পুরুষদের মধ্যে এই যৌনতার বিকার সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর। এবং বিশেষ করে নাবালিকাদের জন্যে তো প্রচণ্ড দুঃসংবাদ। ধর্ষণ এবং অন্যান্য যৌন অপকর্মের জন্যে বিকারগ্রস্ত পুরুষগুলো, অপেক্ষায় থাকে। এবং যে-কোনও সুযোগই তারা লুফে নেয়। অনেক সময় এই অতিরিক্ত যৌন ইচ্ছা তাদের নিজেদের জীবনেও অসহনীয় সঙ্কটে রূপ নেয়। ফলে সৃষ্টি হয় বিবিধ সামাজিক সমস্যা। তারা নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলেই শুরু হয় ত্রাস। এবং এরকম বিকারগ্রস্ত পুরুষদের এই ত্রাসের সংবাদ সহসাই শোনা যায়, লোকমুখে বা মিডিয়ায় সাবধানতার বাণী হিসেবে। পৃথিবীজুড়ে সবখানেই রয়েছে ধর্ষক। ওদের জন্যে অগণিত নারীর জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। ধর্ষণ, একটি ভয়াবহ প্রক্রিয়া। যে ভুক্তভোগী, শুধু সেই জানে তার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা।
পুরুষদের এই সঙ্কট পতিতালয়ের কারণে অনেকটা প্রশমিত হয়ে যায়। কিন্তু যারা পতিতালয়ে যায় না বা যাওয়ার সাহস পায় না সমস্যা তাদের নিয়ে। এবং এই সমস্যা মূলত মধ্যবয়স্ক পুরুষদের বেলায় অধিক প্রযোজ্য, যে বয়সে বিকারের অবস্থা থাকে তুঙ্গে। আমাদের ক্ষয়িষ্ণু, ধুকে ধুকে মরা পুরোনো সমাজের অযাচিত নিয়মকানুন আর কিছু অযৌক্তিক বাধ্যবাধকতা, সেকচ্যুয়াল ব্যাপারগুলোকে কোণঠাসা এবং অশ্লীল করে, ধর্মবোধ এবং সমাজবোধকে প্রতিষ্ঠার কারণে এই চরম মূল্য। আর তাছাড়াও, দারিদ্র্য-অশিক্ষা-পরনির্ভরতা-নারী নির্যাতন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, এসবের মূল্য দিতে ভাগ্যহীনা মেয়েদের চেয়ে উত্তম শিকার, কি আর হতে পারে সে আমার জানা নেই।
২৭. গেস্ট হাউজ
মেয়ে মানুষদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এক ধরনের ইন্ডাস্ট্রি। গোলার্ধের ওপারে সফিস্টিকেটেড হোটেল-মোটেল, কন্ডো-প্রাসাদ-স্যুইট ইত্যাদি। আর এপারে-ব্যাঙাচির মতো গড়ে ওঠা সস্তায় গেস্ট হাউজ এবং কিছু হোটেল-মোটেল। এই ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু যারা ওদেরকে আমরা ভদ্রজনেরা ভদ্ৰ ভাষায় বলে থাকি পতিতা। তা এই পতিতা কারা এবং তাদের কাজকর্মই-বা কি? কাঁদের বলা হয় পতিতা? পতিতাবৃত্তির রমরমা ব্যবসা বিশ্বব্যাপী সর্বত্রই। কলকজা, যন্ত্রপাতি ছাড়াই এ এক বিশাল শিল্প সংস্থা। ভদ্র ভাষায় বলা হয় যৌন পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন এবং আদিমতম ব্যবসাও বলা হয় একে। আর এতে জড়িয়ে যাওয়ার ইতিহাসও অভিনব, চমকপ্রদ। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর এই করুণ পরিণতি নতুন কিছু নয়। আমি এই পেশার বিরুদ্ধে নই। তবে তা অবশ্যই হতে হবে রুচি, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক স্বীকৃতিসম্পন্ন। বৈষম্যহীন তো বটেই। অন্যান্য কাজের মতো এটিও একটি কাজ, একটি পেশা। ঠিক আর ন’টা-পাঁচটা কাজের মতো।
একথাও অনস্বীকার্য যে, পতিতালয় রয়েছে বলেই আজ অনেক সংসার টিকে আছে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, ঘর ভাঙাভাঙির ব্যাপারটা অন্যায়ভাবে এদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে অনেকে পার পেয়ে যান। যৌনকর্মীরা যে অনেক নিন্দার ভাগী তাতে কোন সন্দেহ নেই। দৈহিক-মানসিক আনন্দ খুঁজতে যৌন শ্রমিকদের কাছে যাওয়া অনেক পুরুষেরই বিলাসিতা। কারো অভ্যেস, কারো বদভ্যাস, কারো অদম্য নেশা। আবার তাদের কেউ কেউ বিকৃত রুচির পুরুষ। ঘরে সুন্দরী বৌ রেখেও, ওরা বেশ্যালয়ে যাবে যাবেই। নোংরা পরিবেশ-নোংরা গন্ধঅলা পেটিকোট খুলে বা তুলে তাদের সেই পরম কাক্ষিত বহুল ব্যবহৃত নারীর নরম মাংসপিণ্ডের নিচে প্রেমবিহীন নিঃসাড় অঙ্গই হয়তো অধিক আনন্দদায়ক। কথায় বলে, আপরুচি খানা পররুচি পিননা। হোক না তবে কি? শুধু শরীর নয়, পতিতারা ভালো আচ্ছা সঙ্গী হতে পারে। সুন্দর সঙ্গ এবং ভালো ব্যবহার ওদের ব্যবসার অঙ্গ। তাৎক্ষণিক ভালো লাগার জন্যে। পতিতালয়ের টান অমোঘ। পতিতারা অন্তত ঘরের একঘেয়ে জীবন থেকে সাময়িক আমোদ-প্রমোদ দানে এক বিকল্প জীবন। নাচ, গান, হাসি, বিড়ি, মদ, গাঁজা, চরস, ভাং, মোক অবশেষে চাইলে অবশ্যই শরীরটাও। এই নিয়ে হলো–পতিতাদের সেই স্বর্ণালয়, যেখানে গেলে দুঃখ নামের জন্তুটাকে নিশ্চিত ভোলা যায়। অন্তত কিছু সময়ের জন্য সুখ কে না চায়! এবং কারো কারো জন্যে, সুখের অন্য নাম–পতিতাপল্লীতে।
পতিতা সঙ্গ–মহাত্মে যার নামকরণ করা হয় পতিতালয়, বেশ্যাবাড়ি বা খানকিপাড়া। এর আবর ব্যাখ্যা কী। মধ্যবয়সী পুরুষদের মধ্যে এই প্রবণতা বিভিন্ন কারণে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে পারে। তার মধ্যে একই নারীর পুরোনো শরীরের নিত্য ব্যবহার সবার ওপরে। এই নেশা অনেকটা মদ বা হেরোইনের মতো। না খেতে পারলে তীব্র শারীরিক কষ্টগুলো বাধ্য করে কোনও একটা আসক্তিতে ফিরে যেতে। পতিতালয়ও তাই। অনেক সংসার ভেঙে যায় সিনেমার রাধিকাঁদের সংসারের মতোই। এই অদম্য আসক্তির কারণে সেখান থেকে ফিরতে চাইলেও পুরুষ আর ফিরতে পারে না। অসুস্থ হয়, ঘর ভেঙে যায়। তবুও না। তাদের কাছে একমাত্র পতিতাই ধ্যান-জ্ঞান, পতিতাই ভালো। পতিতার শরীর ভালো। ওর গন্ধঅলা পেটিকোট, চুলভর্তি নোংরা সঁতসেঁতে ঘর্মাক্ত বগলের গন্ধ ভালো। ওর যোনিদেশের মসৃণ চামড়া ভালো। চামড়ার গন্ধ ভালো। ওর শিল্প ভালো। তার অলঙ্করণ ভালো।
একথা সত্য যে পুরুষদের এই চাহিদা না থাকলে অবশ্য পতিতাপল্লীর প্রয়োজনই হতো না। তবে এখানে একটা যুক্তির কথা থেকে যায়। বৈষম্য বা অধিকারের কথা। তাহলে আমরা কি এই বুঝে নেবো যে পুরুষদের মতো মেয়েদের একরকমের ইচ্ছে নেই বলেই তাদের জন্য পতিতাপল্লী নেই! কে বলেছে, মেয়েদের এই বিলাসিতা নেই! ছেলেদের মতো মেয়েদেরও থাকতে পারে অন্য পুরুষের দেহের প্রতি সমান আকর্ষণ! তীব্র আকর্ষণ। কিন্তু হ্যাঁ, মেয়েদের জগতে অন্তত আমাদের দেশে আছে অনেক সীমাবদ্ধতা, অনেক বিধিনিষেধের বেড়াজাল। পুরুষ যা পারে, মেয়েরা তার সিকিভাগও পারে না। কিন্তু যুক্তির কথাই যদি বলা যায় তবে দোহের মিলনে যদি হয় সঙ্গম, তাহলে বিকল্প জীবন খুঁজতে দাম্পত্য জীবনে অসুখী নারীরা কেন যেতে পারবে না। সংরক্ষিত সমর্থ যুবকপল্লীতে। এই পৃথিবীটা এখন মোড় নিচ্ছে–সমান অধিকারের পথে। কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেয়ার নয়।