটা ঢিপিটার উপরে লাফ দিয়ে উঠল। তারপর পাঁয়তারা করার ভঙ্গিতে, একবার ডান একবার বাঁ পা দিয়ে গোবরের শুকনো আবরণটাকে সরাতে লাগল। আর তখন আসফাক তার পায়ের বড় বড় নখগুলোও দেখতে পেল। পুরনো সার সরে যাওয়ায় উপরের স্তরের চাইতে নরম গোবর বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু ঠোঁট না নামিয়ে নিজের এই আবিষ্কারের গর্বে গলা ফুলিয়ে মোরগটা কক কক কক করে ডাকল। ঝপ করে একটা শব্দ হল। আসফাক দেখল, মোরগটার কাছে একটা মোটাসোটা, তার মতোই বড় সাদা মুরগি উড়ে এসে পড়ল। কিন্তু মোরগটা এক ধাক্কা দিয়ে সেটাকে সরিয়ে দিল। সেটা ঢিপির নীচু দিকে পা দিয়ে গোবরের স্তরটাকে খাবলাতে লাগল। মোরগটা তার সেই আবিষ্কারের জায়গার চারপাশে তার বড় বড় নখওয়ালা পা দিয়ে গোবরের শুকনো আবরণটাকে ভাঙতে লাগল। ঝুপ করে আর একটা শব্দ হল। আর একটা মুরগি এসে পড়ল। আর তা দেখে মোরগটা অত্যন্ত বিরক্ত হয়েই যেন তার গগাবরশৃঙ্গ থেকে নেমে পড়ল। যেন তার পুরুষোচিত পরিশ্রমের পথে এরা বাধাস্বরূপ। কিন্তু তা নয়। গোবর আড়াল থেকে আর একটি মুরগি আসছিল, সেটিকেই পছন্দ হল তার। সেটার দিকে তেড়ে গেল। আর…
আসফাক ঢিপিটার পাশ দিয়ে গেল। মোরগটা তাকে গ্রাহ্যও করল না। এখানে বোরাটা খানিকটা গভীর। একহাত জল হবে। আর তা বহতা এবং পরিষ্কারও। একটা ঠান্ডা ঠান্ডা জায়গা খুঁজে নিয়ে আসফাক বসে পড়ল তার জলপানের গামছা নিয়ে।
সে এবার খেতে শুরু করল। খানিকটা খেয়েই জলপিপাসা পেল তার। ঝোরার ধারে গিয়ে গোরুদের জল খাওয়ার ভঙ্গিতে জলে মুখ নামিয়ে জল খেল সে। আবার খেতে বসল সে। গামছাটার সুগন্ধ আবার নাকে গেল তার। হাতে বাঁধা কালো সুতোর তাগাটাও চোখে পড়ল। জল খেয়ে মুখটা সরস হয়েছিল। জলপান মুখে সুস্বাদু বোধ হল এবার। ক্ষুধাবোধটা জেগে উঠেছে।
ক্ষুধার তৃপ্তিতে মন যখন ডুবে যাচ্ছে, তখন সে ভাবল : তা হলে বিবিসাহেবরা মেনে নিয়েছে যে তাকে ভুলুয়াই ধরেছিল। আর তা হলে তা সকলকেই মেনে নিতে হবে। জাফরও মানবে।
সে খুঁতখুঁত করে হাসল। তারপর কথাটা তার মনে তৈরি হল। শোধবোধ। তা, ব্যাপারি তোমরা থাপ্পড় মারছেন, মুইও দেরি করছং। তোমরা মরেন নাই। তামাম শুধ।
গামছাটার চিড়ার অধিকাংশ শেষ করে, বাকিটুকু জলের উপরে ঢেলে দিল সে। হালকা চিড়াগুলো ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে কিছুদূর, জলে ভারি হয়ে তলিয়ে যাওয়ার আগে। তা, এই সুগন্ধ চিড়াও সকলের জন্য নয়। কমরুনবিবির নিজের ঘরে ছিল। বিবিসাহেবানদের জন্য তৈরি হয়। খুব তৃপ্তি করে জল খেল আসফাক ঝোরার জলে ঠোঁট লাগিয়ে। তারপর সে জলে পা নামাল। পা দুখানা ভালো করে ধুল। অনেক জায়গায় কাটা-ছড়ার দাগ। দু-এক জায়গায় বাদামি বাদামি কাদা সরে যাওয়াতে রক্তের চিহ্ন বেরিয়ে পড়ল। জল লেগে জ্বালা ধরল। এ সেই ঘাসবনে ছোটার চিহ্ন। ধক করে উঠল আসফাকের বুক। সত্যই সেটা ভুলুয়া না কি?
জলে হাতমুখ ধুয়ে নতুন পাওয়া গামছায় মুছে, সে এবার বেশ স্পষ্ট করেই বলল, মুই ওষুধ আনং নাই। তোমরাও মরেন নাই। তামাম শুধ। সে আপন মনে খুঁতখুঁত করে হাসল।
এখন বেশ ভালোই লাগছে। সেই আধভিজে ঠান্ডা ঠান্ডা সুগন্ধ গামছাটা গায়ে জড়িয়ে সে আবার অনির্দিষ্টভাবে হাঁটতে শুরু করল। সুগন্ধ গামছাটার স্পর্শ কেন যেন ছোটবিবির কথা মনে এনে দিল। সুগন্ধ ধারালো এক পরীর মতো ছোটবিবি। আর এ যেন তারই গায়ের গন্ধ।
চমকে উঠে গামছাটাকে গা থেকে খুলল আসফাক। না, না, এ গামছা তো ফেরত দিতে হবে।
কয়েক পা যেতে না যেতেই থমকে দাঁড়াল আসফাক। বেলা ডুবে যাচ্ছে। রং বদলাচ্ছে চারিদিকে। বনের দিকে গাছের ফাঁকে ফাঁকে আলো কমে আসছে। এতক্ষণ যেন সে জ্বরের ঘোরে ছিল, এখন জ্বরটা ছাড়ছে–সেজন্য ক্লান্ত বোধ হচ্ছে এখন। না খেয়ে না ঘুমিয়ে শরীরটা টানটান ছিল, এখন ভেঙে আসছে আর তাতেই যেন আরো খারাপ বোধ হল।
এখন সে কোথায় যাবে? দ্বারিঘরে গিয়ে বসবে, না বলদগুলোকে ঘরে তুলবে? এখন তো তার অনেক কাজ। দেখতে হবে চাউটিয়া এল কিনা, রাখালগুলো মোষ নিয়ে ফিরছে কিনা। সেসব কাজ দেখাশোনা শেষ হলে অন্দরে খোঁজখবর নিতে শুরু করবে। বাড়িতে আজ জাফর নেই। ছমিরও থাকবে না। একাই তাকে সবদিকে চোখ রেখে ঘুরতে হবে।
.
সেবার আর এবারে তফাত আছে। তার মনের উপরে যে শক্ত স্তরটা জমেছিল, হাকিম সেটাকে খাবলে ঘা করে দিয়েছে ওই মোরগটার মতো। নীচের নরম কিছু বেরিয়ে পড়েছে।
মুই অষুধ আনং নাই, তোমরা নাই মরেন। কিংবা এ ওষুধটা কি তেমন নয় যার অভাবে মানুষ মরে? ধক করে উঠল আসফাকের বুকের মধ্যে। এ ওষুধ। কি শুধু বিবিদের ঘরে যেতে লাগে? কিন্তুক মোর দেরিটা থাকি গেইল!
এখন সবই উদাস হয়ে মেনে নিতে হবে, যেন গাড়ি টেনে টেনে চলা।
.
অনেকদিন আগেকার কথা। তা, সাত সাল হবে। চালার নীচের লুকানো জায়গা থেকে নেমেই আসফাক হাঁটতে শুরু করেছিল। অবশেষে এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছিল, যেখানে উত্তর আকাশের গায়ে নীল মেঘের মতো পাহাড় সব সময়েই চোখে পড়ে। শালের জঙ্গল। তারপর কৃষকদের ঘরবাড়ি, জোতজমা। হলুদ ফসল। তারপর আবার সবুজ বন। এমন করে বন আর কৃষকের জমি পর পর। সাধারণত মানুষ দিনে হাঁটে, রাত্রিতে বিশ্রাম করে। আসফাক তখন উলটোটা করছিল। চতুর্থ দিনের সন্ধ্যায় ব্যাপারটা অন্য রকম হল। আগের সন্ধ্যায় পথের ধারের একটা জমি থেকে গোটা দুয়েক শশা চুরি করেছিল সে। কিন্তু আজ কী হবে, এই ভাবনা নিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ সে থমকে দাঁড়িয়েছিল। একটা ছোট শালবন তার সামনে, সেটাকে পার হতে হবে। যদি তার ওপারে কোনো খেতে শশা বা ফুটি থাকে। এদিকের খেতে সরষে। কোথাও এতটুকু ছোলা-মটরের চাষ নেই যে তা খেয়ে বাঁচা যাবে। থমকে দাঁড়াল সে। অদ্ভুত দৃশ্য তার সম্মুখে। জঙ্গলের মধ্যে নীল-নীল আলো। আরো দূরে দপদপ করে মেটে-মেটে আলো জ্বলছে। তার কাছাকাছি সাদা-সাদা কী যেন সব। ভয় আর কৌতূহলের টানে আরো দু-এক পা এগিয়ে গিয়েছিল আসফাক আর তখন সে আবিষ্কার করেছিল, বনের অন্ধকার হয়ে আসা গাছের ফাঁকগুলোতে আট-দশটা মোষ চরছে। কাছের আলোগুলো মোষের চোখ। আর সেগুলোর পিছনেই পাঁচ-সাতটা তাঁবু। হাত-তিনেক উঁচু একটা করে বাঁশের আড়ের উপর দিয়ে একটা করে কাপড় দুদিকে নামিয়ে এনে চারটে খোঁটায় কাপড়ের চারকোণ বাঁধা। সেই তাঁবুর মধ্যে পুরুষ-মেয়ে-শিশু। আগুন জ্বালিয়ে রান্না হচ্ছে। এক জায়গায় সকলে এক সঙ্গে কথা বলছে, যেন ঝগড়া লেগেছে। কিংবা ভয় পেয়েছে। তার একবার মনে হয়েছিল, ওখানে গেলে কি কিছু খেতে পাওয়া যায়? যেন দূর থেকেই খাবারের সুগন্ধ আসছে। হ্যাঁ, নিছক খাদ্যেরই একটা সুগন্ধ আছে, তা পোড়া-পোড়া ময়দার তাল হোক কিংবা আধফোঁটা আধপোড়া ভিজে চাল হোক। কিন্তু যারা নিজেরাই রেগে আছে কিংবা ভয় পেয়েছে, তারা উটকো অপরিচিত লোককে খেতে দেয় না। আর অত যেখানে উত্তেজনা, সেখানে যাওয়াও যায় না। তখন বর্ষা-বাদল ছিল না। বনের মধ্যে ঢুকে একটা গাছতলায় শুয়ে পড়েছিল আসফাক।