আসফাক বলেছিল, এই এত বড় বন। যে বনের মালিক সে কি এতবড় বনকে আগাগোড়া চোখেই দেখেছে, যে তার হবে?
বড়বিবি ফুরসিতে ঠোঁট লাগিয়ে বলেছিল, এই দেশের সীমার মধ্যে যত কিছু দেখো সবই কারো না কারো। বন তো শুনি এক মালিকের। তা তুমি যত দূরে যেখানে যাও, বনে ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারবে, সেই বনও, যাকে তুমি নতুন মনে করো, তাও সেই মালিকের।
বড়বিবির গল্প শুনতে শুনতে ঘুম পেয়ে যায়।
কোথায় যাবে আসফাক জাফরুল্লার এক্তিয়ার ছাড়িয়ে?
.
দুপুরটা গড়িয়ে গেল। ছমির, সাত্তার, নসির, চাউটিয়া খামারবাড়ির এদিকে ওদিকে নড়াচড়া করছে। ওদের সকলেরই স্নানখাওয়া হয়ে গিয়েছে। ছমির একবার তার বিশহাতের মধ্যে দিয়ে গাছের ছায়ায় ছায়ায় বাড়ির দিকে গেল। কিছু পরে সে পিরহান গায়ে ফিরেও এল। আসফাক বুঝতে পারল ছমির হাটে যাচ্ছে। সপ্তাহের হাট। এই সময়ে আসফাক ক্ষুধা অনুভব করল। চব্বিশঘণ্টা সে খায়নি। তা, এই খামারে আসার পরে চব্বিশঘণ্টা না খেয়ে থাকা তার এই প্রথম।
এখন সে কী করবে? দ্বারিঘরের বারান্দার পাশে উঁচু বাঁশের আড়াটায় পাট আছে। কাছেই লাটাইও থাকবে। সে বলদগুলোকে আর একটু সরিয়ে সরিয়ে বেঁধে দিয়ে দ্বারিঘরের দিকে চলল।
আবার ছমিরের সঙ্গে দেখা হল। ছমির তা হলে হাটে যায়নি। টাকাপয়সা ধামা আনতে অন্দরে গিয়েছিল। এখন হাটে যাবে।
মুখোমুখি দেখা হতে আসফাক বলল, হাটৎ যাইস একা।
রাখাও যাইবে।
ও আচ্ছা, বলে আসফাক পা বাড়াল।
ছমির বলল, এক কথা। আইজ তো তোরা আছে। তা আমি ঘরৎ যাই। কী কও।
আর কাঁয় থাকে খামারৎ?
কাঁয়ও না।
কেনে, ব্যাপারি?
আজি না আইসে।
ছমির চাকর বটে কিন্তু এ গ্রামেই তার বাড়ি। কাল রাত্রিতে সে বাড়ি যায়নি। জাফরুল্লার বাড়িতে পাহারা দিয়েছে। আসফাককে পাহারার ভার দিয়ে বাড়ি যেতে চায়।
আচ্ছা, যাও, বলে আসফাক হাঁটতে শুরু করল।
খানিকটা দূরে গিয়ে সে ভাবল : ছমির আজ থাকবে না। তা হলে সেই যে একবার আসফাক জাফরুল্লার ঘরবাড়ি তিনমাস ধরে পাহারা দিয়েছিল, আজও তেমন হল।
কিন্তু তফাত দেখো। কী যে ঘটে গেল! ঘাড় কাত করে থুথু ফেলল আসফাক।
দ্বারিঘর পার হয়ে সে বরং অন্দরের ঘরগুলোর দিকে তাকাল। ঘরগুলোর পিছন দিকে বাঁপাশে একটা ছোট বনের আভাস দিয়ে কতগুলো গাছের মাথা। সবুজ মেঘের মতো স্তরে স্তরে বিন্যস্ত। মেঘ নয় তা বোঝা যায় এজন্য যে, গাছগুলোর মাথার উপর দিয়ে নীল মেঘের ঢেউ। ওটাও অবশ্য মেঘ নয়। পাহাড়। যেন পাহারাদার হিসাবে অন্দরটা এখনই একবার দেখে নেয়া দরকার। যদিও এখন দুপুর সবে মাত্র গড়িয়েছে। যত দেরিই হয়ে থাক, ওষুধ আর ফেরত টাকাপয়সাও তো বিবিদের কাছে দিতে হবে। তার সেই বলদঘরের মাচা থেকে ওষুধ নিল সে।
অন্দরে ঢুকে আসফাক দেখতে পেলে বড়বিবিকে তার ঘরের বারান্দায়। যথারীতি সে নীচু একটা মোড়ায় বসে তার ফুরসিতে তামাক টানছে। তার সামনে গিয়ে ওষুধের শিশি আর পয়সা নামিয়ে দিল আসফাক।
অন্দরের তিনদিকে ঘর। বড়বিবি আর কমরুনবিবি দক্ষিণদুয়ারি ভিটায় পাশাপাশি দুটো ঘরে থাকে। মেজবিবির ঘর উত্তরদুয়ারি, ছোটবিবির ঘর তার লাগোয়া কিন্তু পুবদুয়ারি। মাঝখানে উঠান। তা বৃষ্টিবাদলের দিন ছাড়া ভিটা উঠান নুরীর কল্যাণে নিকানো ঝকঝকে তকতকে। এই নুরী ঝি পারে বটে। সকালে একপেট পান্তা খেয়ে সে তার গোবর-কাদার চাড়ি আর পাটের নুড়ি নিয়ে নিকোতে শুরু করে। এঘর ওঘর করে সব ঘরের ভিটা, মেঝে, বারান্দা, তারপরে উঠোন। পাঁচ-ছ ঘণ্টা একটানা কাজ করে। গোবর-কাদার চাড়িটাই তো আধমণি হবে ওজনে। অবলীলায় সেটাকে সরিয়ে সরিয়ে সে উবু হয়ে বসে লেপে যায়। তার নিজের ওজনও মণবুয়েক হবে। দরকার হলে খড়িও ফাড়তে পারে, যদিও নাকছাবি, কপালের চুল আর থলথলে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বুক দেখে বুঝতে পারা যায় সে মেয়েমানুষ। চাকরদের মহলে ঠাট্টা, সে এক মাদিমোষ, যে মানুষের মতো কাজ করতে শিখেছে।
কে? আসফাক! বলল বড়বিবি।
জে।
বড়বিবি হাসল। নিঃশব্দ হাসি, কিন্তু তার মুখের পেশীগুলোর মধ্যে তার চোখদুটো ডুবে গেল হাসির দমকে।
হাসি থামলে বড়বিবি বলল, কেন, পথ হারাইছিলা?
জে।
আবার ফুরসিতে মন দিল বড়বিবি। আর আসফাক সেই নীচু করে রাখা মুখের দিকে তাকাল। এবার সে বড়বিবির উপরের ঠোঁটের উপর সরু সাদা গোঁফের রেখাটাকে দেখতে পেল।
একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে মুখ তুলল বড়বিবি আর তখন তার মুখখানা হালকা গোঁফের রেখা সত্ত্বেও, বোধহয় তার সাদা চুলের কুণ্ডলীগুলোর জন্য, স্নিগ্ধ দেখাল।
সে বলল, জ্বর হইছে আসফাক? চোখু দুখান লাল দেখং।
আসফাক উত্তর দিতে পারল না।
বড়বিবি বলল, তা হয়। ভুলুয়া ধরলে কালে জ্বর হয়।
ভুলুয়া একটা অপদেবতা যা মারাত্মক চেহারা নিয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে। কোনো মানুষ যদি সে অপদেবতাকে ফাঁকি দিয়ে আসতে পারে তা হলে সে কৌতূহলের বিষয় হয়, আর রাতের অন্ধকারে পরিচিত পথ চিনতে না পেরে গোলকধাঁধায় ঘোরার সম্পূর্ণ ব্যাপারটা কৌতুকেরও হয়। খেতে এসে ছমির, সাত্তার, নসির আসফাকের ভুলুয়া ধরার গল্পটা নিশ্চয়ই করে থাকবে। বিবিদের সকলেরই কৌতূহল থাকার কথা। তাছাড়া এখন রান্না-খাওয়ার পাট চুকে গিয়েছে।