আলের উপরে বসল আসফাক। কানের মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ করছে। মাথা কাত করে কানটাকে সে চেপে ধরল কাঁধের উপরে যেন শব্দটাকে থামাতে। চেষ্টা করে সান্ত্বনার মতো একটা চিন্তা নিজের মনে ফুটিয়ে তুলল সে। কানের মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ করছে–তা, সে বোধহয় না খেয়ে থাকার জন্য। কাল দুপুর থেকে খাওয়া হয়নি তার।
তামাকের খেতেও খুঁটিনাটি লক্ষ করতে লাগল সে। তা এটা দেখার মতো কিছু বটে। তাকিয়ে দেখো, যতদূর চোখ যায় তাকিয়ে দেখো-একটা ঢিল দেখতে পাবে না কিংবা একটা ঘাস। এমন জমি আর জীবনে দেখা যাবে না। যে জমিতে গোবরসার দেয়ার জন্যই দু-কুড়ি গরুবাছুর আছে জাফরের। গর্ব করার মতো কিছু বটে। আসফাকের কৃষকমনে অকৃত্রিম প্রশংসার ভাবটাই দেখা দিল। সে এ জমির কাজ কিছুই শিখতে পারেনি। কজনেই বা তা জানে! আর সেই কিনা। গিয়েছিল তামাকের পাতা ঝরতে! জল দেয়ার জন্য দহের মধ্যে যে টিউবকল, বসে তা পাম্প করো–আচ্ছা! জমির ঘাস তোলো একটা একটা করে খুঁটে, তাও খুব। কিন্তু পাতা ঝোরা? জাফর নিজে ছাতা মাথায় অষ্টপ্রহর দাঁড়িয়ে থাকে, পাতা ঝোরায়। আসফাক তাদের দেখাদেখি দা হাতে করে একটা গাছে কোপ দিতেই ছুটে এসে থাপ্পড় কষিয়ে দিয়েছিল জাফর। স্বীকার করতেই হবে, বুদ্ধি আছে জাফরের। সেই হেঁউতির খেতটা ভাবো। আর কেউ কি ভাবতে পারে ডোঙা দিয়ে জল ছেচে এই বৃষ্টি না-হওয়া দিনে হেঁউতির জমি তৈরি করতে? আল্লা পানি দেয় না, জাফর ডরায় না। আটশো বিঘা জমি এখনো তার। নতুন। আইনে দুশো বিঘা বনকে ফিরিয়ে দিয়েই নাকি এই। তখন ব্যাপারির বাড়িতে গোলমাল লেগেছিল বটে। তা জাফর সে সব কাটিয়ে উঠল। চার বিবি তার, এক ছেলে। সকলের নামে জমি লিখে দিল সে। একেবারে এজেষ্ট্রি করে। শেষে বাড়ির পাঁচজন চাকরের নামে। আসফাকের নামেও জমি লেখা হয়েছিল তখন। তারপর জাফর সকলকেই একশো টাকা করে নগদ দিয়ে পাঁচ হাজার টাকার রেহানিখত লিখিয়ে সে সব জমি নিজের তবে এনেছে। নিজের জমি অন্যকে লিখে দিয়ে মিথ্যা ঋণের রেহানিখতে আবার সে জমিকে নিজের হাতে আনা। বুদ্ধি আছে বটে। সেই জমিতে ধান হয় আর তামাক।
আসফাক যেখানে বসেছিল সেখান থেকেই সে,ছমিরদের আবার দেখতে পেল। তাদের একজন ছিলিম ধরাতে বসল। আর দুজন গেল দহের দিকে। স্নান করবে নাকি?
কিন্তু এসব সে ভাবছে কেন?
[আসফাক বুঝতে পারল না, তার মন চারিদিকের এই সব টুকরো ব্যাপার দিয়ে নিজেকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে।]
দু-তিনটে আল পার হলেই সেই আল যেখানে ওদের তিনজনের একজন ছিলিম ধরাতে বসেছে। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আসফাকের মনে হল, ও যদি ছমির না হয়ে সাত্তার কিংবা নসির হয়, তবে কিছু খবর নেয়া যায় ওর কাছে। এটা ছমিরকে জিজ্ঞাসা করা যেত। কিন্তু সকাল থেকেই ছমিরকে তার ভয় করছে।
সে যেখানে বসেছিল, তার কিছু দূরে এক টুকরো জমি। দূর থেকে বাতাসে দোলা গাছগুলো দেখলে মনে হবে ধান। কিন্তু আউশ নয়। ছম। ঘর ছাওয়ার ছন। কচি অবস্থায় বলদ খায়। বেশি খেলে সহ্য হয় না। কিন্তু মোষ ছাড়ে না। বরং ভালোবাসে। আগে মহিষকুড়ায় যখন মহিষের আচ্ছা, তখন সব দহের পার ধরে শুধু এই ছনেরই জঙ্গল ছিল। আর সেজন্যই তারা আসত।
হঠাৎ ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল সে। প্রথমে এই জমিটাই চষতে দিয়েছিল তাকে জাফরুল্লা। তিন বছর প্রাণপাত করেছিল আসফাক। কিন্তু দশ বিঘায় আট-ন-মণ ফললে খুব। চার বছর হল ওই জমি ছেড়েছে সে।
তারপর–তখন একদিন খুব ভোরে, সেদিন মনটা খুব ভাল ছিল জাফরের, দ্বারিঘরে সে এসে বসতেই তার হুঁকায় ছিলিম বসিয়ে দিয়েছিল আসফাক। হুঁকায় কয়েকটান দিয়েই জাফর বলেছিল, তা আসফাক, দহের ধারে ওই দশ বিঘা জমি তোমাকে দিলাম। মনৎ ঠিক রাখিস। যেন এক কৃতজ্ঞতার দান, যেন কেউ পরামর্শ দিয়েছে, আর তা মানতে পেরে জাফর খুশি। সেই জমিতে আজ রোয়ার জোগাড় করা হচ্ছে।
এটা অন্য জমি বন্দোবস্তের মতো ব্যাপার নয়। এর জন্য কোনো দলিল হয়নি, কোনো রেহানের কাগজে টিপ দিতে হয়নি। কিন্তু জমিটার নাম হয়েছে। আসফাকের ভূঁই।
কিন্তু তার চিন্তা ঘুরে গেল। জাফরুল্লা কখন গেল, কী অবস্থায় গেল, কখন ফিরবে, এসব ভাবতে ভাবতেই এদিকে মন চলে এসেছিল। দেখাই যাচ্ছে ও ছমির নয়। সাত্তার। এখনই ওর কাছে জেনে নেয়া দরকার ব্যাপারির কথা।
কথা বলার আগে আসফাক হাসল খুঁতখুঁত করে।
সাত্তার বলল, ছিলিম?
আসফাক হাত বাড়াল। ছিলিমটা দিল সাত্তার।
সাত্তার বলল, পিঁপড়া চলে, ঝরি হবার পায়।
আসফাক বেশ খানিকটা ধোঁয়া গিলে কাশল। ছিলিমটা সাত্তারের হাতে ফিরিয়ে দিল।
তো হেঁউতির চাষ আগুই হইবে মনৎ খায়। বলল সাত্তার।
আসফাক কথা না বলে অ্যাও-অ্যাও করল।
সাত্তার জিজ্ঞাসা করল, কী বলির চাও, সেই ভুলুয়া?
আসফাক গড়গড় করে হাসল। বলল, ব্যাপারি যেলা গেইছে, দেখছ?
সাত্তার বলল, সে নিশ্চয় দেখেছে। ব্যাপারি সেই হাকিমের সঙ্গে গিয়েছে। সন্ধ্যার পর ভঁকভঁকি এসেছিল তার। সেই গাড়িতে ব্যাপারি গেল তার সঙ্গে আর মুন্নাফও গিয়েছে। হাকিমই পীড়াপীড়ি করে নিয়ে গেল।
অ।
ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় লাগল আসফাকের। তারপর সে হাসল আবার। ভারমুক্ত রোধ হল যেন হঠাৎ নিজেকে। সে জোরে জোরে হেসে উঠল দ্বিতীয়বার। তা হলে ব্যাপারি ওষুধের জন্য অপেক্ষা করে থেকে তার দেরিকে আন্দাজ করতে পারেনি!