খানিকটা ভেবে সে স্থির করল, হয়তো ছমিররা সকলেই কোনো চাষের কাজে গিয়েছে। কী চাষ হবে এই বৃষ্টি না হওয়ার দিনে, তা সে বুঝতে পারছে না। দ্বারিঘরের বারান্দা থেকে ছিলিম নিল আসফাক, বড় একদলা তামাক। খড়ের নুড়ো পাকানো ছিল। তাতে আগুন ধরিয়ে নিয়ে সে চাষিদের খোঁজে বেরোল।
খামারবাড়ির পিছন দিকে দহের ধার ঘেঁষে একটা জমিতে চাষ দিচ্ছে বটে কয়েকজন কৃষাণ। জল-বৃষ্টি নেই অথচ জমিটা যেন জলে টইটম্বুর। তা বোঝা যাচ্ছে উপায়। দহের ধারে খুঁটি আর খুঁটি থেকে ঝোলানো নৌকা। নৌকাকে চেঁকির মতো চালিয়ে দহের জল খেতে চালান দিয়েছে। . সেখানে পৌঁছে আলের উপরে বসে ছিলিম ভরল আসফাক। নুড়ো ভেঙে সেই ছাইয়ে তামাকে আগুন ধরাতে হঠাৎ তার মনে পড়ল–এই আট-দশ বিঘা জমিটা তাকে চষতে দিয়েছিল জাফরুল্লা। তার নামেই আছে এখনো। সে ঠিক দুরস্ত করতে পারেনি জমি। তারপর এক সময়ে এটাকেই ভোগধানের জন্য পছন্দ করে জাফরুল্লা। তা সেই সুগন্ধ ভোগধান লাগেই তো–জাফরুল্লার নিজের খোরাকি, দ্বারিঘরে যারা আসে সেই সাহেবদের পলাউ। তিনটে হাল চলছে। ছমির ছাড়া আরো দুজন। নসির আর সাত্তার।
আসফাককে তামাকের যোগাড় করতে দেখে এক-একজন করে কৃষাণ আসতে লাগল হাল ছেড়ে। সব শেষে ছমির এল। আর তাকে দেখে ছিলিম নতুন করে ভরল আসফাক। ছমিরের হাতে ছিলিম তুলে দিয়ে নিঃশব্দে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। ছমির নিঃশব্দে তামাক টানতে লাগল।
অবশেষে আসফাকই বলল, কেন, কাল রোয়া গাড়েন?
না তো কী?
আর কায়ও চাষ দেয় না কিন্তুক। জল-ঝরি নাই।
ছমির ছিলিমটা আসফাককে ফিরিয়ে দিল।
কেন, ছমির—
কী?
না। তাই কং।
ছমির আল থেকে নেমে লাঙল ধরল। চাষিদের পা কাদায় ডুবে যাচ্ছে। বলদগুলোরও সেই অবস্থা। দহের জল যেন দহ ছেড়ে উথলে এসেছে জাফরুল্লার হুকুমে।
কিন্তু ছমির এবারও কথা বলল না। তাহলে? তার দেরি করে ফেরার ব্যাপারটা জেনেশুনেও দম মেরে আছে। ব্যাপারি ফিরলে লাগাবে সাতখানা করে। শুধু দেরি নয়, ওষুধ যা নাকি মানুষের জীবন বাঁচাবে, তা আনতে গিয়ে দেরি করা!
আসফাকের হাতে তামাকটা বৃথা পুড়তে লাগল। লাগাবেই বা কী ছমির? ব্যাপারি শহরে যাওয়ার আগে কি জেনে যায়নি নিজেই?
হঠাৎ কথাটা মনে এল। সে কি ইতিমধ্যেই এদের কাছে অচ্ছুৎ হয়ে গিয়েছে? সে একটা গল্প জানে : দাগি আসামিদের নাকি এরকম হয়। তার নিজের গ্রামের লোকেরাও কথা বলে না। বললেও তা না বলার শামিল। অথচ দেখো, ওরা একই রেখায় হাল চালাতে চালাতে কথা বলছে। সাত্তার হাসলও যেন একবার। আসফাক কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করল। অনেকক্ষণ ধরে সে ওদের আলাপের পরিধিতে ঘুরে ঘুরে বেড়াল যেন, কিন্তু কেউই ওকে আমলে আনছে না।
হ্যাঁ, দেরি তো হয়েছে, শহরে পৌঁছে যেখান থেকে ওষুধের দোকান দেখা যায়, সেখানে এক গাছতলায় বসে পড়েছিল আসফাক। তখন কে যেন বলেছিল : ওষুধ বলে কথা। ওঠো, দেরি হয়। আসফাক তা শুনে হাঁফাতে লাগল। যেন বলবে : তাই বলে মানুষ কি জিরাবে না! অবশেষে ওষুধ নিয়েছিল। ফিরবার পথে সে পাকা পিচের পথে এসে তারপর গোরু-গাড়ির পথ ধরে এসেছে। অর্থাৎ বনের পথে সোজা আসেনি। দোষ কী বলো? বনের পথ তো আর পথ নয়, গ্রামের মানুষের মনগড়া কিছু। আর তাছাড়া অত রাতে বনে ঢুকলে কি পথ বোঝা যায়? পিচের পথে খানিক দূর এসে তার মনে হয়েছিল বনের পথে ঢোকার কথা, কিন্তু পিচের পথের দুধারে তখন বনের অন্ধকার। তার ভয় করেছিল। সে অন্ধকার যেন আতঙ্কের মতো কিছু।
অবশেষে সে নিজে থেকেই বলল, বোঝো কেনে।
ওরা যেন শুনতেই পেল না।
দ্বিতীয়বারও সে প্রায় চিৎকার করে বলল, বোঝো কেনে।
লাঙলের পাকে সাত্তরই কাছে এসেছিল। সে বলল, কও।
আসফাক বলল, কাল ভুলুয়া না কী কয় তাই লাগছিল।
সাত্তার হাল ধরে ততক্ষণে কিছুটা দূরে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকেই বলল, তা লাগে অনেক সময়।
আসফাক বলল, সাঁঝ থাকি দুইপর রাত। শেষৎ দেখি শালমারির বনৎ চলি গেইছি।
এবার নসির দাঁড়িয়ে পড়ল। ভুলুয়া অপদেবতা। যে নাকি মানুষের পথ ভুলিয়ে দেয়, তেমন হলে দহের জলে ডুবিয়ে মারে। নসিরের বয়স হয়েছে।
শুনে সে অবাকও হল। সে বলল, শোনেক সাত্তার। আসফাক কয়, ভুলুয়া ধরছে। পাছৎ কোটে গেইছিস আসফাক?
শহর।
শহর? নসির কথাটা যেন ভাল করে জেনে নিল।
শহর? সাত্তার বলল, ও সেই ব্যাপারির ওষুধখান।
আসফাকের বুকের মধ্যে ধকধক করে উঠল। জানে, এরা সকলেই জানে তা হলে দেরি হওয়ার কথা।
সাত্তার বলল, তা আসফাক, ভুলুয়া ধরলে বসি যাওয়া লাগে। হাঁটা লাগে না।
নসির বলল, বুঝলা সাত্তার, আমার বড়চাচাক্ একবার ভুলুয়া ধরছিল।
নসির আর কী বলল, আসফাক তা শুনতে পেল না। কারণ প্রথমে সাত্তার, তার পিছনে নসির, সবশেষে ছমির হালের পিছন পিছন আবার দূরে চলে গেল গল্প করতে করতে। ভুলুয়া লাগার গল্পই। দূর থেকে আসফাক দেখতে পেল, ওরা যেন হাসছেও। বিমর্ষ মনে সে ভাবল, ওরা বিশ্বাস করেনি। মিথ্যাটাকে ধরে ফেলেছে।
হঠাৎ আসফাক উঠে দাঁড়াল। কী সর্বনাশই সে করে ফেলেছে। সাত্তার আর নসির হয়তো জানত না তার দেরি করে ফেরার কথা। তারাও এখন জেনে ফেলল।
কী করবে এখন সে? কোথায় যাবে?
নিজের চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, সে তামাকের খেতগুলোর কাছে এসে পড়েছে। যতদূর চোখ যায়, একখানা বাদামি কাগ যেন বিছানো আর তার। উপরে সমান দূরে দূরে সবুজের ছোপ। কিন্তু এখানে কেন এল সে? এখানে কী কাজ আছে? কথাটা চিন্তায় ফুটে ওঠার আগেই আবেগটা দেখা দিল। এই তামাকের খেতে কাজ করতে গিয়েই জাফরুল্লার কাছে থাপ্পড় খেয়েছিল আসফাক একদিন।