আসফাক এখন চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখল। নিজের বুকের দিকে চোখ নামাল সে। কেমন যেন গরম লাগছে সেখানে। হাত দিয়ে মুছে দিল একবার। পরে সে বুঝতে পারে, কিন্তু যখন বোঝা দরকার তখন যেন সব গুলিয়ে যায়।
এখন ছমিরের মনোভাবটা বোঝা দরকার। তার দেরি করার ফলে তো কিছু ঘটবেই। এসব ব্যাপারে চুপচাপ মেনে নেয়ার লোক নয় জাফরুল্লা। তার দেরি দেখে নিশ্চয়ই জাফরুল্লা সন্ধ্যায়, রাত্রিতে খোঁজখবর নিয়েছে। ছমির, নসির, সাত্তার এদের সঙ্গে আলাপও করেছে। সুতরাং ছমিরের কাছে বোঝা যাবে।
সে ছমিরের দিকে এগোচ্ছিল, পিছিয়ে আসতে হল তাকে। জাফরুল্লার শোবার ঘরের এদিকের জানালাটা খুলছে। ওই জানালায় এখনই জাফরুল্লার। মুখটা দেখা যাবে আর বাজ-ঠাটার মতো গর্জন শোনা যাবে : আসফাক, এই বেইমান।
জানালাটা খুলল কিন্তু কিছুই ঘটল না। এমন বিস্ময় কেউ কল্পনাও করতে পারবে না–এই কিছু না ঘটা। এতক্ষণে যেন বেলাটাও নজরে পড়ল। তা এতক্ষণে জাফরুল্লার দুছিলিম তামাক পুড়ে যায়। আসফাককেই তা দিতে হয়। সে না থাকলে ছমির দেবে। কিন্তু দেখো ছিলিম ধরিয়ে নিজেই মজা করে টানছে ছমির। তাও এমন জায়গায় বসে যে জাফরুল্লার জানালা থেকে স্পষ্ট দেখতে পাওয়ার কথা।
তা হলে? তা হলে কি ব্যারামের মুখে ওষুধ না পেয়ে জাফরুল্লা–বাক্যটাকে চিন্তাতেও শেষ করতে পারল না সে। স্তম্ভিত আসফাক তার চিবুকের যেখানে সেই ছ-সাতটা লোমা দাড়ির কাজ করে, সেখানে হাত রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল তার দেরি করার এই ফল দেখে। সে জাফরুল্লার ঘরের খোলা নিঃশব্দ জানালার দিকে চাইল আর তার হাত-পা যেন অবশ হয়ে গেল। তা হলে দেরি বলে আখেরি দেরি করেছে সে!
ইতিমধ্যে ছমির কলকেটা শেষ করে মাটিতে উপুড় করল। দুহাত জড়ো করে মটমট করে আঙুল ফোঁটাল। আবার নতুন করে ছিলিম ধরাল। এইবার আসফাক ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ছমিরের দিকে।
মৃদুস্বরে সে বলল, তা, ছমির, ব্যাপারি?
ধোঁয়ায় মুখ বন্ধ ছমিরের। আরো দু-টান দিয়ে ছিলিমটা সে আসফাককে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, ব্যাপারি শহরে। ছমির চলেও গেল।
আসফাক বসে পড়ল। অবসন্নতায় তার শরীর যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। রাত্রিতে ঘুম হয়নি। কাল দুপুর থেকে খাওয়া হয়নি। বনের সেই ব্যাপার, পথের সেই ধকল। আর ভয়, যা এইমাত্র একটা চূড়ান্ত ধাক্কা দিল তাকে।
কিন্তু এটার ভালো দিকও আছে। খানিকটা সময় তো পাওয়া গেল। বসে থাকতে থাকতে এই বুদ্ধি এল আসফাকের মাথায়। বুদ্ধিটাকে আর একটু পাকা করে নেয়ার জন্য নতুন করে ছিলিম ধরিয়ে নিল সে। অবশেষে স্থির করল, ছমির বা অন্য কোনো চাকর হয়তো এখনো ব্যাপারটা সবটুকু বোঝেনি। সময় মতো ফিরে, তা রাত হয়েছিল ফিরতে, বনে পথ হারিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল–এটাকে কৈফিয়ত হিসাবে দাঁড় করানো যায় কি না দেখতে হবে। দেরি করেনি সে ইচ্ছা করে, এটাই প্রমাণ করা দরকার।
রোজকার মতো কাজ শুরু করল সে। সেটাই কৌশল হিসাবে ভালো হবে। বলদগুলোকে ছেড়ে দিল। অন্যান্য দিনের মতো হেইহই করে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে চলল। না তাড়ালে খড়ের মঠে মুখ দিয়ে পড়বে।
খামার থেকে কিছুদূরে একচিলতে বন আছে। একচিলতেই বটে, পঞ্চাশ-ষাটটা শালের গাছ। এই বনের পাশ দিয়ে ঝোরা। ঝোরার ওপারে কাশের ঝোপ একেবারে জলের ধার ঘেঁষে। ঝোরায় এখানে একহাঁটু জল। এপার থেকে ঢিল ছুঁড়লে ওপারে গিয়ে পড়ে। কিন্তু স্রোত আছে। আরো পশ্চিমে এর জল স্বচ্ছ। পাথরকুচি মিশানো বালির খাত-অনেকটা চওড়া কিন্তু শুকনো। ঝোরা সেখানে অনেকগুলো ধারায় তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যেখানে দাঁড়িয়ে আছে আসফাক, সেখান থেকে সিকি মাইল গেলে ব্যাপারির দহ-জাফরুল্লার নাম থেকেই নাম। সেখানে জল বেশ গভীর। জলের রং প্রায় নীল। আর তার উপরেই জাফরুল্লার খামারবাড়ি।
এখানেও, এই বনের মধ্যে ডুবে থাকা জমিও জাফরুল্লার। আসল বনের সীমার বাইরে এই বনটা কী করে হল? চাউটিয়া ছমিরকে বলেছিল, আর তখন আসফাক শুনেছিল, বনটার দোষ নয়। জাফরুল্লাই বনের মধ্যে ঢুকেছে। আগে এদিকে কার কতটুকু জমি আর কতটুকু বন, তার খোঁজ কেউ রাখত না। গাছ কেটে চাষ দিলেই হল। কোন আমলা এতদূর এসে জমির মাপ দেখে খাজনা নেবে? সেইবার সেটেলমেন্ট হল। আর তখন সেই এক কানুনগো এসেছিল। জাফরুল্লার বাবা ফয়েজুল্লার সঙ্গে তার ফিসফাস ফুসফাস ছিল। এখানে ওখানে বনের মধ্যে ঢুকে বনের জমিকে চাষের জমি বলে লিখিয়ে কী সব করে গিয়েছে। এখন এই ত্রিশ-চল্লিশ বছর পরে জট খোলা কঠিন। ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে এদিকে কোথায় বন, কোথায় তার সীমা, কোথায় কার কতটুকু জমি, কেউ জানত না। একবার বন এগোত, একবার চাষের খেত। বনই পিছিয়ে যেত বেশির ভাগ।
নদী, চাষের খেত এবং বন সম্বন্ধে এই সব দার্শনিক চিন্তা শেষ করে আসফাক আবার খামারের দিকে ফিরল।
তার তখন মনে হল, যাই হোক, ছমির কী ভাবছে, তা এখনো বোঝা যায়নি। এটা মনে হতেই তার মুখটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। জাফরুল্লা মরেনি, তার দেরি করাতেও বেঁচে আছে। সে নিজের চারদিকে ঘুরে ঘুরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধ খামারবাড়িকে লক্ষ করতে লাগল। কেউ যেন সাড়া দেয় না, অন্য চাকরগুলোই বা গেল কোথায়!
বলদগুলোর ঘরটা এখনো সাফ করা হয়নি। আসফাক ফিরে গিয়ে ঝুড়ি করে গোবর ফেলতে শুরু করল। যেখানে-সেখানে ফেললে চলবে না। হয় খামারের পিছনের উঁইতে কিংবা তামাকের খেতে। অন্যদিনের চাইতে বেশি মন দিয়ে করলেও ঘরটা সাফ করতে বেশি সময় লাগল না। এর পরে গাভীদের আড়গড়াতেও ওই একই কাজ! কিন্তু ঘণ্টাখানেক ধরে একাজটা শেষ করেই আবার তার মনে হল : আশ্চর্য, ছমির নিজে থেকে কিছুই বলছে না! সকলেই তার থেকে দূরে থাকছে।