সাত্তার বলল, সে ভুলুয়ার কথা যা বলেছে তা মিথ্যা নয়। তার বড়চাচা সব আইন জানত। সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত একই জায়গায় ঘুরে ঘুরে সে যখন ক্লান্ত, তখন সে বুঝতে পেরেছিল, ভুলুয়া ধরেছে। পিরহান খুলে ফেলে, কাপড় ঝেড়ে, পরে বগলের তলা দিয়ে চেয়ে সে আবার পথ খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু বগলের তলা দিয়ে চাইতে গিয়ে সে ভুল করে ফেলেছিল। কারণ সে একজনকে। দেখে ফেলেছিল, যার চোখদুটো রক্তের মতো লাল। মোটরগাড়ির পিছনের আলোর মতো আর তার মাথায় শিং। বাড়িতে ফিরে বড়চাচা প্রাণে বাঁচল, কিন্তু মাথায় দোষ হয়ে গেল।
ছিলিমটা সাত্তরের হাতে দিয়ে উঠে দাঁড়াল আসফাক। নিঃশব্দে সে হাঁটতে : শুরু করল। এ সব ক্ষেত্রে কাজ করতে করতে আলে উঠে ধরানো ছিলিমে টান দিয়ে আবার কাজের দিকে ফিরে যাওয়াই প্রথা। বিদায় দেয়া-নেয়ার প্রথা নেই।
একটু যেন ভয়-ভয় করল আসফাকের। সাত্তারের বড়চাচার সেই ভুলুয়া কি দেখতে মোষের মতো ছিল নাকি? কিন্তু মানুষ যেমন করে কাজে যায়, তেমন করে বেশ তাড়াতাড়িই হাঁটতে শুরু করল, যেন একটা সরকারি কাজ মনে পড়েছে। সেই ভঙ্গিতে চলতে চলতেই সে যেখানে বলদগুলোকে বেঁধে রেখে এসেছিল সেখানে গিয়ে উপস্থিত হল। এটার পিঠ চাপড়াল, ওটাকে ধাক্কা দিয়ে রোদ থেকে ছায়ার দিকে সরিয়ে দিল। যেন সব কয়েকটি ঠিকঠাক খাচ্ছে কি দেখল। তারপরই একটা গাছের ছায়ায় বসে পড়ল।
দেখো কাণ্ড! হাকিম জাফরুল্লার মিতা। আর তার কাছে কিনা নালিশ জাফরুল্লার নামে!
কাল রাতে ঘুম হয়নি। তার উপরে সে সকাল থেকে কাজ করছে। কাল দিন-রাতে একবারও খাওয়া হয়নি। এখন আজকের খাওয়ার সময়ও গড়িয়ে যাচ্ছে। যেখানে সে বসেছিল, সেখানে বাতাস চলছিল। ক্লান্তি, অবসন্নতা, ক্ষুধায় ঝিমুনির মতো লাগল তার। আর তার মধ্যে দিয়ে যেন এই খামারে তার নিজের অবস্থিতির কথা ঠান্ডা-ঠান্ডা হয়ে মনে হতে লাগল। কেমন একটা ঔদাস্য ভর করল তাকে।
.
সাত সাল হল তার এই খামারে। এককুড়ির কম ছিল বয়স তখন। আঠারো-উনিশ হতে পারে। এখানে পৌঁছানোর পরই সব যেন এক সাজানোগোছানো বন্দোবস্ত হয়ে গেল। বুধাই রায়ের খামার ছাড়ার মাস চার-পাঁচ পরেই হবে।
আর এখানে সে খারাপই বা কী আছে? দুবেলা খেতে পায় সে। পরিশ্রমও বেশি নয়। ধরতে গেলে ধীরে ধীরে জাফর তাকে অন্য চাকরদের থেকে একটু পৃথক করেই দেখে, সেই থাপ্পড়ের ঘটনাটা ঘটলেও। তামাকের খেতের কঠিন কাজে তাকে যেতে হয় না। ধানের খেতে বেচাল বর্ষায় ঘাস হলে নিড়ানি নিয়ে বসতে হয়। বলদ, মোষ, গরু দেখাশোনা, রাখালদের খবরদারি করা, দড়ি পাকানো, তামাক বানানো, বাজারসওদা করা–এসবই তার কাজের ফিরিস্তি। বড় জোর চাউটিয়াকে উনি টেনে সাহায্য করা। তা সেটা বর্ষার পরে শীত আসার সময়ে, যখন দুধে মাখন বেশি হয়।
আর এছাড়াও প্রমাণ আছে। তিন সালের পুরনো হল ব্যাপারটা। জমি নিয়ে কাজিয়া। যদিও জাফরের বাড়ির অধিকাংশই তখন সাদা। তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ, সঙ্গে সঙ্গে চাকর-তাধিয়ার মিলে আট-দশ জনকে। মানুষ নাকি খুন হয়া গেইছে।
সে যখন যাচ্ছে আসফাককে ডেকে বলেছিল : আসফাক, বাপজান, ইদিক শোনেক। সব দেখি-শুনি রাখবা, কেমন? আসফাক বড় ভালো ছাওয়াল।
জাফরুল্লার চার বিবি তখন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ফোঁতফোঁত করছে। তখন জাফরুল্লা ধীরে ধীরে তার সঙ্গে যারা ধরা পড়েছে, পুলিশের ঘেরের মধ্যে দ্বারিঘরের বারান্দায় যারা বসেছিল, তাদের নাম করে করে প্রত্যেককে সাতবিঘা চাকরান দেয়ার কথা বলেছিল। যার যেখানে বাস তার চারিদিকে ছ-সাতবিঘা করে চাকরান। লেখাজোখা নাই। কিন্তু বড়বিবিকে বন্টনের দায়িত্ব দিয়ে, অন্য তিন বিবিকে সাক্ষী রেখে বন্দোবস্ত ঠিক করেছিল। আর, তারপরে, বলেছিল দহের ধারে নাবলা দশ বিঘা আসফাকের। বলেছিল, মুই যেদু না ফিরির পাং, তো ওই জমি আসফাকের থাকি যাইবে।
কথার ভাব শুনে মনে হয়, জাফরুল্লা ধরে নিয়েছিল, সে আর ফিরবে না। বলেছিল, আমার যদি ফেরা না হয় সবই মুন্নাফের। চার বিবি সব দেখে রাখবা, কেমন। আর আসফাক সকলেক দেখবা, আসফাক, বাপজান।
এই শুনে, তাকে নিয়ে যেতে দেখে, আর জাফরের চার বিবি আর মুন্নাফের কান্নার সামনে আসফাকের চোখে জল এসেছিল। জাফরুল্লা প্রায় তিনমাস পরে ফিরেছিল। কিন্তু কথা ফিরিয়ে নেয়নি। সেই চাকর-আধিয়াররা– ছমির, নসির, সাত্তার, চাউটিয়া, দুপরু, ঠেংঠেঙ্গা, যে যখন ফিরেছে, তারাই সে চাকরান ভোগ করেছে। দহের ধারের সেই দশবিঘা এখনো আসফাকের ভূঁই।
আর জাফর যখন অনুপস্থিত, তখন আসফাক কী না করেছে? ধান-তামাকের খেতখন দেখাশোনা তো বটেই, জাফরের বিবিদের তদবির-তদারক। আর বলদ গরু মোষ, যা তার আসল জিম্মি, তাদের চেহারা তেমন কোনোদিনই আর হবে না, সেই তিন মাসের যত্নে যা হয়েছিল। সেই সময়ে মুন্নাফ কথা বলতে শিখছিল। তখন তাকে কেউ শিখিয়ে দিয়ে থাকবে। সেই থেকে মুন্নাফ তাকে ধলা মিঞা বলে। এখনো ছমির, নসির, সাত্তারদের যেমন নাম ধরে ডাকে তেমন নাম ধরে ডাকে না আসফাককে।
সেই সময়ে বড়বিবির সঙ্গে অনেক কথা হত। একদিন বড়বিবি বলেছিল, তা আসফাক, এই পিথিমিতে যত জমি দেখো, তা সবই কোনো না কোনো জাফরের। এই যে বন দেখো, তাও একজনের।