হাকিমের সন্মুখ থেকে চলে আসতে আসতে আসফাক নিজেকে অদ্ভুত রকম ভারমুক্ত মনে করেছিল। এসব নালিশ শুনলে গ্রামের লোকেরা ঠাট্টা করতে পারে। গত সাতবছরে সে কি একবারও নালিশ করেছে? হাকিমও হেসেছে বলা যায়। তা হলেও–
কী অদ্ভুত কাণ্ড। দুপুরে আসফাক সেদিন খেতেই পারল না। তারও আগে ঝোরায় স্নান করতে গিয়ে উত্তেজনায় যেন তার দম বন্ধ হয়ে এসেছিল। স্নান করে ভিজে গায়েই খানিকটা সময় সে দুপুর রোদে ঝোরার পার ধরে ধরে হেঁটেছিল। তার মুখে একটা হাসি ফুটে উঠেছিল তখন। হাকিমকে কিনা সব বলে দিয়েছে সে!
কিন্তু হঠাৎ তার গা ছমছম করে উঠেছিল। হাকিম সাহেব কি ব্যাপারিকে সব বলে দেবে? এতক্ষণে বলেও দিয়েছে হয়তো! তা হলে? আসফাক যেন কিছুই হয়নি, এমন ভঙ্গি নিয়ে, নালিশ করার আগে যেমন পাটের সুতলি নিয়ে বসেছিল, তেমন করে আবার বসল।
আর তখনই মুন্নাফ এসে বলেছিল, তার আব্বাজানের জন্য ওষুধ আনতে হবে শহর থেকে।
ব্যাপারির বাড়ি থেকে বেরিয়ে খানিকটা পথ খুব তাড়াতাড়ি হেঁটে গিয়েছিল আসফাক। ওষুধ, যা কিনা মানুষের চূড়ান্ত বিপদের সময়ে দরকার হয়। ব্যাপারির বয়স হয়েছে, তিন-কুড়ির কম নয়। আজকাল কঠিন কঠিন অসুখ হয়। কয়েকমাস আগেই শহর থেকে ডাক্তার এসেছিল। যাওয়া-আসার জিপ ভাড়া ছাড়াও দুদিনে পাঁচশো টাকা নিয়ে গিয়েছিল ডাক্তার। তা, এমনটাই মানায় জাফরকে। এখনো আটশো বিঘা জমি তার যার চার-পাঁচশো বিঘাই একলপ্তে রিজার্ভ ফরেস্টের ধার ঘেঁষে। ওষুধ-যার অভাবে নাকি জাফরুল্লা মরতে পারে!
আসফাক তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করেছিল। বনের পথ সড়কের পথের অর্ধেক। সময়ও লাগে আধাআধি। অভ্যাসমতো কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করার দিকে মন চলে গিয়েছিল। বনের পথ ধরেছিল সে। হঠাৎ একটা অস্বস্তির মতো কিছু মনে দেখা দিল। কিছু ভুলে গেলে যেমন হয়। তারপর সেই অস্বস্তিটাই যেন উষ্ণ হয়ে উঠল। তখন তার মনে পড়েছিল, হাকিমঘটিত ব্যাপারটা। যা সে করে ফেলেছে, তার তুলনা তার নিজের জীবনে নেই। কিন্তু ঠিক সে কথাই নয়। অন্য আরো কিছু, যা আরো উষ্ণ। এই চিন্তাগুলো যেন তার গতিকে শ্লথ করে দিয়েছিল। তারপর কী হল, কে জানে!
যখন সে আবার পাকা রাস্তায় উঠেছিল, কিংবা বনের শেষে এমন এক পিচের রাস্তায় এসে পড়েছিল যার ওপারেও বন, তখন যেন সম্বিত পেয়ে পিচের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করেছিল ওপারের বনে না নেমে। তখন বেলা পড়ে গিয়েছে। তারপর সন্ধ্যার পরে সে শহরের হাটখোলায় পৌঁছেছিল যেখানে ওষুধের দোকান।
তারপর ওষুধ নিয়েছিল সে। কিন্তু সোজাসুজি বনের পথ না ধরে সে পাকা। পথ ধরেছিল মহিষকুড়ার। সে নিজের কাছে যুক্তি দিয়েছিল–পথ তো পাকাই হওয়া উচিত, বনের পথ তো গ্রামের লোকের মনগড়া কিছু। সে পথে যেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সেবারও যে ডাক্তার এসেছিল, সেও এই পাকা সড়ক ধরে।
কিন্তু এই জায়গাটার একটা কথা তার মনে পড়ে গেল। বনের মধ্যে ও ব্যাপারটা কেমন হয়েছিল? অদ্ভুত বললে কিছু বলা হয় না। সে কি ঘুমিয়ে পড়েছিল? তার সারা শরীর ছমছম করে উঠল–ঘুম যদি হয়, তবে তার গায়ের পিরহান কোথায়? পাকা পথ হলেও তো অন্ধকার, আর দুপাশেই নিচ্ছিদ্র বন এখন। তখন আসফাক স্থির করছিল, সাহস করে চলতে হবে। ভয় পেলেই খারাপ।
আর এখন, এই দিনের বেলায়, একটা ব্যাপারই পরিষ্কার, আসফাক দেরি করে ফেলেছে। কাল সন্ধ্যার মধ্যে যার ফেরার কথা ছিল, সে ওষুধ নিয়ে ফিরেছে রাত ভোর করে। কাজের ভার নিয়ে এমন দেরি সে করতে পারে–এ তার সম্বন্ধে কল্পনা করা যায় না। ফিরেই তো আসতে হয়েছে, তবে সেসব বোকামি করার কি প্রকার ছিল? ওষুধ–যার দেরি হলে মানুষ মরে!
আসলে হাকিমের সামনে নালিশ করতে যাওয়াই যত গোলমালের মূল।
.
সেই সেবারের কথা। ব্যাপারটা ঘটবে আগেই জানা ছিল। অনেকেই বলেছিল তাকে। সংসারে থাকার মধ্যে ছিল তার বাপ। মায়ের বয়স অনেক হয়েছিল। চুলগুলো শনের নুড়ি, চোখেও ঝাপসা দেখত। কাজেই তার মৃত্যু ধরে নেয়ার মতো ব্যাপার হয়েছিল। কিন্তু তার বাপ তুলনায় জোয়ানই ছিল বলতে হয়। অথচ মায়ের মৃত্যুর মাস কয়েকের মধ্যে তারও মৃত্যু হল। তখনই বুঝতে পারা গিয়েছিল, অঘটন কিছু ঘটবেই। বাড়ি বলতে একখানা খড়-পচা পুরনো চৌরি ঘর, যার বারান্দায় রান্না হত। অন্য একটা ঘর ছিল যার বেড়া ছিল ফাটানো বাঁশের, আর ছাদ ছিল খড়ের। এই ঘরে থাকত একটা নড়বড়ে মই আর মরচে ধরা একটা লাঙল। কিছু দড়িদড়া থাকত। অন্যদিকে থাকত একটা বুড়ো বলদ যার কাঁধে একটা পাকাঁপোক্ত রকমের ঘা ছিল। ছবিঘা জমি চষত আসফাকের বাপ। জমির মালিক বুধাই রায়। বাবার মৃত্যুর পরই আসফাক শুনতে পাচ্ছিল, এবার নতুন আধিয়ার আসবে। এই ছবিঘা জমিতে সে সোনা ফলাবে। ও আর আসফাকের কর্ম নয়। কী বলিস আসফাক? দশজনের মুখে শুনে সে বলত–হেঁ। কাজেই খড়ের সেই চৌরিখানা যে ছাড়তে হবে, এ বিষয়েও সে নিঃসন্দেহ হল। কিন্তু এত জেনেও কী হল? সেই একদিন সকালে সেই নতুন চাষি যখন বাড়ি দখল নিতে এল, তখন কার কাছ থেকে দখল নেবে, তা খুঁজে পেল না। কারণ গোয়ালঘরের চালার নীচে পাট, তামাক রাখার জন্য আসফাকের বাবা যে বাঁশের টোং-মাচা বেঁধেছিল, সেখানে লুকিয়ে আসফাক তখন ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। কে যেন বলছে, দূরে যাও, আড়ালে যাও, এখানে কিছু নেই। চোখ বন্ধ করে সে সেখানে পড়েছিল একটা দিন, একটা রাত্রি। অথচ কী ছিল ভয়ের? নতুন বর্গাদার তো আদালতের পেয়াদা নয়, পুলিশও নয়।