প্রথমে এল মেজবিবি প্রায় ছুটতে ছুটতে। তা বছর চল্লিশ বয়স হবে তার। মোটাসোটা হাসিখুশি মানুষ। কিছু বলার আগেই সে খিলখিল করে হাসল। হাসি থামলে বলল, ত্যা আসফাক, ভুলুয়ার শিং কেমন ছিল? তাক দেখছ?
হাসির শব্দে আর জোরে জোরে বলা কথার শব্দে পায়ের মলের শব্দ তুলে ছোটবিবি, আর তারপর বড়বিবির পাশের ঘর থেকে ধীরে সুস্থে কমরুনবিবিও বেরিয়ে এল।
ছোটবিবির বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ হবে, যদিও জাফরুল্লার বয়স তিনকুড়ির উপরে। ছোটবিবি সব সময়েই ফিটফাট থাকে। এখনো তার পরনে আসমানি নীল শাড়ি। আর চোখে সুর্মা। আর তার হাঁটা চলা দাঁড়ানোর কায়দায় তার রঙিন কামিজ চোখে পড়বেই অল্প অল্প। কমরুনবিবির বয়স বরং বেশি যদিও সে শেষ নিকা। ছোটবিবি যদি দশ-বারো বছর আগে এসে থাকে, কমরুনবিবির সবে সাত সাল চলছে। তা কমরুনবিবির বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হবে, ভারভরন্ত শরীর।
ছোটবিবি বলল, তা দেখং, আসফাক, তোমার চোখুও লাল। ভুলুয়ার চোখু লাল থাকে, সাত্তার কইছে।
আসফাক কিছু না বলে তার উশকোখুশকো মাথাটা ঝকাল। এতক্ষণে সে অনুভব করল, তার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। তাকে মাথা ঝাঁকাতে দেখে ছোটবিবি শিউরে উঠে দুরে সরে গেল। তার সেই শিউরে ওঠা দেখে মেজবিবিও তাড়াতাড়ি দুপা পিছিয়ে গেল। সেখান থেকে বলল, বড়বিবি, উয়া তেল পানি খাওয়া লাগে?
বড়বিবি ভাবল। একটু পরে বলল, না বোধায়।
আসফাক ভাবল ওষুধ দেয়া হয়েছে, এখন ফিরে যাওয়া ভালো।
ছোটবিবির চোখদুটো উত্তেজনায় ঝকমক করছে। এ সময়ে তাকে যেমন সুন্দর তেমন ধারালো দেখায়।
গম্ভীর হয়ে বড়বিবি বলল, এলা পানি-পড়া খাওয়া লাগে। আর হাতৎ বান্ধা লাগে তাগা। তো মাইঝলা, তোর ঘরৎ কালা সুতা হইবে?
মেজবিবি মাথা ঝাঁকাল। ছোটবিবি বলল, রোস, মুই আনং। সে তার নিজের ঘরে গেল। আসফাক এবার অবাক হল, তার চেহারা কি ভূতেধরা মানুষের মতো দেখাচ্ছে। একটু ভয়ই পেল সে। কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে চোরাচোখে দেখল।
কমরুন অবাক হয়ে দেখছিল আসফাককে। এতক্ষণে সে তার ভারি কিন্তু মৃদু স্বরে বলল, কেনে, আসফাক, কাল দুইপরৎ খাও নাই, আতৎ খাও নাই, আজ দুইপরৎ খাওয়া বাদ দিলু।
মেজবিবির হেঁসেল আজ। সে বলল, ঠিক-এ তো। খাবু এলা আসফাক? পান্তা করা আছে ভাত।
বড়বিবি তার কর্তৃত্ব ফলাল। না, মাইঝলা। মনৎ খায়, উয়ার জ্বর আসি গেইছে। তো জলপান খায় তো আনি দেও। উপাসপারা ভাল হইবে আজ।
ছোটবিবি পায়ের পাতার উপরে নাচতে নাচতে তার ঘর থেকে একটা কালো কাপড়ের পাড় এনে দিল। আর বড়বিবি সেটা হাতে করে মন্ত্র পড়তে নিজের ঘরের মধ্যে উঠে গেল। আসফাক ভাবল, এখনই তাগা এনে পরাবে বড়বিবি তার হাতে। আর তা কি তার পরা উচিত? সত্যি কি তাকে ভুলুয়া ধরেছিল?
কমরুন বোধহয় আসফাকের না খেয়ে থাকার কথা ভুলতে পারছিল না। সে বলল, তোমার গামছাটা কোটে, আসফাক? চুড়া গুড় দেং। খায়া, পানি খাও।
আসফাকের সঙ্গে গামছা নেই। তার মনে পড়ল এতক্ষণে। তাহলে সেটাও সে কাল বনেই হারিয়েছে পিরহানের সঙ্গে। সে ভাবল, সে কথা বলা কি ভালো হবে?
এ এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। এখন কার কী করা দরকার বোঝা যাচ্ছে না। তা হলেও এ এক ভয়-ভয়, খেলা। যা খেলতে ভালো লাগে। আবার ছোটবিবি বলল, রোস, মুই গামছা আনি দেং।
সে শুধু গামছা আনল না। গামছায় করে খানকয়েক বাতাসাও আনল। তার হাত থেকে গামছা নিয়ে কমরুন নিজের ঘরে গেল। দুপ্রান্তে গিট দিয়ে গামছাটাকে থলের মতো করে চিড়া গুড় নিয়ে এসে আসফাককে দিল আর সেই গামছা নিতে গিয়ে চোখ তুলেছিল আসফাক। তখন তার লাল টকটকে চোখের উপরে ঝাপসা ধোঁয়া ধোঁয়া কিছু দেখা গেল।
মন্ত্র-পড়া কাপড়ের পাড়টাকে (সেটাকে আরো সরু করে ছিঁড়ে পাকানো হয়েছে) নিয়ে বড়বিবি তার ঘর থেকে এল। আসফাককে এগিয়ে আসতে বলল। আর সে এগিয়ে এলে তার ডান কনুইয়ের কিছু উপরে বেঁধে দিল সেই তাগা। বলল, ভয় না খাও আসফাক। জ্বর জোর হইবে না, মনৎ খায়। পানি না ডুবান আজ।
মেজবিবি বলল, এলাও কি উয়ার পানিৎ ডর আছে?
ভুলুয়া যে অনেক সময়েই মানুষকে জলের ধারে কিংবা জলার পাঁকে ভুলিয়ে নিয়ে যায়, এ তো জানা কথাই। ছোটবিবি আর একবার শিউরে উঠল।
অন্দরের থেকে বেরনোর সময়ে বাড়ির পিছন দিকের পথ ধরল আসফাক। খানিকটা দূরে গিয়েই একটা ঝোরা। জল এখন এত কম যে মার্বেলের গুলির মতো ছোট ছোট পাথরের সবটুকু ডোবে না। দহের কাছে গিয়ে, অবশ্যই, ক্রমশ গভীর। ঝোরার পাশ দিয়ে হেঁটে চলল আসফাক। জলপানের গামছাটার গিট দেয়া একপ্রান্ত তার হাতে, অন্য প্রান্ত কাঁধের উপরে। বেশ বড়, আর নতুন গামছাই। আর তা থেকে একটা সুগন্ধ উঠছে। আসফাক ভাবল, ও, এটা তা হলে ছোটবিবির নিজের ব্যবহার করা গামছা। সে জন্যই এই মিষ্টি গন্ধ। কবে যেন এরকম মিষ্টি গন্ধ সে পেয়েছিল!
দহের কাছে ঝোরার ধারে একজায়গায় দু-তিনটি পিঠুলিগাছ। আসফাকের মনে পড়ল-জাফর একদিন বলেছিল, বড় গাছটাকে খড়ির জন্য কাটলে হয়। আসফাক স্থির করল, এবারও যদি জাফরের দু-চারদিন ফিরতে দেরি হয়, গাছটাকে সে কেটে দেবে।
কিন্তু তফাত দেখো, সেবারে আর এবারে। আর এসব কিছুর জন্যেই দায়ী সেই হাকিম। হাকিম না এলে, আর সে সকলের সঙ্গে দরবার না করলে, এমন হত না।