- বইয়ের নামঃ মহিষকুড়ার উপকথা ও একটি খামারের গল্প
- লেখকের নামঃ অমিয়ভূষণ মজুমদার
- প্রকাশনাঃ . দে’জ পাবলিশিং
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
মহিষকুড়ার উপকথা
আমাদের এই গল্পটা মহিষকুড়া নামে এক নগণ্য গ্রামকে কেন্দ্র করে। আকাশ থেকে দেখলে মনে হয়, বিস্তীর্ণ সবুজ-সাগরে একটা বিচ্ছিন্ন ছোট দ্বীপ। এত ছোট, এত নগণ্য, চারিদিকের জঙ্গলে এমন ঘেরা যে তাকে আবিষ্কার করার জন্য জিপগাড়ির বহর সাজিয়ে অভিযান করলে মানিয়ে যায়; বরং সুখ ও মৃদু উত্তেজনার কারণ হয় : বনের হিংস্র জন্তুদের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, পিকনিকের আবহাওয়ায় নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে, কারণ মনে হতে থাকে এরা বোধহয় বনে পথ হারিয়ে যাওয়া এক মানবগোষ্ঠীর বংশধর, যারা এই বিচ্ছিন্নতাকে চোখের মণির মতো রক্ষা করে।
.
এসব ধারণা অবশ্যই ঠিক নয়। একটু সাহস করে এদিক ওদিক হাঁটলে দেখা যাবে, অরণ্যের শালসারির ভিতর দিয়ে সরু সরু পায়ে চলা পথ আছে; গরুর গাড়ি, এমনকী জিপ চলতে পারে এমন একটা চওড়া মেটে পথ চোখে পড়া সম্ভব, যা এক গ্রাম থেকে বেরিয়ে বনের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। আর সে পথ শেষ হয়েছে বনের বুক চিরে এগিয়ে যাওয়া কালো কোনো পিচের পথে; কিংবা সে পথে কিছু দূর পর্যন্ত মিশে থেকে আবার তা থেকে পৃথক হয়ে আর একটি নগণ্য গ্রামের দিকে চলে গিয়েছে, যে গ্রামের নাম হয়তো তুরুককাটা, কিংবা ভোটমারি, কিংবা নিছক ছোট শালবাড়ি। সে সব গ্রামও জঙ্গলে ঘেরা।
তা, এদিকে এক সময়ে নিরবচ্ছিন্ন অরণ্যানী ছিল, এখন যাকে এ জেলা সে জেলা নামে বিভক্ত করে পরিচিত করা হয়, সেই ভূমিকে নিরন্তর আচ্ছন্ন করে। এমন গহন যে, এক রাজা তার সৈন্য-সামন্ত-অন্তঃপুর নিয়ে পালিয়ে থাকতে পেরেছিল। মীরজুমলার অনুচরেরা, বাঘা বাঘা ইরানি তুরানি তুর্ক, মাথায় কুল্লা-মুরেঠা-শিরপেচ, কোমরবন্ধে দামিস্কের কিরিচ, চোখে সুর্মা সুখ, মুখে চুস্তপুস্ত-খুঁজে খুঁজে হয়রান। অবশেষে এ রাজ্যটাও আমাদের হল–এই ভেবে রাজ্য-রাজধানীর মুঘলাই নাম দিয়ে, রাজবংশের এক ছোকরাকে মুঘলাই নামে তখতে বসিয়ে গুম্ফে চারা দিয়ে মীরজুমলা আরো পূর্বদেশ কব্জা করতে রওয়ানা হয়েছিলেন। আমরা, অবশ্যই, গুম্ফের ব্যাপারটায় হলপ নেব না, কেননা মীরজুমলার গুম্ফ ছিল কি না তা ইতিহাস লেখে না। প্রবাদ এই : সাহেবান রাজ্যসীমার নদী পার হতে না হতে রাজার সৈন্যদল শালসারির মধ্যে দিয়ে পিলপিল করে বেরিয়ে এসেছিল, রাজ্য-রাজধানী আবার দখল করেছিল, তখতনসিন সেই ছোকরা নয়ামুঘলের যারপরনাই হেনস্তা করেছিল।
.
যাক সে কথা, ইতিহাস খুব গোলমেলে গল্প। মহিষকুড়ার যে বন, তার জাতিগোত্র চিনতে পারাই আসল কথা। কালবশে সে অরণ্যের হ্রাস হয়েছে। নতুবা জেলাগুলির জন্ম হত না। মুঘল-তাতার-তুর্কি যার কাছে হার মেনেছিল, সেই বন যেন সাধারণ মানুষের ভয়ে পিছিয়ে গিয়েছে। যাই হোক, এত ক্ষয় সত্ত্বেও সে অরণ্য এখন ইংরাজি নামের সম্মান পেয়ে রিজার্ভ ফরেস্ট। সেই বনের মধ্যে এখনো নদী আছে, তীব্র স্রোতের ঝর্না আছে, তড়াগ-পন্থল-সরোবর আছে, এক প্রান্তে তো নীল পাহাড় আবেগের ঢেউ বুকে হিমালয়ের দিকে এগিয়েছে। তা হলেও নামেই প্রমাণ, এখন সে অরণ্য মানুষের কজায়। তার বুকে, যেন এক শত্রুরাজ্যকে শাসনে রাখতে, লোহার শিকল পরানোর মতোই বা, কালো কালো পিচের রাস্তা-সড়ক। হুড়মুড় করে বাস চলে, ঝরঝর করে লরি-ট্রাক, কলের করাতের যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে বনস্পতিরা লুটিয়ে পড়ে। কিন্তু এত শাসন সত্ত্বেও, কোথায় যেন এক চাপা অশান্তি ধিকধিক করে, যেন বিদ্রোহ আসন্ন, যেন পাকা সড়কের বাইরে যাওয়া সব সময়ে নিরাপদ নয়। মনে হয়, কোথাও এমন আদিম গভীরতা আছে যা একটা মানবগোষ্ঠীকে নিঃশেষে গ্রাস করতে পারে, যেন সেখানে এক দারুণ বন্য হিংস্রতা আছে যা মানুষের হিসাবকে ওলটপালট করে দিতে পারে। অন্যদিকে দেখো, এই মহিষকুড়া, কিংবা ভোটমারি, অথবা তুরুককাটা গ্রামগুলোকে : তারা যেন বনের কোলে ঘুমায়, বনের বুকে খেলা করে, দুঃখে বনের বুকে মুখ রেখে কাঁদে। এসব দেখে আমার একবার মনে হয়েছিল, অরণ্যের দুই রূপ আছে, এক রূপে সে আশ্রয় দেয়, অন্যটিতে সে প্রতিহত করে। রাজাকে আশ্রয় দেয়ার সেই পুরাকালের ঐতিহ্য সে ধরে রাখতে চায়। কিন্তু সেখানেই তার ভুল। সে প্রকৃতপক্ষে এক বোকা জামুরিনের মতো হার্মাদদের নিজের রাজ্যে আশ্রয় দিয়ে বসেছিল। কারণ যারা বনের বুকে ফুটন্ত কালো গরম পিচ ঢেলে সড়ক তৈরি করে আর যারা লাঙলের পিছনে ধৈর্য করে এগোয়, তারা একই জাতের। আগুনে পুড়লে তবু আশা থাকে, ছাইয়ের তলা থেকে নবান্ধুর দেখা দেয়; লোভের লাঙলে পড়লে তেমন যে শাল-পদাতিকের নিরেট নিচ্ছিদ্র ব্যুহ, এক বনস্পতির এলাকা থেকে অন্য বনস্পতির এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত বিষমুখ কাটালতার তেমন যেসব ব্যারিকেড–সব ধ্বসে যায়।
কিন্তু মুশকিল এই, সংগ্রাম ও শান্তির প্রতীক হিসাবে তরবারি ও লাঙল ইউরোপের মানুষেরা এত বেশি প্রচার করেছে যে এখন আমাদের পক্ষে লাঙলের সঙ্গে লোভ শব্দটাকে যুক্ত করতে সঙ্কোচ দেখা দিয়েছে। লাঙল যে মানুষের সভ্যতার অগ্রগতির চিহ্ন হতে পারে, তা ভাবতেও অনিচ্ছা হয়।