- বইয়ের নামঃ মধ্য বয়সের সঙ্কট
- লেখকের নামঃ মিনা ফারাহ
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১. মিডলাইফ ক্রাইসিস
প্রথম প্রকাশ : ফাল্গুন ১৪০৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৩
উৎসর্গ : মধ্য বয়সের নারী
০১. মিডলাইফ ক্রাইসিস
মানুষের হৃদয় নিয়ে বিরাট একটা বিষয় পড়ে আছে। নিঃসন্দেহে জটিল এই বিষয়টি গভীর গবেষণার দাবিদার হলেও ভলিউমের পর ভলিউম রিসার্চ রিপোর্ট ভিত্তি করে এ লেখা হয়নি। বিষয়টি এমনই জটিল যে-সাধারণ বুদ্ধিতে অন্তত মনে হয় মঙ্গলগ্রহে মনুষ্যপ্রাণীর এই মুহূর্তে গিয়ে বসবাসের সঙ্গে তুলনা করলেও তা যথেষ্ট হবে না। নরম। হৃদয়ের সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলোকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পণ্ডিত থেকে শুরু করে নিরক্ষর অধিকাংশই ব্যর্থ হয়েছেন। সামাজিক নিয়মনীতির শৃঙ্খলাবদ্ধ করে তার অপব্যাখ্যা ছাড়াও অবিচারও করা হয়েছে প্রচুর।
হ্যাঁ, বলছি প্রেম ভালোবাসার কথা, যখন তাকে বলা হয় অবৈধ। ট্যাবলয়েডের ভাষায় পরকীয়া প্রেম। এখানে বলছি মিডলাইফ ক্রাইসিস। . হৃদয়ের ব্যাপার নিয়ে সামাজিক ভুল বোঝাবুঝি পাহাড়-সমান। প্রেমের সৌন্দর্য অসামাজিক কূপমণ্ডুকতার কারণে অপব্যবহৃত এবং উপেক্ষিত।
প্রেম এবং ভালোবাসা মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি সত্ত্বেও, সামাজিক জীবনে গতানুগতিকতা থেকে একটু বাইরে গেলেই একে নিয়ে খোলাখুলিভাবে টানাহ্যাঁচড়া শুরু হয়। গতানুগতিক বলতে বিয়ে, প্রেম এবং সংসার। বৈধ ম্যারেজ সার্টিফিকেটের ছাতার তলে। গতানুগতিকতার বাইরের প্রেমও যে কত সুন্দর এবং প্রয়োজনীয় হতে পারে আমাদের সমাজ তা স্বীকার করতে এখনও একেবারেই শেখেনি।
মানুষের হৃদয় আছে। হৃদয়ের একটি ব্যাপারও আছে। যার ওপর নিয়ম, বৈধতা, শাসন, রেশন, ক্যাপশন কিছুই চলে না। যুক্তি তো নয়ই। দীর্ঘদিন বিবাহিত জীবনযাপন শেষে কখন যে সেই জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মায় ঘড়ি ধরে তাকে কেউ ব্যাখ্যা দিতে পারে না। কখন যে কার প্রেমের অনুভূতি অন্য আর একজনের জন্যে উদয় হয় সে কথাও নিয়ম করে কেউ বলতে পারে না। তবে অনেকের জীবনেই তা ঘটে যায়। সামাজিক ভাষায় যাকে বলা হয় অবৈধ, কিন্তু অভিজ্ঞদের ধারণায় তা মিডলাইফ ক্রাইসিস। নারী এবং পুরুষের জীবনে এই মিডলাইফ ক্রাইসিস সহসাই আসতে পারে। তবে মধ্যজীবনের আগে নয়। এবং এটা যে কত বড় একটি মানসিক সমস্যা অধিকাংশ মানুষই এখনও তা চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
চল্লিশোর্ধ্ব নারী কিংবা পুরুষের জীবনে হঠাই তাদের অজান্তে এমন এক সঙ্কট আসতেই পারে, যার কারণে তারা হারিয়ে ফেলে তাদের পুরনো অনুভূতিগুলো।
ভালোবাসা হারিয়ে যেতে পারে এমনকি পেটের সম্মানের উপরেও। এই ক্রাইসিস অনেকেই লালন করে গোপনে। অনেকেই আবার প্রকাশ্যে। কিন্তু যেভাবেই এই ক্রাইসিস তারা ধারণ করুক না কেন সমাজের চোখে তা সবসময়ই অবৈধ। আমরা খুব পরিচিত এর প্রতিরূপ একটি শব্দের সঙ্গে, ট্যাবলয়েড যাকে বলে পরকীয়া প্রেম। এই হেডলাইনের ব্যানারে অনেক মুখরোচক সংবাদসহ এমনকি আত্মহত্যার সংবাদও প্রায়শই আমাদের চোখে পড়ে।
মধ্য জীবনের সঙ্কট জীবনে যখন উদয় হয় তখন মনে হতেই পারে যেন বিগত বছরগুলো ধরে বিবাহিত জীবনটা ছিল পারদ উঠে যাওয়া আয়নার মতো, যেন সম্পূর্ণ অতীত জীবনই একটা আবছা আয়না।
ইন্টারনেটের যুগে বিশ্ব এখন করতলে। মানুষ মঙ্গল গ্রহে গিয়ে হানিমুনের স্বপ্ন দেখছে। টাইটানিক সমুদ্রগর্ভ থেকে উঠে এসে ডাঙ্গায় বসবাসের কথা ভাবছে। আর উত্তর মেরুতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন বারবিকিউ চিকেন উইং আর বিয়ার হাতে পার্টি করছে। কিন্তু হায়! এই মিডলাইফ ক্রাইসিসের মতো এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার কোনও প্রাধান্যই পেল না!
একটি হৃদয় দ্বিখণ্ডিত। দু’পাত্রে রাখা। রক্ত ঝরছে দু’দিক থেকেই। ভাবল না কেউ দ্বিখণ্ডিত সেই হৃদয়টির কথা। তার ব্যথা। তার কষ্ট। আমি কোনও মনস্তাত্ত্বিক নই। কিন্তু বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এই হার্দিক বিষয়টির বিরুদ্ধে যথেষ্ট অত্যাচার দেখা যায়। অবৈধ প্রেমের কারণে, ভ্যালিড ম্যারিড সার্টিফিকেটের যুক্তি নিয়ে হৃদয়ের অনুভূতির বিরুদ্ধে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনেক যুদ্ধ দেখা যায়। কিন্তু বিচারকেরা ভুলেই যান যে, জোর করে কাউকে কখনও ভালোবাসানো যায় না। জোর করে মানুষটাকে ঠিকই পাওয়া যায়। কিন্তু তার হৃদয়? অনেকের কাছেই মিডলাইফ ক্রাইসিস কোনও ব্যাপার নয়। ভাবে, সময় দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। ভাবে, এটা কোনও সাময়িক অবসেশন। বাস্তবে তা একেবারেই ঠিক নয়।
প্রেম এবং ভালোবাসা ছাড়া মানুষ বাঁচে ঠিকই। কিন্তু প্রেমিক মন প্রেম ছাড়া বাঁচতে পারে না। প্রেমহীন মন এবং হৃদয় মরুভূমিতে শুকিয়ে পড়ে থাকা মৃত ক্যাকটাসের মতো। প্রেমই মানুষকে চিরসবুজ রাখতে পারে। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে বয়স্ক, প্রেম যে-কোনও বয়সেই আসতে পারে।
বয়ঃসন্ধিকালের প্রেম: একরকম। শরীরে তখন তারুণ্যের চাঞ্চল্য। হরমোন পরিবর্তনের সময়। সে সময়কার প্রেম যতটা মানসিক তার চেয়েও বেশি শারীরিক। প্রি-টিন, টিন এবং পোস্ট টিন-এজের প্রেম জীবনের যে বয়সে ঘটে, মিডলাইফ থেকে তা অনেক আগের ঘটে-যাওয়া ঘটনা। এবং সেই শুরু থেকেই মিডলাইফ অবধি, জীবন বলতে গেলে একটা প্রায় সমান্তরাল ধাচে চলতে থাকে। মনে হয় এই অনুভূতি চিরকালের। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সংসারে একটি সন্তান আসার সঙ্গে সঙ্গেই সেই ভালোবাসা ভাগ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন একসঙ্গে থেকে এককালের লাইলী-মজনু হয়ে পড়ে অনেকটা ভাইবোনের মতো। বিয়ের দু’বছর পর কিংবা প্রথম সন্তান জন্মানোর পরেই তারা গোয় দেয়ালের দিকে মুখ দিয়ে। একে অন্যের দিকে পিঠ ফিরিয়ে। বিছানায় যাওয়াটা তাদের একটি রুটিন, স্বামী-স্ত্রী। তারা দুটো যন্ত্র, সংসার তাদের যুদ্ধক্ষেত্র। তখন প্রেম পালিয়ে যায় জানালা দিয়ে।
বসন্তের হাওয়া, তার ছোঁয়া হৃদয়ে নতুন করে আবার লাগতেই পারে। বিবাহিত স্বামী নয়, স্ত্রী নয়। একেবারেই অন্য কাউকে ভালোবেসে। দেখা দেয় শুকিয়ে যাওয়া ফুল গাছটায় নতুন করে কুঁড়ির সম্ভাবনা। তাকে দেখলেই বোঝা যায় যে সে প্রেমে পড়েছে। সমস্যাটা প্রেম নয়, বরং তার বৈধতা। দু’দশক আগে যাকে ভালো লেগেছিল তাকে আর ভালো লাগে না। দু’দশক আগের সেই মন এবং শারীরিক ক্ষুধা তাকে দেখলে আর জাগে না। তবে তা জাগে, তা আসে, অন্য কাউকে দেখলে। তার গন্ধ পেলে। তার নাম শুনলে। তার কণ্ঠের শব্দে স্পন্দিত হয় সমগ্র নার্ভাস সিস্টেম। যেখানে পৃথিবীর সবরকম যুক্তিই তুচ্ছ।
তুচ্ছ, আসলেই কী? পরকীয়া প্রেম বলে কোনও শব্দের প্রয়োজন কি থাকা উচিত? ধর্ম-জাত-বর্ণ-লিঙ্গ-বয়স, প্রেম কি এসব কারণে বৈধ কিংবা অবৈধ হওয়া উচিত?
সমকামীরাও প্রেমিক-প্রেমিকা। তারাও ভালোবাসে। কালো এবং ফর্সা ওরাও ভালোবাসতে পারে। ছোট্ট ছোট্ট বালক-বালিকারাও প্রেম করে। প্রেম করে বয়স্করাও। এমনকি থুথুরে নারী ও পুরুষও। তবে একেক বয়সের প্রেম একেক রকম। ধর্মের বিষয়টা আমার জীবনেও ঘটেছিল। আমরা একজন হিন্দু আর একজন মুসলিম। সমাজ আমাদের প্রেমের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু আমাদের প্রেমের তীব্রতা, অভিভাবকের হস্তক্ষেপ এবং সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেছিল বেশ নিষ্ঠুরতার সঙ্গে।
আমাদের বেলায় নিষ্ঠুরতা করাটা সহজ হয়েছিল কারণ বিয়ের পরপরই আমরা। আমেরিকায় পালিয়ে আসি ইমিগ্রেশন নিয়ে। ফলে সোশ্যাল হিউমিলিয়েশনটা ধীরে ধীরে হালকা হয়ে যায়। ভারত কিংবা বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমানের বিয়েটা এখনও গ্রহণযোগ্য নয়। অধিকাংশ সময়েই তা সামাজিক পাপ। অভিভাবকদের হস্তক্ষেপে সেই প্রেম ভেঙেও যায়। হৃদয়ের ওপর জোর খাঁটিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের অন্যত্র বিয়ে। দিয়ে দেয়া হয়।
সোশ্যাল হিউমিলিয়েশন আমাদের পরিবারে একেবারেই যে ঘটেনি তা নয়। আমার বিয়ের কারণে পরবর্তীকালে আমার পরিবারের অনেকের বিয়েই ভেঙে গেছে এবং আমার পরিবারের অনেককেই দীর্ঘদিন মৌখিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। সেই লজ্জায় অনেক অশ্রুপাতও ঘটেছে। তবে সেসব এখন অতীত। কোয়ার্টার সেঞ্চুরি পেরিয়ে আজ আমরা দু’জনে যেখানে আসতে পেরেছি এক সঙ্গে, দু’জনের একসঙ্গে হেঁটে আসা এই যে একটা সাফল্যের মাইলস্টোন, আমাদের বিয়ে যদি না হতো ধর্মের কারণে তা হলে এর পেছনে সমাজ কী যুক্তি দেখাত? যদি পারতো তা হলে সেটা কীরকম হতো? আর না পারলে? তার মানে এই নয় যে, এখান থেকেও কোনও পরিবর্তন বা বিচ্যুতি ঘটবে না। এমন কোনও নিয়ম কোথায়ও লেখা নেই। প্রেম কখন যে তার খোলস বদলাবে তা বলাটা দুরূহ।
পরকীয়া বা অবৈধ প্রেমের অনেক মুখরোচক ঘটনা, বিশেষ করে যখন তা ঘটে সেলিব্রেটিদের জীবনে, তা জানাজানি হয়ে গেলেই খবরে পরিণত হয়। রিপোর্টাররা ক্যামেরা নিয়ে জাহাজ ভাড়া করে তাদের ছবি তুলে ট্যাবলয়েডের কাটতি বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ পাশ্চাত্যে-প্রিন্সেস ডায়ানা, ম্যাডোনা, মাইকেল জ্যাকসন, লিজ টেলর প্রমুখের কথা বলা যায়। লেটেস্ট সোপ অপেরা চলছে বর্তমানে নিউইয়র্ক সিটির মেয়রের প্রেমকাহিনী ও বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে।
যারা সেলিব্রেটি নয় তাঁদের কাহিনী ট্যাবলয়েডের কাটতি বাড়ায় না, সেসব সাধারণ মানুষের অবৈধ প্রেমের সংবাদ অন্যরকম প্রাধান্য পায়। তাদের নিয়ে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়।
সকালের সূর্য ওঠার মানেই কি অস্তমিত চাঁদের প্রতি অবিচার! সূর্য আর চন্দ্র আছে বলেই না বৈচিত্র্য আছে। বৈচিত্র্য থাকা ভালো। তাতেও জীবনের জোয়ার থাকে। জোয়ারে আনন্দও থাকে ঢেউয়ের পরতে পরতে। প্রেমও ঠিক তেমনই। বৈচিত্র্য আসে তাতে।
স্থবির নদীতে বান ডাকলে কি তা দোষের? যাদের চোখে তা দোষের, তারা চায়। নদী মরে যাক তাও ভালো, তবুও এখানে বান না ডাকুক! এখানেই কাজ করে বৈবাহিক সম্পর্কের স্পর্ধা।
যুগে যুগে প্রেম এবং ভালোবাসা গড়ে উঠেছে নারী আর পুরুষের মধ্যে। বাধার সম্মুখীন তারা হয়েছে। বাধার সম্মুখীনে প্রেমের তীব্রতা বেশি। এবং এ তীব্রতার কারণে প্রাপ্ত শাস্তি বেত্রাঘাত থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ড।
প্রেমের প্রকাশ কামের মাধ্যমে। কামসূত্রই তার প্রমাণ। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে কামসূত্রের বইয়ের ছবির মতো হাজার হাজার ছবি খোদাই করা আছে, যা সারা বিশ্বের পর্যটকেরা এসে দেখে অবাক হন। উদাহরণস্বরূপ কোনারকের সূর্য মন্দির। এসব সভ্যতার বয়স আড়াই হাজার বছর।
অবাক লাগে, সে-সময়েও মানুষের দৃষ্টি ছিল কত উদার। মন কত মুক্ত। সমাজ কত অরক্ষণশীল এবং কত খোলামেলা। মন্দিরের গায়ে উলঙ্গ-অর্ধউলঙ্গ বিভিন্ন চরিত্র, প্রেম ও কামের ছবি বিভিন্ন আসনে নারী ও পুরুষের, স্তন-যোনি এবং লিঙ্গের বিভিন্ন ভঙ্গিতে খোদাই করা ছবি মন্দিরের গায়ে শোভা পাচ্ছে। আধুনিক যুগের মানুষেরা সেগুলো দেখে কি অবাক হয় না? ভাবুন যে, সে যুগের মানুষেরা কত খোলাখুলি, কতটা মুক্তমনে প্রেম করেছে। তাদের আফসোস হয় না কি এসব দেখে, হায়! এত বছর ধরে বিবাহিত জীবনযাপন করলাম। কতবার প্রেম করলাম। কিন্তু একী! আজ অবধি পেটিকোটের ফিতে কিংবা ব্লাউজের বোতামটা খুলে কখনও দেখিনি আমার প্রিয়ার শরীরের সৌন্দর্য, সে কেমন?
হৃদয়ের ব্যাপারগুলোকে বৈধ কিংবা অবৈধ বিশেষণে বিশেষিত করাটা ভুল। এর একটি নিজস্ব জগৎ আছে, যেখানে কোনও রকম যুক্তি-তর্ক-নিয়ম কিছুই কাজ করে না।
প্রেম, সুন্দর। মধুময়। প্রেম, জীবনের উৎস। প্রেম, চিরন্তন। আর কাম হলো তার প্রকাশ। একে অপরের উৎস এবং সম্পূরক। প্রেম পরিপূর্ণতা পায় কামের জোয়ারে। কামবিহীন প্রেম কি প্রেমবিহীন কাম যা অসম্ভব! যেমন অন্ধের দুই চোখ। দিব্যি সুন্দর দুটো চোখ স্নায়ুর অভাবে, দৃষ্টিবিহীন। প্রেমবিহীন শরীর আর স্নায়ুবিহীন চোখ, এক।
প্রেম, হোক না তা পরকীয়া, তবুও তারই জয়জয়কার। তার সৌন্দর্যের। ব্যক্তিগত চরিত্র বিশ্লেষণ সেসব অন্য বিষয়গুলো দেখার দায়িত্ব অন্যদের। আমি শুধু বুঝি মানুষের জীবনে তার অনিন্দ্যসুন্দর উপস্থিতি, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। যা মানুষকে আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়।
০২. ক্রাইসিসপূর্ণ জীবন
চোখ খুলে তাকালেই দেখতে পাই, চারদিকে সঙ্কট আর সঙ্কট। মানুষের জীবনে এর কি কোনও শেষ আছে? আসলে মানুষের জীবন মস্ত এক যুদ্ধক্ষেত্র। আর এই যুদ্ধক্ষেত্রে জীবনের নানাবিধ সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতেই যেন মানুষের জন্ম এবং মৃত্যু। প্রতিদিন কত রকমের সমস্যা আমাদের জীবনকে ঘিরে থাকে। এই যে ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা-নাশতা। খেতেই হবে। না খেলে পেটে ক্ষুধায় তীব্র যন্ত্রণা হবে। কিছু না খেলে এই যে চলে না, এই যুদ্ধ দিয়েই আমাদের দিনের শুরু। এরপর দিনের প্রহর যত গড়িয়ে যায় প্রহরের সমান তালে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে সমস্যা আর সমস্যা।
প্রতিটি চলার মুহূর্তই মানুষের জীবনে, সমস্যার মুখোমুখি হওয়া। আর মোকাবিলা করতে করতে বেঁচে থাকা। যেমন ধরুন একজন ক্যান্সারের রোগী। সেও বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকার কি তীব্র বাসনা তার! সেজন্যই কি সে কেমো-রেডিয়েশন নিচ্ছে না! কিন্তু ওদিকে মৃত্যু নিয়ত তাকে ছোবল দেয়ার জন্যে প্রস্তুত। এই যে বেঁচে থাকার লড়াই জীবন আর মৃত্যুর সঙ্গে, একে কি বলবো? তবে অনেক সময় মানুষ তার সমস্যাগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কারণে না ধরতে পারে, না পারে বুঝতে। তবুও মানুষ, বোঝা না বোঝার ভান করে করেই বেঁচে থাকে।
মানুষের চাওয়ার যেমন অন্ত নেই। ক্রাইসিসেরও তেমনই শেষ নেই। মানুষের চাওয়া-পাওয়া অফুরন্ত বলে ক্রাইসিসও ফুরোয় না। চেয়ে চেয়ে কাঙাল হয়ে বেঁচে থাকা। কত দুঃখ আর মৃত্যুর মতো সত্য প্রতিদিন আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। কিন্তু এই অপরিমিত চাওয়ার ভারে মানুষ ক্লান্ত হয় না। যা পায় না, তারই জন্যে সীমাহীন লোভ। যা পেলো তার প্রতি অবহেলা। এই করে করে মানুষ অর্থহীন জীবনটাকে অর্থবহ করে তোলার উন্মত্ত নেশায় মত্ত। কত কিছুইতো আমাদের চাই। না চাইলে লাগে না। পেলে আরো চাই। আরো পেলে, আরো আরো চাই। আমাদের পেটটা যেন ভগবানের অপরিমিত ক্ষুধার দান। একদিকে যেমন দিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তেমন খেয়েই চলছে। খেয়ে খেয়ে তার ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় না। এমনকি তার খাওয়ার ছুতো করে সেগুলো আবার আমরাই খাই। আসলে এই ক্ষুধাটা কার? আমাদের না ভগবানের? ভগবান তো একটা অজুহাত। তেমনি অজুহাত সন্তানের। অজুহাত সংসারের। অজুহাত নিজের। সবার জন্যেই কিছু না কিছু চাই। ভাত থাকলে সঙ্গে ডাল। ডাল থাকলে সবজি। সবজি থাকলে চাই মাছ, চাই মাংস। আর সব থাকলে চাই, যা নেই। ভিখিরিদের চাই শুধু ভাত। না পেলে ভিক্ষে। ভিক্ষে না মিললে, চুরি। শুধু এক মুঠো ক্ষুধার অন্ন চাই। দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরের সময় সে চাওয়া আবার ফ্যানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হতে পারে।
আমাদের চাওয়ার কোনও শেষ নেই। লাগাম নেই। কোনও লজ্জাবোধও নেই। দুঃখ থাকলে সুখ। সুখ হলে দুঃখ। ঘুম এলে যে-কোনও জায়গায় একটি বালিশ পেতে ঘুমোলেই চলে। কিন্তু ঘুমের জন্যে আমাদের চাই রুম। রুম হলে, বেডরুম। বেডরুম হলে, মাস্টার বেডরুম। মাস্টার বেডরুম হলে …। অথচ শোবার একটু জায়গা, একটু ঘুম, এইটুকু হলেই কিন্তু শোয়া যায়। যেমন রাস্তায় অসংখ্য ভাসমান মানুষেরা ঘুমোয়। যেমন মুটে-মজুর, কুলি-রিকশাওয়ালা-টোকাইরা ঘুমোয়। অথচ পাশেই কি বিশাল ইমারতে কেউ হয়তো মাথা খুঁড়ে মরবে সামান্য একটু ঘুমের আশায়! ওষুধ খেয়েও ঘুম আসছে না। তা সে দালান-কোঠা, ফুটপাত যেখানেই হোক না কেন ঘুম, দু’জনেরই কিন্তু এক। পাঁচ হাজার টাকা বেতনেও সংসার চলে। আবার পাঁচ লক্ষেও। কিন্তু কখনো কখনো আমাদের পাঁচ কোটিতেও কুলোয় না। ক্রাইসিস লেগেই থাকে। কত। খাদ্য চাই! কত বিত্ত! ক’জোড়া জুতো! কটা গাড়ি, বাড়ি! ক’খানা কম্পিউটার সেলফোন! যখন সেসব ছিল না তখন দিন যায়নি! ব্রোঞ্জ-প্রস্তর-লৌহ যুগ, যায়নি! গ্যাছে, তখনও দিন গ্যাছে কিন্তু এখন যায় না। যায় না কারণ এখন যত আছে, আমাদের চাহিদাগুলো তার চেয়ে বেশি ক্ষমাহীন, সীমাহীন। “সীমাহীন লোভের কারণে সৃষ্ট চাহিদাগুলোই রূপ নেয় ক্রাইসিসে।” যেন বিপুল পরিমাণ বিত্ত, খাদ্য, পোশাক, প্রাসাদও আমাদের যথেষ্ট নয়। যদি হতো, তাহলে-পৃথিবীর সব পুঁজিবাদ বন্ধ হয়ে যেত। পুঁজিবাদ যা সৃষ্টি করে কৃত্রিম অভাব। অভাব নেই, তবুও। অভাব বাজারের। যেখানে ওরা বিক্রি করবে। মানুষ কিনছে একটার জায়গায় তিনটে। কিনে ফেলে রাখছে। পুরোনো হলে-গার্বেজে ফেলছে। কখনো কখনো আমরা পুঁজিবাদের এই কৃত্রিম ক্রাইসিসেরও শিকার। আমরা বলতে যারা গৃহী এবং গেরস্ত। যারা গৃহস্থ, তাদের ক্ষেত্র সংসার। সংসার হলো, সংসার চাহিদা এবং ক্রাইসিসের ভ্রূণ নিষিক্তের প্রসূতিকাগার।
এই যে বেঁচে আছি! বড়ই অবাক লাগে। বেঁচে আছি শোষণের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাস, ক্ষুধা, যুদ্ধ, অসুখ-বিসুখ, স্বৈরাচারী আচার-আচরণ, দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নিষ্ঠুরতা, চাহিদা, অস্থিরতা, ভগ্নহৃদয়, ব্যর্থ প্রেম …। প্রতিটি মুহূর্তেই সঙ্কট। যে কোনও কিছু ঘটে যেতে পারে। সামান্য কারণে মৃত্যু পর্যন্ত। একটু পা পিছলে পড়লেই মৃত্যু। একটা সংক্রামক ভাইরাস। একটা চলন্ত গাড়ির চাকা। রাস্তার হিংস্র কুকুর। সন্ত্রাসীর উড়ন্ত বুলেট। তবু বেঁচে থাকি দুর্ঘটনার মতো। মৃত্যুর কাছে আমাদের এই ক্ষুদ্রতা আমরা বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু না বুঝলেও তাকেই অতিক্রম করার যুদ্ধ। তাকে অস্বীকার করি বলেই ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারি। না হলে পারতাম না। ফলে শাসন-শোষণ, যুদ্ধের কারণে মানুষের এত যে অহেতুক মৃত্যু, এই অস্বীকারের ব্যাখ্যাও কিন্তু ঐ ক্রাইসিসের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। তবে মৃত্যু কাউকে ক্ষমা করে না। না শাসক, না শোষক কাউকে না। জীবনের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য যাকে আমরা প্রতিনিয়তই ভুলে যাই তা হলো–”জীবনের কাছে মৃত্যুকে আমরা ঋণ করেছি।” যার অর্থ মৃত্যু দিয়েই একদিন, জীবনের কাছে আমাদের যাবতীয় দায়-দেনা পরিশোধ করতে হবে। করতেই হবে। কেবল সেখানেই কোনও ক্ষমা-ঘেন্নার অবকাশ নেই।
একটি শিশুর জন্ম। যম আর মানুষ। মা ও শিশুর বিপন্ন জীবন। মৃত্যুর আগাম শঙ্কা নিয়ে এভাবেই আমাদের জীবনের শুরু। এবং তারপর থেকে মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত জীবনে, প্রতিটি দিন মানুষ যেন বেঁচে থাকে তার জন্মের উত্তর দিতে দিতে, কেননা মানুষ জন্মই একটা বিশাল প্রশ্নমালা। কেন বেঁচে আছি! কি জন্যে! নশ্বর জীবন ঘিরে বড় বড় প্রশ্নমালা। মন্বন্তরের হা-ভাতেদের মতো হাত পেতে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে! আর আমরা, তারই মধ্যে অপরিসীম আনন্দ ও যন্ত্রণায়-সরবে নীরবে, সুখে-দুঃখে জীবনযাপন করে যাই মাত্র কয়েক দশকের জন্যে মাপা যে জীবন, সেই জীবনকে, গোপনে গোপনে মৃত্যুর প্রস্তুতিতে।
আমরা ভাবতেই পারি, এত সব ক্রাইসিস এই বুঝি একটা সমাধানের মধ্য দিয়ে শেষ হতে চলছে। কত আশা আমাদের! অপেক্ষাই সার। একটি শেষ হচ্ছে আর একটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মেয়ে বড় হয়েছে। ছেলে পাস করেছে। নিজের ব্লাডপ্রেসার। ওষুধ। ডাক্তার। চেষ্টা, একটার পর একটা। বিয়ে হয়, চাকরি হয়, ডাক্তার হয়। বিয়ে হলে বাচ্চা হবে। চাকরি হলে বাড়ি-গাড়ি হবে। ব্লাডপ্রেসার কমলে তাকে সারাজীবন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ক্রাইসিসগুলো ভাইরাসের জীবাণুর মতো কেবলই বাড়তে থাকে শতক, সহস্র, অযুত-নিযুত আর কোটিতে।
সমস্ত জীবন ধরে এত এত জবাবদিহিতা। ব্যাংকের হিসেবের বইয়ে কোটি কোটি টাকা। বাড়ির গোটা বিশেক দলিল। বিশালাকারের সংসার। মাটির তলায় লুকিয়ে রাখা ঋণ খেলাপির অর্থ। ”আমাদের ক্ষুদ্রতা” মৃত্যুর হাত ধরে আরও ক্ষুদ্রতর হওয়া। অবশেষে একদিন লক্ষ্মী ছেলের মতো শোষক এবং শাসক দু’জনকেই, মৃত্যুর হাত ধরে চলে যেতে হয় সব ছেড়েছুঁড়ে। আর আমাদের ফেলে যাওয়া ক্রাইসিসগুলোকে ঘিরে। নতুন নতুন সব সমস্যার সৃষ্টি হয়। রেখে যাওয়া সম্পত্তি কে খাবে! কতটা খাবে! নির্ভর করে পেট কার কতটা বড়। কত বড় ক্ষুধা। ক্রাইসিস আমাদের চলে যাওয়ার পর পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যায় নবায়ন হয়ে।
এই যে এতো বড় বড় ঝড় আমরা কাটিয়ে উঠি! ক্যান্সারের মতো অসুখ! সন্তানের অকাল মৃত্যু। নিজের অকাল বৈধব্য। মনে হয় এরপর কি আর অন্ন খাবো? ঘুমোবো? বাঁচবো? তখন মনে হয় জীবন কত তুচ্ছ। এরপর সব-সব ছেড়ে দেবো। দিয়ে শুধু পরকালের কথা ভাববো। কিন্তু ক্রাইসিস কমলে, আমরা কি ঠিক আগের মতো গল্প করি, খাই-দাই, ঘুমোই, সিনেমা দেখি, শরীর খেলি। আমরা কি সন্তানের মৃত্যু-শোক কুলিয়ে ওঠা শেষ হলে, সত্যিই বিত্তের ভাবনাগুলো ছেড়ে দিই? গাড়িতে চড়ি না? ঘুমোই না! খাই-না! ক্যান্সার সত্ত্বেও কি সত্যিই ব্যাংকের ঋণ করা টাকা মেরে দিয়ে স্বেচ্ছায় দেউলিয়া হওয়া থেকে বিরত থাকি? হজ শেষের সব প্রতিজ্ঞাই কি রাখি? রাখলে যে পরিমাণ হাজী এই বাংলাদেশে রয়েছে শুধু তারাও যদি অন্তত তাদের প্রতিজ্ঞা পালন করে দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে পারতো তাহলে গোটা দেশের চেহারাটাই পাল্টে যেত। মনে রাখা প্রয়োজন, মুসলিমপ্রধান দেশের অধিকাংশ শাসকই ধর্মপ্রাণ হাজী। অথচ সেসব দেশেইতো দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি। সুতরাং আমার হিসেবে মেলে না কিছুই, কিছুতেই।
ক্রাইসিস কোথায় নেই। বেডরুম-লিভিংরুম, সেক্রেটারিয়েট, রমনা পার্ক, সংসদ, সংবিধান, গাঁজা স্ট্রিপ, শাঁখারিবাজার, পার্ক সার্কাস, কাবুল, ওয়াশিংটন, সুন্দরবন, বঙ্গোপসাগরের উপকূল, প্রতারক প্রেমিক, নিষ্ঠুর স্বামী, গার্মেন্টসের বিষ, জনসংখ্যা, বাতাসে কার্বন, ভেজাল খাবার, নার্সিং হোম আর হাসপাতালের অপারেটিং রুম, ক্রাইসিস কোথায় নেই? যা খাচ্ছি, যা পরছি, যা দেখছি, যা অনুভব করছি। বেঁচে থাকাটাই দুর্ঘটনা। মৃত্যু, সকল সন্দেহের ঊর্ধ্বে। পায়ের নিচে পড়লে সব পিঁপড়েই মরে না। কিন্তু ছ’তলা থেকে পা পিছলে পড়লে যে-কোনও মানুষের মৃত্যু সুনিশ্চিত। সুতরাং এত প্রতিকূল কিছুর মধ্যেও যে বেঁচে আছি এটাই মিরাকল। জীবন, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের মতো গগনচুম্বী। জীবন আবার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের মতো একটা খেলনা, একটা ঠুনকো হালকা চুড়িও। কয়েক সেকেন্ডেই ধসে যায়। কারণ যত শক্তিশালীই হোক, মৃত্যুর কাছে তা কাগজের চেয়েও-নরম।
লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, জাত, বয়স, সবাই সবকিছুর বিরুদ্ধে। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে। ক্রাইসিস, সৃষ্টি করে রেখেছে তার কোটি কোটি পা। মানুষ ইচ্ছে করে একটার বিরুদ্ধে আরেকটা দাঁড় করিয়ে তার বিরুদ্ধে নিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছে। যুদ্ধ তো আর কিছু নয়, শুধুই ক্লান্ত করবে। শুধুই শূন্যতায় ভরবে। অথচ সভ্যতা যখন ছিল না, তখন সমস্যাও ছিল পরিমিত। তাহলে দোষটা কার? সভ্যতার! আধুনিকতার! নাকি মূল্যবোধবিহীন মানুষের!
কটা টাকার জন্যে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নেয়া শিশুকে টুকরো করে ফেরত দেয় সন্ত্রাসী। যুদ্ধে জয়ী হয় একপক্ষ, অপরপক্ষের কয়েক লক্ষ কফিনের বিনিময়ে। কৃষ্ণাঙ্গরা তাই ক্রীতদাস। অস্পৃশ্যরা তাই অমানুষ। দারিদ্র্য তাই ফকির-মিসকিন। নারী, পুরুষের চেয়ে নিচু। শুধু অন্যায় আর বৈষম্য। একজাতি আরেক জাতির বিরুদ্ধে। এক দেশ আরেক দেশের বিরুদ্ধে। মানুষ, মানুষের বিরুদ্ধে। ক্যুনিজম গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। মানুষ ক্রাইসিসের সৃষ্টি করে। সৃষ্টি করে যেহেতু একটা উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষকে ব্যস্ত থাকতে হয়। নিষিদ্ধ ফলের ওপর আকর্ষণ বেশি। সমস্যা ভালো, সমাধান আমাদের পছন্দ নয়। ক্রাইসিস, একটা আনন্দ। একটা এন্টারটেইন্টমেন্ট। যেমন শাশুড়ি, বৌ পেটায়। বৌ শাশুড়িকে। স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে। এগুলো হলো গৃহস্থ-আনন্দ। দেশে দেশে, মহাবিশ্ব জুড়েই সর্বত্র সবকিছু, সবকিছুর বিরুদ্ধে, পরাজয়ের বিনিময়ে বিজয়ের আনন্দ করে। উল্লাস করে। নৃশংসতার বিনিময়ে একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হয়। এক জাতির বিরুদ্ধে আরেক জাতি জয়ী হয়। মানুষের বিরুদ্ধে শাসক, শোষক হয়। মৃত্যু, রক্ত, অন্যায়ভাবে মানুষের আনন্দ হয়। মানুষের কষ্ট দেখে মানুষ সুখী হয় এবং একমাত্র মানুষের পক্ষেই তা সম্ভব। কারণ আমরাই সবচেয়ে বড় অমানুষ!
তবে সব ক্রাইসিসকে ছাড়িয়ে আমার কাছে আজ যে ক্রাইসিসটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের ক্রাইসিস। নিজের সঙ্গে দূরত্ব। নিজেকে বুঝতে না পারা। আমিত্ব থেকে বিচ্যুতি-বিচ্ছিন্নতা। মানুষের বিভ্রান্তির শুরু এখানে। জীবনের অপচয়ও এখানেই।
যৌবনের শুরুতে যা একরকম, মধ্য এবং বৃদ্ধ বয়সে তা অন্যরকম। মধ্য বয়স যা বয়সের সঙ্গে সময়ের বিষয়। প্রত্যেকের জীবনেই এই সত্য অমোঘ। না হলে মানুষ কেন একই চেহারায়, সৌন্দর্যে, গঠনে, আজীবন এক থাকে না! কৈশোরের রূপ কেন যৌবনে পাল্টে যায়। বার্ধক্যে কেন যৌবনের রূপ থাকে না! কেন মাথার চুল আজীবন কালো থাকে না। কেন মুখের চামড়া মুখ থেকে ঝুলে পড়ে! কেন বৃদ্ধ বয়সের দাঁতগুলো যৌবনের মুক্তো ঝরানো হাসি হাসে না!
স্বৈরাচারী শাসকের চেয়েও বড়, সময় বড় নিষ্ঠুর এবং ক্ষমাহীন। সময় হাত ধরে আমাদের নিয়ে যায় জন্ম মুহূর্ত থেকে মৃত্যুর দিকে। শৈশব থেকে বার্ধক্যে। ওষুধ দিয়ে মৃত্যুকে দেরি করানো যেতে পারে। কিন্তু সময় তাকে ফেরানো যাবে না। কিছুতেই না। বার্ধক্য–ঠেকানো যাবে না। সময় তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে।
সময়ের যাত্রাপথে মানুষের সব বয়সের সন্ধিক্ষণ মধ্য বয়স। মধ্য বয়স, প্রথম এবং শেষ জীবনের মধ্যিখানে। কি সুন্দর একটি মিলনক্ষেত্র! মিলনক্ষেত্র, যখন আমাদের যৌবনকে আমরা জানাচ্ছি বিদায় আর বার্ধক্যকে জানাই অভিবাদন। যা জানাতে আমরা বাধ্য। কোনও বিত্ত বা ক্ষমতা একে রোধ করতে পারে না। মধ্য বয়স, জীবন নামে একটি মহাসমুদ্রের একেবারে মাঝখানে, যেখানে এসে জোয়ার এবং ভাটা কিংবা বলা যেতে পারে যোগ আর বিয়োগ মিলে, (+ -) = বিয়োগ। এবং এই বিন্দুতে পৌঁছে জীবনের মহাসমুদ্র, একটা নিরঙ্কুশ শূন্যতা, অর্থাৎ সাব-জিরো, যেখানে পৌঁছে মানুষ প্রথম খুঁজে পায় বিচ্ছিন্নতা, যৌবনের সাথে। যোগাযোগ অনুভব করে বার্ধক্যের সাথে। এই মহাসমুদ্রে তখন সে একা তার একমাত্র সঙ্গী হতে পারে তার ‘আমিত্ব’। কিন্তু এই আমিত্বকে যে চিনতে ভুল করে সেখানেই তার সর্বনাশের শুরু। আর যে চিনতে পারে, ধরতে পারে তার জীবনের আরো বহু খোলা জানালা এখানেই খুলে যাবে।
মানুষের মিডলাইফ যেমন আছে। মিডলাইফের ক্রাইসিসও তেমন আছে। একদিকে বিচ্ছেদের বেদনা। অন্যদিকে প্রাপ্তির। এই বিচ্ছেদ এই প্রাপ্তি কোনওটাই আমাদের কাম্য নয়। এই মহাসমুদ্র, ভীষণ অচেনা। কৈশোর-যৌবনের সোনালি সময় ফেলে কে যেতে চায় বার্ধক্যে! কে চায় মৃত্যুর হাতছানি! এই যে সন্ধিক্ষণ, জীবনের সঙ্গে সময়ের, মন ও অনুভবের, গ্রন্থির সঙ্গে হরমোনের! এই সময়ে অনেক রকম জটিলতার সৃষ্টি হয় মানুষের মনের ভেতরে। মেয়েদের মেনোপজ বা ঋতুর শেষ কয়েক বছর আর পুরুষের শুক্রাণুতে ভাটার সময়। উভয়েরই দুটো মূল্যবান সম্পদ জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার মতো দুঃসংবাদ। ফলে মেয়েদের শরীরের গোপন জায়গা হয়ে ওঠে শুষ্ক, আর ছেলেদের বেলায় শৈথিল্য। এই সময়ে পৌঁছে নারী ও পুরুষ উভয়েরই শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন, স্বাভাবিক ও সর্বজনীন। এর কারণ, সময়। সময়, যা একই সঙ্গে নিষ্ঠুর এবং ক্ষমাহীন।
যৌবনের অনেক নিষ্পাপ ভুল এখানে এসে প্রথম ধরা পড়ে। মিডলাইফ ক্রাইসিস, অতীতের পুঞ্জীভূত মেঘ, মেঘ যা অতীত জীবনের আকাশে শুধু স্তরে স্তরে জমেই গ্যাছে একটার পর একটা বছরের পৃষ্ঠে বছর ধরে, কোনওরকম বর্ষণ ছাড়াই। মধ্য বয়স, সেখানে পৌঁছে জীবনের আকাশ প্রথম কেঁপে ওঠে ঝড় আর বিদ্যুতের চমকানিতে। তারপর আসে বর্ষণ আর উতল হাওয়া। শুরু হয় ঝড়বৃষ্টি। ঝড় একটু করে কমে, আকাশের মেঘ একটু একটু করে পরিষ্কার হয়। অতীত, পরিচ্ছন্ন আকাশে তাকিয়ে নতুন করে প্রথমবারের মতো ফিরে দেখা যায়। যেখানে দেখা যায় যৌবনের সব পুঞ্জীভূত নিষ্পাপ কিংবা ইচ্ছাকৃত ভুল। একটার পর একটা। ভুল যা মনে হয়, না হলেও পারতো। না চাইলেও, করা হয়ে গ্যাছে। হয়ে গ্যাছে যা, অতীতে। অতীত যা এখন মৃত। যা এখন মৃত বলে দূরে এবং দূর বলে দূর থেকে যা আরো স্পষ্ট করে দেখতে পাওয়া যায়। দেখতে পাওয়া যায় তাকে, যাকে ঘটনার এত কাছে বলে অতীতে কখনোই মনে হয়নি, যে এগুলো ভুল বা এগুলো অপচয়। মধ্য বয়স, সেই অনুভূতিগুলো উপলব্ধির প্রথম বয়স। মধ্য বয়স, জীবনের সবচেয়ে সত্য, বাস্তব ও সুন্দর সময়।
কৈশোর ও যৌবনের যাচিত ও অযাচিত সমস্যাগুলো মধ্য বয়সে এসে প্রথম ধরা পড়ে। মিডলাইফের জটিল ক্রাইসিস মানুষের বাকি জীবনকে নড়িয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে নারীর জীবন। অতীতে তার মাতৃত্বের কারণে সকল শারীরিক, প্রাকৃতিক জটিলতা এবং বর্তমানের হরমোন পরিবর্তন, মেনোপজ, জরায়ুর শুষ্কতার কারণে করুণ। যৌনজীবন। সংসারে নারীর জীবন যেন বহুরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যে একটি যন্ত্রের মতো। যৌবন গেছে। এবার মধ্য বয়সে এসে শুরু হয় সত্যিকারের ঝড় কাকে বলে। তার রুচি-অভ্যেস-ঘর-সংসার-হৃদয়-মন এবং মানসিকতা। নারী, এখানে পৌঁছে তার সবকিছু নিয়ে, নড়ে ওঠে।
০৩. মিডলাইফ ক্রাইসিসের রহস্য
ক. মিডলাইফ ক্রাইসিস নিয়ে আমার কেন এই কৌতূহল, সে নিয়ে অনেকেরই মনে প্রশ্ন। আবার কিছু কিছু ভুক্তভোগীরা বলছেন, বাহ! বেশতো, সাবজেক্টটা তো বেশ ভালো! যৌবন আর বার্ধক্যের সন্ধিক্ষণের এই যে একটা সময়, এখানে পৌঁছে মৃত্যুর। প্রথম অনুভব। একে কি অস্বীকার করা যায়! সুতরাং এটাই তো লেখার শ্রেষ্ঠ বিষয়। এবং খুব ভালো বিষয়। আমিও বলি! সেই তো! ওরাও বলে! অনেকেই বলে। এবং অবশেষে দেখি, সবাই বলে।
বয়ঃসন্ধি-কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ। এক অনন্য পরিবর্তন এবং অনুভূতি। বালক ও বালিকাদের বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক পরিবর্তন, যা শাশ্বত। যা দৃশ্যমান। এই সময়ে তাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন লক্ষণীয়। প্রথমে ভাঙে তাদের কণ্ঠস্বর। নারী ও পুরুষের শারীরিক চিহ্নগুলোর পরিমিত বর্ধন হতে শুরু করে। মেয়েদের ঋতু, ছেলেদের বীর্যপাত ধরনের জটিল বিষয়গুলো যা হরমোনের সঙ্গে জড়িত, বয়ঃসন্ধিতেই হয় তার প্রথম প্রকাশ। শরীরে প্রথম এক অন্যরকম পুলকের অনুভব। রোমাঞ্চ আর অনুভূতি। আর এই রোমাঞ্চ থেকে শরীর অনুসন্ধানের কৌতূহল সবই সম্ভব হয় বয়ঃসন্ধিকালে। বয়ঃসন্ধি আনন্দের। বয়ঃসন্ধি বসন্তের। এই সন্ধি যৌবনের আগাম উৎসব। আমি তাকে বসন্ত বলি যেখানে যৌবনের কুঁড়ি ধরে, কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটে। রঙ লাগে। পাতা গজায়। যৌবনের প্রারম্ভে এই বয়ঃসন্ধি আমাদের যাচিত। নিজেকে ঘিরে এই মধুমাখা দুপ্রাপ্য সময় আমাদের বড় প্রাপ্তি। বয়ঃসন্ধির এমত কৌতূহল এবং ভালোলাগা খুবই কাম্য। কিন্তু তখন তা হয় গিয়ে যৌবন আর বার্ধক্যের বয়ঃসন্ধি! যেখানে পৌঁছে, যৌবনের সব জোয়ারে পড়ে ভাটা। সেটাও কি আমাদের কাম্য?
মিডলাইফ, সে-কি চিহ্ন, দুঃখের! সে-কি সুখের! সে-কী? কীসে? বার্ধক্যের প্রথম চিহ্ন দেখে আমরা কি ভয়ে চমকে উঠি না? মেয়েদের বেলায়, ঋতুতে অনিয়ম। যৌনাঙ্গে শুষ্কতা। হাঁটুতে ব্যথা, মেরুদণ্ডে ব্যথা। ব্যথা সর্বত্রই। ডাক্তার-ওষুধ, পথ্য। মাথায় পাকা চুল। দাঁতের মাঢ়িতে নেকলেসের মতো কালো কালো পাথর। পুঁজ, রক্ত, দুর্গন্ধ। দুই দাঁতের মধ্যে কালো অর্ধচন্দ্র গর্ত। ছেলেদের বেলায়, লিঙ্গ শিথিল হয়ে আসতে শুরু করে। রতিক্রিয়ার সময়ে পুরুষেরা ঠিক আগের মতো শক্তি পায় না। স্ত্রী, স্বামীকে দায়ী করে, কেন তুপ্তি হলো না। সুতরাং এত কিছু নিয়ে যে বয়স ও সময়টা জীবনে আসে, যৌবনের বিপরীত যা, তাকে নিয়ে লিখবো না তো কি নিয়ে লিখবো! তবে এখানেও ভাগাভাগির প্রশ্ন আছে। সমস্যা এই বয়সে কারটা বেশি! পুরুষ না নারীর। এর সোজাসাপটা উত্তর, নারীর। মেয়েদের মিডলাইফের সমস্যা অনেক অনেক গুণে বেশি। তার কারণ মেয়েদের রয়েছে সামাজিক সীমাবদ্ধতা। নারীর এত সীমাবদ্ধতা না থাকলে তার সমস্যাগুলো পুরুষের সমস্যার মতোই আবছা এবং অস্পষ্ট হতে পারতো।
প্রাপ্তি আর হারানোর এই বয়সে মেয়েদের সবচেয়ে বড় সমস্যা শরীরে তার হরমোনের পরিবর্তন। তার মাসিক ঋতু বন্ধ হয়ে যাওয়া। যাকে বলে মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি। ঋতুর পরিবর্তন, তার মনের ও চেহারার পরিবর্তনের সঙ্গে সংযুক্ত। মেনোপজের শুরুতে বা মধ্যখানে অনেক মেয়ে, এমনকি আত্মহত্যা করার মতো মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যেতে পারে। ঋতুবন্ধের আগে যেমন লাগতো, মন বা শরীর কোনওটাই ঋতু বন্ধের পরে তেমন লাগে না। ইংরেজিতে তাকে বলে ব্লু ফিলিং। বাংলায় নীল অনুভূতি। অনেক কিছুই তখন ভীষণ অন্য রকম মনে হয়। কেমন যেন ভালো না লাগার একটা সার্বক্ষণিক অনুভূতি। ভয়, না চাইলেও বার্ধক্য দুয়ারে এসে গ্যাছে। ওপরের ঠোঁটের দু’পাশে নাকের বাঁশি বরাবর মাংসের লম্বা দুটো ভাজ। আর নিচের ঠোঁটের দুই পাশের কোণার মাংসে দুটো ভাঁজের আগাম আলামত। মুখশ্রীতে কি বিশ্রী একটা পরিবর্তন! থুতনি, নাক সবকিছুই একটু নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। ভাঙে। নাক সংলগ্ন চোখের দু’কোণে জমে ওঠে ক্লান্তিজনিত কালো ছাপ। প্রস্তুতি নিতে থাকে। চোখ দুটো ভিতরের দিকে যাওয়ার। চেহারায় ম্লান হতে শুরু করে যৌবনের সৌন্দর্য। গাল দুটো ভারি হয়। একটু অতিরিক্ত মেদ, এখানে সেখানে সবখানে বিশেষ করে পেটে যাকে বলে নেয়াপাতি ভুড়ি। আয়নায় দাঁড়িয়ে মনে হবে–সত্যিই! এই ভঁজ কি সত্যি! এবং তা শত চেষ্টা সত্ত্বেও, মিথ্যে হয় না। সব মিলিয়ে বার্ধক্যের একটা ছাপ, চোখে পড়ার মতো। শিথিল হয়ে আসে শরীরের চামড়া। ত্বক হারায় তার লাবণ্য। মিডলাইফ, শরীরের ও মনের আরেক ধাপ আগাম পরিবর্তনের পুঞ্জীভূত মেঘবর্ষণের সময়সীমা।
মেয়েদের আরেকটি অন্যতম জটিল সমস্যা তার জরায়ু। তার মাতৃত্বের পাসপোর্ট যা বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে এই বয়সে। যেমন টিউমার বা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। ফলে অনেক সময়েই এই জরায়ুটা তাদেরকে ফেলে দিতে হয়। জরায়ু, একখণ্ড মাংসপিণ্ড, যা হরমোনের ভারসাম্যতা রক্ষার জন্যে জরুরি। ফলে, জরায়ু হারিয়ে নারীর জীবনে বিভিন্ন সমস্যার আগমন হয়, যা সৃষ্টি করতে পারে ছোটখাট ছাড়াও,ভারসাম্যহীনতার সমস্যা।
খ. আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে নারী নির্যাতন অনেকটাই প্রথার সামিল। হবেই, অল্প বা বেশি। বিয়ের পর থেকেই নারীর ওপর পুরুষের যে নির্যাতন তার প্রভাব, সেখান থেকে সৃষ্ট তার মানসিক প্রতিক্রিয়া, এর সবই যৌবনের তারুণ্যে ও শক্তিতে কাটিয়ে ওঠা যায়। মধ্য বয়সে না পৌঁছুনো অবধি ক্রাইসিসগুলো ঠিক বোধগম্য হয় না। বোধ, যা তাকে এই বয়সে এসে জাগায়, তাড়না দেয়। ভাবায়, চেনায়। মধ্য বয়সে আমরা, কি-না ভাবি? যৌবনে যা ভাবতে পারি না, মধ্য বয়স আসে সেই ভাবনাগুলো নিয়ে। সংসার-সন্তান, দায়িত্ব এবং তার প্রভাব। যা, মধ্য বয়সে পৌঁছে জন্ম দেয় একটি বোধের, যা নারীকে করতে পারে অনুশোচনায় ভারাক্রান্ত! জীবনে সে কি করলো আর কি করলো না। সংসার করার লাভ ও ক্ষতি। এবং ক্ষতি যার বেশি সে ভাববে, সংসারের বিড়ম্বনা তার জীবন থেকে এই যে যৌবনের বছরগুলোকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল, পড়ে থাকা বাকি বার্ধক্য দিয়ে সে করবেটা কী? বার্ধক্য, তার কি কোনও কাজে লাগবে! একমাত্র অসুস্থ হওয়া, পরের গলগ্রহ, বা বৃদ্ধ হওয়া ছাড়া! অথচ তার বিদ্যা তার বুদ্ধি সবই ছিল। সে শিক্ষক হতে পারতো। ব্যাংকে চাকরি করতে পারতো। শিল্পী-সাহিত্যিক অনেক কিছুই হতে পারতো। পৃথিবীতে সংসার ছাড়াও করার বিষয় কি কিছু কম ছিল। তার মনে হতে পারে। কিন্তু সংসার ও সন্তান তাকে সে সময়, বা সুযোগ, কোনওটাই দেয়নি। এখন সময় আছে তবে মন নেই। স্বামীও তাকে যথেষ্ট সময় দেয়নি। কথায় কথায় সে করেছে অপার সন্দেহ, মৌখিক আর শারীরিক নির্যাতন। সুতরাং ”মিডলাইফের অনুভূতি, যদি হয় অতীতের অনুতাপ, তবে তার তাপ রূপান্তর হতে পারে ভবিষ্যতের ক্রাইসিসে।”
এখন সে আর যুবতী নয়। তবে বৃদ্ধও নয়। যদি এখান থেকে সে অন্য কোথাও যায় যাবে, শুধু বার্ধক্যের দিকেই। পরমায়ু শেষের দিকে। ভাটার দিকে। জোয়ারের উল্টো ভাটা। আর যৌবনের উল্টো, বার্ধক্য। তখন কৈশোর আর তার যৌবনের সবচেয়ে বড় সম্পত্তি। তার মাসিক ঋতু যার শুরু হয় বয়ঃসন্ধিতে, যার আগমনে শরীরে যৌবনের জোয়ার নামে, যার উপস্থিতি মানে সে যুবতী, সেই অনন্য সম্পত্তিটুকুও তার এখানে এসেই হারিয়ে যায়। অর্থাৎ সে আর যুবতী নয়। এই অনন্য সম্পদ হারিয়ে যাওয়ার খেসারত প্রচুর। প্রথমত, তার মানসিক ও শারীরিক জটিলতা। আর দ্বিতীয়ত, তার শরীরে মেনোপজের কারণে যে শুষ্কতার সৃষ্টি হয়, রসক্ষরণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট অসুবিধায়। অনেক পুরুষই তার নারীর শরীর ত্যাগ করে বা অবহেলা করে। অনেকেই পরকীয়া, কেউ কেউ অন্য বিয়ে। মাসিক ঋতু বন্ধ হয়ে যাওয়ার মানে সে এবার বার্ধক্যের দুয়ারে। নারীর মেনোপজ, যার প্রতিক্রিয়া কেড়ে নিতে পারে রাতের ঘুম। জীবনের মায়া।
কালজয়ী শেক্সপিয়রের ভাষায় জীবন একটা রঙ্গমঞ্চ। আর সকলেই এখানে অভিনেতা। আমরা সব অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা এখানে পৌঁছেই ঠিক করে ফেলি নাটকের শেষের অঙ্ক কেমন হবে। জীবনটা কী ক্রাইসিস! নাকি ক্রাইসিস নয়। মিডলাইফে এসে, মানুষ প্রথম অনুধাবন করে নিজের সঙ্গে শরীর, মন ও আত্মার অবিচ্ছেদ্য যোগাযোগ। মিডলাইফ, একটি চরম সত্য। এই নিষ্ঠুর চরম সত্য উপলব্ধির জন্যে নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত একটি সময় ও বয়সের একটি কেন্দ্রবিন্দুই হলো মিডলাইফ। সে আসে অনেক অনেক ক্রাইসিস সঙ্গে নিয়ে।
০৪. বাস্তবিক ও মানবিক
ধারালো, অর্থভারি শব্দের ফুলঝুরি ছড়িয়ে আর বুদ্ধির কড়চা নয়, বরং সহজ সরল গদ্যে মানুষের হৃদয়ে মাঝচল্লিশে যে ক্রাইসিসগুলো সহসা এসে হুমড়ি খেয়ে নড়িয়ে দেয় জীবনের খুঁটি। সেসব নিয়েই লিখতে বেশি ভালো লাগে। কারণ বিষয়টা দারুণ বাস্তব ও মানবিক। মানুষের হৃদয়ে যদি সাড়াই না জাগলো তাহলে সে লেখা লিখে লাভ কী? এবং এই কথাগুলো মানুষের কথা। সবার কথা। সব মানুষের। আমি চাই মানুষের কথা বলতে। তাদের দুঃখ-সুখ, তাদের হৃদয়। মাঝচল্লিশ, নারী আর পুরুষের জীবনে, মন ও হৃদয়ের ক্রান্তিলগ্ন। প্রশ্নবোধক বর্তমানকে ঘিরে, অতীতের সাথে ভবিষ্যতের ক্রান্তিকাল। যেখানে ভোর এবং সকালের আলোর সন্ধিক্ষণের মতো জীবনের দুটো সময় একটার মাঝে আরেকটা এসে মিলিয়ে আবার, দিনের আলোয় বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মাঝচল্লিশ, অতীত এবং ভবিষ্যতের সম্মিলিত মঞ্চে নাটকের উৎসবের মাঝপথে, দৃশ্য বদলের অঙ্ক, সমাপ্তির প্রস্তুতির পথে।
জীবন মধ্যাহ্নের নাটকে, সময়ের সাথে সাথে যখন দৃশ্য বদল হয় তখন, শেষ অঙ্কে পৌঁছে বেশি সময়েই দেখা গেছে হাসির বদলে কান্না। শুকিয়ে যাওয়ার বদলে, রক্ত। মূল কারণ পরকীয়া। পরকীয়ার চেহারাই তাই। নীল-নীল মেঘ নদী। সুখ নেই। যাকে না গেলা যায়, না যায় উগরানো। শাখের করাত।
ব্যক্তিগত জীবনে সৃষ্ট সঙ্কটের জবাব দিতে গিয়ে পরকীয়ার মতো, বিকল্প জীবনের শান্তি খোঁজেনি সংসারে এমন সাধু বা সতী ক’জন আছে! সংসারের বাইরে দু’দণ্ড শান্তির পথ। এই সমস্যাগুলো তাদেরও, আমার এবং আপনার মতো, নিতান্তই আপন! তফাত শুধু, কেউ সাড়া দেয়। কেউ দেয় না। ব্যক্তিগতভাবে সন্ধান করে করে এই বিষয় নিয়ে প্রচুর সাড়া পেয়েছি প্রকাশ্যে এবং নীরবে দুইভাবেই। কেউ কেউ বলে, অবশেষে জানতে পারছে এত খোলাখুলি। বলে এ যে আমারই কথা! আমাদের সমস্যা। আসলে সঙ্কটে আমরা সকলেই এক। একটি সঙ্কট লাগে, এক হতে গেলে। আমরা রক্ত-মাংসের মানুষ, আর তাই আমাদের দুঃখকষ্টভারগুলোও একই তরঙ্গে বয়। কিন্তু উল্টো কেউ কেউ যে থুতুও ছিটোচ্ছে না তাও বলবো না। কিন্তু তাতে আমার কি কিছু এসে যায়? যায় না। কারণ ইটস অ্যা ফ্যাক্ট।
দিনের শেষে দিনের শুরুতে, মাস্টার আর স্লেইভ, যে যেখানেই থাকুক, তাদের। সবচেয়ে বড় পরিচয় তারা হৃদয় এবং আবেগতাড়িত মানুষ। অনেক মানুষই তার হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতির কাছে কারাবন্দি, বুদ্ধিহীন শিশু। মাস্টার বা স্লেইভ বিছানায় সবাই এক। সেখানে আমি আপনি সবাই ভালোবাসি, মানুষকে। যন্ত্রকে নয় প্রকৃত অর্থে, ভালোবাসি। যার উদাহরণ, একটি শিশুর জন্ম। মাস্টার বা স্লেইভ। এখানে কোনও কৃত্রিম বলে কিছু নেই। একেবারেই আদিম। স্পষ্টত খোলামেলা, অকৃত্রিম।
প্রেমবিহীন জীবন কোনও জীবনই নয়। বয়স্ক গাছেও আমের মুকুল ফোটে। চৌষট্টি বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধার গর্ভে সন্তান আসে। প্রেম সর্বদাই রোমাঞ্চসঞ্চারী। চির যৌবনা, যে-কোনও বয়সেই। প্রেম, বয়সবিহীন এবং অমীমাংসিত। ”প্রেম–দূরান্বিত করে বার্ধক্য। আর প্রেমহীনতা বার্ধক্যকে করে ত্বরান্বিত।”
বিয়ের পরে প্রেম! সমাজ বলতেই পারে–সেই প্রেম, পরকীয়া যত্তসব নষ্টামো তার নষ্টামো। নোংরা। ছিঃ! কিন্তু হৃদয়ের অনুভূতির অপূর্ণ কোষগুলো যখন মস্তিষ্কের স্নায়ুতে গিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করে বলে, দাও প্রেমের সুধা। দাও জল। দাও ফল ও ফুল। তখন সে কি করবে! হৃদয়ের কাছে আমি কি ক্ষুদ্র নই! আপনি কি দরিদ্র নন? সেও কি ভিক্ষুক নয়! আমি, আপনি ও সে, অতঃপর হৃদয় নদীর তীরে আমরা সকলেই, শ্রীশ্রী বোকাঁচন্দর। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ যেমন। বৃষ্টির ভূতলের বদলে আকাশে পতনের আশা যেমন। পাহাড়ের চূড়া আকাশের বদলে উল্টো মাটিতে দেখার প্রত্যাশা যেমন! অবাস্তব, অসম্ভব। ঠিক তেমনি, মাঝ বয়সে হৃদয়ের হঠাৎ পরিবর্তন, চিনতে পারার ভুলে তার বিরুদ্ধচারণ, তা ক্ষতিকরই শুধু নয়, অন্যায়ও। নিজের প্রতি নিজের দারুণ ক্ষতি। সুতরাং পরকীয়াকে অস্বীকার করা বা অশ্লীল বলা কোনওটাই ঠিক নয়। স্বাভাবিক বিবাহিত জীবনের মতোই, পরকীয়াও জীবনের উল্টো পিঠ, যেখানে প্রেম আছে। ভালোবাসা আছে। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ, কান্না, বিরহ, হাসি, সুখ, ঘর ও সন্তান আছে। পরকীয়া যদি হয়, তখন তা কোনও না কোনও কারণে বা যুক্তিতে হয়।
বিত্ত বা ক্ষমতা কিংবা যুগপৎ এ দুই থাকলে কি না সম্ভব! পৃথিবীর সর্বত্রই বিত্তবানদের দ্বৈত সংসার। অগণিত রম্যবালা তারা কিনে রাখে, কিংবা পারলে খাঁচায় পুষে রাখে দেশে-বিদেশে তাদের প্রাসাদগুলো বা প্রমোদ তরীতে চলে ঘরের রমণী ফেলে বাইরে বাইরে সুরা আর সাকির, দ্বৈত জীবনযাত্রা। তখন মনে হয় কেন বিত্ত হয় না! কেন ক্ষমতা হয় না! এমন মিডলাইফ ক্রাইসিস কেন হয় না, যখন ধর্ম এসে তাকে আরো সম্প্রসারিত করে সমৃদ্ধির হাত এভাবে বাড়িয়ে দেয়। বাহ! কি মজা। কি মজাদার এই রাজকীয় ক্রাইসিস। মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকা এসব দেশের শরিয়া আইনের সুযোগে বিত্তবান মুসলমান পুরুষদের সংসারে একাধিক স্ত্রী কোথায় নেই? আমরা তাকে পরকীয়া না বলে বলি, বহুবিবাহ। বহুবিবাহ কি বিয়ের অজুহাতে বিকল্প পরকীয়া নয়! যা শুধু পুরুষেরাই একাই ভোগ করে! বহুবিবাহ, পরকীয়ার একটা বিকল্প ব্যবস্থা। সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ থাকা উচিত নয়। এবং মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এসব দেশের বিত্ত বা ক্ষমতাবানদের জীবনে বহুবিবাহ এবং পরকীয়া, খোলাখুলি ব্যাপার! বহুবিবাহ, পরকীয়া, আরব বা আফ্রিকার মুসলিমদের জন্যে যে বিলাসিতার সম্ভার বিশ্বের কোথাও, নারীদেহ নিয়ে তার সমান্তরাল কিছু নেই। দুঃসংবাদ! নারীদের জন্যে নেই বহুবিবাহ। পরকীয়া করলে ওদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। দুঃসংবাদ দারুণ–দুঃসংবাদ।
দুর্বল হৃদয় এবং লোভী যৌনাঙ্গের কাছে, মানুষ বুদ্ধিহীন। সোজা কথা প্রেম ও কামের কাছে আমরা সবাই কোনও না কোনওভাবে পরাজিত। যার হৃদয়ে হঠাৎ সে আক্রমণ করবে, তার রক্ষে নেই। জবাব দিতেই হবে, হয় নিজের, না হয় অন্যের হৃদয় নিঃশেষ করে।
০৫. আত্মতৃপ্তি
ক. প্রথাবিরোধী বাক্যই চতুর্দিক থেকে পাগলা ঘণ্টির মতো বেজে উঠতে থাকে সর্বনাশের কলরব কোলাহলে। আমাদের জীবনটা যেন শুধু সংসার আর সংসারকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। আমাদের বিশ্বাস, সংসার না হলে জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কিন্তু আসলেই কি তাই? সংসার না হলে সত্যিই কি জীবন অসম্পূর্ণ?
সব মানুষই সমান হয়ে জন্মায় না। সব মানুষের মনমানসিকতা, ইচ্ছা, রুচি এক হতে পারে না। অর্থাৎ পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষই যার যার নিজের মতো আলাদা। এদের মধ্যে, যারা শুধুই বেঁচে থাকার জন্য জন্মায় তাদের জন্যে সংসার হলো একটি সঠিক চৌরাস্তা। নিজেকে এখানে কারণে-অকারণে ব্যস্ত রাখার অনেক সুড়ঙ্গ খোলা রয়েছে। কিন্তু সমস্যা তাদের নিয়ে যারা শুধু কারণে-অকারণে বেঁচে থাকার জন্যে জন্মায় না। পৃথিবীকে কিছু দেয়ার জন্যে জন্ম যাদের।
যারা অসাধারণ, কিছু দেয়ার জন্যে জন্ম যাদের, তাদের জন্যে চাই সংসারের চৌরাস্তার চেয়েও আরও অনেক বড় কিছু। চাই অনুভবে, চাই শূন্যতায়। চাই প্রথার কারুকার্যের বাইরে, সৃষ্টির অমূল্য পাথর। চাই কোহিনূর! হ্যাঁ কোহিনূর! এবং এই অনন্য হীরক খণ্ডটি পেতে হলে নিজেকে নিয়ত পুড়িয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার হতে হয়। আর সংসার, এখানে পুড়িয়ে অঙ্গার হওয়ার চেয়ে নিয়ত পোড়া অঙ্গার হতে হয়। এই অঙ্গারে শুধু ছাই আছে। কোহিনূর নেই। সুতরাং অসাধারণ মানুষদের জন্যে চাই, সংসারের বাইরের অন্য কিছু এবং অনেক কিছু, যেখানে তারা খুঁজে বেড়াবে–সেই দুর্লভ হীরক খণ্ডটি।
জীবন, অনুভবের। অনুভব, যা উপভোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখার, একধরনের প্রাপ্তিযোগ। আমাদের মধ্যে ব্যক্তিক্রমী কিছু সৃষ্টিশীল মানুষ আছে যারা উপভোগের বদলে অনুভবের মধ্য দিয়ে খুঁজে পায় তাদের সৃষ্টির প্রয়োজনীয় চিন্তাভাবনা। সংসারে বা সংসারের বাইরে থেকেও, অনুভবের পুঁজিটুকু দিয়ে তারা সৃষ্টি করে শিল্প। সৃষ্টি করে সাহিত্য। আর এই লেখাটি সাধারণ এবং অসাধারণ এই দুই ধরনের মানুষের জন্যে। দুই পিঠে যার, উপভোগের বিরুদ্ধে অনুভব। গৃহীর বিরুদ্ধে প্রথাবিরোধী মানুষ।
আমাদের খিদে পায়। ক্ষুধার কামড় বলে একটা কথা আছে। যতক্ষণ না খাওয়া হবে, ততক্ষণ এই কামড় খাবারের সবরকম রসনা ও আস্বাদনের অনুভূতি দেবে। কিন্তু খাওয়া মাত্রই ক্ষুধার তীব্র অনুভূতি শেষ হয়ে যায়। তখন মনে হতে পারে কেন খেলাম! তেমনই, কাম ও রতি। না পাওয়ার তীব্রতা থেকে অনুভব হয় শরীরের পুলক ও রোমাঞ্চ। কল্পনা, মুহুর্মুহু রতি অনুভবের। প্রেম হয়ে গেলেই, হৃদয় ভরে ধরে রাখা, সেই সুখানুভূতিও চলে যায়।
না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে সৃষ্ট সারাক্ষণ পাওয়ার অনুভূতির মধ্যে সকল পাওয়ার যে নিবিড় সুখ, উপভোগ থেকে তা আসে না। সেই পাওয়াকে বরং তুলনা করা যেতে পারে হারানোর সঙ্গে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে মানুষ শুধু অনুভূতি আর কল্পনা নিয়েই বাঁচবে। আসলে বলতে চাওয়া হচ্ছে স্বল্পসংখ্যক, সেই সব মানুষের কথা যারা বাতাসে, জলে, সমুদ্রে, নক্ষত্রে, ঘাসে, যেদিকে খুশি তাকায় না কেন, কিছু না কিছু অনুভব উপলব্ধি করে সেখান থেকে খুঁজে বের করে নিতে পারে, সৃষ্টির জন্যে উপযুক্ত চিন্তাভাবনা।
তবে অনুভবী মানুষগুলো সংখ্যায় বড় অল্প। স্বেচ্ছায় এই কষ্ট, এই নির্বাসন, সহজ কোনও কাজ যে নয়, একমাত্র ভুক্তভোগীরাই তা জানে। তবুও কিছু কপালপোড়া মানুষ এই নিঃসঙ্গতাই বেছে নেয়। পৃথিবীতে তারা সংসারে থেকেও, নির্বাসিত ভেতরে এবং বাইরে। জীবনানন্দের ‘বোধ’ নামের কবিতাটির সঙ্গে কবির এবং আমাদের এই নিঃসঙ্গ নির্বাসনের একটা অনন্ত মিল।
“আলো-অন্ধকারে যাই–মাথার ভিতরে
স্বার্থ নয়, কোনো এক বোধ কাজ করে!
সকল লোকের মাঝে বসে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা! …”।
খ. মনে হয় শিল্প ও সাহিত্যের জগতে যত সার্থক এবং স্মরণীয় সৃষ্টি রয়েছে তার অধিকাংশ স্ৰষ্ঠাই নিঃসঙ্গ এবং অনুভবী জগতের মানুষ। এমন সৃষ্টির মধ্যে ‘গীতবিতানের’ নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ্য। গীতবিতান, জীবনের যাবতীয় সঙ্কট মুহূর্তে, সব প্রশ্ন এবং সব উত্তরের বিশ্বকোষ। উত্তর, যা তাৎক্ষণিক। যা সত্য। মনে হবে গানটি একান্তভাবে তারই জন্যে রচিত যে তাৎক্ষণিকভাবে সেই অনুসন্ধানে ব্যাপৃত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আকাশ-সমান ধরন-ধারণ ক্ষমতা ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে। কবিগুরুর সব বয়সের অনুভূতিগুলো, যার সবটাই তার নিজের সঙ্কট হয়েও যা আমাদেরও সঙ্কটের সঙ্গে মিলে গিয়ে রচিত হয়, গীতবিতান। তার অনুভূতি, আমাদের প্রাপ্তি। একজনের অনুভব বিতরণ হয় কোটি কোটি মানুষের সমস্যার উত্তর হয়ে।
গ. আমরা কি নিজেকে চিনি! আমি ও আপনি মিলে আমরা যে চারদিকে সারাক্ষণ অসুখী মানুষের পাহাড় গড়ে চলেছি, এই গুজব কি মিথ্যে? প্রতিদিনই আমরা কি অসুখী নই। কোনও না কোনও অজুহাতে। কেউ সরবে। আবার কেউ-বা নীরবে। যার বিত্ত আছে, যার নেই, সবাই কিন্তু একসঙ্গে গলা মিলিয়ে কীর্তনে যোগ দিই। যে বন্ধ্যা, যে নয়। যার টইটম্বুর, যে শূন্য। ব্যাধিহীন যে, যার শরীরে ক্যান্সার। মানুষ অসুখী, সব উপভোগ, সব অনুভব, সব সত্ত্বেও মানুষ অসুখী। আপন মনে হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস পড়বেই। যে সব পেয়েছে, আরো চাই বলে। যার কিছুই নেই, সামান্য চাই বলে। চেয়ে চেয়ে শুধু কাঙাল হওয়া। সংসারের দায়িত্বে পড়ে আমরা ভুলে গেছি, আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ নিজেকে চেনা। আমাদের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো সংসারের তাগিদে যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
সংসার থাকলে, চাহিদা ও সমস্যা থাকবেই। এবং সে কারণে নিজের সঙ্গে একটা সমঝোতা গড়ে নিতেই হয়। সংসারী মানুষের থাকে কতরকমের দায়বদ্ধতা। ছেলেমেয়ে, রোজগার, আত্মীয়স্বজন। মানুষদের জীবন থেকে সংসার গিলে খায় সময়। সময় গিলে খায়, বয়স। আর সংসারের গর্ভে হারিয়ে যায়, সময় এবং বয়স দুটোই। সৃষ্টিশীল মানুষদের জন্যে সংসারের সঙ্গে কোনও রকম সমঝোতা, সর্বনাশের চিহ্ন।
উপভোগ আর অনুভবের নির্দিষ্ট কোনও সংজ্ঞা ঠিকঠাক দেয়া কি সম্ভব। বিষয়টা-মনস্তাত্ত্বিক। শুধু চোখ দিয়ে দেখে, কান দিয়ে শুনে, যা দেখি, যা বুঝি, তাই বোঝাতে চাই। অনুভবের যেমন রয়েছে উত্তাপ। উত্তাপ, যা জ্বালিয়ে দেয় বোধের কোষ। সেই জ্বালানো-পোড়ানো থেকে সৃষ্টি হয় কোহিনূর। কিন্তু সংসারী মানুষদের মধ্যে যারা সৃষ্টিশীল তারা সংসারের দায়িত্বে ক্লান্ত হতে হতে একসময়, নিরুত্তাপ হয়ে ওঠে বলেই তাদের বোধের কোষে সৃষ্টির আর কোনও যন্ত্রণা থাকে না। ফলে তারা হতাশা নামক শূন্যতার এক অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হয়। এজন্যই মহাজনরা সংসারের নাম রেখেছে সৃষ্টিশীলদের জন্যে সর্বনাশের তীর্থক্ষেত্র। রবীন্দ্রনাথও কি বলেননি, ‘সেদিন চৈত্রমাস/তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ।‘ সংসারের তাগিদে এই অবক্ষয় প্রথম অনুভব হয় যে বয়সে সেটাই মধ্য বয়স।
ঘ. আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই কিছু না কিছু সম্ভাবনা থাকে। থাকে সক্ষমতা। কেউ তাকে সাহসের সাথে উন্মুক্ত করতে পারে। কেউ তাকে অজুহাত দিয়ে উড়িয়ে দেয়। কেউ ভয়ভীতি দিয়ে ঢেকে রাখে। অধিকাংশ মানুষই তাদের সক্ষমতাকে ভয় পায়। প্রতিভা অপচয়ের ব্যাখ্যায় সংসারের অজুহাতের জুড়ি নেই। এ কারণ, সে কারণ। কতই না কারণ আমাদের অজুহাতের! ছেলের অজুহাত, মেয়ের অজুহাত সংসারের অজুহাত। কিন্তু সময় কাউকে ক্ষমা করে না। এবং অলস সময়গুলো, বয়স গিলে খাওয়ার সাথে সাথে মনের অধঃপতনকে দ্রুত করে। মন, যা পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় রহস্য। মন, যার কোনও বসতি নেই, পরিচয় নেই, ঠিকানাও নেই। মন, যা সকালের আবহাওয়ায় যেমন থাকে, দুপুরে থাকে না। যা প্রতিদিন এক পোশাকে থাকে না। প্রতিটি সকাল এক মনে হয় না। কখনো দুঃখ, কখনো সুখ কোন কারণ ছাড়াই। সন্ধেবেলায় পুকুর পাড়ে নির্জনে বসলে যেমন লাগে, কোলাহলে তেমনটা লাগে না। টিন-ইজ মনের সঙ্গে মধ্য ত্রিশের মনের সম্পর্ক আলাদা। সন্ন্যাসীর আলাদা। গৃহীর আলাদা। পথিকের আলাদা। জীবনের প্রকৃত অনুভূতিগুলোকে একমাত্র সৃষ্টিশীল মনই যথার্থ ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে পারে। সুতরাং ‘বন’ রক্ষার মতো ‘মন’ রক্ষাও জরুরি। এবং সৃষ্টিশীলদের মনের বেলায়, এখানে কোনওরকম হস্তক্ষেপ কিংবা প্রভাব –নিষিদ্ধ।
স্বামী, স্ত্রীর প্রভাবে, স্ত্রী স্বামীর। সংসারে আমাদের চিন্তাধারাগুলো অন্যের রুচি ইচ্ছা-ফরমায়েশে চলে। অন্যের বা অন্য কিছুর প্রভাব সৃষ্টিশীল মানুষদের সৃষ্টির মৌলিক চিন্তার বিরুদ্ধে কাজ করে। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হলে, মৌলিক চিন্তাগুলো হারিয়ে সে নিঃস্ব হতে পারে। অনুভূতি তখন আর অনুভবে সীমাবদ্ধ থাকে না। এবং তা গতি পরিবর্তন করে রূপান্তরিত হয় দায়িত্বে। দায়িত্ব, অন্যের প্রতি। এবং এর ভেতর থেকে যা সৃষ্টি হবে–তা ঘুণে ধরা। তা মৌলিক নয়। যা মৌলিক নয়, তা সৃষ্টি না করাই ভালো। নিরঙ্কুশ নিঃশর্ত নিঃসঙ্গ না হলে, সেই সৃষ্টির মূল্যও নেই। সেই সৃষ্টিও, দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। সেজন্যেই অপসৃষ্টি বা কু-সৃষ্টি দিয়ে বাজার ভরে গেছে। অনেকটা অক্ষম অনুবাদ সাহিত্যের মতো। অন্যের জিনিস, অন্যের চিন্তার, অসম্ভবকে সম্ভব করার প্রয়াসে, বিকৃত রূপান্তর।
নিজের চিন্তায় নিজে বিকশিত হতে হলে অন্যের প্রভাব সেখানে টিকতে পারে না। টিকলেই সংঘাত, সৃষ্টির সঙ্গে ব্যক্তির। শূন্যতার সঙ্গে ব্যক্তির। নিঃসঙ্গ নির্বাসনের সঙ্গে ব্যক্তির। সময়ের সঙ্গে ব্যক্তির। সময়, আগেও বলেছি কাউকে ক্ষমা করে না। সময় নিষ্ঠুর নিঃসন্দেহে। এবং তা অপচয়ের যন্ত্রণা, সৃষ্টিশীল মানুষদের মধ্যে প্রথম আসে মধ্য বয়সে। তখন তারা মদ-গাঁজা-ভাং ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচে।
ঙ. সংসার বাদি আর সংসার বিবাদি। সাংসারিক মানুষগুলোর সঙ্গে প্রচণ্ড তর্ক তোলা যায়। ধরা যাক, ওদের বিশ্বাস, কেউ কেউ ভণ্ড, নীতিহীন সমাজসংস্কারক। সংসারে থেকেও, যতটা স্বাধীন ও সৃষ্টির ক্ষমতা ভোগ করা যায় তারা তা না। সুতরাং সে মানুষটি পথবিচ্যুত তো বটেই বিভ্রান্ত বলেই সংসারের বিরুদ্ধে ওকালতি করছে। এই সব সংসারী মানুষগুলোর জন্যে সত্যিই সবার করুণা হওয়া উচিত। ওরা সেসব কথা ধরতে না পেরে, শুধু তর্কই করে গেল। অথচ এদের প্রায় প্রত্যেকেরই যথেষ্ট শিক্ষিত বলে সমাজে পরিচিতি আছে। ওরা চাইলে অনেক কিছুই করতে পারত। কিন্তু করলো না। যা করলো তা–সমঝোতা, সংসার-দায়িত্ব আর সময়ের সঙ্গে। ওরা উপভোগের উপাসক। তবে মধ্য বয়সে পৌঁছে এই সংসারী মানুষেরা প্রথম বুঝতে পারে পৃথিবীতে তাদের কিছু না রেখে যাওয়ার ব্যর্থতা। এই প্রথম তারা অনুভব করে তারা এমন এক বৃক্ষ, যাদের বুড়ো হওয়া ছাড়া কোনও গত্যন্তর নেই।
আমাদের দিনের সমস্যা মিটিয়ে রাত আসে। আর রাতের সমস্যা মেটাতে মেটাতে হয়ে যায় সকাল। আমরা সমস্যাপ্রিয়। সমস্যা না থাকলে, সৃষ্টি করি। একটা সন্তান থাকলে, দুটো। একটা ঘর হলে, তিনটে। এক জোড়া থাকলে, নজোড়া। চেয়ারম্যান হতে পারলে সাংসদ। সংসদে পৌঁছুলে মন্ত্রিত্ব। মন্ত্রী হলে দেশের সর্বোচ্চ মন্ত্রীর পদটি। আমাদের, চাওয়া-পাওয়ার, সমস্যার, কোনও আদি-অন্ত নেই। অনেকটা তলাবিহীন ঝুড়ির মতো। আমাদের আরো চাই, চেয়ে চেয়ে শুধু কাঙাল হতে। সুতরাং, চাহিদা আর সমস্যা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তা স্পষ্ট। আমরা পরাধীন অনেক কিছুর কাছে। যা করি তা অন্যের জন্যে, তা অন্যের ইচ্ছায়। অনুতাপ একদিন আসবেই। তবে তা প্রথম এবং প্রখরভাবেই আসে, মধ্য বয়সে। কিন্তু তখন, সৃষ্টির মতো মন বা ইচ্ছা কোনও কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না।
চ. সবশেষে, আমার অনুভূতি। আমার সন্দেহ হয় যে, মধ্য বয়স এমন একটা সময় যেখানে এসে আমার মতে সৃষ্টিশীল স্বামী বা স্ত্রীর মুক্ত হওয়া উচিত একে অন্যের স্বত্বাধিকার থেকে। যৌবনে সয়েছে তবে, জীবনের এই পর্যায়ে পৌঁছে, নারী বা পুরুষ উভয়েই নিজেরা স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। এবং নিজের মতো করে। যা চাইলেও সে এতকাল পারেনি। মধ্য বয়সে এসে জেগে ওঠে নারীর স্বাধীনতার তীব্রতা। আর নারীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে আগে বাদ সাধে পুরুষ। মধ্য বয়সী পুরুষ। তার ইচ্ছে অনুভূতি স্বাধীনতা ও অধিকার, পুরুষ নিয়ন্ত্রণ করে। আর তার সৃষ্টির আগুন যা বিয়ের পরপর পুরুষই তা নিভিয়ে দিয়েছে আবার রুখে দাঁড়ায়।
কি নিষ্ঠুর আর নির্মম! বিয়ের আগে যে মেয়েটি সুন্দর গাইতো, ছবি আঁকতো, বিয়ের পর সে আর গান গায় না, আঁকে না! বিয়ের পরপরই তার স্বামী, এই কুকর্মটি সবচেয়ে আগে এবং সবচেয়ে ভালোভাবে সেরে ফেলে। কারণটা, সেই স্বত্বাধিকার। স্রষ্টা এবং তার সৃষ্টিকে বাঁচাতে হলে কখনো কখনো অনেক ত্যাগ, অনেক বাস্তব, সামনে এসে দাঁড়ায়। অনেক সময় আমার মনে হয়েছে, প্রতিভাবান নারীর প্রতিভা বাঁচাতে প্রয়োজন একটা বিবাহ চুক্তির, তার প্রতিভা তার প্রাপ্তিকে রক্ষা করতে। প্রয়োজনে এই চুক্তি নবায়ন না করার স্বাধীনতা, শুধু থাকবে নারীরই অধিকার। তবেই নারীর মুক্তি আসবে। তবেই সে স্বাধীন। তবেই সে শিল্পী। তবেই, নারী। আর না হলে–ওরা অর্ধ মানুষ।
০৬. একান্ত কিছু মেয়েলি সমস্যা
মেয়েদের সমস্যার কি শেষ আছে? মধ্য জীবনের সঙ্কট লিখতে বসে মনে হচ্ছে আমি যেন সাপের গায়ে খোঁচা মেরেছি। আর সাপগুলো যারা এতকাল ছিল ঘুমিয়ে, সব তেড়ে বের হয়ে আসতে শুরু করেছে কিলবিল করতে করতে। যেন গুণে ওদেরকে কখনোই শেষ করা যায় না। সাপ গোণার এই অক্লান্ত পরিশ্রম, দূরে বহু দূরে পরিবার পরিজনকে ফেলে এসে এই নিঃসঙ্গ নির্বাসন আমার, একাকিত্বের নিঃশব্দ যন্ত্রণা; সব মিলিয়ে আজ মনে হচ্ছে আমি যেন কোথায় ভুল করে ফেলেছি। সাপের গায়ে খোঁচা মারাটা বোধহয় আমার ঠিক হয়নি। এখন না পারি গিলতে, না উগরাতে। আমি তো কোনও সাপুড়ে নই। আমি পড়েছি এক মহা-বিপদে। যারা রক্ষা করার, তারা আরো উসকে দিয়ে বলছে, সাপ ধরো, সাপ মারো। ইচ্ছে হয় জানতে-এই সাপ ধরার দায়িত্ব কি শুধুই আমার একার? তবে সে যাই হোক, যে দায়িত্ব একবার কাঁধে নিয়েছি তা শেষ করে ছাড়ছিও না।
মেয়েদের মিডলাইফ নিয়ে অনেক সমস্যার কথাই লিখেছি। তবে অধিকাংশই অলিখিত রয়ে গিয়েছে। কেননা অকূল সমুদ্রের তলায় মুক্তো খুঁজে বেড়ানো আমার। পক্ষে আর সম্ভব নয়। যে ক’টি পেয়েছি সে ক’টিই পাঠকের সামনে পেশ করেছি।
তবে এর মধ্যে দুটো বিশেষ প্রসঙ্গ আবার হাইলাইট না করে পারছি না। তা হলো মেয়েদের ঋতু আর জরায়ুর গুরুত্ব। মেয়েদের ঋতু আর জরায়ুর সঙ্গে ক্রাইসিসের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর বলেই এই টুকরোটি লিখতে হচ্ছে। একটি মেয়ের ঋতু আর জরায়ু তার শরীরের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তবে ঋতু, যা শুরু হয় ন’ থেকে তের বছর অবধি যে-কোনও সময়ে তা মধ্য বয়সে এসে বন্ধ হয়ে যায়। প্রক্রিয়ার নাম, মেনোপজ। মেনোপজ কারো হয় মধ্য চল্লিশে। কারো কারো পঞ্চাশ পার হয়ে। শরীরের হরমোন কমে আসে। অর্থাৎ তখন গভীরের রস রক্ত শুকিয়ে আসে। শুষ্কতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে ঋতুও বন্ধ হয়ে যায়। এবং এই পরিবর্তনের সঙ্গে দেখা যায় বিভিন্ন রকমের সমস্যা। মেয়েদের এই পরিবর্তনের কারণে শুরু হতে পারে, অতিশয় করুণ যৌনজীবন। ফলে অনেক সংসারেই আগুন লাগে। পুরুষরা বিকল্প চিন্তা করে। আর মেয়েরা সম্মুখীন হয়, নিষ্ঠুরতার।
ঋতু বন্ধ হয় প্রাকৃতিক নিয়মে। এখানে মেয়েদের করার কিছুই নেই। ঋতু হারানো মেয়ের শরীরে এটা একটা মূল্যবান সম্পদ চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনার মতো। এই মেয়ে সম্মুখীন হতে পারে প্রতিকূল মানসিক ভারসাম্যতার। একটি মাসিক শিশু, প্রতিমাসে একবার করে কেঁদে উঠতো। এখন সে আর কাঁদে না। মেয়েদের শরীরে এই পরিবর্তন থেকে তার সবকিছুতে আমূল পরিবর্তন আসতে পারে। শরীরের গভীরে শুষ্কতা, ধ্যান-ধারণা, স্মরণশক্তি, স্মৃতিশক্তির শৈথিল্য মনমানসিকতা জীবনধারণ সবই পাল্টে যেতে পারে। মিডলাইফ আসে এই ক্রাইসিসগুলোকে নিয়ে। এখান থেকে উত্তরণ নির্ভর করে ব্যক্তির ইচ্ছা, বোধ ও চেষ্টার ওপর। এক হয় সে নিজেই ক্রাইসিসে নিমজ্জিত হয়। না হয় সে তরতর করে এই নদী পার হয়ে যেতে পারে। কিংবা গোপনে কষ্ট সহ্য করে যায়। বেঁচে থাকে, না বাঁচার মতো; কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে। মেয়েদের মাতৃত্বের দুটি পাসপোর্ট। এক–ঋতু, দুই–জরায়ু।
জরায়ু মেয়েদের আরেকটা সম্পদ, যা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হতে পারে একটি ভয়ানক সমস্যায়। যেমন টিউমার, ক্যান্সার, উল্টে যাওয়া, নেমে যাওয়া, অতিরিক্ত রক্তপাত ইত্যাদি। ফলে এই মাংসপিণ্ডটিকে ফেলে দিতে হয়। এই অঙ্গটি নারীর জীবনের অন্যতম অলঙ্কার। যার ওপর নির্ভরশীল নারীর মাতৃত্ব। এই অঙ্গটি হারিয়ে নারীর অনেক রকমের সমস্যা হতে পারে। তার মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীনতা অন্যতম। হতাশা, হঠাৎ হঠাৎ গরম লাগা, নীল অনুভূতি, হতে পারে নানারকম রোগব্যাধি। সঙ্গের পুরুষটি হয়ে ওঠে তার অন্যতম সমস্যা। সে আর আগের মতো স্বাদ অনুভব করে না তার একান্ত নিজস্ব নারীটির প্রতি। ফলে অবজ্ঞা, দুস্থ যৌনজীবন, নারীর জীবনকে ঠেলে দেয় না বেঁচে থাকার অনুভূতি দিয়ে।
ঋতু হারানো মেয়ে যত দ্রুত পাল্টায়, সমবয়সী বীর্য কমে আসা পুরুষের বেলায় তা হয় না। মেয়েদের বার্ধক্য ছেলেদের চেয়ে দ্রুত। তার সংসার–মাতৃত্ব, ঋতু, জরায়ু। অনেক কিছুই সেজন্য দায়ী। তাছাড়াও আরো অনেক মেয়েলি রোগ সংক্রান্ত সমস্যার পাহাড় নিয়ে নারীর অন্তহীন দুর্দশা থেকে সে উতরাতে কমই পারে। সে হতে থাকে জীবন্ত পুতুল। মধ্য বয়স থেকে চলতে শুরু করে বার্ধক্যের ঘড়ি। বার্ধক্য যা সবাইকেই হাত ধরে সত্যের দিকে নিয়ে যায়-নীরবে। জীবন্ত পুতুল নারীটিও যায়। নারী যে শুধু একটা অপচয়।
০৭. পাঁচ মিশেলি
নারীর জন্ম হয়
নারীর জন্মই হয় পরীক্ষা দিতে। কঠিন কঠিন সব পরীক্ষা। পরীক্ষা বলতে, ধৈর্য, সংযম, ধর্ম, সতীত্ব, জরায়ু, মাতৃত্ব। বৈধব্যে নারীর পরীক্ষা, বাকি জীবন তার যোনিকে বিশুদ্ধ রাখা। মজার ব্যাপার পুরুষের বেলায় কিন্তু বেঁধে দেয়া বলতে তেমন জোরালোভাবে কিছুই নেই। এমনকি প্রযোজ্যও নয়। অত্যন্ত স্পষ্ট এমন কিছু বৈষম্য নারীর বেলায় রয়েছে, যা তার মধ্য বয়সের ক্রাইসিসকে আরও ত্বরান্বিত করে। কিছু বাতিল সামাজিক নিয়মকানুন ও প্রথা যা নারীর জীবনকে করে তোলে স্রেফ, ‘নারী ও নরক’।
বংশ রক্ষা করতে বন্ধ্যা নারীর স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে অবধারিত। কিন্তু বন্ধ্যা পুরুষের স্ত্রী! বৈজ্ঞানিক সমাজভিত্তিক আধুনিক পাশ্চাত্য নারীদের কথা ভিন্ন। তারা যা করে আমাদের কূপমণ্ডুক সমাজে সম্ভব নয়। তাদের সামাজিক নিয়মকানুনের মধ্যে ধর্ম ও শ্লীলতার ভণ্ডামো নেই বিধায়, সেই সমাজের নারীরা এত উন্নত, স্বাবলম্বী এবং স্বাধীন। বাধ্য এবং অর্পিত বলে তাদের জীবনে কিছু নেই।
আমাদের নারীদের জীবনে সবচেয়ে বড় সঙ্কট সামাজিক সংস্কার। সব রকমের অনুশাসনের মধ্যে থেকে তাদের প্রমাণ করতে হয় যে তারা যে-কোনও অবস্থাতেই ঘুণে ধরা দাম্পত্য, বৈধব্য, সমাজের সকল বাতিল নিয়মের গণ্ডিতে থেকেও নিজের সতীত্ব বজায় রেখেছে। সুতরাং তার কন্যার ভালো বিয়ে হবে। কারণ সে অকাল বিধবা হয়েও দ্বিতীয়বার বিয়ে করেনি, পরকীয়া করেনি। পেট ফোলেনি তার। কেউ তাকে ন’মাসের জন্যে চোখের আড়াল হতে দেখেনি। আমাদের অকাল বিধবাদের রক্ষা করতে হয় স্বামীর বংশের সুনাম। পুরুষের বেলায় অনেক কিছুই ভিন্ন। মাস না যেতেই বিপত্নীক পুরুষের বিয়ে হবে। হ-বে-ই। তার ছেলেমেয়েদের বিয়ে, সমাজের প্রশ্ন নয়। দ্বিতীয় স্ত্রী কোনও সমস্যা নয়। পুরুষের দ্বিতীয় নারী গ্রহণ বংশ মর্যাদার জন্যে, হুমকির নয়। সুতরাং সেসব বৈষম্য ও সঙ্কট বিবেচনা করে একজন বিধবা মধ্য বয়স্ক নারীকে করতে হয় বিকল্প জীবনের সন্ধান। গোপন জীবন এবং পরিরণ ইত্যাদি।
একথা অজানা নয় যে, এই মেয়েদের সবরকম অনুভূতিই আছে। তাদের বুদ্ধি আছে। সুতরাং বিধবাদের অধিকাংশই মেয়ের বিয়ে হবে না বলে দ্বিতীয় বিয়ে না করলেও, লুকিয়ে লুকিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য যৌনজীবন কোনও না কোনওভাবে উপভোগ করে। সোজা কথা যোনি থাকলে তার ক্রাইসিসও আছে। থাকাই স্বাভাবিক এবং তা নিঃসন্দেহে সুস্থ এবং স্বাস্থ্যসম্মত।
অনেক বিধবাই আমার আশপাশে রয়েছেন যারা আমার আন্তরিকতা দেখে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাদের গোপন জীবনের গল্প নির্দ্বিধায় বলে গেছে। বাইরে ওরা যতই নিষ্পাপ থাকুক, ভেতরে ভেতরে ওদের গোপন জীবন কি, ওরাই ভালো জানে ও বোঝে। এবং লোকচক্ষুর আড়ালে ওরা তা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পালন করে যায়।
নারী ও পুরুষের, দোহের যৌনজীবনেই–জীবনের বিভিন্ন সময়ে কিছু না কিছু স্বাভাবিক সঙ্কট থাকে। তবে মিডলাইফের সঙ্কটটা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। এই বয়সে, নারী ও পুরুষের যদি অপরপক্ষ চলে যায় বা মারা যায়, তখন যে ক্রাইসিস হয়–সেই ভুক্তভোগীদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা আমাদের ভাবার সময় কই? আমরা ভীষণ ব্যস্ত, নিজেকে নিয়ে। কার জন্যে কার সময় আছে? পৃথিবীতে কে কার!
বিপত্নীক ষাটোর্ধ্ব পুরুষের বেলায় তা আরো মজার। তারাও বিয়ে করে। শিথিল লিঙ্গ বা স্বল্প বীর্য ওদের সমস্যা নয়। ওদের জন্য ওরাল সেক্স একটা সুন্দর বিকল্প ব্যবস্থা। ৩৫-৪০-৪৫-এ বিধবা নারী যা ভাবতে পারে না, ৬৫তেও বিপত্নীক পুরুষ তা পারে। আর মধ্য বয়সের যে-কোন বিপত্নীক পুরুষও! বিয়ে করবেই। সমাজই দেবে। মেয়ের বাবা এসে ঘুরঘুর করবে। কিন্তু একথা ক’টা বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা নারীর বেলায় সত্য!
মধ্য বা বৃদ্ধ বয়সে দ্বিতীয় বিয়ের মানে কি শুধুই কাম? স্বামী বা স্ত্রী মারা গেলে নিঃসঙ্গতা ঘোচানোর জন্যে একজন সঙ্গীর বিকল্প কি আছে? বনে-জঙ্গলের পশুপাখিরাও দল বেঁধে থাকে। আর আমরা তো রক্তমাংসের। একজন মানুষ পাশে না হলে, মানুষ সুস্থভাবে বাঁচে কি করে! বাঁচতে পারে না। একটা মানসিক আদানপ্রদান, সর্বাগ্রে। নিঃসঙ্গতা তৈরি করে, হতাশা। হতাশা থেকে মানসিক ভারসাম্যহীনতা। সেখান থেকে আত্মহত্যা। মধ্য এবং বৃদ্ধ বয়স, যে-কোনও বয়সের নারী ও পুরুষেরই উচিত, পুনর্বিবাহ করে নিজেকে অবিচার থেকে মুক্ত করা। কিন্তু আমাদের এই ঘুণে ধরা সমাজ ও রঙ্গভঙ্গ ধর্মীয় কালচার এখনও এই মানসিকতায় পৌঁছুতে পারলো না। বিশেষ করে নারীর বেলায় তো নয়ই। নারীর বেলায় ১৪৪ ধারা মুখে চুনকালি।
আরবের মেয়ে বিয়ন্ড দ্য ভেইল
আরবের মেয়েদের জীবনে ধর্ম ও পুরুষের নিষ্ঠুরতা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে তার একটি চিত্র পাওয়া যায় ‘বিয়ন্ড দ্য ভেইল’ বইটিতে। বইটির লেখক ড. স্যামুয়েল গ্রে। যেহেতু ওদের জন্যে পরপুরুষের কোনও রকম ছায়া ও ছোঁয়া নিষিদ্ধ, সেহেতু ওরা গোপনে যা করে তা আরো বীভৎস। নিষিদ্ধ বলেই ওরা যায় আরো গভীরে। অধিক নরকে। ড. গ্রের বইটিতে চার দেয়ালের ভেতরে ওদের যৌনজীবন আপন চাচা, মামা, খালা, মাসি, ভাগ্নী, ভাইপো, সবার সঙ্গে সবার, কিশোর থেকে বৃদ্ধ সবার অবাধ যৌনাচার। যা ঘরে ঘরে বেশ্যালয়ের তুল্য।
বাংলাদেশি কাজের মেয়ে এবং পুরুষ ড্রাইভার সমাচার
বিশেষ করে আমাদের দেশের নারী পাচারকারীরা চাকরির কথা বলে বাংলাদেশের বোকা অশিক্ষিত মেয়েদের পাঠায় বর্বর আরবদের রান্নাঘরে। রান্নার লোকের কথা বলে আরবের পুরুষেরা ভিসার জন্যে প্রয়োজনীয় কাগজ দিয়ে, নিয়ে আসে ওদের সম্ভোগের নারী। পরবর্তীকালে, আরব প্রভুদের গণধর্ষণ অস্বীকারের ক্ষমতা নারীর থাকে না। তাহলে সমূহ বিপদ। যেমন জানাজানি হলে তার মুণ্ডপাত। না দিলে, ভিসা বানচাল। পালিয়ে যাওয়ার কোনও জায়গা নেই।
সুতরাং সৌদি মালিকদের দেয়া কাগজপত্র ভিসা নিয়ে যে মেয়েই সেদেশের রান্নাঘরে যাবে তারই একই পরিণতি। দেশের নারী পাচারকারীদের জন্য এটা ১০০ কোটি টাকার কল-কারখানা। আরবের ঘরে ঘরে চলে পর্দার আড়ালে তাই এই বেশ্যাবৃত্তি। বেশ্যাবৃত্তি, কি নারী, কি পুরুষ! আর যে বিরোধিতা করে, তাকে মূল্য দিতে হয়, জীবন দিয়ে।
কি বীভৎস! পুরুষ বঞ্চিত, অবরুদ্ধ, হতাশাগ্রস্ত সৌদির মেয়েগুলো পুরুষের একটু স্পর্শ পেতে গোপনে শরণাপন্ন হয় পুরুষ ডাক্তারের। আশা, ডাক্তাররা ওদের বুকে, পেটে, হাতে পুরুষের আঙুল বোলাবে। তাই ওরা মিথ্যে অসুখের ভান করে ছোটে ডাক্তারের চেম্বারে। টাকা দিয়ে একটু স্পর্শ নিতে যায় পুরুষের কাছে আর যা মেলে না কিছুতেই।
সৌদি মেয়েদের যৌনজীবন দরিদ্র এবং সংরক্ষিত। একেক পুরুষের কয়েকজন নারী। তারা স্বামীর সঙ্গ, সঙ্গম যথেষ্ট পায় না। এই অবস্থায় পবিত্র দেশে বাংলাদেশি ড্রাইভারদের দুরবস্থার একটি কারণ হলো, স্বামীর পর তারা ড্রাইভারকেই বেশি দেখে। দেখার সুযোগও পায়। সেক্ষেত্রে গোপনে একটি পুরুষ ড্রাইভারকে প্রতিদিন ৪/৫ জন নারীকে তৃপ্ত করতে হয়।
দল বেঁধে ক্ষুধার্ত মেয়েরা আসে। মালিকের বৌ, মেয়ে, বান্ধবী। না হলে চাকরি থাকবে না। জানালে, মুণ্ড ঘ্যাচাং। আর পালালে যাবে কোথায়। ভগ্ন স্বাস্থ্য, দুর্বল ধাতু, আগা মোটা-গোড়া চিকন হয়ে ওরা ফিরে আসে দেশে। কান মলে দিয়ে বলে আর যাবে না পবিত্র দেশে। অমন জন্তুর মতো ক্ষুধার্ত মেয়ে, আর নয়! প্রতিদিন ৪/৫ জনের ক্ষুধা মেটানো অসম্ভব! তার চেয়ে বরং না খেয়ে দেশে থাকবো। এরকম দুস্থ ড্রাইভারের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কথায় আছে, প্রায় প্রতিটি সৌদি গৃহই একেকটি ছোটখাট পর্নো হাউজ।
ধর্ম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যৌন সঙ্কট
ধর্ম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছায়ার তলে রয় বিকারগ্রস্ত পুরুষ। ধর্মান্ধ মানুষ। চার্চ, মন্দির, মাদ্রাসায়, বাবা-মায়ের চোখের বাইরে কিশোর-কিশোরীদের যৌন শিক্ষার প্রথম হাতেখড়ি এসব প্রতিষ্ঠানে। সমকামী উভকামিতার শিক্ষাও, এখানেই! শিক্ষক বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের গণ্যমান্য পুরোহিত, যাজক এবং মাদ্রাসার মৌলবী এখানেই ধর্ম শিক্ষার সাথে ওদেরকে হাতেকলমে যৌন শিক্ষা দিতে একটুও ভুল করে না।
বাড়িতে প্রাইভেট পড়াতে আসা ধর্ম, নাচ, গান বা পড়ার শিক্ষক, পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে মেয়েদের প্যান্টের ফুটোয় আঙুল পেন্সিল ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে এবং সুযোগ পেলেই ঢুকিয়ে দেয় ওদের পুরুষাঙ্গ। বাবা-মা জানেন, সন্তানেরা পড়ছে। সন্তানেরা ভয়ে, ওসব কথা কাউকে বলে না। কারণ ওরা মাস্টার। ওদের কথাই চূড়ান্ত। তাছাড়া বাবার বয়সী, ভাইয়ের বয়সী, কাকার বয়সী শিক্ষকদের কথা অবিশ্বাস করবে! এমন সাধ্য কার?
বুদ্ধিজীবী লেখক, শিল্পীদের কথা
এরা অধিকাংশই কেন সেক্যুয়াল পারভার্ট হয়? অধিকাংশই হয় স্বেচ্ছাচারী। তার কারণ বিবিধ। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যা তা হলো, জানি না আমার মতো সবাই অনুধাবন করেন কিনা যে, আমাদের অসাধারণ লোকদের দাম্পত্য জীবন হয়, অত্যন্ত বা মাঝারি, সাধারণ লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে। যেমন একজন নামিদামি লেখকের স্ত্রী, কখনো কখনো একেবারেই–গো-মূর্খ। দেখা গেছে লেখকের স্ত্রী, স্বামীর সাথে লেখা নিয়ে একটি কথাও বলতে পারে না। এক কলম আলোচনাও করতে পারে না। তার জন্যে একটি বই খুঁজে একটি রেফারেন্স বের করে দিতে জানে না। কারণ সে নিজেই লেখাপড়া জানে না। ইংরেজিতো নয়ই। এমতাবস্থায়, শরীরের আকর্ষণ ক’দিনের? মন না বসলে, প্রেম হবে কি করে? প্রেম ছাড়া কি শরীর জাগে? লান্টু মার্কা চকচকে চেহারা, আর গোলাপি চামড়ার আকর্ষণ ক’দিন? সারল্য ক’দিন? নিষ্পাপ ক’দিন? সারল্যের তলে নির্বুদ্ধিতা এবং পাপহীনতা কি একদিন–বোঝা হয়ে উঠবে না যখন তাকে আর শরীরের জন্যেও ইচ্ছে করবে না! ঘরে না থাকলে বাইরে তো যাবেই। একজন নয়, রাস্তায় এক পা পড়লে, দেখা হবে বহুজনের সঙ্গে। আকর্ষণ হবে যৌন অত্যাচার, বিকার।
সমমনা স্ত্রী ডিঙিয়ে বেশ্যালয়ে যাবে এমন সাহসী পুরুষ কম। বা প্রয়োজনও হয়। সমমনা দু’জনের বেলাতেই তা সত্যি। শরীরের আকর্ষণ শেষ হতে পারে। কিন্তু সুন্দর মনের সঙ্গে জ্ঞানের সমুদ্র যখন এক হয়, তখন তার বিকল্প কিছুই থাকে না। কেন যে বুদ্ধিমানদের দাম্পত্য হয়, বুদ্ধিহীনদের সঙ্গে, যারা দৌড়ে কুলোতে না পেরে হোঁচট খেয়ে পড়ে পড়ে যায়, আমার বোধগম্য নয়। আমার দুঃখ হয়, ঘরে ঘরে অসুখী লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী নারী-পুরুষের পাহাড় দেখে। এবং তাদের দাম্পত্য জীবন যা, অত্যন্ত নিম্নমানের, রুচি এবং বোধের। শুধু শরীর নয়, দাম্পত্য চায় আরো অনেক কিছু। চায় মনের গভীরে, সমানে সমানে যেতে। দেখা গ্যাছে এদের অসুখী দাম্পত্য জীবনের সমাপ্তি ঘটে বিচ্ছেদ-পরকীয়া-বেশ্যালয় থেকে বিকারে। যেখানে গেলে তারা উজ্জীবিত হয়। প্রাণ পায়। সুন্দর হয়।
লেখকের স্ত্রী বই বোঝে না। শিল্পীর স্বামী, তৈলচিত্রের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলে, তেল কই? দার্শনিকের ধর্মভীরু স্ত্রী, দর্শনের বইগুলোকে ফেলে দিয়ে সেখানে বোখারী শরীফ তুলে রাখে। একথা প্রমাণিত যে গুণীজনদের জীবনে ক্রাইসিস বড় বেশি, বিশেষ করে তাদের মিডলাইফ ক্রাইসিস। অধিকাংশেরই পা–ঘরের বাইরে। ওদের ঠেকাবে কে?
০৮. দাম্পত্য, সমাজ, সংসার
১. মধ্য বয়সের নিক্তি
বিশ্ব সংসারে আমাদের সৃষ্ট নানাবিধ সাংসারিক সামাজিক সঙ্কট যার দায়ভার পরবর্তীকালে আমাদেরই বইতে হয়। আমরা সৃষ্টি করি সংসার। তার কারণ আমরা সামাজিক জীব। সৃষ্টি করি সন্তান। সংসার ও সন্তান থাকলে থাকবে অর্থনৈতিক বিষয় আশয়গুলো। সংসারের ঘানিতে চাহিদা থাকে। থাকে দায়িত্ব। সেগুলো মেটাতেই হয়। আর থাকে দাম্পত্য, যা থাকলে তার সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী থাকবে কলহ। থাকে অভিযোগ।
স্বামী-স্ত্রী, শ্বশুর, শাশুড়ি দেবর, ননদ, ননদাই, জেঠা, খুড়ো, তালতো ভাই, বেয়াই …। সব নিয়েই তো সমাজ! সমাজ আছে বলে আছে সামাজিকতা। পালন করলে অনেক বড়। না করলে কিছুই নয়। সমাজ বলে বিশাল এক বাধ্যবাধকতা আছে, যার কারণে চাইলেও ভালো থাকা থেকে, স্বাধীন জীবনযাপন থেকে পেছনে পড়ি, পিছিয়েও পড়ি। সংসারে কত রকম নিয়ম-যৌক্তিকতা। পালন না করলে, নেই। করলে অনেক কিছু। আবার না করলে–হায়-হায়! ও করলো না! কেন করলো না! নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে! কেন কি হয়েছে! কি হয়েছে! খোঁজ! খোঁজ! ওর পেছনে কতগুলো ছিদ্র, কতবড় ঘা ওর গুহ্যদ্বারে। এটাই সত্যি এবং এর সবই আমাদের বোধের অক্ষমতা! দায়ভার। বোধ, যা বুদ্ধির উঁচু বা নিচু স্তরের, থার্মোমিটার।
জীবনের সকল সঙ্কটের পুঞ্জীভূত ও পরিপূর্ণ মেঘ যে আকাশে, তার কেন্দ্রবিন্দু হয় আমাদের মধ্য বয়স! কেন এবং কি এই মধ্য বয়স? আর এই বয়সে কেন, অতীতের ফেলে আসা বা আগামীর আকণ্ঠ সঙ্কটের সকল ভার এসে মুখ থুবড়ে পড়ে? কিসের এ ভারসাম্যহীনতা এই ‘৪৫’-এ! প্লাস-ও মাইনাস, ফাঁইভ। মানুষ যদি গড়ে নব্বই বছর বাঁচতো, তবে ৪৫-কে বলা যেতো নিক্তির মধ্যস্থলের কাঁটা, যেখানে ডাইনে–বায়ে মিলে ওজনের একটা ভারসাম্যতার সৃষ্টি হয়। কিন্তু মানুষের গড়পড়তা আয়ু তো মাত্র ৫৫ থেকে ৭০। কিন্তু বাস্তবে ৪৫-এর আশপাশে ভিড়েই মানুষ প্রথমে নড়ে ওঠে তার সমগ্র অস্তিত্ব নিয়ে। তার অতীত তার ভবিষ্যৎ এবং তার বর্তমান। এবং এই ৪৫-এর প্রকৃত অর্থ হতে পারে মৃত্যুর সময় কতটা বাকি তার চেয়েও বরং জীবনের পথ কতটা পেরিয়ে এলাম। এবং ফেলে আসা পথের সকল ভুল-ভ্রান্তি ফিরে দেখা। অতীতের কত জানা-অজানার ভুল থেকে উদ্বুদ্ধ পরিতাপ। দাম্পত্য, শরীর, মন, সমাজ, সন্তান, অর্থ সম্পদ, ধর্ম সব ভারের প্রভাব এসে এখানেই ঘাঁটি গাড়ে। খুঁটি শক্ত হলে সে ভার টেকে। না হলে নড়ে যায়।
২. পাল্টানো জীবনের মোড়
মধ্য বয়স, জীবনের মোড় পাল্টানোর শুরু এখান থেকেই। পথ পরিবর্তন, বিকল্প, বিচ্যুতি, বিধ্বস্ত, গড়ে ওঠা, সূর্যাস্ত, চন্দ্ৰাস্ত-এখানেই। সব এখানেই। যাকে ভালো লেগেছে এতকাল, সেই দাম্পত্য আর ভালো লাগে না। এখন ভালো লাগে অন্য একজনের ঠোঁট, কি চিবুকের গাঢ় তিল। কৃষ্ণকালো চোখ কিংবা তার শাড়ির আঁচলের পাটপাট ভাঁজ। আগে, সপিং মল না হলে মাতালের নেশা না জমার মতো গা বমি বমি লাগতো। আজকাল বরং শুনলে, গা বমি বমি লাগে। আগে লাগতো শহর, এখন গ্রাম। লাগতো গ্রাম, এখন শহর। আগে মাসে একবার সঙ্গমেই হাঁপিয়ে উঠতো আর ৪৫-এ পৌঁছে মনে হয় আহা কত প্রেম! কতরূপ তেরা মাস্তানা! কত কাভি কাভি মেরে দিল মে! মনে বসন্ত আর চোখে সবুজ। তার চোখে সে সুচিত্রা সেন। তার চোখে সে উত্তম কুমার। ওকেই মনে হয় রবীন্দ্রনাথ। মনে হয় কবি নজরুল। বিছানায় নিজেকে মনে। হতো জন্তু! এখন মনে হবে নপুংসক। আগে যেতো বেশ্যালয়; এখন মন্দির-মসজিদ। ক্লাব ছেড়ে দিয়ে হজ। মন্ত্রিত্বেও সুখ নেই। উল্টো মনে পড়ে মায়ের কবর। পেশার চেয়ে ভালো লাগে নেশা। মাছ ধরা, নৌবিহার। সন্তানকে মনে হবে অভিশাপ, মনে হবে বন্ধু। মুখ দিয়ে মিথ্যে বেরোত না। কিন্তু অসদাচরণ এমন পেয়ে বসলো যে টাকার লোভে বা পরকীয়ায় এক মিথ্যে লুকোতে সহস্র মিথ্যে। একসময় মিথ্যে বলতে বলতে মিথ্যেও আর রোচে না। টাকার লোভ–সেখানেও ক্লান্তি এসে যায়।
অতীতের ছলচাতুরি প্রতারণা সে অভ্যেসেও মোড় ঘোরে। বা অতীতের সৎ-সাধু জীবন, ছলচাতুরি প্রতারণার প্রভাবে সিক্ত হয়। জীবনের রুপোর কাঠি-সোনার কাঠি, দিক পাল্টায়। যে নেশাখোর ঢোকে ঢোকে শ্বাসের সঙ্গে মদ গিলতো, তার ভালো লাগে শুষ্কতা। জীবনে যে ছোঁয়নি, প্রয়োজনে সে পচা পান্তার বাংলা গিলতে হরিজন পল্লী ছুটে যায়। ইচ্ছে হয় নতুন বন্ধনের। নব বন্ধুত্ব। কামনা হয় নব্য শরীর। বদল হয় দাম্পত্য রুচি। জাগে নতুন অনুভূতি পুরুষে, নারীতে। জাগে মাতৃত্বে। চেতনা হয়। অতীতের অবহেলা থেকে। নতুন দায়িত্ব কর্তব্যবোধ এসে শির উঁচু করে দাঁড়ায়, ক্ষতিপূরণ চেয়ে। সকল দায়িত্ব কর্তব্যবোধ পালন করতে গিয়ে নিজের প্রতি চরম অবহেলা। নিজেকে খুইয়ে, সংসার,অন্যের প্রভাবে নিজের সব খুইয়ে মানসিক ও বৌদ্ধিক যন্ত্রণা–সব এখানেই, এই ৪৫-এই। এখানে ভারসাম্যতার নিক্তি ডাইনে বায়ে দুলতে থাকে।
আমাদের জীবনযাত্রা প্রভাবিত হয় মূলত আমাদের সমাজ দ্বারা। সমাজের প্রচলিত অনিয়ম। মরচে ধরা সমাজের সেকেলে অবিচার। শ্বশুর-শাশুড়িসহ একান্নবর্তী পরিবার আমাদের। কিন্তু পরিবারের নববধূটির ওষ্ঠাগত প্রাণ। তার ওপর চাপানো সংসারের সব দায়িত্ব। তার ওপর পরীক্ষা আর পরীক্ষা। সতীত্বের পরীক্ষা, মাতৃত্বের, জরায়ুর। সকলের চাহিদা তারই ওপর। তাকেই বিয়ের নামে এক পরিবার থেকে অন্য পরিবারে স্থান বিচ্যুত করা হয়, এবং এনে তাকে কঠিন শাস্তি ও পরীক্ষার আগুনের সামনে নিক্ষেপ করা হয়। দজ্জাল শাশুড়ি। ননদ সাক্ষাৎ এক যম। স্বামী একজন জল্লাদ। আর ঘরে বসে তছবিহ্ গুণতে গুণতে সব কিছুতে ইন্ধন যোগান শ্বশুর। সব-সবাই-সবকিছু অচেনা। অজানা। রিক্ত।
অন্যদিকে স্ত্রীর প্রতারণা। যখন-তখন নারী স্বাধীনতার স্লোগান। মধ্য বয়সের জন্যে জমা হয়ে থাকে। ফোড়া, যেমন পুঁজ হতে হতে এক সময় ফেটে বেরোবেই। মধ্য বয়সে, অতীতের যত পুঁজ, বহুমুখী ফোড়ার মতো, ফেটে বের হবেই। পুঁজের সেই থলে খালি হলে, সে নতুন করে কি দিয়ে ভরবে পুঁজ না অমৃত, নির্ভর করে তার জীবনের আকাশে তখন চন্দ্রোদয় নাকি চন্দ্ৰাস্ত। যদি চন্দ্রোদয় হয় ভালো। যদি উল্টো হয়, তবেই ডুববে তরী। নিভবে বাতি।
হেলে-খেলে অপচয় হয়েছে কত সময়! তখন অনুভব হয়নি। আজ হয়। ৪৫-এ হয়। অনুতাপ হয়। ফেলে এসেছে বলে অশ্রু হয়। অপচয় বলে গ্লানি হয়। নেই বলে আফসোস হয়। পাতা ওল্টাতে গিয়ে দেখে শূন্য হাত। যে গ্যাছে যা গ্যাছে। অতীতের সব–সব অতীত। নেই সে আর ফেরে না। আর ফিরবেও না। সে মৃত। অনুভূতি ফিরে এলো, কিন্তু সে নেই।
ইচ্ছে হয় তাকেও কবর থেকে উঠিয়ে ভালোবাসতে। তার প্রতি সকল অবিচার, অন্যায়, ক্রোধ! তাকে রেখে পতিতালয়ে যাওয়া, সেজন্যে তার অশ্রু। তাকে অবজ্ঞা। তাকে দুঃখ দেয়। আজ কবরে বসে স্রেফ অশ্রু ছাড়া কিছু নেই।
ইচ্ছে হয় তাকে কবর থেকে উঠিয়ে ভালোবাসতে। তার প্রতি সকল অবিচার, অন্যায়, ক্রোধ। তাকে রেখে পরকীয়া, সেজন্য স্বামীর অশ্রু, তাকে অবজ্ঞা। তাকে দুঃখ। দেয়। আজ কবরে বসে শুধু অশ্রু ছাড়া কিছু নেই। সবই ফিরে এসেছে। কিন্তু হায়, সে কোথায়? যার জন্য সমাজ ত্যাগ, পালিয়ে আসা যার হাত ধরে, তার সঙ্গে দশ বছর জীবনযাপনের পর, বিবাহ বিচ্ছেদ। পরকীয়া।
দূরত্ব, নিঃসঙ্গতা –দু’জনকে আবার এক করে। দূরত্ব নিঃসঙ্গতা দু’জনকে দুই করে। মতামত, ব্যক্তিত্ব, ঐশ্বর্য, যোগ্যতা, মানুষকে দূর করে। মানুষকে এক করে। জীবনের ট্রেনের ৪৫ নম্বর প্লাটফর্মে পৌঁছে মল্লিকাঁদের প্রথম অনুভব হয় ছুটে পালিয়ে বাঁচতে। আর নয় স্বামী নামের এক দানবের অত্যাচার! এতকাল যাতে অভ্যস্ত, এখন তাতে বিদ্রোহ।
৩. সামাজিক অবকাঠামো
আমাদের সামাজিক অবকাঠামো, নির্দেশ করে আমাদের মধ্য বয়সের ঋতু। শুষ্ক ঝোড় না বসন্ত। দুঃসংবাদ যে, আমাদের সামাজিক অবকাঠামোগুলো আধুনিকতার কাছে এতই অবৈজ্ঞানিক, এতই বাতিল বলে গণ্য হয়, যে কারণে আমাদের জীবন হয় দুর্বিষহ। তথাকথিত বিজ্ঞজনেরাও এই পঙ্কিলতার বৃত্ত থেকে বাইরে নয়। বরং যত বেশি বিজ্ঞ, ধর্মান্ধতা, সমাজন্ধতা, সংস্কারন্ধতা তত বেশি।
গ্রামে-গঞ্জে মূলত একান্নবর্তী পরিবার ও নিরক্ষর বা স্বল্প শিক্ষিত পরিবার। নিম্ন বা মধ্যবিত্ত পরিবার। এই পরিবারগুলোতে ছেলের বৌয়ের অপমৃত্যুর হার অনেক। তার কারণ–একান্নবর্তী পরিবারের সকল কুসংস্কার। শাশুড়িজনিত কষ্ট, স্বামীর তাচ্ছিল্য ও অত্যাচার; এসব সংসারে একটা সুস্থ মানুষকে করে তোলে অসুস্থ। একান্নবর্তী পরিবার একটি অসুস্থ জায়গা, যেখানে সংসারের নামে চলে জল্লাদখানা। নারীর অধিকার, স্বাধীনতা কিভাবে হরণ করতে হয় জানতে হলে এখানে আসতে হয়।
একটা সমুদ্রে ঝরে যায় কত খড়কুটো, ডালপালা, ছেঁড়া কাগজ, কত হারানো মণিমাণিক্য। ভেসে যায় কত জেলে নৌকো, তারুণ্যের কত নৌবিহার! আর জীবন! সেতো পৃথিবীর সব-জল একত্র করলে, তার চেয়েও বড় সমুদ্র। অথচ এই সমুদ্রকে সঙ্কীর্ণ মনের মানুষেরা কল্পনা করে পুকুর। এখানে ঘটে-যাওয়া কোনও ব্যতিক্রমকে আমরা বলি অসামাজিক। আমরা কি আসলেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে অন্ধ হয়ে যাইনি?
কত সমস্যাই ঘটে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। সুখ সে আর কতটুকু! হাসি সে আর কতক্ষণ! পূর্ণতা সেও ক্ষণজীবী! তাহলে!
সামাজিক প্রতিবন্ধকতা আমাদের হাসি, সুখ, পূর্ণতাকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। ফলে আমরা যথেষ্ট হাসতে পারি না, সুখী হতে পারি না, পূর্ণ হই না।
৪. দাম্পত্য দুঃখ-সুখ
সার্বক্ষণিক বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে দাম্পত্য সুখ একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। সকল সমস্যার মধ্যেও এই সুখটুকু যদি আমাদের থাকে, তাহলে অন্য সব অসুখ একসঙ্গে বয়ে নেয়া সহজ হয়। কিন্তু দাম্পত্যের এই সুখটুকুই বড় বেশি ঝোড়ো হাওয়ার সম্মুখীন। এর কারণ ব্যাখ্যার অতীত। দু’জন দুই মানুষ। দুই মতবাদ। দুই ব্যক্তিত্ব। দুই ভালো-মন্দের। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিস্তর মতানৈক্য, বিবাদ, চরম হতাশা, নিষ্ঠুরতা সুখের বিরুদ্ধে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দাম্পত্য ভাঙার কারণের শেষ নেই।
এমতাবস্থায় কি করা উচিত যখন নপুংসক স্বামীর পাশে শুয়ে সখিনা, বছরের পর বছর অতৃপ্ততার কষ্ট পেয়ে বৃদ্ধ হলো! কিন্তু কোনদিনও কাউকে সে জানায়নি তার দুঃসহ কষ্ট! এই সমাজে এসব জানানোর কারণ নেই, ভাষাও নেই। নিরক্ষর সখিনার অর্ধেক জীবন কাটালো–অর্ধপাগল। পাগলা গারদ।
অন্যদিকে শিক্ষিত ও চালাক মেয়ে সূচনা–নপুংসক স্বামীর অগোচরে দীর্ঘ বছর ধরে গোপনে যৌনজীবন চালিয়ে গ্যাছে মিজানের সঙ্গে। মিজানের সমস্যা তার স্ত্রী পক্ষাঘাতে পঙ্গু। মানবিক কারণেই সে মুনমুনকে ডিভোর্স দেয়নি। কিন্তু তার যৌনজীবনেও সে কোনও সমঝোতা করেনি।
সমস্যার কোনও সমাধান সমাজ করবে না। কিন্তু যদি কেউ বিকল্প খুঁজে নেয়, সমাজ তখন বৈরী হয়! দা-কুড়োলে। শ্বাস ও কণ্ঠনালিতে। তাহলে এই কথা বললে কি ভুল হবে যে, আমাদের সমাজ, সুস্থ সূচনার বদলে অসুস্থ সখিনা তৈরির প্রসূতিকাগার? আমাদের অসুস্থ সমাজ। ভাগাড়-সমাজ।
দীপের পাশে শুয়ে মল্লিকা বিয়ের পনেরো বছর পরেও ভাবে শমসেরের কথা। দীপকে জড়িয়ে ভাবে তার শমসের। দীপকে খেতে দিতে দিতে ভাবে শমসেরকে দিচ্ছে। কারণ তুচ্ছ। সে শমসেরকে ভালোবাসতো। শমসের মুসলিম তাই, অন্ধ সমাজের কারণে ওদের প্রেম, প্রাণ পায়নি। দীপকে সে কখনো পরিপূর্ণ করে আপন ভাবতে পারে না।
অতিরিক্ত কামুক স্বামীকে আটটি সন্তান দেয়ার পর মাসুদা ক্লান্ত। সে করিমের কাছে যেতেই চায় না। অনেক অনুনয়-নিষেধ সত্ত্বেও করিম ফের বিয়ে করে নিয়ে আসে জোবেদাকে। এতগুলো মাতৃত্বের এতদিনের বিবাহ, এত ত্যাগ স্বীকার! সবই কি বিফলে গেল, প্রশ্ন?
পাশাপাশি রাতের বেলায় সতীনের ঘরের বাতাসে কামের গন্ধ মাসুদার মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে! শুলেই যুগল দৃশ্য ভাসে চোখে। এই কষ্ট সইতে না পেরে মধ্য বয়সে পৌঁছে মাসুদা ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। একদিন ইঁদুর মারা ওষুধ খেয়ে তার সন্তানগুলোকে মাতৃহীন করে দিয়ে –মনে ক্লান্ত মাসুদা ইহজগৎ ত্যাগ করলো।
অকাল বিধবা হেমলতার সঙ্গে রাতের বেলায় ঘুমোত এগারো বছরের এক কিশোর। হেমলতা তাকে মহাভারত পুরাণের গল্প শোনাত। সজল–হেমলতা ছাড়া অন্য ঘরে ঘুমোবে না। বাবা-মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও না। মায়ের তৃতীয় চোখ। বাবা। বললো স্রেফ অপত্য স্নেহ। সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত মা বলে-না। একদিন গভীর রাতে উঁকি দিয়ে দেখলো সজল হেমলতার স্তনে মুখ দিয়ে। কারো শরীরেই কাপড় নেই। জানি, এর উত্তর নেই। তবে বিধবা হলেই যে রতি মরে যাবে, একথা ভুল। বিধবারা যাবে যাবেই। রতির তাড়না তাকে নিয়ে যায়। সন্তানের বয়সী থেকে গোয়াল ঘরে এমনকি ষাড়ও সই। রতির যন্ত্রণা এতই যন্ত্রণাদায়ক শতকরা পঁচানব্বই জন বিধবারই গোপন। যৌনজীবন থাকে এবং বিপত্নীকদের তো বটেই। এবং তা ভালো। তা মঙ্গলজনক। তা স্বাস্থ্যকর।
স্ত্রীর মৃত্যুর এক মাসের মধ্যে ৭০ বছর বয়সে মি. শহীদুল্লাহ আবার বিয়ে করলেন। ছেলেমেয়েরা তাকে ত্যাগ করলো একই দিনে। মি. উল্লাহর যুক্তি ছিল আমার একজন সঙ্গী চাই। কথা বলার, পাশে বসার। তার প্রয়োজন কি যুক্তির বাইরে ছিল? প্রয়োজন কি সবসময় যুক্তি মানে? যুক্তির তলায়–মর্মবেদনা কি যুক্তি শাস্ত্রের চেয়েও মানবিক শাস্ত্র হতে পারতো না? মি. শহীদুল্লাহ দুঃখ করে বলেছিলেন, ওরা তো যার যার সংসারে সুখে আছে। ওরা কী জানে, আমার দিন কি করে কাটে?
সমমনা নয় বলে বাবুল আর শাহীনা বিয়ের তৃতীয় বছর থেকে ভিন্ন বিছানায়। তারপর ডিভোর্স। সেই থেকে শাহীনা ভ্রান্তিপাশের শিকার। এক ভুল থেকে অন্য ভুল। এক পুরুষ ছেড়ে অন্য পুরুষ। ধোকার পর ধোকা। চরম দুঃখশেষে মুক্তি পেতে আসক্তির আশ্রয়। তারপর একদিন অনিবার্য আত্মহত্যা।
রজঃনিবৃত্তি বা মেনোপজের তিন বছর আগে বিজয়া এমন জান্তব হয়ে উঠলো যে প্রতিরাতে ওর কামনা মেটাতে ওর স্বামীর হিমশিম অবস্থা। প্রতিরাতেই তার পুরুষ চাই। অপারক স্বামী তাকে ভুল বুঝলো। গোপনে শুরু হলো–বিজয়ার বিভিন্ন রকমের বিকার। সমকামী এবং উভকামিতার জীবন।
শফিকের পতিতালয়ে যেতেই হবে। কারণ ঘরের পুরোনো মেয়েমানুষের শরীর বড় একঘেয়ে। হায়দার তা না করে পরকীয়া করতো। আর মুনীর? বাড়ির দক্ষিণ পাশে একটা গরুর গোয়াল ছিল, সেখানে চারটি দুধেল গাভী ছিল। সে লুকিয়ে যেতো গাভীর কাছে। গাভীর শরীরে মেটাতো ওর কাম।
মিশু, তরু, নদী ওদেরকে নষ্ট করার পর খেরু মামা তার দু’মাসের ভাগ্নীকেও ছাড় দিল না। একলা ঘরে এনে ওর প্যান্ট খুলে, না ফোঁটা ফুলে আঙুল প্রক্ষেপণ করে মেয়েটিকে সুযোগ পেলেই কাঁদাতো।
ঘটনাক্রমে প্রদীপের সঙ্গে বেবীর মাত্র দু’বার যৌন সম্পর্ক হয়েছিল। প্রদীপ, বেবীকে যেভাবে নিয়েছিল, যে কারুকার্যে সে ফুটিয়ে তুলেছিল ওর নারীত্বের অলঙ্কারগুলো! বিছানায় বেবী নিজেকে মাত্র দু’বার যেভাবে আবিষ্কার করেছিল প্রদীপের সঙ্গে, সালমানের সঙ্গে তা দশ বছরে একবারও ঘটেনি। সালমান শুধু শরীর কিন্তু প্রদীপ বোঝে প্রেম। সেই থেকে বেবীর জীবন, সালমানের সঙ্গে কখনো আর এক হলো না।
দাম্পত্য, নির্ভর করে সমস্যার গভীরতার ওপর। একে কেন্দ্র করে বিয়ে ভাঙে। বিয়ে গড়ে।
৫. জীবনের গলিত লাভা
পরম-আয়ু। মানুষ কি পরমায়ুর হিসেব বোঝে? এই ‘পাটিগণিত’, মানুষ বোঝে কী? অফুরন্ত মনে হতে পারে, আয়ু। মনে হতেই পারে বেঁচে থাকবো সত্তর, আশি, নব্বই, একশ’ বছর। সেতো অনেক সময়।
হ্যাঁ, চব্বিশ ঘণ্টায় একদিন হলে, সত্তর, আশি, নব্বই, অনেক অনেক সময়। মাঠ মাঠ সময়। মানুষের গড়পড়তা আয়ু ভূগোল বিশেষে ৫৫-৭০।
শৈশব। কৈশোর। যৌবন। বার্ধক্য। শৈশব থেকে বার্ধক্য–মাঠ মাঠ সময়। সত্তর থেকে, দশ-কুড়ি-ত্রিশ এমনকি চল্লিশ বছর পরমায়ু ফুরিয়ে যাওয়া কিছুই নয়। এই ফুরিয়ে যাওয়া শেষেও অনেক সময় সামনে পড়ে থাকে। তাই বিচলিত হওয়ার কোন কারণ থাকে না।
এমনকি জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ সময় ফুরিয়ে গেলেও অনুভব হয় না–পরমায়ু। হয় না পঞ্চাশেও। মনে হয় অনেক সময় সামনে পড়ে আছে। ততদিনে তারুণ্যের ঝোঁক গেলেও, অস্তমিত যৌবনের আকাশে ছিটেফোঁটা যৌবনের রেশ লেগে থাকে। তখনও ইচ্ছে হয় কাম, ইচ্ছে হয় ভরা যৌবনের কিছু কিছু উন্মাদনা। মনে হয় অনেক সময় সামনে পড়ে আছে। পঞ্চাশেও লোভ-লালসা, চাহিদা, দায়িত্বের ভারে ভুলে যাই মৃত্যু হবে। আমাদের মৃত্যু হবে। মনে হয় আমরা মৃত্যুঞ্জয়ী। মাঠ-মাঠ সময় আছে, মনে হয়। আমরা হয়ে উঠি–আরো লোভী। বাড়াই বোঝ। জড়িয়ে পড়ি অধিক দায়িত্বে। দাম্পত্য, মধ্য বয়স, শরীর ততদিনে হয় বাধাগ্রস্ত। আমরা সেসব এড়িয়ে চলি। মাঠ মাঠ সময় আছে।
বার্ধক্য আসেনি? মধ্য বয়সে, নাকের দু’পাশের মাংসে ঠোন বরাবর গভীর ভজ, এ কিসের আলামত! বার্ধক্য আসেনি? গালের দু’পাশ ভারি। শরীর তার হাল ছেড়ে দিয়েছে। নাইকুণ্ডলীর চারপাশে বালিশের মতো ফুলে ওঠা তলপেট, বার্ধক্য আসেনি এখনও? বয়স পঞ্চাশ তখন। মধ্য বয়স।
বার্ধক্য! ষাটের পর? সত্তর হতে কত বাকি? সত্তরই যদি পরমায়ু হয় তবে মৃত্যুর ক’বছর বাকি? চল্লিশ, পঞ্চাশ! যেমন ছিল কৈশোর! ছিল যৌবনে? যখন দশ, বিশ, ত্রিশ বছর চলে যাওয়ার পরেও মনে হয়েছে, মাঠ মাঠ সময় আছে!
ষাটের পর? সত্তর যদি পরমায়ু হয় তবে মৃত্যুর ক’বছর বাকি? পাটিগণিতের সোজা অঙ্ক তবে ৭০-৬০=১০। সেতো কৈশোরের ঠিক উল্টো। অর্থাৎ ৭০-১০=৬০।
সুতরাং কৈশোরে ত্রিশ বছর চলে গেলে কিছু নয়। কিন্তু ষাটের পর প্রতিটি বছর। মৃত্যুর ঘড়ি আরেকটু স্পষ্ট বাজে। ষাটের পর, মৃত্যুঞ্জয়ী এবার মৃত্যুর ডাক শোনে। ষাটের পর। একেবারেই সময় নেই। মৃত্যু দুয়ারে। মৃত্যু বলছে, ওঠো, ওঠো তৈরি হয়ে নাও। আমেজ, একটা বছর, ষাটের শেষে, অতীতের দশ বছরের সমান। তবুও শোনে না।
এইটুকু জীবন। কোথাও শান্তি নেই। জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ শেষে, মধ্য বয়সে এসে মানুষ যখন শান্তি পাবে, তখনই জ্বলে ওঠে আগুন। পরমায়ু ফুরিয়ে যেতে থাকে। আমাদের তাতে ক্ৰক্ষেপ নেই। আমরা আগুনে জ্বলি জীবনের গলিত লাভায়।
মরে যাই, পরমায়ু শেষে। ক্রাইসিস, মৃত্যুই যার একমাত্র উত্তর।
০৯. মেয়েদের যৌনজীবন
মেয়েদের যৌনজীবন সম্পর্কে এখনো আমাদের অনেক ভুল ধারণা আছে। আমরা ভাবি, সংসারের অন্য অনেক দায়িত্বের মতোই নারীর যৌনজীবনটাও যেন সন্তান উৎপাদন যন্ত্র আর স্বামীর সুখের গর্ত। আবার এও বিশ্বাস করতে হয় যে মেয়েদের যৌনজীবন সাময়িক। যেমন বিয়ের প্রথম কয়েক বছর কিংবা গুটি কতক সন্তান সৃষ্টি। এবং এই পর্ব শেষ হতে না হতেই দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটে। শুরু হয় দাম্পত্যে। অরুচি। কেন? মেয়েরা অনেকে নিজেরাও জানে তাদের এই সীমিত জীবনের কথা।
আজ এই আধুনিকতার যুগেও, আমাদের মা-মাসিরা তাদের জীবন গুটিয়ে ফেলে, সন্তান-সন্ততি প্রসব শেষ হতে না হতেই। পঁয়ত্রিশ, চল্লিশ বা তার কিছু কম বয়সেই আমাদের মা-মাসিরা, স্বামীর বিছানা ছেড়ে স্বেচ্ছায় আলাদা বিছানায় ঘুমোতে শুরু করে। তাদের ধারণা, একটা সময়ের পরে সঙ্গম আর করতে নেই। ওতে স্বামীর পৌরুষই নয় আয়ুও নষ্ট হয়। নারী নিজেও নিজেকে গুটিয়ে নেয় ভেবে যে ওসব আর নয়। এখন সময় মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন।
কিন্তু বাস্তব মেনে নিলে, মেয়েদের যৌনজীবন আসলেই সেরকম নয়। শিক্ষার অভাব, কুশিক্ষা এবং অপসংস্কারে অভ্যস্ত মেয়েরা জানে না বা জানতে চায়ও না যে, তাদের শরীরের চাহিদা এবং কামনা-বাসনা অনুশীলন –প্রয়োজনীয় এবং উচিতও। নারীর শরীর অনেকটা বেস্ট সেলার বইয়ের মতো। বেস্ট সেলার। বিয়ের পরপরই প্রথম প্রথম স্বামীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। দু’এক বছর গেলেই রুচি চলে যায়। তখন দিশেহারা মেয়েগুলো বুঝে উঠতে পারে না কাজের মেয়ের মশারির তলায় যাকে দেখলো বা গেস্ট হাউজ থেকে ফিরে আসা এই অতি সুখী স্বামীকে নিয়ে ওরা কি করবে!
সেকচুয়ালি উজ্জীবন, সঙ্গম, প্রেম বা প্রেমের চিন্তা একটি মানুষকে প্রস্ফুটিত করে তুলতে পারে উজ্জীবিত রাখার সঙ্গে সঙ্গে। স্বীকার করি আর নাই করি যৌন বিষয়ক চিন্তা, অন্যান্য সুস্থ চিন্তার মতোই, বদ্ধ জলাশয়ে ঝরনার নতুন জলের মতো। প্রাণের সঞ্চরণ হয়, উজ্জীবিত হয়। চেহারায় আসে কমনীয়তা। ঝিমোনের বদলে ঝিকিয়ে ওঠে চোখের তারা। যখন জানে তার জন্য রয়েছে কারো ভালোবাসা। কেউ তাকে ভালোবাসে। দূরে বা কাছে। মেয়েদের মন ও চেহারায় দ্রুত বার্ধক্যের আরেক কারণ আর হারিয়ে যাওয়া হীরে সমেত–যৌন অনুভূতি। যে অনুভূতিমালা উপভোগের চেয়েও মূল্যবান। মানসিক অনুপ্রেরণাও। অনুভবের মাধ্যমে অনুভূতিকে ধরে রাখাও একটি বিরাট কাজ। একটি শিল্প। শিল্পচর্চা। শিল্পবোধ। শিল্পীর অলঙ্করণ। সাধারণ জীবনের প্রতি আগ্রহের বিকাশ ঘটে এভাবেই। প্রেম ও শরীর বিষয়ক ভাবনা, অস্বীকারের উপায় নেই যে, এক ধরনের প্রেম তাড়না, চাঞ্চল্য জাগায়। আগ্রহ ফিরিয়ে আনে। জীবন জাগায়। সুস্থ প্রেম বা কামনা, এসব চিন্তার কোনও বিকল্প নেই।
তবে নারী এবং পুরুষের যৌনজীবনকে অনেকগুলো বিষয়, বাইরে এবং ভেতরে প্রভাবিত করতে পারে। বিয়ের প্রথম দশ থেকে পনেরো বছরের মধ্যে সন্তান-সন্ততিরা যা জন্ম নেয়ার তা জন্মে যায়। সন্তান সৃষ্টির আগে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে যৌন আকর্ষণ তা কমতে কমতে প্রায় শূন্য এসে দাঁড়ায় বিয়ের চৌদ্দ কি পনেরো বছরের মাথায়, হয়তো তার মধ্যেই তাদের শেষ সন্তানটি জন্ম নিয়েছে। এই পনেরো বছরে মা-বাবা দু’জনই ব্যস্ত থাকে সংসারের সমরাঙ্গনকে সামাল দিতে। কারণ তখন প্রধান দায়িত্ব হয়ে ওঠে ছেলেমেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করা। কারো হাই স্কুল, কেউ কিন্ডারগার্টেন। দায়িত্ব এবং বাস্তবতা নিয়ে দু’জনকেই থাকতে হয় ব্যস্ত। এবং এই পনেরো থেকে কুড়ি বছর সময় হলো তাদের জীবনের সবচেয়ে জটিল সময়। এই সব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রাসঙ্গিক উদ্ভূত সমস্যার কারণে সামাজিক এবং সাংসারিক দিক থেকে নিজেদের প্রতি অবজ্ঞা অবহেলা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আকর্ষণ অনেকটা কমে গিয়ে তারা পরস্পর পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারে। এত বছরের এই সঙ্গত ব্যবধানে এবং নিজেদের দূরত্বের কারণে শারীরিক আকর্ষণ কমে যাওয়াও স্বাভাবিক। মানসিক যোগাযোগের ব্যাপারেও তাই। এরই মধ্যে ছেলেমেয়েগুলো বড় হতে থাকে।
এরপর ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেলে নিজেদের জন্যে অনেকটা সময় পাওয়া যায়। সন্তানদের সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়টা পার হয়ে যাওয়ার পর, অন্য মন, অন্য শরীর নিয়ে তখন দু’জনই আবার সম্পূর্ণ নতুন প্রেমিক-প্রেমিকাও হয়ে উঠতে পারবে। কিংবা চিড় ধরে যেতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে অনেক সময়েই হয়তো এই দীর্ঘ ক’বছরের সৃষ্ট দূরত্বে, দু’জনের প্রতি দু’জনের আগেকার সেই আকর্ষণ আর একই তরঙ্গে বইছে না। তার মানে এই নয় যে তাদের কাম বা রতি কমে বা শেষ হয়ে গ্যাছে। তখন তাদের মধ্য বয়স। তাদের আকর্ষণ অন্য নারী বা অন্য পুরুষে। এটাই স্বাভাবিক। এটাই সত্য। শরীরে ফের অনুভূত হয় প্রথম যৌবনের পুলক।
তখন মেয়েদের মেনোপজের ঠিক সাত থেকে দশ বছর আগের বয়স। এই বয়সে মেয়েদের অনুভূতি আগের চেয়েও অধিক হতে পারে। মধ্য বয়সে ফের ফিরে আসতে পারে নতুন করে তার মধ্যে প্রথম যৌবনের প্রেম, মন ও মানসিকতা। নারীর শরীর, তার মেনোপজের অল্প আগে, বয়স ও সময় পরিবর্তনের ক্রান্তিকালে হয়ে উঠতে পারে, জান্তব। যে জান্তবতা সে আগে কখনোই অনুভব করেনি। নতুন উন্মাদনা, শরীর নিয়ে। পুরুষ সেও শরীর শৈথিল্যের পূর্বে বা বীর্য কমে আসার আগে অনুভব করে ভিন্নতা। সেও খুঁজতে পারে, অন্য জীবন। এখান থেকে আবার প্রবল ঝোড়ো হাওয়ায় যা অশান্ত হয়ে উঠতে পারে। এই ঝড় কখনো স্থিতি পায়। কখনো ধ্বংস করে দেয়। আর সবকিছুর মূলেই কিন্তু কাজ করে ঐ মধ্য বয়সে।
পরকীয়া, বা অন্য কোনও অভ্যেস, অভিজ্ঞতা, বিকল্প, যার ওপর কারোরই নিয়ন্ত্রণ নেই। নারী এখানে পরাজিত পক্ষ। একে অশ্লীলতার ব্যাখ্যা দিয়ে উতরানো যাবে না। ভুল করেও যদি কেউ ভাবে নারীর যৌনজীবনে বয়সের সাথে সাথে ভাটার টান নেমে আসে তাহলে বুঝতে হবে প্রকৃতি সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তবে হ্যাঁ, পুরুষ এবং নারীর যৌন অনুভূতি বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন তরঙ্গে বদলাতে পারে। এই পরিবর্তন বোঝার মতো বিশুদ্ধ বুদ্ধি, খোলামেলা মন, আলোচনা, জানাজানি সবই জরুরি। এ নিয়ে লজ্জার কিছু নেই। খোলামেলা শিক্ষামূলক যৌন বিষয়ক আলোচনা সমস্যাগুলোকে উন্মুক্ত করে দেয়। এখন এসব আলোচনা পারিবারিক বা ঘরোয়া হওয়া উচিত। মুক্ত খোলামেলা বিজনেস্ হিসেবে। এবং সেটাই ভালো। সেটাই মঙ্গল এবং বিজ্ঞানসম্মতও।
» ১০. সময়ের ডানায় ভাসা তিন কন্যা
কাহিনী—
মানুষের হৃদয়ে এমন কিছু ইচ্ছে লালিত হয় যা প্রথাবিরুদ্ধ, কিন্তু বাস্তব। অবাস্তব মানুষদের সঙ্গে বাস্তবের সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষ আসলে মিথ্যের সঙ্গে সত্যের। অবাস্তব, যা মিথ্যে। যা মানবজীবনের জন্য ক্ষতিকর। অকাল বিধবার মতো আমারো মনে লক্ষ প্রশ্ন জাগে এই ভোরবেলায়, যখন মানুষ ঘুম থেকে ওঠার আড়মোড়াও ভাঙেনি। ভোরের পাখিরা তখনও ভোর জাগায়নি। সেই ভোরে। যে ভোর এতো কালো যে মৃতদেহ চিতায় ওঠানোর আগেও ওরা আরেকটু অপেক্ষা করে। সূর্যের আলোর মতো কিছুর। যার প্রতীক্ষায় কাটতে থাকে পৃথিবীর কোথাও কোন নারীর প্রত্যাশা। সেই ভোরের বেলায়, আমার ঘুমহীন মাথায়, একা বসে ভাবি অনেক নষ্ট কিছু জটিল প্রশ্ন। প্রশ্ন, যার কোনও গ্রহণযোগ্য উত্তর আমাকে কেউ কখনো দিতে পারে না। আমার একান্ত ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্ন। যার সাথে আমার কারো না মনে, না মতে মেলে। প্রশ্নগুলোর নাম, কেন? আর এই প্রশ্নগুলো নিয়ে আমি দিনদিনই একা হতে থাকি।
প্রশ্নগুলোর সবকটিই প্রথা ভাঙুনীদেরকে ঘিরে। যারা মানুষের অপছন্দনীয়। যারা অভিশাপ কুড়োনি, একঘরে। প্রথা মানেই কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা। প্রথা আছে বলেই সমাজজীবন অলঙ্করণে রয়েছে এত অবিচার! ধর্মান্ধতা আছে বলেই বর্বরতা। আমি নিজেও প্রথা ভাঙা নারী। যাদের সঙ্গে মিশি তারা ভালো। কিন্তু এই একটি জায়গায় এসে সবার সঙ্গে আমার গোলমাল। তখন নিজের জন্য বড় দুঃখ হয়। মনে হয় কেন জন্মেছিলাম! আর এই জটিলতায় মৃত্যুকে আপন বোধ করি। জানালার ধারে বসেই প্রতিদিন এই প্রশ্নগুলো নিয়ে আমার সকাল হয়।
এখন সকালের পাখিগুলো রোদের তৃষ্ণায় ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। ঘাপটি মেরে থাকা লাল সূর্যটা ক্রমশ রোদ হচ্ছে। আজ এই তরুণ রোদের আলোয় আমি আমার নিজের শরীর নিজে দেখতে পাচ্ছি। জেগে ওঠা পৃথিবীর–কলরবে নিজেকে আমি অনুভব করছি। মনে হচ্ছে, আছি। সত্যিই বেঁচে আছি, হ্যাঁ, আমি সত্যি সত্যি বেঁচে আছি, মনে হয়। কারণ গতরাতে আমি তিন কন্যা দেখেছি। আমার মনমানসিকতার তিন কন্যা। আমি শ্বাসের গন্ধ পাচ্ছি। শ্বাসের শব্দ ছুঁয়ে অনুভব করছি, জীবন। আমি ঘুম। ভাঙা পাখিদের সঙ্গে নিজের চোখ ঝাঁপটে স্বাগত জানাচ্ছি, সকালকে। আমি বেঁচে আছি।
আজ আমি এই তরুণ সকালে এই সময়ের সাহসী তিন কন্যার কাহিনী বলছি। জগতের পঙ্কিল গণ্ডি কাটিয়ে উঠে যারা গোলাপ পেতে চায়। মানুষের সৌন্দর্য যাদের কাছে মানুষের চেয়ে বড়। সত্যের চেয়েও বড়-সত্যবাদিতা। দাম্পত্যের চেয়েও, তার কারণ।
১. প্রথমা
সেদিন দুর্গা পুজোর মণ্ডপে বসেছিলাম। পাশেই খালি চেয়ার আর এই চেয়ারে বসে যিনি হঠাৎ আমার কুশলাদি জানতে চাইলেন তিনি অনন্যা। তার সাথে আমার দেখা হলো প্রায় বছর তিনেক বাদে। ঢাক বাজানোর শব্দের মধ্যে তার এই সহসা উপস্থিতি। চোখে-মুখে নব উচ্ছলতা। ছিল নতুন প্রাণ, যা আগে দেখিনি। এ যেন তার ”কাক্ষিত নক্ষত্র দেখতে পারার উচ্ছলতা।” তিনি আমাদের পাড়ারই বৌ। বয়সে আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। তা সত্ত্বেও আমি তাকে আপনি বলছি কারণ, সাহসে তিনি আমার চেয়ে ঢের বড়। জীবন সংগ্রামে তিনি আমার চেয়েও সংগ্রামী। প্রথা ভাঙায় তিনি অদ্বিতীয়া। কোন এক বিশেষ কারণে তাকে আমি খুঁজছিলাম। তার সম্পর্কে আমি যা শুনেছি তার সবটাই প্রথা ভাঙার।
সমাজের চোখে আঙুল দেখিয়ে বৈধব্যের এক মাস পর থেকেই তিনি ধুতি ছেড়ে ফের রঙিন পরেন। হাতে, কানে, গলায় অলঙ্কার। পাড়ার লোকেরা প্রতিবাদ করে বললো, দু’ভরি সোনা! এই সাজসজ্জা তোমার নয়। চারদিকের শাসন সত্ত্বেও তিনি নিজেকে সংস্কারের কারাগারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। বৈধব্যের শুরু থেকে অদম্য সাহসের সঙ্গে সমাজকে দেখালেন বুড়ো আঙুল। আর সমাজ তাই একদিন ওকে একঘরে করে দিয়ে বললো–বেশ্যা। ওরা এই সাহসী নারীকে নারী না বলে, বেশ্যা বললো। কারণটা বিশেষ। রঙিন ছাড়াও, স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই, তার ঘরে শহরের এক বড়লোক ব্যবসায়ীর আনাগোনা। অনেকটা স্বামী-স্ত্রীর মতো ওরা। ঘর বন্ধ করে দেয় যখন-তখন। নবমীতে তখন পুজোর কলরব চলছে। ঢাক বাজছে গুরুম-গুরুম। এর মধ্যেই পাড়ার একটি বৌ আমার কানে ফিসফিস করলো। ওমা! খবরদার। ওর সাথে কথা নয়। ও খুব খারাপ মেয়েমানুষ। এক ভিনজাতের ছেলের সঙ্গে শরীর খাটায়। জানি ও কি বলতে চাইছে। বন্ধুত্ব থাকলেই কি বেশ্যা হয়! বন্ধু ছাড়া মানুষ কি বাঁচে! কথা না বললে! এই যে প্রতি বিকেলে ঐ কলতলায় বসে তোরা নিয়মিত ঝগড়া করিস এও তো একধরনের আড্ডা। শাশুড়ি, বৌয়ের গালাগালি এও একটি অভ্যেস। ঝগড়ার কলরবে, জানিয়ে দেয়া, বেঁচে আছি। বললাম ও যা করেছে, ভালো খুব ভালো। তোদের সে ক্ষমতা নেই। এই যে পরনিন্দে করছিস, এও বিলাসিতা। কথা বলে হালকা হওয়া। ওর এখন সেই মানুষই চাই। আর কেউ যদি তাকে সেটুকু দিয়ে থাকে, নিশ্চয়ই সে ভালো। ভালো-মানুষ। লাল পেড়ে শাড়ি পরা বৌদি মাথা নিচু করানো। সব মেনে নেয়ার চিহ্ন।
তার নাম রিনি। সুর্বাচন ওর একমাত্র ছেলে। সুর্বাচনের বয়স এখন আঠারো। স্বামীর মৃত্যুর পর নিজে একবেলা খেয়ে ছেলেকে তিন বেলা খাইয়েছেন। ওকে নিয়মিত স্কুলে পাঠিয়েছেন। প্রাইভেট পড়িয়েছেন। আর প্রথম দিকে শহরেরই সেই বড়লোকের দেয়া টাকা দিয়ে সেলাই মেশিন কিনে, এনজিওর কাজ, (গৃহ আর শরীর অলঙ্করণ) রাতভর সেলাই করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেছেন। রিনির যুক্তি, আমি নিজে কষ্ট করবো কিন্তু সুর্বাচনকে কখনো ওর বাবার মতো কষ্ট করতে দেবো না।
ওর ইচ্ছে পুর্বাচন একদিন অনেক বড়মাপের মানুষ হবে। ভালো মানুষ হবে। এবং ভালো মানুষ হয়ে সে মানুষের ভালোমন্দগুলোকে নিজের ভালোমন্দ বলে ভাববে। যার ওষুধ কেনার সামর্থ্য নেই, সুর্বাচন দেবে। পথ্য নেই, দেবে। পথ্য আর ওষুধের অভাবে ক্যান্সারাক্রান্ত স্বামীর শেষ দিনগুলোর যন্ত্রণার কথা রিনির পাথর বুকে মরুভূমির ফসিলের মতো মরে শুকিয়ে আছে।
দিনদিনই রিনির সৌন্দর্য বাড়ছে। যৌবন উথলে উঠছে। ধুতির বদলে রঙিন। রিনির ঘরে শহরের সেই বিত্তশালীর আনাগোনা। একসঙ্গে ওরা চা খায়। আচ্ছা করে। গান গেয়ে ওঠে। ঘর থেকে হাসির শব্দ বাজে। আর সুখের যে-কোন শব্দ পেলে, পাড়ার বুড়ো শিশুদের অসময়ের ঘুম ভেঙে যায়। গালাগাল দিয়ে বলে ওঠে, বেশ্যা মাসি। হেরে বাইর না করলে এই পাড়ায় মান সম্মানে থাকন যাবো না। রিনি ওসব গালমন্দ বাক্যবাণ নীরবে সহ্য করে যায়। তার তো কারো কাছে হাত পাততে হয় না। ওদের কাছে হাত পাতা, শরীর বিছিয়ে দেয়া থেকেও নরক।
রিমি একঘরে। রিমি সমাজ-বিচ্যুত। ওর দোষ মতিনের সঙ্গে সে মাগ-ভাতারে, থাকে। আমি সেই ফিসফিসকে বললাম, তাতে দোষের কি? মানুষের জীবনে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে কি বাকি জীবনের জন্যে তার সব সুখ চলে যাবে? যদি তাই হয় তাহলে মানুষ বাকি জীবন বাঁচে কি করে? ফিসফিস মেয়েটির মাথা আরো নুইয়ে পড়লো। যেন মস্ত ভুল করে ফেলে সে এখন অপরাধী। বড়লোকের সঙ্গে সাবধানে কথা বলতে হয়। ওকে দেখে মনে হলো, খুব বুঝেছে।
এই বয়সেও কত সখ আমার? সমুদ্রের পাড়ে, স্বামীর বুকে শুয়ে সূর্যের আলো খেতে ইচ্ছে হয়। পূর্ণিমা রাতে এক নিঃসঙ্গ গাছের তলায় শুয়ে ওর গায়ের গন্ধ নিতে আমার ইচ্ছে হয়। ভোর ছুঁই ছুঁই রাতে নির্লজ্জ বেহায়ার মতো চাইতে ইচ্ছে হয় দাও প্রেম, দাও অমৃত সুধা। মধু দাও। দাও গো-ও-ও-ও। এবং আমি জানি মানুষের সুখের চাওয়াগুলো সব, এক। পাথরের তলে, লোহার নিচে, শক্ত মানুষটিও কত দুর্বল তার হৃদয়ের কাছে আমি জানি।
রিনি বয়সে আমার চেয়ে মাত্র পাঁচ বছরের ছোট। ওর ইচ্ছেগুলোর বয়সও পাঁচ বছর–তরুণ। তারুণ্যের চাওয়া অধিক প্রখর। কে বলেছে, না! আমাদের সমাজ আজও বলে–বিধবার আবার ইচ্ছে কি? খুলে ফেল হাতের, কানের, গলার! ঝেড়ে ফেল গা থেকে কামের গন্ধ। মেরে ফেল-রতি। হেঁটে দাও মাথার বিনুনি। রঙিন, ফেলে দাও।
রিনিকে সুধালাম ওর ভালোমন্দ। ওকে ঘিরে শোনা নানান নোংরা। রিনি বলেন, যখন না খেয়ে থাকতাম তখন কেউ ঘরে উঁকি দিয়েও দেখেনি। আর আজ, ওরা উঁকি দেয় কে এলো দেখতে। বললো, তাতে আমার কিছু এসে যায় না! দারিদ্র আমি ঘৃণা করি। গরিব থেকে থেকে আমার চামড়া পচে গ্যাছে। জানেন! মৃত্যুর আগে সে এমন সব মাছ দিয়ে ভাত খেতে চাইলো, বললো–আমি কই মাছ, রুই মাছ দিয়ে ভাত খেতে চাই। আর আমি দশ টাকা কর্জ করে কিনে আনলাম পুঁটি। সেসব মাছ কেনার সামর্থ্য আমার ছিল না। আজ আছে, কিন্তু রঞ্জন নেই। দারিদ্র ঘৃণা করি। …চামড়া পচে গ্যাছে…। কি সাঙ্ঘাতিক কথা তিনি বলতে শিখেছেন! একি তারই কথা! গ্রামের একটি মূর্খ অকাল বিধবার! নাকি দর্শন, যা জীবন ঘেঁটে নেয়া! দর্শনের এই বয়ান, জীবন ঘটতে যারা নর্দমায় যায় শুধু তারাই পাবে। এবং তারাই প্রকৃত মানুষ। রিনি সেই অর্থে প্রকৃত মানুষ। মনে মনে ভাবি।
মতিনের সাথে তোর কি সম্পর্ক! অনেকেই বলছে, মতিন তোকে পৌরসভার ইলেকশনে দাঁড় করাচ্ছে। আর সেজন্য অনেক অর্থও সে ঢালছে তোর পেছনে! পোস্টার, মাইক, আলোচনা! ব্যাপারটা কী।
-রিনি, বললেন হ্যাঁ দাঁড়াচ্ছি। মতি ভাই চায় আমি ইলেকশান করি। চায়, আমি…। বলেই তিনি থামলেন।
আমি মতিনকে চিনি। সে আমাদের প্রতিবেশী। ওদের দুজনের বিষয়ে কৌতূহল ছিল বলেই রিনিকে আমি খুঁজছিলাম। আর সমাজ এজন্যেই, অসুখী। সুখ! মানুষ কি সুখ বোঝে? সুখ মানেই নয়, স্বর্গীয় পবিত্রতা–ব্রাহ্মণ, যা নিষ্পাপ। সুখ, সে নরক থেকেও আসতে পারে। পারে, সঞ্চিত আবর্জনা ঘেঁটে কিছুর সন্ধান করতে। আর এই পেট উগরে আসা আবর্জনার মধ্যে পাওয়া অতীতের কারো এক টুকরো চিরকুট, কিংবা একটুখানি জীবনের সন্ধান পাওয়ার সুখ। কারো কাছে সেটাই স্বর্গ। সেই –জীবন।
বললাম, মতিন তো বিবাহিত। তার ওপর সে মুসলিম। এ তো আগুন নিয়ে খেলা। তোর ভবিষ্যৎ কী? কিছুক্ষণ চুপ থেকে কোন দ্বিধা ছাড়াই বললো, মতিন ভাই বলেছে, দু’মাস পর আমাকে বিয়ে করে ঘরে তুলে নেবে। তাছাড়া মতিন ভাইয়ের বৌ সারা বছরই অসুস্থ, প্রায় পঙ্গু। সেও জানে। তুই মুসলিম হবি! জিজ্ঞেস করলাম। কেন হবো না। মানুষ মানুষই। ধর্মবোধ যারযার ব্যক্তিগত। সে আমায় বাকি জীবন খেতে দেবে-পরতে দেবে। মতিন ভাই নির্ঘাত দেবতার মতো মানুষ। অন্য কেউ নয় স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র সেই আমাকে চরম দুঃসময়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। সে নির্ঘাত দেবতা।
এবং এরপর রিনি চলে গেলে আমি ভাবছি রিনি যা পারে, আমি কী পারতাম?
২. দ্বিতীয়া
এরপর এলো একসঙ্গে এক জোড়া সতীনের, একজন। আমার বান্ধবী লিপি। মধ্য বয়সের, ক্ষয়ে যাওয়া চেহারার এক নারী। বাচ্চা হয় না বলে বহু ধর্মকর্ম অনেক টাকা দান-দক্ষিণা, পীর, সন্ন্যাসীশেষে সন্তানের আশা ব্যর্থ হলে শেষে, এক ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে তিনি পরীক্ষা করে বললেন, তোমার যে জরায়ুই নেই! বাচ্চা কি করে হয়? লিপির প্রশ্ন তাহলে এই মন্দির, এই অর্থদান! সব বৃথা। ডাক্তার বললো, ওগুলো ভণ্ডামো। আপনাদের দোষ যে আপনারা ওখানে যান। এবং এই সত্য প্রকাশের এক মাসের মধ্যে স্বামী আবার বিয়ে করলো।
লিপি বললো, নন্দন ওকে ভুলে গ্যাছে। নন্দনের দুই ছেলের মা, সতীনের পাশে সে একটা-না থাকা, ছায়ার মতো। একজন অতিরিক্ত মানুষ যাকে না হলেও চলে। নিজের স্বামীকে এভাবে বছরের পর বছর অন্য নারীর বিছানায় দিয়ে ভেতরটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে গেছে। বললো এখন সে মৃত্যু চায়। নিজের স্বামীকে অন্যের বুকে বিসর্জন দিয়ে নরকের সঙ্গে তার এক যুগের সংসার সে ঘোচাবে। সে আত্মহত্যা করবে। লিপির দুই মৃত চোখের দিকে তাকিয়ে সেদিন আমার আর ইচ্ছে হলো না বলতে, না মরিস না। বরং বললাম, কর, তোর যা খুশি। তাতেও যদি তোর শান্তি আসে। জীবন আকাশে যখন সূর্যাস্ত, সে জীবন জীবনই নয়। বরং সে জীবন থেকে মুক্তি নেয়া ঢের ভালো। তবুও মনে আমার এক সূক্ষ্ম বিশ্বাস ছিল যে লিপি একদিন না একদিন আলোর সন্ধান পাবে। সে বেরিয়ে আসবে এবং শেষ পর্যন্ত বেরিয়েও এসেছে। শুনেছি, নন্দনকে ডিভোর্স দিয়ে সে সবার বিরুদ্ধে একা, সবার ছিছিক্কার দলিয়ে দিয়ে এক বিপত্নীক তিন সন্তানের পিতাকে বিয়ে করে বিশাল ঘর-গেরস্তি নিয়ে বেশ সুখে শান্তিতেই আছে।
৩. তৃতীয়া—
সবশেষে দেখা হলো এমন একজনের সঙ্গে যে আমারই সমস্ত অনুভূতিতে আমাকে সাপটে-লেপটে গেল। মেয়েটি শহরের এক আলোচনার বিষয় বটে। এক বিচিত্র সে। হেঁটে এসে বসলো। কিছুটা আগন্তুকের মতো। আবার চিনি চিনিও ভাব। তার চোখেমুখে ক্লান্তি। ওর দিকে তাকিয়ে সন্দেহ সেই মেয়েটি! না, না। দ্বিতীয় মন বললো, কেন হবে না! পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কি কিছু আছে? কি হাল! অশান্ত অস্থির জীবন খুঁড়ে কোনদিনও কি সে আর, জাগবে? মরা নদী কি জাগে? হা, হ্যাঁ, জাগে। জাগবে না কেন? আয়ুর প্রত্যাশা কার নেই? মৃত্যুর আগেও বলে যাবো না। যাবো না। কিন্তু কবিতা! ওকে দেখে মনে হলো ওর সেই প্রত্যাশা নেই।
বিভ্রান্ত-বিচ্যুত–বিদিশা!
মানুষ যখন ভ্রান্তিপাশের শিকার হয়, তখন সে এক ভ্রান্তিপাশ ছেড়ে অন্য ভ্রান্তিপাশে, দৌড়য়। ভ্রান্তিপাশ তাকে ছেড়ে যায় না। তার কাছে মনে হবে এই ভুলই, সত্য। ভুল আর নির্ভুল এই দুটোকেই গুলিয়ে ফেলে ক্রমশই ঘোলা জলে মাছ শিকারের মতো, হাতড়াতে হাতড়াতে একদিন হতাশার প্লাবনে নিঃশেষ হয়ে যায়। অবশেষে সে অস্ত। যায় তার জীবন আকাশ থেকে। মেয়েটির দু’চোখে চাঁদ ছেঁড়া সেই প্লাবন নেই! ছোটবেলায় ওর দু’চোখে প্রতিভার যে আগুন আমি দেখেছি, সে আগুনে আজ জলে থিতোনো ছাই। সে ধসে গ্যাছে।
আমরা একই ক্লাসে একই স্কুলে পড়েছি। স্কুল কেটেছি এক সাথে। আচার কিনে ভাগ করে খেয়েছি। ছোট থেকেই সে ভালো ছাত্রী। গানে ভালো। নাচেও। ওর নাম কবিতা। ওরা আমাদের পাশেই থাকতো। কবিতা আমার মতো। কারো কথাই শুনতো না।
আর একদিন করেও বসলো–যা খুশি। অবিশ্বাস্য কিন্তু ওর জন্যে অসম্ভব নয়। বিলেত যাওয়ার কথা বলে একদিন সে উধাও হয়ে গেল একটি শশীর সঙ্গে। শশী, কবির উপযুক্ত কিছুতেই নয়। সবার মনোযোগ কেড়ে নেয়া এই মেয়েটি–শশীর খপ্পরে কি করে যে পড়লো, ওর বাবা-মায়ের সেটাই দুঃখ। শশী, সব দিক দিয়েই কবিতার নিচু। কিন্তু প্রেম তো প্রেম। প্রেম, অন্ধ। কবিতাই, শশীতে ডুবে গিয়েছিল।
প্রেমের জন্যে অসামান্য ত্যাগের উদাহরণের কি কিছু আকাল পড়েছে? একটি নারীর জন্যে সিংহাসন ত্যাগের মতো ঐতিহাসিক প্রেমকাহিনী কি, অলৌকিক? প্রেম-সে কি শুধু মোহ? সত্য নয়! স্বর্গ নয়! আলো নয়! যদি নাই হবে তবে, কেন এই সিংহাসন ত্যাগ? আত্মহত্যার মতো ক্ষমাহীনতা! এই দুঃখকষ্টভার! কে ছোট! সিংহাসন। না প্রেম? ধর্মদ্রষ্টাদের রুচিমাফিক, প্রেম। তাহলে তাকে কি বলবো যখন ব্যর্থ প্রেম, মানুষের জীবনকে রক্তাক্ত করে। যখন সে হেলাফেলায় ত্যাগ করতে পারে রাজ সিংহাসনের মতো দুর্লভ সম্মান, সম্ভ্রম। তুচ্ছ করে জীবনের মায়া। আর সেকথাই প্রমাণ করলো কবিতা।
শশী ভালো ছেলে তবুও কবিতার যোগ্য সে নয়। কিন্তু কবিতার চোখে শশী, শশীই। রক্তে হলুদ লাগা পূর্ণিমার চাঁদ সে! শশী ভালো-মানুষ। আর এই ভালো মানুষকে কবিতার বড়ই ভালো লাগতো। পুতুল-পুতুল। সুন্দর। সুন্দর সুন্দর চিঠি লিখতো কাব্য করে। ওকে দেখলেই কবিতার চুমু খেতে ইচ্ছে করে। শুতে ইচ্ছে হয়। কবি, যৌবনে উত্তাল এক অনন্য কিশোরী।
এক কালের জমিদার বাড়ির মেয়ে কবিতা। জমিদারি নেই। তবে রক্তে আছে ঐতিহাসিক পাপের অতীত। বংশের একটা দুর্নাম আছে। লোকেরা আজো বলে, কবিতার জেঠতুতো কাকার ঠাকুরদা জমিদার ইন্দ্রমোহন সেন, প্রজাদের কর অনাদায়ে নিতেন, তাদের জমি আর সঙ্গে সুন্দরী মেয়ে। অমন অত্যাচারী জমিদার সে সময়ে নাকি আর দ্বিতীয় বলতে কেউ ছিল না। কবিতা তাদেরই বংশ। কিন্তু একবারেই উল্টো সে। শীতের শিশিরকণার মতো সরল। আবার বর্ষার মতো অস্থির। তবে বিদ্যা-বুদ্ধিতে অসামান্যা হলেও, সে হৃদয়ে শিশু। যে শিশুটি তার গোলাপি ভবিষ্যৎ ভালোবাসার কাছে সব তুচ্ছ করে উধাও হয়ে যাওয়ার আগে এক মুহূর্তও ভাবলো না, … তারপর?
শিগগির বিলেত যাচ্ছি। বিলেত! কেন-কোথায়-কার কাছে-কবে-কি করে! যা জিজ্ঞেস করতেই বললো, একটা ভিসা জুগিয়েছি। প্রথমে নার্গিসের ওখানেই থাকবো। পড়বো। চাকরি করবো। দেশে ভবিষ্যৎ নেই। নার্গিস ওর বান্ধবী। মা সেকথা ভালো জানেন। শুরু হলো ওর বিলেত যাওয়ার প্রস্তুতি। জিজ্ঞেস করলেই মাকে একটা কিছু বুঝিয়ে দেয়। চালাক হওয়ার সুবিধেই তাই। চটজলদি বুঝিয়ে থিতিয়ে দেয়া যায়। কবিও বোঝাত। কবিকে বিশ্বাস করা না করার কারণ নেই, কারণ কবির জন্যে আশ্চর্য কিছু নেই। তবে ওকে বাধাও দেয়া যাবে না। দিলে শুনবে না। ইংল্যান্ড যাওয়াটাকে সে এভাবেই বাড়িতে ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত করে নিলো। মা ভাবলো, যাক এই সুযোগে সে শশীকে ভুলে যাবে।
সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা। বিপদ বুঝে দু’জনে মিলে ঠিক করলো পালিয়ে প্রথমে রাজশাহী যাবে। গিয়ে প্রথমে সেলিমের ওখানে উঠবে। তারপর রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করবে। আর এই পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতির নামই বিলেত যাওয়া।
নেই-নেই, লন্ডনের কথা বলে ছ’মাস ওরা নিখোঁজ। শশী আর কবি রাজশাহীতে আছে, কিন্তু বিয়েটা হয়ে ওঠে না। দু’পক্ষেরই বাবা-মা সেকথা জানেন। পরস্পরকে দোষারোপ করেন। শহর জাগিয়ে ঝগড়া করেন। অভিশাপ দেন। ও বলে তুমি, সে বলে তুই। আমার ছেলেকে, আমার মেয়েকে, ভাগিয়ে নিয়েছ, নিয়েছিস, তুই, তোরা, তোর ছেলে, তোর মেয়ে, এ্যাই! এ্যাই। ওরা কেউ যাবে না, কিছুতেই ওই নচ্ছার ছেলেকে-মেয়েকে দেখতে যাবে না। ছ’মাস বাড়িতে শোক। প্রচার হয়ে গেছে–ওদের বিয়ে হয়নি। এমনিই থাকছে। দুর্নামের পর দুর্নাম। বিয়ে হয়েছে কি হয়নি, এ নিয়ে শশী আর কবিরও সন্দেহ। তবে সই দিয়ে কিছু ঘটেনি। তাকে কী? ওরা সংসার করে। যায়। আইন ও সমাজের চোখে স্বামী-স্ত্রী হতে হলে সই লাগবে। সামনে বিপদ।
ছ’মাস পর। শুধু প্রেমে হাবুডুবুতে কি পেট ভরে? ভরে না। সঙ্গে যা ছিল, ফুরিয়ে আসছে। ভালো কোনও কাজ হলো না। কথায় আছে, সুখ ছাড়া প্রেম জানালা খুলে পালিয়ে যায়। ঘরে প্রায় কিছুই নেই। তবুও সংসার। মাটিতে পড়ে থাকা তোশক। দু’চারটে বাসন। দুজনেই জানে, আনুষ্ঠানিক বিয়ের অর্থ ওদের নেই। প্রয়োজন ভালো কাজ। কাজ হলো। বাসা হলো। আর আনুষ্ঠানিকতার রাতেই, দুর্বলচিত্তের শশী, যার নামের সাথে আসে চাঁদের কলঙ্ক, হঠাৎ উধাও। নেই তো নেই। কোথাও নেই। কবি পুরো এক সপ্তাহ হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াল ওর শশীকে। কেঁদে-কেটে অনাহারে অসুস্থ হলো। তবুও ফিরে যাবে না। যদি শশী ফিরে আসে। মা বলছে, ও বাবা-মায়ের কাছে চলে গ্যাছে। কবি বিশ্বাস করে না। সে যাবে না। কখনো না। বাবা-মা ঘরে তালা দিয়ে ওকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যায়। আর সেই সঙ্গে সাঙ্গ হলো ওদের ছ’মাসের স্বামী-স্ত্রী খেলার সংসার। যেখানে প্রেম থাকলেও সই ছিল না। এবং যুতসইভাবে ফিরে যাওয়ার পর বিয়ে হয়েছে কি হয়নি তা নিয়ে দুই পক্ষের তুলকালাম, প্রায় লাঠালাঠি। সই হলে এক, না হলে অন্য। শশীকে ওর বাবা-মা প্রহরায় আলাদা করে রাখলো।
শশীর কাছে কবি ছুটে চলে যায়। –আমি যাবো। যেতে দাও। ওকে ধরে রাখা যায় না। লোকেরা ভিড় করে তামাশা দেখে। মন্তব্য করে। কবিকে ওরা বাড়ির সীমানায় আসা বন্ধ করে দিলো। তবুও কৌশলে শশীকে সে দেখে, যাচ্ছে, আসছে। কিন্তু শশী ওকে দেখলে চোখ ঘুরিয়ে ফেলে। যেন-চেনেই না। একি কোনও কষ্টের মুখোশ! এড়িয়ে যাওয়ার! শশীকে ও নাম ধরে ডাকে। কেঁদে কেঁদে ডাকে। শশী একবার কথা বলো। একবার! ধর্ম মনুষ্যত্ব বলে কি তোমাদের কিছুই নেই? শশীর ভেতরে তুফান। ভুলে যেতে হলে, না চেনাই ভালো। না চেনার ভান করে কবিকে ভুলে থাকে। কঠিন সমাজ। সামাজিক কেলেঙ্কারি। এই ঘটনার শেষে ওকে ভুলতে হবেই। হঠাৎ একদিন শশীকে আর দেখা গেল না। সেই থেকে ওর কোনও সংবাদও কেউ আর জানলো না।
তারপর থেকে কবি, পুরো একবছর অসুস্থ। ভোলা কি যায়? যাওয়া কি এতই সহজ? প্রেম, যাকেই ভালোবেসে গড়ে ওঠে সে ভুল হোক আর ঠিক, তার কাছে সেই প্রেম সত্য। সে যত দরিদ্র বা যত কুৎসিত হোক, প্রেমের একটা তৃতীয় চোখ থাকে। সে চোখ অন্ধ। সেই চোখ শুধু তার সৌন্দর্য ছাড়া নোংরা দেখতে পারে না।
অভ্যস্ত প্রেমের শূন্যতা কি অত সহজে মেটে! কবি ওর নিজস্বতা হারিয়ে এবার ভিন্ন এক কবিতে রূপান্তর হয়। এই কবির সঙ্গে আগের কবির কোনও মিল নেই। শূন্যতা পূর্ণ করতে সে নতুন ভ্রান্তিপাশের খোঁজে বের হয়। অস্থির দুর্বলচিত্ত শুধু তাকেই খোঁজে আর খুঁজে খুঁজে হয় আরো ও ভ্রান্তিপাশের শিকার। স্বাভাবিক বুদ্ধি-জ্ঞান তখন লোপ পায়। কবিকে নিতে হলো পাগলের ডাক্তারের কাছে। একবছর, দু’বছর…। কবি সুস্থতার দিকে। তিন বছর পার হয়ে গেল শশীর চলে যাওয়ার। কবি একটু সেরে উঠেছে অতীতের ক্ষত থেকে। এবার বিধান। সে মুগ্ধ হয়। বিধানে সে, শশী দেখে। যেন যমজ দেখে। শশীর কাল সাপটিকে হত্যা করতে কবি দৌড়য় বিধানে।
দুটো ফুল একই বৃন্তের না হলেও যদি একই গাছে ফোটে বা পাশের গাছটি যদি এপাশের গাছের মতো হয় তবে, যমজ নয় কিন্তু ফুলগুলো গন্ধে, বর্ণে, রূপে, রসে এক। ফুটবে এক সাথে। ঝরবেও একই সাথে। পরমায়ু–উদ্দেশ্য–জীবন, সবই এক হবে। শশী আর বিধান এক বৃন্তে না হোক, একই পরামায়ুর। একই পরিতাপের! কবির সন্দেহ যায় না।
কিছু মানুষ জন্মায় সুখ করতে। আর কিছু মানুষ, দুঃখ। কিছু ভালো মানুষ যারা সহজ, সরল, যারা প্রথার তোয়াক্কা করে না, যারা জীবনটাকে দেখে শুধুই ফুরিয়ে যাওয়া পরমায়ু! পৃথিবীতে যাদের জীবনে প্রেম ছাড়া, স্নেহ ছাড়া চাইবার কিছু নেই, যারা পৃথিবীর এত জটিলতা, এই পঙ্কিল আবর্জনা, এত মিথ্যে, নিষ্ঠুরতা, অসুন্দরকে চোখ বুজে এড়িয়ে যায়, যারা বোঝে না কোনও হিংসে, কোনও জাত-বিভেদ! কিছু মানুষ আছে। সত্যিই কিছু মানুষ আছে যারা, উত্তমকে তাদের জীবন দর্শনে অবলম্বন। করে, শুধু কষ্টই পায়। আর কষ্ট করতেই শুধু, জন্ম তাদের।
তারা নির্বোধ নয়, তবে সরল। ফলে মানুষের প্রতারণার বিষ খেয়ে, ওরা নীলকণ্ঠ শিবের মতো নীল হয়ে যায়। নিষ্পাপ, কখনো কখনো অতিরিক্ত সারল্যের সঙ্গে মিশে সৃষ্টি করে দুঃখ। আর কবির মতো সহজ-সরল মেয়েরা, সেই দুঃখই পায়।
কবিতা সেই নীলকণ্ঠ শিবের বিষ। গেছে শশী। এবার গেল বিধান। কি অন্যায়! ভাবে কবি। সেদিন কবি গিয়েছিল–আশুলিয়ায় একটা কাজে। সেখানেই বিধানকে দেখতে পায় অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে। ফ্যান্টাসি আইল্যান্ডে ওরা এক প্লেট থেকে তুলে দু’জন ফুচকা খাচ্ছে। খাইয়েও দিচ্ছে। হাসছে। হাসতে হাসতে প্লেটের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে যাচ্ছে। চুলের বিনুনি পড়ছে প্লেটে। কৃত্রিম খেজুর গাছের শরীরে। তারপর আইসক্রিম। আইসক্রিমের পর ফের ফুচকা। তারপর চটপটি। নতুন প্রেমের সব ছেলেমানুষির চিহ্ন। কবি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো।
কত সুখ ওদের! দূর থেকে দাঁড়িয়ে কবি হাঁফ ছাড়ে। ক্লান্ত দেহ মন। আর পারে না। বিসর্জন দিতে চায়। তাও পারে না। ভ্রান্তিবিলাস ওকে সুস্থমতো ভাবতে দেয় না। হৃদয়, বাস্তবকে ছাড়িয়ে যায়। তৃতীয় চোখে বলে–এটা স্বপ্ন। এই দেখা, ভুল। ওর মতোই কেউ! কিন্তু সে নয়। হায়! কি কঠিন কি দুরন্ত কঠিন এই, বাস্তব! ইচ্ছে হয় মনটাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে। অনুভূতিগুলোর শেকড়টা উপড়ে নির্বংশ করতে! তবেই হয়তো কাউকে আর ভালোবাসতে ইচ্ছে হতো না। এই যে বিধান গতকাল ওর নাইকুণ্ডলীর নিচে নেমেছিল বলে ওর সকল সঞ্চিত স্মৃতি, আর আজ এই যে অন্য একটি মেয়ের নাইকুণ্ডলীর ওপরে ওর হাত, তলিয়ে যাওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি, রাতে যে প্রস্তুতি প্রাণ পাবে সজ্জিত সম্ভারে! সইতে না পেরে হাতের কাগজগুলো ছিঁড়ে ফেলে। খেজুর গাছে মাথা কোটে। আকুল কাঁদে যেমন কেঁদেছিল একদিন শশীকে হারিয়ে। এবার সে একটা রিকশায় চেপে বসলো। বিধান মেয়েটির সঙ্গে গাড়িতে। হাসতে হাসতে গাড়ি চালাচ্ছে মেয়েটি নিজে। পাশেই শীতলক্ষ্মা। রাজ্যের নোংরা-যতরকম আবর্জনা-নৌকোর অস্থিরতা-জেলের ভারি জাল-সব ছুঁড়ে ফেলা দায়ভারে যন্ত্রণা বুকে করে বয়ে চলে, অভিযোগহীন। কবি বাড়ির দিকে যায়। যেতে যেতে তাকায় জলের গভীরে।
আজ এই দুর্গা পুজোর নবমীর রাতে, এই ঢাকের বাজনার ভিড় ছাপিয়ে যে মেয়েটির ক্ষীণ কণ্ঠ আমার কানে আজও বাজে, যে মেয়েটির অযত্নের বিশাল জটপাকানো চুল আমার চোখে বাধে, যে–যে মেয়েটির হাতে নোংরা দুর্গন্ধ–কাপড়ের পুটলি থেকে উদ্ভট গন্ধ–আমার নাক পুড়িয়ে দেয়! পেটিকোটে যার বারো মাসের ঋতুর রঙ লাগানো। লাল ছোপ ছোপ। পথে পথে পড়ে থাকে, ঘুমোয়, আকাশের নিচে। নোংরা, গন্ধ, অসুস্থ, উকুন, পেচ্ছাব সব-সব মিলে যে, নরক! ঠিক ধরেছেন এই সংসারত্যাগী, এই প্রথা ভাঙুনী, কবিতা। সে এখন পূর্ণ পাগল।
হ্যাঁ ও পাগল হয়ে গ্যাছে। পা-গ-ল! পা-গ-ল! লোকেরা সিটি দেয়। পেছন পেছন ‘রূপ তেরা মাস্তানা’ গান গায়। খোলা আকাশের তলে ইচ্ছে হলেই ওকে চুদে দেয়। প্রতিবাদ করে করে, প্রতিবাদ করা সে ছেড়ে দিয়েছে। পেট ফুলেছিল দু’বার। বারবার ধর্ষণে রক্তপাত হয়ে জণগুলো ধুয়ে গেছে। শহরের মানুষ ওকে চেনে। ব্যথায় কষ্ট পেলে–কেউ এসে ওকে ট্যাবলেট, কেউ খাবার দেয়। শহরের লোকেরা এই জমিদার বংশের কন্যার জন্যে দুঃখ করে। ওকে দয়া করতে চায়। নতুন শাড়ি। টাকা। সে হাতজোড় করে বলে, না-না-না। অতীত ভুলে গেছে সে। দুটো নাম তার মনে পড়ে। শশী আর বিধান। মাঝে মাঝে দূরে তাকিয়েই থাকে। থাকে তো থাকেই। অথচ দেখার কিছুই নেই। তবুও সে দেখে। ওদের কথা বলতে বলতে কবি খালি হাসে। হেসে ভেঙে পড়ে। ওর মধুর স্মৃতি কথা। একমাত্র সম্পত্তি।
কবি মাঝেমাঝেই এই শহরের দুটি বাড়িতে যেতে ভুল করে না। ঘর-সংসারী বিধানের বাড়িতে গেলে বিধান ওকে চেনে না। কবি তবুও বিধানকে হেসে হেসে কি যেন বলে, সেই জানে। কিন্তু শশীটা আজকাল মায়া করতে থাকে। কবি গিয়ে একটু দাঁড়ায়। কিছু বলে না। কিছু চায়ও না। দুয়ারে শীতল দাঁড়িয়ে মিনিট পাঁচেক পর চলে যায়। এটা ওর একটা নিয়মের মতো।
শশীর এই শহরেই বড় চাকরি হয়েছে। ভালো টাকা বিয়ে-থা সংসার হয়েছে। তবুও ইদানীং বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্কটা কবিকে কেন্দ্র করে নষ্ট হয়েছে ওর। ওর বিবেকে কোথাও গণ্ডগোল বেঁধেছে। একটি মেয়ে, ওর নারী, একদিন যাকে ভালোবেসেছিল। যার শরীর নিয়েছিল। ইদানীং শশীর অপরাধবোধ, সমাজবোধকে ছাড়িয়ে গেছে। সে বিবেকের সগ্রামে ভোগে। ইদানীং সে অস্থির, অশান্ত। কবিকে। বললো, শোন! ওভাবে আর রাস্তায় রাস্তায় নয়। এসো তোমার জন্য একটা ঘর ভাড়া করে তোমাকে চিকিৎসা করাই।
কবি দুই হাত জোড় করে তার নিজস্ব ভাষা ও উচ্চারণে বললো–এই কথা কইয়েন না। …হা সত্যি, দয়া করে এই কথা বলবেন না। আপনাকে আমি চিনি। আপনিও এক প্রতারক। আমি বৈধ নই তাতে কী? কেন সেদিন প্রতিবাদ করলেন না? কি জন্যে? আর আজ কেন? জানেন না, আমার আমার, শশী আছে! তাকে নিয়ে আমি সুখে আছি। জানেন না! রাস্তা ভালো। সেখানে আমি স্বাধীন। আমি ঘর চাই না। কিছু লাগবে না। কিছু চাই না। না-না-না। বলতে বলতে, কবি হেসে গড়িয়ে পড়ে। শশী চুপ করে শোনে। মনে করার চেষ্টা করে, অতীত। আমার শশী! পুরোনো, পরিচিত। চির নতুন। গায়ে শিহরণ হয়। ফের মিলিয়েও যায়। স্নেহভরে, ভাত খাও কবিতা! ভাত! শশী, পরমস্নেহে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো। এবার করুণ চোখ তুলে কবি বললো, দিবা! দেও। শশী নিজ হাতে ওর জন্যে একথালা ভাত-মাছ এক গ্লাস জল নিয়ে এলো। এইখানে বসো কবি–এইখানে। ভাত খাও, বললো। পেছন পেছন ওর স্ত্রী আর দুই মেয়েও এসে দাঁড়ালো। কবি খেয়ে চলে গেল। শশীর চোখে জল। বললো, কাল এসো। খেয়ে যেও–কবি!
১১. আজকের দিনের এক স্ত্রীর পত্র
তোমাকে,
গল্পগুচ্ছের–”স্ত্রীর পত্র” বারবার পড়েও যেন পড়া শেষ হয় না। তার কারণ হয়তো এর বিষয়ের গভীরত্ব বা জীবনবোধ, যা মানুষের মনকে অন্তহীন চিন্তার সাগরে ডুবিয়ে দেয়। মানুষকে করে তোলে ভাবুক। ঘর ছেড়ে এসে মৃণালের মতো মনে হলো তোমাকেও এরকম একটা চিঠি লেখা জরুরি হয়ে পড়েছে। আজ সেই সময়। আজ সেই গোধূলিলগ্ন। তবে কেমন করে তা লিখবো সে নিয়ে বিড়ম্বনা। লেখার বিষয় এত বেশি, আর সমস্যাগুলো এত অন্যরকম যে সেজন্যেই হয়তো আমার মধ্যে এই। জটিলতা দেখা দিয়েছে। যেমন কি বলবো, কি লিখবো, কেমন করেই-বা ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার মৃণালকে দিয়ে যা বলাতে চেয়েছিলেন, সে কাজটা শুরুতেই। তিনি স্পষ্টভাবে করিয়ে নিয়েছেন।”আমি তোমাদের মেজো বৌ। আজ পনেরো বছর পরে এই সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে জানতে পেরেছি, আমার জগৎ এবং জগদীশ্বরের সঙ্গে অন্য সম্পর্কও আছে। তাই আজ সাহস করে এই চিঠিখানি লিখছি। এটা তোমাদের মেজো বৌয়ের চিঠি নয়। কোথায়রে রাজমিস্ত্রির গড়া দেয়াল! আইন দিয়ে গড়া কাটার বেড়া। ঐ তো মৃত্যুর হাতে উড়ছে জীবনের জয় পতাকা। …আমি আর তোমাদের সাতাশ নম্বর মাখন বড়ালের গলিতে ফিরব না।”
আমিও সংসারের সকল বন্ধন উপড়ে ফেলে, অর্থের সকল প্রাচুর্য, মোহ, ত্যাগ করে ফিরে এসেছি সুদূর থেকে এই ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে। আমার শৈশবের স্মৃতিঘেরা-নদী। আমারও মাথার ওপরে আষাঢ়ের জলভরা আকাশ। দূরে, মাছ ধরা। নৌকো থেকে কিছু আলো জোনাকির মতো ভেসে আসছে ব্রহ্মপুত্রের জলে। এখন। অনেক রাত। লোকেরা এত রাতে একটা মেয়েকে এভাবে একা একা বসে থাকতে দেখলে ভাববে আস্ত পাগল। ভাবুক। পাগল ভালো। কারণ তারাই একমাত্র অতীত ভুলে যেতে পারে। অতীত, যা আমি ভুলতে পারবো না। কারণটা বড় জটিল, ভীষণ নরক।
সেই জটিল, সেই নরক থেকে সরে এসে এখন আমি যে জায়গাটায় বসে আছি, প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যে ঘেরা এই জায়গাটায় অনেক সবুজ ঘাস। ঘাসের ওপরে ধুয়ে যাওয়া বৃষ্টির জল। সবখানেই কাদা। অন্ধকারে দূর থেকে দু’একটা ব্যাঙের ডাক শোনা। যায়। কিছু দূরে অনেকগুলো ছোট বড় গাছের আভাস, নদীর গতিকে বুঝিয়ে দিতে। ঝিঁঝি পোকাগুলো করাত দিয়ে কাটছে বর্ষার অন্ধকার রাত। ঐ দূরে একটি আগুনের শিখা। অনবরত জ্বলছে। জানতাম, ঐখানেই কোথাও হবে, ব্রহ্মপুত্রের পারে, বহু পুরোনো একটা আদি শ্মশান। শ্মশান, যার নাম শুনলে আগে ভয়ে কাঁপতাম। আজ সেসব অতিরিক্ত ভয়গুলো আমার আর নেই। কারণ যে নরক দেখেছে, শ্মশানে মরা পোড়ানোর নিষ্ঠুরতা তার কাছে অনেক কম যন্ত্রণাদায়ক। আর আমি সেই নরক তোমার মধ্যে দেখে দেখে শুশানের ভয় থেকে মুক্তি পেয়েছি।
তবুও বিশ্ব নামের এত বড় বিশাল সংসার থেকে মুক্তি, বন্ধন ছিন্নতা সহজ কর্ম নয়। আপন সংসারের যে মায়া, যে মাধুর্য, সেখান থেকে শেকল কাটাও সহজ নয়। সংসার একটি দৈত্যসুলভ সর্বনেশে মায়া ও বন্ধনের সমুদ্র। এখানে অক্টোপাসের আটটির বদলে ষোলটি বাহু। আর সে তার বাহুগুলোতে আমাকে সংসার সন্তানের মায়া মরীচিকা দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দি করে রেখেছিল। কিন্তু আমার ওপর তোমার অন্যায় অবিচার এত মাত্রাহীন হয়ে উঠলো যে বোধ একদিন আমাকে তাড়া করলো। আর সেজন্যেই আজ আমি এই জায়গায় পৌঁছুতে পেরেছি। তা সত্ত্বেও প্রিতুর কারণে সেখান থেকে উত্তরণ ঘটতে ঘটতে চলে গেল জীবনের অনেকটা সময়। জীবনটা যে এত দ্রুত এরকম বুড়ো মানুষের দাঁতের মতো নড়বড়ে হয়ে যাবে সে আমি একেবারেই যে বুঝিনি তা ঠিক নয়, তবে ভেবেছিলাম হয়তো বর্ষণ হয়ে একদিন ঝরে যাবে আমাদের মধ্যেকার দুর্যোগের এই মেঘ। কিন্তু সময় যত যায় ততই দেখি দুর্যোগ, নৌকোভর্তি মেঘ ঢেলে দিয়ে দ্রুত চলে যায়, শুধু ফিরে আসতে আরো দুর্যোগে ভেজা মেঘ সঙ্গে করে নিয়ে।
আমি জানি, মৃণাল ও আমার সময়, জীবনযাত্রা, পরিস্থিতি এক নয়। তবে মুক্তির পথ, এক। গৃহহীন হয়ে ফিরে যাওয়া প্রকৃতির কাছে, যেখান থেকে আমরা এসেছি। জলে, সমুদুরে। আমাদের দেহের শতকরা আশি ভাগই তো জল দিয়ে তৈরি। তাই এই ব্রহ্মপুত্রের বিশালতার কাছে আমার ক্ষুদ্রতা ধুয়ে নিজেকে ফিরে পেতে, এখানে ফিরে এসেছি আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে। এসে প্রতিদিনই নিজেকে চিনতে চেয়েছি, ক্ষুদ্রতা ধুয়ে। আজ মনে হচ্ছে এখনই সময়। এই দশ বছর সময় আমার জীবনে একটি হিমালয়ের মতো এতই বিস্ময়কর পাহাড়, যার জঙ্গলে বসে আমি নিজেকে খুঁজে নিয়েছি। তবুও অতীতের সেই সংসারের কত স্মৃতিই তো মনে পড়ে! মনে পড়ে সুন্দর এক যুবকের কথা, যে ছিল আমার হৃদয়ের মধ্যমণি। মনে পড়ে বিয়ের পরপর সংসার নিয়ে আমার রোমাঞ্চের কথা। কাজের পর বাড়ি ফেরার জন্যে মনটা চঞ্চল হয়ে থাকতো। কাজশেষে বাড়ি ফিরে রান্না করবো, একসঙ্গে খাবো। বিছানায় শুয়ে তোমার সঙ্গে গল্প করবো গভীর রাত অবধি। তোমার বুকে মুখ লুকিয়ে একটি শিশুর মতো অবুঝ হয়ে ভুলেই যাবো আমি কে। তোমার বুকের ওম আমার শরীরে জাগাবে, ভালোবাসা। যেন একটা নেশায় পেয়ে বসলো।
বিয়ের পাঁচ বছর অবধি, তোমার মধ্যে আমি অন্যান্য পুরুষের মতো হীনমন্যতা দেখিনি। বরং তুমি আমাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে সাংসারিক বিভিন্ন জটিলতার সময়ে আমার পক্ষেই কথা বলেছ। কিন্তু বিদেশে আসার প্রায় সাত বছর পর হঠাৎ যেন। তোমার মধ্যে কি ঘটে গেল। অদ্ভুত এক পরিবর্তন দেখলাম যখন বহু প্রতীক্ষার পর প্রথম সন্তানটি পেটে এলো। তুমি বললে বাচ্চা হয়ে গেলে কাজ ছেড়ে বাসায় বাচ্চা মানুষ করতে হবে। আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। একি কথা শুনছি তোমার মুখে! যেন এক অন্য তুমি! মাতৃত্ব ভালো, কিন্তু মাতৃত্ব যে অভিশাপও হতে পারে সেইদিনই প্রথম অনুভব করলাম, যেদিন এই তুচ্ছ ব্যাপারটি নিয়ে ফের দারুণ গণ্ডগোল শুরু হলো। এ নিয়ে ঝগড়া হয়ে উঠলো নিত্যদিনের বিষয়। এই প্রবাসে চাকরি ছেড়ে ঘরে থাকা! অসম্ভব! মা হওয়ার আগাম সমস্ত সুখই নষ্ট হয়ে গেল। বললাম, টাকার অভাব। যখন নেই, না হয় তোক রেখে নেবো। তুমি বেশ রূঢ় কণ্ঠে বললে, না। বললে, আমার সন্তান মানুষ হবে তার মায়ের কোলে। আমি বললাম, আমিও তো আমার মায়ের সন্তান। মা আমাকে পড়িয়েছেন। তাছাড়া এত ভালো কাজ। বিদেশে কি কেউ বসে থাকে! বললাম, তা কি থাকা যায়? কথায়, কথায় তর্ক বাড়লো। রাগ যখন চরমে, বললাম, তুমিই না হয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাচ্চা মানুষ করো। কেন করবে না? চাকরিটা আমি কেন ছাড়বো? তুমি এক চড় মেরে বললে, তোমার এই বাইরে থাকা আর ছেলেদের সঙ্গ আমার আর ভালো লাগছে না। আমি বুঝে গেলাম তোমার আসল তোমাকে! তুমিও সবার মতো সাধারণ। হঠাৎ ভীষণ উত্তেজনায় আমি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। তারপর আর কিছু জানি না।
সেদিন চোখ খুলে দেখলাম আমি হাসপাতালে। বিছানায় রাখা চার্টে লেখা–উচ্চ রক্তচাপ। স্যালাইনের সুই ডান হাতের কবজির ওপরে। বাম হাতে রক্তের ব্যাগ। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে! ডাক্তার বললো, আপনি এখন ঘুমোন। ডাক্তার, সেও লুকিয়ে গেল। বুঝলাম, আমার বাচ্চা নষ্ট হয়ে গ্যাছে। প্রথম যখন জানলাম আমার অনুমানই সত্যি–তখন তুমি কাছে ছিলে না। না থাকাটাই ভালো ছিল। থাকলে না জানি কি ঘটতো। হয়তো দুই হাতের সুই ছিঁড়ে ফেলে হাসপাতালেই এক ভীষণ কেলেঙ্কারি বাধাতাম। তার তিনদিন পর প্রচণ্ড রক্তপাতশেষে জ্বণের অবশিষ্টাংশ পরিষ্কার করে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে এলাম। তৈরি হলো এক অদৃশ্য দেয়ালের ভিত তোমার আর আমার মধ্যখানে। সৃষ্টি হলো দূরত্বের আকাশ, দু’জনের–আচরণে। আমি অনেক পুরুষের মধ্যে নারী বিষয়ে–হীনমন্যতা দেখেছি। কিন্তু তোমার মধ্যে সেই একই হীনমন্যতা, সেই সন্দেহ, যা আমি বরাবরই ঘৃণার চোখে দেখে এসেছি, দেখে নড়ে উঠলাম।
বাড়িতে তুমি আমি দু’জনেই গম্ভীর। এই গাম্ভীর্যের ভাবখানা এরকম যে তুমি আমাকে বলছো সব দোষ আমার। আর আমি বলছি তোমার। চোখ দিয়ে ঘৃণা আর শাসন করা এবং তখনকার জন্যে এটাই ছিল বরং সবচেয়ে সহজ কাজ। কেননা দোষ দিয়ে নিজের অন্যায় অন্যের ঘাড়ে চাপাতে পারলে ভালো লাগে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকলো তোমার ভালোমানুষি পুরুষের আস্তিনের তলায় ছদ্মবেশী এক রক্ষণশীল স্বভাবের পুরুষের প্রকৃত চেহারা। এই চেহারা, যা পুরুষের শাশ্বত রূপ। যা আমার সংসারে নবাগত।
জেনেছিলাম–সাদা, কালোর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। স্বৈরাচার, গণতন্ত্রের চেয়ে। সবল, দুর্বলের চেয়ে। সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘুর চেয়ে পুরুষ নারীর চেয়ে। তুমিও দিন যত যায়, বোঝালে সংসারে পুরুষ নারীর চেয়ে বড়। কি করে বুঝলাম! বুঝাবার যথেষ্ট কারণ তুমি দেখিয়েছ। ক’টা বলবো! তবে সবচেয়ে বেশি বুঝলাম, যেদিন দেশ থেকে আমার ছোট বোনটার বিয়ের খবর এলো। রমা লুকিয়ে বিয়ে করেছে এক মুসলিম ছেলেকে। ছেলেটিকে আমি চিনতাম। অনেক নিষেধ সত্ত্বেও এই ভয়ই সত্য হলো। রমার ব্যাপারটা, তুমিও জানতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, সঙ্গে সঙ্গে তুমি বললে, রমা একটা নষ্টা। একটা জারজ। ও যেন এখানে কখনো যোগাযোগ না করে। বললাম, কি বলছো এসব! বিদেশে তুমি তাহলে কাঁদের সঙ্গে থাকছো, কাজ করছো! ভিন জাতের বাড়িতে নেমন্তন্ন খাচ্ছে। অথচ সব দোষ হয়ে গেল রমার! জানি না হিন্দু আর খ্রিষ্টানের বিয়ের সঙ্গে কি তফাত হিন্দু-মুসলিমের।
যখন প্রয়োজন তোমার সমবেদনা, তখন তুমি দেখালে ঘৃণা। তুমি জেদ ধরে বসলে যে, আমি আমার নষ্ট জারজ পরিবারের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখতে পারবো না। রমার এই সংবাদে, বাড়িতে শোকের ছায়া। যেন কেউ মারা গেছে। এই সংবাদটি ফোন করে জানালো বিল্ট, আমার ছোট ভাই। বললো গ্রামে ভীষণ হৈ-চৈ হচ্ছে। লোকজন বাড়িতে এসে হট্টগোল করছে। বাবাকে অপমান করছে। বাবার হার্ট এ্যাটাক হয়ে সে হাসপাতালে, প্রায় মৃত্যুমুখে। অপারেশনের জন্য টাকা লাগবে, প্রায় দু’লক্ষ। তোমার ভয়ে প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। কি করি! কি করা যায়। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করি, লুকিয়ে। টাকা পাঠালাম, লুকিয়ে। বুঝতে পেরে, আমাকে ভীষণ গালাগাল করলে। অন্যদিন, ধরে মারলে। তোমার এই মনুষ্যত্বহীনতা আমাকে–উভয় সঙ্কটে ফেলে দেয়। এ কথা কাউকে না পারি বলতে, না পারি গিলতে। এতকাল পুরুষের দানব চরিত্রের যেসব কাহিনী শুনে এসেছি, সে জিনিস এখন সত্য হলো আমারই কপালে!
রমার ব্যাপারে তোমার সিদ্ধান্তে তুমি রইলে অটল এবং ক্ষমাহীন। দুজনের মধ্যে একরাশ নীরবতা আমাদের ঘরটাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে। তা সত্ত্বেও –বছরখানেক পর, মুহূর্তের আবেগে কি যেন ঘটে গেল! ফের আমার পেটে বাচ্চা এলো। বাচ্চাটা পেটে এসে বিপদ আবার নতুন করে বাড়লো। মনে শান্তি নেই। মনে হয় পঙ্গু বাবার কথা। সারাদিন বিছানায় শুয়ে শুধু রমা রমা করেন। রমা-তুই, কি করলি! বলেন, আর কেঁদে-কেটে বুক ভাসান। আমাদের সমাজ। যেখানে মানুষের মন ক্ষমাহীন, নিচু। মর্ত্যের নরক। রমাকে নিয়ে সামাজিক গণ্ডগোল তুঙ্গে। মানুষের অত্যাচারে বাড়ির ওরা ভারতে চলে যাবেন বলে ভাবছেন। অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। মা বললেন, তুই একবার আয়। দেশে তোর আসাটা খুবই জরুরি। পাড়ায় একটা মীমাংসারও ব্যাপার আছে। তাছাড়া, হিন্দু-মুসলিমের বিষয় নিয়ে যে নোংরামো এবং কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি চলছে, মার বিশ্বাস এতে করে ওদেরকে হয়তো সব সম্পত্তি বিনে পয়সায় দিয়ে, ভারতে চলে যেতে হবে। পড়শিদের দু’একজন এই সুযোগে আমাদের বাড়িঘর দখলের ষড়যন্ত্র করছে বলে মা জানালেন। সুতরাং বুঝতেই পার আমার যাওয়াটা, কতটা জরুরি। কিন্তু পেটের বাচ্চার অজুহাত দেখিয়ে তুমি যেতে দিলেই না। বাবা মৃত্যুপথে। তুমি সেটা বুঝলে না। তবে ডাক্তারেরও নিষেধ ছিল বলে সেদিন আমিও জোর করিনি।
আমি ছোটবেলা থেকেই সময়ে বিশ্বাসী। সময়ই সব ক্ষত শুকিয়ে দিতে পারে। আমি অপেক্ষায় রইলাম। এরপরে প্রিতু হলো। বাবা মারা গেলেন। রমার জীবনটা আস্ত নরক হলো। আমিও অপারক। তা সত্ত্বেও প্রিতুর কথা ভেবে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ থেকে বিরত রইলাম। তুমি কাজে চলে যাও সকালে। আমি বেলা অবধি মেয়েটিকে নিয়ে বাড়িতে। তখন আমি মা। আমার অন্য আরেকটা কাজের জায়গা, দু’ দুটো কম্পুটার, দুটা টেলিফোন, বছরে চল্লিশ হাজার ডলার বেতন সবই অন্যের দখলে। ড্রাইভওয়েতে আমার নতুন গাড়িটা বেকার সময় কাটায়। রাত জাগা আমি দিনে ঘুমোই। মেয়ের মুখে তুলে দিই স্তনের বোটা। অনবরত স্তনের এই দুর্দশা, আমাকে মাতৃত্ব বিষয়ে বিশ্রী অনুভূতি দেয়। স্বাভাবিক কর্মজীবন থেকে এই বিচ্যুতি আমাকে প্রবল ক্রোধের দ্বারস্থ করে তোলে। বাচ্চা হওয়ার পর নীল অনুভূতি আমাকে ক্রমশ গ্রাস করতে থাকে, হতাশায়। মাতৃত্ব আমাকে নরক যন্ত্রণা দিতে শুরু করে। হঠাৎ হঠাৎ মনে হতো, দু’হাতে প্রিতুর গলা টিপে মেরে ফেলি। কারণ ওর জন্যই তো আমার এই বন্দি জীবন। না হলে বাবাকে দেখতে পেতাম। প্রিতুকে একদিন গলা টিপে প্রায় মেরেই ফেলেছিলাম। তুমি বাড়ি ছিলে না বলে টের পাওনি। ও খুব কেঁদেছিল। তুমি শুধু বললে, ও এত কাঁদছে কেন? বলেছিলাম, খিদে পেয়েছে তাই। আজ বলতে বাধা নেই, প্রিতু, সেদিন প্রায় মরেই গিয়েছিল।
মা আমাকে ছোটবেলা থেকেই বলতেন, মেয়ে হয়েও ওর খুব বুদ্ধি। গাছের মতো মা আমাকে সর্বক্ষণ তার ছায়ায় রাখতেন। আমাকে নিয়ে তার একটি বিশেষ অহঙ্কার ছিল। বিদ্যুৎবিহীন গ্রামে বসেও তিনি বলেছিলেন এই মেয়েটি একদিন অনেক বড় আর ভালো মানুষ হবে। তার এই অসম্ভব বিশ্বাসের ভিত্তি বা সম্ভাবনা নিয়ে কেউ বিশেষ সন্দেহ করেনি। এবং বড় হয়ে আমি তার আশা পূর্ণ করেছিলাম। সবাই বলে আমি নাকি একজন ভালো মানুষ, সহজ-সরল। আজ মনে সন্দেহ জাগে এই সারল্যই কি আমার অভিশাপ? এই সারল্যেরই কি তবে প্রয়োজন ছিল? যদি তাই হবে তাহলে, রমা এবং বাবার এই কষ্ট, মা একাই কেন ভোগ করলেন? -কেন আমি সেদিনই সংসার ত্যাগ করিনি? কেন? এর উত্তর, প্রিতু। তুমি আমাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করেছ। একাকিনী মা। তার একটা চোখে ছানি। দু’পায়ে গিঁট বাত। তুমি সবই জানো। কিন্তু পুরুষত্ব–অন্যদের মতো তোমাকে পশুত্বে রূপান্তর করেছে।
ভার্সিটিতে যেদিন পরীক্ষার ফল বের হলো, বাড়িতে বেজায় খুশিতে আমার নিরক্ষর মা আবারো বললেন, মেয়ে নয় ও আমার ছেলে। কিন্তু যখন শিক্ষিত কোনও মানুষ আমাকে মনে করিয়ে দিতে চায় যে আমি মেয়েমানুষ এবং সেরকম আচরণ করতে, তখনই আমার নিরক্ষর মায়ের কথা মনে করে তোমাদের জন্য বড় আফসোস হয় যে, তার তুলনায় বড় বড় ডিগ্রির সার্টিফিকেট সত্ত্বেও তোমরা কত অল্পশিক্ষিত! মার কথা ভেবে বিশ্বাস করি যে, বড় বড় কলেজে গেলেই শুধু শিক্ষিত হওয়া যাবে না। শিক্ষার আলো, শুধু শিক্ষায় নয়, তার বোধের আলো দ্বারা প্রথমে উদ্ভাসিত হয়। বোধ। যা, আমার মায়ের আছে প্রচুর। যা তোমার মধ্যে তুলনায় যৎসামান্যই।
মনে রেখো, প্রদীপের তলায় থাকে বিশাল অন্ধকার। এই সুশিক্ষিত সমাজেও আজ বোধের যে বিশাল শূন্যতা; তোমাদের মতো বুদ্ধিমানদের বোধের অবক্ষয় বোঝাতে বোঝাতে জ্ঞানী-গুণীদের ভাণ্ডারও ফুরিয়ে যাবে। কারণ তোমরা যে জ্ঞানপাপী। জ্ঞানপাপীদেরকে বোঝানো আর সমুদ্রে মুক্তো খোঁজা সমান কাজ। এরপর থেকে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে, এটা করি, সেটা করি। করতে করতে সেই কাজও ফুরিয়ে যায়। ভাবি, আর কি নিয়ে ব্যস্ত থাকা যায়! বন্ধু খুঁজে বেড়াই। ভালো বন্ধু, যাদের সাথে কথা বলা যায়। যারা আমার সমমনা।
তাদেরই উৎসাহে নারীবাদ, সাহিত্য এসব নিয়ে অনুসন্ধানে লিপ্ত হলাম। সেজন্যে লাইব্রেরিতে যাই। এখানে-সেখানে বিভিন্ন ছোটখাট অনুষ্ঠানে যাই। এভাবেই পরিচয় হয় একগুচ্ছ মেয়ের সঙ্গে যে মেয়েগুলো বেকার সময় কাটাতে ঘুরে বেড়ায় দোকানে, রাস্তায়, পার্কে। কেনে যা কেনার প্রয়োজন নেই। কিনে কিনে ঘর ভরে। ভরে গেলে, জায়গার অভাবে আবর্জনার স্তূপে তা ফেলে দিয়ে আসে। ঘরকন্না এই মেয়েগুলো প্রায় সবাই শিক্ষিত। এদের মধ্যে গৃহিণী এক মেয়ে আইন বিশেষজ্ঞ। বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে এক সি.পি.এ.। কেউ সেলস্ গার্ল। স্বামীর সংসার করতে গিয়ে ওরা সবাই বিসর্জন দিয়েছে। ওদের পেশা এবং পেশার ভালোবাসা। কেউ স্বেচ্ছায়, অধিকাংশই অনিচ্ছায়। এদের মধ্যে একটা মেয়ে ছিল যে ছয় ঘরের বেতনে চাকরি করতো একটি বিশাল ল ফার্মে। সুন্দরী, স্মার্ট, প্রতিশ্রুতিশীল। স্বামী তাকে চার চারটি সন্তান উপহার দিয়ে তাকে গৃহবন্দি করে রাখার উত্তম বন্দোবস্ত করে রেখেছে।
মৃণাল জেগেছিল শতবর্ষ আগে যখন আধুনিকতার অভাব ছিল। আর শতবর্ষ পরে, প্রবাসের এবং দেশের বিপুল অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি যে, আমাদের আজকের মেয়েরা নিজে নিজে জাগে না, ওদেরকে কেউ জাগাতে পারে না। পারবে না মুক্ত করতে পুরুষের দাসত্ব থেকে। নাহিদকে ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও সংসারী হতে হলো, আমেরিকার মতো জায়গায়। তিনটে সন্তান মানুষ করছে সে। কিন্তু কাজে গেল ওর স্বামী। শিক্ষিত মেয়েরা সার্টিফিকেটের যে কি অপচয় করে এর উদাহরণের কি কোনও শেষ আছে? শিক্ষিত গৃহিণীদের ঘরে যত যাই, ততই অবাক হই। এরাই আত্মঘাতী; এরাই সংরক্ষণশীল। শিক্ষিত মেয়েরা বরং বিশ্বাস করে নারীর স্থান গৃহে। স্রেফ সামাজিক কুসংস্কার। স্রেফ ধর্মান্ধতা, যা অজুহাতে রূপান্তরিত হয়। বুঝি, ভার্সিটি পাস মেয়েদেরকে তোমরা কেন বিয়ে করো। যেন ওরা তোমাদের জন্যে শিক্ষিত সন্তান উপহার দিতে পারে। নয় কি? তার মানে এই যে, ঘরে শিক্ষিত স্ত্রী থাকলে, সন্তানও শিক্ষিত হবে। তাদের মধ্যে শিক্ষিত মেয়েরা যাবে স্বামীর ঘরে ফের শিক্ষিত সন্তান তৈরি করতে। যাদের মধ্যে থেকে মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি যাবে ভবিষ্যতে শিক্ষিত সন্তান তৈরি করতে, ছেলেরা যাবে কাজে। অর্থাৎ চক্রটা বৃত্তাকার।
তোমার সন্দেহকে সেবার প্রত্যাখ্যান করলাম। ছেলে বন্ধুগুলোকে নিয়ে এলাম বাড়িতে। তুমি বাধা দিয়ে বললে, শেফালী-রিতু-সেতু ওরা নেই কেন? এই প্রশ্নের ফলে আমার জগৎ আরো সীমিত হতে থাকলো। বাড়িতে একদিন এক অনুষ্ঠানে মুখের ওপর অপমান করে বসলে বয়স্ক প্রবীণদাকে। সে এক বিব্রতকর পরিস্থিতি। প্রবীণদা বয়োজ্যেষ্ঠ এক কবি, যিনি লুকিয়ে করিডোরে সিগ্রেট ফুঁকছিলেন। তুমি তাকে তক্ষুণি বের করে দিলে। প্রবীণদা, ভয়ে দৌড়ে বের হতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ব্যথা। পেলেন। ভারি বিব্রতকর এক পরিস্থিতি, তাকে আমি এ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। প্রবীণদার ডান পাটা ভেঙে গিয়েছিল। শুধু আমার অনুরোধে তিনি এ নিয়ে উকিল-আদালত করেননি। তা না হলে কি ঝামেলায় তুমি জড়াতে তোমার কোনও ধারণাই নেই। আমি তাও সইলাম। আর তখন আমার পেটে আবার তিন মাসের ভ্রূণ। তুমিও জানতে না। আমি চলে গেলাম ওম্যানস্ ক্লিনিকে। গর্ভপাত করিয়ে বাড়ি ফিরলাম। এরপর থেকে প্রিতুকে গল্পের ছলে তৈরি করি, মা ছাড়া পৃথিবীর জন্য। কারণ আমি জানি এ সংসার ছেড়ে আমাকেই যেতে হবে। আমি চলে গেলেও, প্রিতুকে তুমি দেবে না এবং এ দেশের কোর্টও তা দেবে না। আমি প্রিতুকে কোনও নিষ্ঠুরতার যুদ্ধে দাঁড় করাতে রাজি নই। নই, কোনও প্রতিযোগিতার যুদ্ধে। আগে আমি বাঁচবো। তারপর প্রিতুকে এমন মনোভাব নিয়ে, মনে মনে এগোতে থাকলাম মুক্তির চিন্তায়। বিবাহ বিচ্ছেদ এবং মৃণালের মতোই সংসার ছেড়ে, দূরে কোথাও চলে যাওয়ার। শুরু হলো উঁকিলের সঙ্গে কাগজপত্র নিয়ে। ডিভোর্সের ঝুট-ঝামেলা। লাভ-লোকসানের হিসেব তো বটেই।
এদিকে প্রবীণদাকে কেন্দ্র করে তোমার সঙ্গে আমার মানসিক দূরত্ব দ্রুত বাড়তে থাকে। একটা অকারণ জেদ, প্রতিশোধের আগুন, অধিকারবোধ তখন থেকে আমার মনে তীব্রভাবে কাজ করতে শুরু করলো। দেখা হলেই ঘৃণা। দেখা হলেই এড়ানোর প্রতিযোগিতা। চললো তাচ্ছিল্যের ম্যারাথন।
বাতিকগ্রস্ত তুমি সব পুরুষকেই সন্দেহ করতে। কথা বলতে দেখলে, কোথাও একসঙ্গে বসলেই। সন্দেহ যা একটা অসুস্থতা। একটা নরক। এই নরক পুরুষের নিজস্ব। আর তুমি হলে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। তোমাদের ধারণা কথা বললেই মেয়েরা পুরুষের সঙ্গে শোয়। অসীমকে তুমি সবচেয়ে বেশি সন্দেহ করতে। ভাবতে, ওর সঙ্গে আমার শুধু প্রেমই নয়, দৈহিক সম্পর্কও আছে। ভাবতে সাহিত্য-টাহিত্য কিছু নয়। সব, ছুতো। তবে হ্যাঁ, অসীম আমার বিশেষ বন্ধু। আমার সবচেয়ে বেশি মানসিক যোগাযোগ ওরই সঙ্গে। তোমার সঙ্গেই বেশি করে আমার সেই যোগাযোগ থাকার কথা। কিন্তু শূন্যতা মেটাতে তোমার স্থান পূরণ করলো অসীম। অসীমকেও তুমি একদিন তাড়িয়ে দিলে। আর সেইসঙ্গে হৃদয়টা ওর জন্যে ব্যথায় গুমরে উঠলো। শুধু সন্দেহ আর সন্দেহ নিয়ে ভরে গেল তোমার পৃথিবীটা।
দেশে ফিরে যাবো সেই প্রস্তুতিই নিচ্ছি। এদিকে ডিভোর্সের কাজ চলছে। এর মধ্যে জীবনের আরেকটা মোড় হঠাৎ ঘুরে গেল। সেবার কবি-সাহিত্যিকদের একটা সম্মেলন হবে আপ স্টেইটে। অসীম ফোন করে বললো, আমাকে সেখানে যেতে হবে। অসীমরা দল বেঁধে যাচ্ছে। শুনে মনটা খুশিতে নেচে উঠলো। গেলাম আমিও। আর সেখানেই কখন যেন তোমারই সন্দেহ আর গুমরে ওঠা হৃদয়, ভালোবাসা হয়ে ফুটে উঠলো। হলো, অসীমের প্রতি অসীম ভালোবাসা।
আপ স্টেইটের পাহাড়ের কোলে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিলাম, নতুন অভিজ্ঞতার ঝুলিভর্তি অসীমের ভালোবাসায়। আমার ভালোবাসাহীন শুকনো হৃদয় আর দীর্ঘদিনের বিবর্ণ ঘাসে যেন অনন্ত জলধারা গড়িয়ে পড়তে লাগলো। ফিরে এলাম, তোমারই সংসারে অন্য মানুষের জন্যে, অন্য অনুভূতি হৃদয়ে নিয়ে।
প্রিতুর তখন পাঁচ বছর। আর আমার বয়সটা মেয়েদের জীবনে নানারকম পরিবর্তন আর জটিলতার সময়ে। তোমার সন্দেহকেই শেষ পর্যন্ত সত্যি করে তুলোম। পরকীয়া। যা আগে কোনওদিন আমার ভাবনায় উদয় হয়নি। অসীম আমাকে শূন্যতার যন্ত্রণা থেকে সাময়িক মুক্তি দিয়েছিল। পরকীয়া, আমার দুঃসময়ে আমাকে বাঁচায়নিই শুধু, মুক্তিও দিয়েছিল সীমাহীন যন্ত্রণা থেকে।
বন্ধন ছিন্ন করার প্রস্তুতি প্রায় শেষ। এবং সেই চুলোয় আরো আগুন জ্বালাতে হঠাৎ উপস্থিত হলো রমা। যেন ভূত দেখার মতো। কি করে যেন ভিসা জুটিয়ে ওরা দু’জনেই চলে এলো। আর ওদের দেখেই তুমি উঠলে জ্বলে। হলো ঝগড়া। আমাকে সেদিন। জখম করেছিলে বেল্ট দিয়ে পিটিয়ে। তোমার ভাগ্য ভালো-যে, প্রিতুর জন্ম হয়েছিল। তাই ওর কষ্ট হবে ভেবে পুলিশ ডাকতে চাইলেও পারিনি।
তুমি ভুলে গিয়েছিলে যে, এই দেশটা সম-অধিকারের। ভেবেছিলে যে মানা না মানার ক্ষমতা আমারও ছিল! তোমার মতো পশুর সঙ্গ দ্রুত ত্যাগ করতে হলে, প্রিতুকে সাময়িক হারাতে হবে। আমি তো সে সত্য মেনে নিয়েছি। সুতরাং আমার আবার ভয় কিসের? যুদ্ধ হবে, রণাঙ্গন তৈরি। রমাকে বললাম, কোথাও যাবি না। এ বাড়িতেই থাকবি যতদিন আমি আছি। এ নিয়ে হাঁকাহাঁকি পুলিশ ডাকাডাকি হলো। ঝগড়া, কান্না, চিৎকার। আমি রইলাম অনড় আমার অধিকারে। পুলিশই সেকথা বলেছিল। আর তুমি। ভয় পেলেও, জেদটাকেই অধিক তুলে ধরলে।
প্রস্তূতি খুব দ্রুত চলছে। এবং সেজন্যে আমি উকিলকে অতিরিক্ত কিছু অর্থও দিলাম। এ দেশের আইনে বলে, ছোট বাচ্চাকে নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়া যাবে না। তোমারই জয় হলো। সে এক দৃশ্য! আমি সুটকেইস হাতে। তুমি প্রিতুকে কোলে করে। আমি বিদায় নিলাম তোমার সংসার থেকে। জেনে রেখো, মাতৃত্ব কেড়ে নেয়া যায় না। যেমন যায় না পিতৃত্ব। প্রিতু, আমাদের দু’জনের। আমি জানি প্রিতু ফিরে আসবে আমার কাছে, আসতে বাধ্য। আজ না হোক, কাল। কথা আর না বাড়িয়ে, অপেক্ষমাণ ট্যাক্সিতে বসে চলে এলাম রমাকে নিয়ে, বন্ধুর বাড়িতে। তারপর সেখান থেকে-এখানে।
পুরুষ, তোমরা সবই পারো। আমার মতো আধুনিক, শিক্ষিত মেয়েকেও তোমরা যখন ছাড়লে, তখন বিশ্বের হাজার হাজার সখিনারা তো কোন ছার! আমার মতো কর্মক্ষম একটি মানুষকেও ধরেবেঁধে তোমরা ঘরে বসিয়ে রেখেই শুধু নয়, তার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছ ঘৃণিত সন্দেহের তীর। নিয়ত হেলাফেলা। মৌখিক আর শারীরিক অত্যাচার। আমায় ঠেলে দিয়েছো পরকীয়ায়। মধ্য বয়সে পৌঁছে আমার উপলব্ধি, মৃণালের উপলব্ধির সাথে দেখলাম হুবহু মিলে যাচ্ছে। যৌবনের সব পুঞ্জীভূত অবিচার, মধ্য বয়সে এসে আমাদেরকে বাধ্য করে তোমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে। যা মৃণাল করেছিল শত বর্ষ আগে। কিন্তু দু’জনেরই সমস্যা শত বর্ষ আগে ও পরে, এক। কারণ, আমরা পাল্টালেও পাল্টাওনি তোমরা। মৃণালের চিঠিতে কবিগুরু একে কোনও সঙ্কট নামে চিহ্নিত করেননি, তবে আমি জানি মৃণাল আর আমার সমস্যা এক এবং অভিন্ন। অর্থাৎ উপলব্ধি জীবনের একটা নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছে দেয় একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা। এবং মৃণাল এবং আমি দু’জনই তা অর্জন করেছি, সাহসের সঙ্গে। নয় কী?
যাদের অন্তরে সুখ নেই, জন্ম থেকেই যারা সর্বক্ষণ দগ্ধ, তারা পৃথিবীর সুখ দেখতে নারাজ। তুমিও তাদেরই একজন। আজ আমার কষ্ট শেষ। তোমার শুরু। যারা জগৎটিকে দেখতে পায় অন্তের বদলে-অনন্ত, সুখ তাদেরই জন্যে রক্ষিত। আমি সেই অর্থে-সুখী। বিত্ত-বৈভব-সন্তান ও সংসার তোমার চোখে তার যে অর্থ, আমার চোখে তা এক নয়। আমি সবখানেই অনন্ত দেখতে পাই। তলের জায়গায়, অতল। আমার কাছে জগৎটা অনেক বড়। সমস্ত পৃথিবীটাই আমার সংসার। যেসব ছেড়ে দিতে পারে, তাকে আর কি দিয়ে অসুখী করবে! তোমার বিলাসিতার শিকার, সংসারের খাঁচা খুলে পালিয়ে গেছে।
তোমার চত্বর ছেড়ে, আজ আমিও মুক্ত। স্ত্রীর পত্রে’র মৃণালের মতো আমিও আর তোমার ঐ নরকের গলিতে ফিরছি না। এমনকি প্রিতুর জন্যেও না। আমি জানি, আমি কত নিষ্ঠুর মা, যে তার মেয়েকে ফেলে চলে যেতে পারে। কিন্তু কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে একজন মা এই কাজটি করতে পারে ভেবে দেখছো কখনও? হ্যাঁ, আমি সেই পরিস্থিতিরই শিকার যেখানে বাধ্য হয়ে শক্তি সঞ্চয় করতে হয়। নিজের বোধের মৃত্যু ঠেকাতে, কোলের আদরিনীকেও সাময়িক ছাড় দিতে হয়। সে আমার। চিরদিনের জন্যে আমার। সে ভরে আছে আমার বোধ-হৃদয় আর মনে। আমার সকল পৃথিবীটাই প্রিতু আর প্রিতুময়। যেখান থেকে কেউ তাকে কেড়ে নিতে পারে না। এমনকি তুমিও না। প্রিতু আজ প্রায় প্রাপ্তবয়স্কা। এখান থেকে সে স্বাধীন। এতকাল তুমি তাকে মা ছাড়া করে রেখেছিলে। তাই আজ এই চিঠি লেখা। আর নয়। এবার ফেরার সময়। মায়ের কাছে মেয়ে। জগতের ভ্রান্তির কাছে, সত্যের।
–ইতি,
প্রিতুর মা।
১২. পরিবাদ বা স্ক্যান্ডাল
ক. কেউ জন্মায় নারী, কেউ পুরুষ হয়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষের ব্যক্তিগত যৌন অভ্যাস আর তার বাহ্যিক লিঙ্গ পরিচয়, দুটো সবসময় এক হয় না। পুরুষ এবং নারীর সত্যিকারের যৌন অভ্যাস নিয়ে আজ যথেষ্ট ঝড় বইছে বিশ্বময়। বিশেষ করে আমেরিকা আর ইয়োরোপে। সেসব দেশেও মানুষের যৌন অভ্যাস এখন আর কোনও রাখঢাকের ব্যাপার নয়। পুরুষ। অথচ সে পুরুষ নয়! নারীর প্রতি তার আকর্ষণ নেই। তার আকর্ষণ, পুরুষ। কিংবা নারী। সে নারী নয়! পুরুষের বদলে তার আকর্ষণ, নারী। যাকে বলা হয় সমকামিতা। কিংবা একজন নারী বা পুরুষ, সে আকর্ষণ অনুভব করে, নারী-পুরুষ দু’জনেরই প্রতি। যাকে বলে, উভকামিতা। এই দু’ধরনের অনুভূতি নিয়ে জন্মানো মানুষ, সারা বিশ্ব জুড়েই রয়েছে। নরনারীর স্বাভাবিক যৌনজীবনের মতোই এদের জীবন। একে অস্বীকার। করার কোনও উপায় নেই। করলে ব্যক্তির জন্যে তা চরম দৈহিক ও মানসিক শাস্তির নামান্তর হয়ে উঠবে। তা সত্ত্বেও আমরা তা মেনে নিতে পারি না। আজকাল প্রচুর সমকামীদের বিয়ে হচ্ছে। তারা নিয়মিত ঘর-সংসার করছে। তবে, সমকামী আর উভকামিতার বিষয়টা কোনও পরিবারের জন্যেই সুসংবাদ নয় এবং নিঃসন্দেহে যে-কোনও বাবা-মায়ের জন্য তা হৃদয়বিদারক। কিন্তু এই অনুভূতি নিয়ে জন্মানো মানুষটির কষ্টও কি কম। বাবা কাঁদে। মা কাঁদে। বোঝায়। কিন্তু তার অনুভূতি আলাদা। তার ভিন্নতাকে সাধারণভাবে আমাদের পক্ষেও গ্রহণ করা দুরূহ। তবে স্বস্তির সংবাদ এই যে, পশ্চিমে বিষয়টি, রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক দিয়ে দ্রুত প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। সেসব দেশে সমকামীরা বিয়ে, পালক সন্তান, সম্পত্তি সবকিছুতেই সমান অধিকার পেতে শুরু করেছে। কিন্তু পূর্বে অধিকাংশ দেশেই বিষয়টি যেমন ধর্ম-বিরুদ্ধ, তেমনি সমাজ-বিরুদ্ধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও একে রোধ করা যাচ্ছে না।
সমকামীরা আমাদেরই আশপাশে। ছোটবেলায় হঠাৎ দেখেছি, গলির ভেতরে, ঘরের পেছনে, হঠাৎ নিরু কাকা আর নিমাই, তুলি আর মালতী, মিজান-শমসের মিজান-মালেকা। ওদেরকে দেখেছি অন্যরকম ব্যবহার করতে। হঠাৎ হয়তো ওদেরকে দেখেছি জড়িয়ে চুমু খেতে। তখন ঠিক বুঝতে পারিনি। তবে আজ বুঝি যে ওরা আসলে সম বা উভকামী।
সমকামী বা উভকামীদের হাবভাব চলাফেরা কথা বলার ভঙ্গি সব অন্যরকম। কিন্তু আমাদের রক্ষণশীল সমাজে এই নিগূঢ় সত্যকে ওদের লুকিয়ে চলতে হয়। এবং এই অনুভূতি যাদের আছে তাদের সঙ্গে অন্য লিঙ্গের মানুষের বিয়ে হলে সেই বিয়ে সবসময় টেকেও না। আর টিকলেও সুখের হয় না। আবার দেখা গ্যাছে কখনো কখনো অনেকেরই বিয়ের পাশাপাশিও গোপন জীবন চলছে। ঘরের বৌ অসুখী, অতৃপ্ত। স্বামীর এই গোপন অভ্যাস, সে জানে না। নিজের সমস্যাগুলো ঠিকমতো মোকাবিলা না করতে পারার ফলে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের যৌনজীবনের সঙ্কট, মধ্য বয়সে পৌঁছে আরও অনেক সমস্যায় রূপ নিতে পারে। শরীরকে অস্বীকার করতে করতে, মানুষ একসময় বাধ্য হয় পরাজিত হতে, অনুভূতি এবং অভ্যাসের কাছে। শরীরের প্রতিবাদের মুখে, প্রকাশ হয়ে যায়–গোপন পরিচয়। যা সে একা বহন করে করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। একসময় জানাজানি হয়ে যায় সেই অজানা।
অনেকেই সম বা উভয়কামিতার বিষয়টি নিজেরাও ঠিক বুঝতে পারে না, বিয়ে না হওয়া অবধি। বিয়ের পরে দ্বিতীয় শরীরের প্রতি অনীহা থেকে সমস্যার প্রথম আবিষ্কার। এবং যতই সে ভাবে ঠিক হয়ে যাবে বা সেরে যাবে, কখনোই তা ঠিকও হয় না, বা সেরেও যায় না। সম বা উভয়কামিতা দুটোই সত্য। সত্য, যা সত্য। সত্যকে অস্বীকার করা যাবে না। কিছুতেই না। কারণ ওরাও ভালোবাসে, ঠিক আপনার এবং আমার মতোই। যেমন ভালোবাসে স্বামী ও স্ত্রী। সম বা উভকামিতা, এক ধরনের প্রবৃত্তি। ক্ষুধা ক্ষুধাই।
ক্ষুধা পাকস্থলীর। ক্ষুধা যৌনাঙ্গের। তীব্র ক্ষুধা পেলে ওরা প্রতিবাদ জানাবে। পাকস্থলী আর যৌনাঙ্গ দুটো দুই জিনিস; ক্ষুধার যন্ত্রণা এক। শরীরের অন্যান্য অনুভূতির মতোই সম বা উভয়কামিতাও। যদিও এগুলো মধ্য বয়সের সমস্যার ফ্রেইমে ঠিক আঁটে না, তবুও বলা চলে এই সঙ্কটকালে এসে তীব্র হয় যে বয়সে সেটাই মধ্য বয়স। মানুষের যৌন অনুভূতি একটি মানবিক বিষয়। সূক্ষ্ম, ব্যক্তিগত এবং গোপন।
নিজেকে ভালোবাসার, ভালো লাগার বিষয়। যা স্বাভাবিক, যা প্রাপ্য। দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো যৌনাঙ্গেরও রয়েছে নিজস্ব তাড়না। অনুভূতি ও মন। ওদের একটা আলাদা পৃথিবী আছে। ওরাই ঠিক করে নেয় কার কি চাই। যৌনাঙ্গের বুদ্ধি, অনুভূতি ও মনের বিরুদ্ধে যে-কোনও রকম বিধিনিষেধ বা বিরোধিতা, বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টির জন্যে যথেষ্ট। আর এই বিরূপ প্রতিক্রিয়াই বিশেষ করে দেখা যায় ধর্ম প্রতিষ্ঠানগুলোতে, যেখানে প্রচণ্ড রকমের ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে মানুষের এই মৌলিক চাহিদার বিরুদ্ধে দিয়েছে নানারকম বিধিনিষেধ। লিঙ্গের ওপরে যারা ঢাকনা দিয়েছে বা ১৪৪ ধারা। চলে না। চলবে না। কিছুতেই না।
খ. চার্চের মধ্যে, ক্যাথলিক চার্চের অনুশাসনে রয়েছে যাজকদের বিয়ে বা সহবাস নিষিদ্ধ। কিন্তু ২০০২ সালের শুরু থেকে ক্যাথলিক চার্চের ভেতরে যেসব লোমহর্ষক কাহিনী আবিষ্কার হতে শুরু করেছে খোদ আমেরিকাতে, তারপরেও কি কোনও সন্দেহ থাকা উচিত যে, লিঙ্গেরও রয়েছে নিজস্ব মন ও অনুভূতি যার কাছে ধর্মীয় অনুশাসন টাসন সবই বৃথা। প্রবৃত্তির তাড়না বলে কথা। চার্চের যাজকদের হাতকড়া পরিয়ে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কারণ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বছরের পর বছর নাবালক ধর্ষণ। রামকৃষ্ণ মিশনেও রয়েছে, ক্যাথলিক চার্চের মতোই কঠোর বিধিনিষেধ। কিন্তু তাই বলে কি মিশনারিরা ক্ষুধার্ত বসে থাকে? গবেষণাশেষে যখন কোনও মতবাদ দেয়া হয়, তার বিরুদ্ধে বা পক্ষে বিতর্ক সম্ভব। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণা ব্যতিরেকে যে-কোনও সিদ্ধান্ত ভিত্তিহীন। এবং সমাজের জন্যে অকল্যাণকর বলে তা তাৎক্ষণিকভাবে পরিত্যাজ্য হওয়া উচিত।
মাদ্রাসা শিক্ষার ক্লাসে, সম বা উভকামিতার সংবাদ সেভাবে না ছড়ালেও, ভুক্তভোগী ছেলেগুলো এর শ্রেষ্ঠ সাক্ষী। ওরাই বলবে, মৌলবীরা কি নিষ্ঠুরভাবে ধর্ষণ করে। সন্তানতুল্য কিশোরীদেরকে। চার্চ-মিশন, মাদ্রাসা, সমকামিতার পিঠস্থান এবং অভ্যেস সৃষ্টির ফ্যাক্টরি। মানুষের যৌন অনুভূতি প্রতিষ্ঠানের বিধিনিষেধ দিয়ে মস্তিষ্ক ধৌত করে উপশম করা যাবে না। লিঙ্গের অনুভূতিগুলোকে অনুশাসনের শেকল পরিয়ে ক্ষণিকের জন্য নিস্তেজ করা যাবে, কিন্তু ১৪৪ ধারা দিয়ে নিঃশেষ করা যাবে না। অবশেষে বলল রাখা ভালো যে, বিশ্বব্যাপী প্রায় সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেই চলে নিষিদ্ধ জীবন। অত্যন্ত গোপনে। মাঝে মাঝে যা গোপন থাকে না। স্ক্যান্ডাল কোথায় নেই? চার্চগুলোতে ২০০২ সালের এই তোলপাড় করা কেলেঙ্কারির সংবাদে এটাই প্রমাণ হয় যে লিঙ্গের বিরুদ্ধাচরণ সব ধর্মের মানুষের সবরকম শাসনকে তুচ্ছ করে দেয়।
১৩. মৃত্তিকা, মা আমার
স্নেহের মৃত্তিকা,
তিন বছর পর সাহস করে তোমাকে লিখতে বসেছি। বুকটা আজ খুব ভারি। তোমাদের কথা মনে করে, কেঁদেছি সারা দিন। আজ তোমার বাবার দশম মৃত্যুবার্ষিকী। সে চলে যাওয়ার পর, দু’ভাইবোন তোমরা সামান্য কারণে, যে নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে আমাকে ত্যাগ করলে, তা আজো আমার বোধের অনধিগম্যই রয়ে গেল। সে সূত্র নিয়ে আমি তোমাদেরকে আজ দু’চার কথা লিখবো বলে এতদিনের সঞ্চিত সাহস বুকে নিয়ে বসেছি।
তোমরা কেউ বুঝতে চাইলে না, কি যন্ত্রণায় আমি বাধ্য হয়েছিলাম তোমার বাবার মৃত্যুর দীর্ঘদিন পর কামালকে বিয়ে করতে। যেজন্যে আজ তোমাদের সঙ্গে আমার এই অকারণ ভুল বোঝাবুঝি। মৃত্তিকা, আমি জানতাম, উন্নত দেশে গেলে মানুষের চিন্তা শক্তিও উন্নত হয়, হয় উদার। কিন্তু তুমি বিদেশে থাকলেও আমার দুঃখ যে, তোমার বেলায় সে কথাটি আমি ঠিক বলতে পারিনি। সোহেলের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু মা, তুমি তো পশ্চিমে রয়েছে অনেক বছর। তাহলে তোমার মনে কেন আজো এই সঙ্কীর্ণতা! কেন এই কষ্ট, এত পুঞ্জীভূত অভিমানের মেঘ! তুমি কেন বুঝতে চেষ্টা করলে না–ব্যক্তিজীবনে নিঃসঙ্গতার বোঝা কত ভারি। তুমি যেখানে আছ তুমি কি দেখোনি সেখানে জীবন কতটা রঙধনু রঙে রাঙানো!
প্রথমেই বলে নেয়া ভালো, তোমার বাবাকে আমি কোনও রকমেই ভুলে যাইনি। ভুলে যাওয়ার কথাও নয়। তাকে আমি ভালোবাসি, সম্মান করি। এবং তার সমানে সমানে কাউকে দাঁড় করানোর মতো স্পর্ধা আমার নেই। কোনদিন হবে বলেও মনে করি না। সুজন আজও আমার প্রাণ। সেই ছোটবেলায় তাকে পেয়েছিলাম খেলার সাথির মতো। কিন্তু কালব্যাধি এতই দুরারোগ্য হলো যে লিভারের ক্যান্সার তাকে তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম কিন্তু বড় অসময়ে নিয়ে গেল। আর সুজন চলে যাওয়ার পর তোমাদের নিয়ে আমি হয়ে পড়লাম সম্পূর্ণ একা। দুঃখেকষ্টে ভারি একা। তার মৃত্যুর পরপরই, তোমরা দুই ভাইবোন ঘুমের মধ্যে প্রলাপ বকার মতো প্রায়ই কেঁদে উঠে বলতে বাবা কই! বাবা কখন আসবে? বলতাম, হ্যাঁ, বাবা ফিরে আসবে। তোমরা এখন ঘুমোও। তোমরা, বিশেষ করে তুমি বলতে, সত্যি বলছো তো! আবার মিথ্যে না তো? তোমাকে বুকে নিয়ে কতদিন যে মিথ্যে বলেছি আজ সেসব আর মনে নেই। মা, আমি ঘুমোই। আব্ব এলে ডেকে দিও। এসব যে কত কঠিন কাজ ছিল মা-মণি সে কি করে বোঝাব তোমাকে।
আজো সুজনের জন্যে আমার একান্ত গোপন ভালোবাসা। এইসব প্রেমানুভূতি এতই ব্যক্তিগত যে সেসব আমি কারো কাছে কখনোই বলিনি। বলবোও না। সুজনের চলে যাওয়ার পর আত্মীয়-স্বজনেরা অনেকেই এলো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। হায়! আফসোস করে বলতে শুরু করলো মেয়েটার এত কম বয়স! দুটো সন্তান, এত দায়িত্ব! এত বড় সংসার এদের মানুষ করতেও তো মানুষ লাগে। বিয়ের জন্যে অনেক ছেলে নিজেরাও প্রস্তাব নিয়ে এলো। মানুষের চোখে আমি সুন্দরী, শিক্ষিতা, কর্মজীবী। কিন্তু আমি তোমাদের মুখের দিকে চেয়ে নিজের কথা কক্ষণো ভাবিনি। সবাইকেই ফিরিয়ে দিতে দিতে বলেছি, না-না-না! কিছুতেই না। আমার দুটো সন্তান। ওরা কষ্ট পাবে। কক্ষণো না। তোমাদেরকে আমি একা হাতে মানুষ করার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোমার বাবার কাছে। মৃত্যুশয্যায় তাকে কথা দিয়েছিলাম, আমার সন্তানদের জীবনে দ্বিতীয়বার কোনও বাবা আসবে না। কিন্তু মৃত্তিকা আমিই আমার সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছি। আমি অনুতপ্ত। কিন্তু তার পেছনেও কারণ আছে। যুক্তি আছে। কি কারণে এই কাজটা আমি করলাম তা তোমরা কেউ বুঝতে চাইলে না। তোমরা শুধু আমার বাইরেরটাই দেখলে, সন্তান হয়ে আমার ভেতরের জ্বালাটা একবার ভেবে দেখলে না। অপার এক শূন্যতায় কিভাবে আমি ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছিলাম আমার দুই চোখের নিচে এক আঙুল কালি, দেখনি! শোননি আমার প্রলাপ গভীর রাতের বেলায়! কিন্তু বুঝতেও চেষ্টা করলে না। দুঃখটা আমার সেখানেই। তোমরা আমার আত্মজা হয়েও উল্টো আমাকেই ভুল বুঝলে।
তোমরা দু’ভাইবোন ছিলে আমার প্রাণ। সুজন চলে যাওয়ার পর আমি ভালোমন্দ অনেক কিছুই করতে পারতাম। সে সুযোগ, সে প্রলোভন এবং স্বাধীনতা আমার ছিল। তোমরা কিন্তু সেসব কিছুই জান না। দেখতে দেখতে একদিন তোমরা বড় হয়ে গেলে। সমাজের রীতি অনুযায়ী একদিন তোমাদের বিয়ে হয়ে গেল। সেই সঙ্গে আমার কাজও ফুরিয়ে গেল। আর আমি হয়ে পড়লাম খাঁচায় বন্দি একটা পাখি। বেকার বিধবাবিধুর। মাঠ মাঠ সময়। তেমন কিছুই করার নেই। থাকলেও যাই না। যাও যেতাম সব বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলাম স্বেচ্ছা নির্বাসনে। ডাক্তার বললো, ডি প্রেশন।
আজ খোলাখুলিভাবে তোমাদের বলতে কোনও বাধা নেই যে বিশেষ করে একজন মাঝ বয়সী মানুষের জন্যে এই সংযম ও সংস্কার কোনও সহজ কাজ নয়। তোমাদের নিয়ে যেদিন রুকু খালার মেয়ের বিয়েতে গেলাম সেদিন যে লোকটি তোমাকে কোলে নিয়ে সমস্ত বাড়ি ঘুরে বেড়ালো, মনে আছে! তুমি বললে, আম্মু এই আঙ্কেলটা আব্দুর মতন ভালো। ওকে বিয়ে করো না কেন! আমাকে না খুব আদর করেছে। তুমি জানতে না যে, সেই কোটিপতি লোকটা কতবার আমাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। বড়ই ভালো মানুষ সে। রফিক আমাকে হৃদয় থেকে চেয়েছিল। কিন্তু মা, আমি তো সুজনকে কথা দিয়েছিলাম। আর রফিক অপেক্ষায় থেকে থেকে শেষে অন্য জায়গায় যেদিন বিয়ে করে ফেলো, সেদিন একসঙ্গে অনেকগুলো ঝড়ের তাণ্ডব সহ্য করতে না পেরে এত কেঁদেছিলাম যে তুমি ভয় পেয়ে রুকু খালাকে লুকিয়ে ফোন করে নিয়ে এলে যখন, তখন কত রাত! মনে আছে সেকথা!
এমনি করে একসঙ্গে বাবা-মায়ের দায়িত্ব একাকী হাতে পালন শেষে যেদিন আমি তোমাদেরকে ভালোভাবে বিয়ে দিতে পারলাম সেদিন চারপাশের সবাই বাহবা দিলো আমার ত্যাগ আর ধৈর্যের। বলতে গেলে সবাই এক নিশ্বাসে প্রশংসার ফুলঝুরি ছিটিয়ে বলতে থাকলো, আহা! কি ত্যাগী নারী! কি ভালো! কিন্তু ওরা কি কেউ আমার মন প্রাণের আসল খবর জানে? আমার হতাশা! দুঃখ! নিঃসঙ্গতা! কতখানি দারিদ্র এই ঐশ্বর্যের নিচে কাজ করছে! কতখানি আগুন এই গলিত লাভার বুকে! কেউই জানলো না।
তোমরা যাওয়ার পর বাড়িটা হঠাৎ নতুন করে ফের শূন্য হলো। এত বড় বাড়িতে আমি ছাড়া আর শুধু রেনুর মা। বহুদিনের পুরোনো কাজের লোক সে। বুড়ো হয়ে সেও ঝিমিয়ে গেছে। দেখি সেও শুধু পড়ে পড়ে খায় আর ঘুমোয়। কাজ যা থাকে, দু’ঘণ্টায় শেষ। কোনও রকমে দুটো খেয়ে আমিও শুয়ে-বসে শুধু দেখি সামনে বিশাল শূন্যতা। আর নিজেকে মনে হতে লাগলো, অপচয়–। নিষ্প্রয়োজন। অকারণ বাঁচা।
খবরের কাগজ, টেলিভিশন, ম্যাগাজিন, চা, টেলিফোন এসব বড়জোর ঘণ্টা দুই’র জিনিস। তারপর থেকে শুরু হয় বাকি সারাদিনের জন্যে বুকের মধ্যে একটা হালকা চিনচিনে ব্যথা। ভয় হয় এত সময় কি করে কাটাবো! একরাশ রুদ্ধশ্বাস, দমকা হাওয়ার মতো দাপিয়ে বের হয়ে যায় তীব্র যন্ত্রণায়। এক ধরনের পাগলামো। আমাকে গ্রাস করে বসলো। আরো মাস দুয়েক পর। এমনি এক রাতে একদিন হঠাৎ ঘুমের মধ্যে, তোমার বাবার মূর্তি, অন্ধকারে আমার সামনে এসে যখন দাঁড়াল আমি চিৎকার করলাম। দৌড়লাম। দৌড়েও পথ খুঁজে পাই না। সেও বারবার ফিরে আসে কল্পনায়, এসে কথা বলে। চা খায়, খাবার খায়। শোয়, বই পড়ে। গল্প করে। দাম্পত্য করে। জেগে খুঁজি, হাতরাই, নেই-নেই কোথাও কেউ নেই। ভয়ে আমি বিছানা ফেলে রেনুর মায়ের পাশে শুয়ে পড়ি। আর যখন অনুভূতির রোলার কোস্টার আমাকে নির্মম শারীরিক কষ্ট দিতে শুরু করলো, আমি যেন নিজের কাছে হয়ে উঠলাম একটা ক্লাউন। ক্ষণে হাসি, ক্ষণে কাঁদি। ক্ষণে পাগলি, ক্ষণে পণ্ডিত। শিউলি আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। ব্যাপারটা সে খুব সিরিয়াসলি নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করলো। ওর জোরাজুরিতেই শুরু করলাম মানসিক রোগের চিকিৎসা। ডাক্তার বললো বিয়ে করুন। সঙ্গীর প্রয়োজন আছে। আপনার মানসিক হতাশা চরমে। রোগের নাম ”ম্যানিক ডিপ্রেসিভ সাইকোসিস”, সঙ্গী ছাড়া এই রোগ নিরাময় হবে না। মন-শরীর এখন আপনার বিরুদ্ধে। চললো পাগলের চিকিৎসা আর ওষুধপত্র। আর শিউলী গোপনে গোপনে–কামালের সঙ্গেও গভীর যোগাযোগ করতে থাকলো।
আমি জানি, কামালের উপস্থিতি এই সংসারে, তোমাদের একেবারেই পছন্দ নয়। তোমরা ওর নামটি পর্যন্ত শুনতে চাও না। এবং এটাই স্বাভাবিক। এবং আমিও যে বুঝি না তা নয়। বলেছ–কখনো আর আমার মুখ দেখবে না। মা, কামালকে বিয়ে করে আমি ভুল করেছি কিনা তার চেয়ে বড় কথা ওকে বিয়ে করেছি বলে এখনো সুস্থ মনে বেঁচে আছি। কামালকে পেয়ে আমি মানসিক রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছি। বিয়ের পর মানসিক রোগের ওষুধ ছাড়তে পেরেছি। ও আমার কথাসঙ্গী। আমার বলার মানুষ। খাওয়ার টেবিলে পাশে বসার মানুষ। তোমাদের তো বরং তাতে খুশি হওয়া উচিত ছিল যে, তোমাদের মা রাস্তার পাগল হয়নি যাকে দেখলে লোকেরা পেছন পেছন দৌড়তো আর ঢিল ছুঁড়ে মারতো, সেটাই কি ভালো হতো। তোমাদের চলে যাওয়ার পর একদিন ঘরে যে শূন্যতা এসেছিল পিঙ্কি এসে তা কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে পৃথিবীর কেউ-ই তোমার বা সুজনের শূন্যস্থান পূরণ করেছে। তোমরা রয়েছে আমার অন্তরে যে যার জায়গামতো। কামাল, সুজনের স্থান কখনোই পাবে না। কিন্তু তাই বলে কামালকে আমি ছোট বলেও ভাবতে পারবো না। কামালকে তোমরা গ্রহণ করবে কি করবে না সেটা তোমাদের ব্যাপার। কিন্তু তোমরা যে বিষয়টা বুঝতেই চাইবে না, সেটাও ঠিক নয়। অন্তত যুক্তি দিয়ে বিচার করে দেখো। আমি কতটা প্রয়োজনে বা অ প্রয়োজনে দ্বিতীয়বার বিয়ে করলাম। মা, একা একা বাস করা যায় না। মানুষ যখন জঙ্গলে ছিল তারাও দল বেঁধেই থাকতো। বনের পশু-পাখিও এমনকি জলের মাছেরাও দল বেঁধে থাকে। প্রাসাদের চেয়েও বড় মানুষ, আর মানুষের চেয়ে বড় তার সঙ্গ। নিঃসঙ্গ তাজমহলের চেয়ে জনাকীর্ণ বস্তি অনেক অনেক ভালো। নয় কি? মানুষ মানুষকে দেখতে পারে না। মনে রেখো, মানুষ ছাড়া মানুষ থাকতেও পারে না।
শূন্যতার চেয়ে বড় অভিশাপ কিছু আর নেই। নিঃসঙ্গতার কারণে হঠাৎ একদিন আত্মহত্যার চিন্তাও মাথায় এসেছিল। গিয়েছিলাম দক্ষিণের ছাদে, আমাদের পাঁচতলার ঐখানে। কামাল তারই বিকল্প। পিঙ্কি তোমাদের ছোট বোনটি তারই ফল। সে সন্তানের চেয়েও বরং বেশি বন্ধু। আমি ওর মধ্যে তোমার ছবি দেখতে পাই। পিঙ্কি তো তুমিই। আর এভাবেই চলে যায় আমার জোড়াতালি জীবন। আগামীর স্বপ্ন নেই। আশা নেই কোন। শুধু মাঠ মাঠ অতীত আর সামান্য বর্তমান। অতীত, যার মধ্যে রয়েছে তোমরা তিনজন, থাকবে যেখানে যার স্থান। দিন চলে যায়। দিন আমিও পার করে দিচ্ছি। একে যদি বলো বেঁচে থাকা, তাহলে আমি বেঁচে আছি। তার বেশি নয়। সুতরাং কি পরিস্থিতির শিকার হয়ে কেন আমি আবার বিয়ে করলাম হয়তো সামান্য হলেও বোঝাতে পেরেছি। জীবন একটি সুন্দর অনুভূতি। বইবার মতো যথেষ্ট কারণ বা আনন্দ না থাকলে তা হতে পারে একটি বোঝা। এই বোঝা বইবার শক্তি যখন ফুরোলো তখন ভাঙলো আমার প্রতিজ্ঞা।
তোমাকে আবারো বলছি, আমার মতো পরিস্থিতি হলে একা থাকার মধ্যে কোনও বীরত্ব নেই। বাকি জীবন বিধবা থেকে দিনের পর দিন শূন্যতার সঙ্গে যুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে সুনাম অর্জন করা যেতে পারে, মানুষ বাহবা দিতে পারে, কিন্তু বাস্তবে এর কোনও মানে নেই। এবং ব্যক্তির নিজের জীবনের ওপর তা চরম নিষ্ঠুরতা।
বুঝতে পারলে, ক্ষমা নিষ্প্রয়োজন। জানি, একদিন তোমাদের বোধোদয় হবে। মান-অভিমান ভুলে ফিরে আসবে। আমার হৃদয় সে আশায় আমৃত্যু খোলা রইলো।
সবশেষে রবি ঠাকুরের শেষের কবিতা থেকে বলছি —
‘আমারে যে দেখিবারে পায়,
অসীম ক্ষমায়
ভালমন্দ মিলায়ে সকলি …।’
তোমাদেরই স্নেহের মা (মালবিকা)।
১৪. কালসাপ
রূপালি,
ভালো আছিস আশা করছি। আমিও আছি। আমাদের তো ভালো থাকতেই হয়। নয় কী? নইলে জগৎ সংসারের এই ঘানি টানবে কে? সেদিন জানতে চেয়েছিলি রাজ আর আমার ব্যাপারে। জিজ্ঞেস করেছিলি, এসব কি শুনছি! তোদের নাকি ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে! তুই-ই বল, জীবনের মতো সূক্ষ্ম এতো গুরুত্ববহ ব্যাপারগুলোর উত্তর কি এত দ্রুত কোনও চাইনিজে বা কোনও ক্যাফেতে বসে চা খেতে খেতে দেয়া যায়? যায় না রে! রাগ করিস না, সেদিন তোর প্রশ্নের জবাব দিইনি বলে। বিচ্ছেদ, কখনোই সুখের নয়। তুই দেশে এসেছিলি বহু বছর পরে। তাই সেদিন আমার বিচ্ছেদের কথা বলে, তোকে বিষণ্ণ করতে চাইনি। তুই তো জানিস আমার এমন কোনও কথা নেই যা তোকে আমি বলতে পারি না।
তোকে যা বলতে পারি, শুধু তোকেই পারি। অপেক্ষা ছিল সময়ের। সময়টা ঠিকঠাক না হওয়া অবধি, লিখতে বসতে পারিনি। যা বলার, গুছিয়ে, আজ মনে হলো এই সাত সকালের বৃষ্টি ঝরা বিষণ্ণ আকাশের দিকে চেয়ে, হ্যাঁ! আজই লেখার সময়।
সময়, মন আর জীবন। এই তিনটে শব্দ গত দু’বছরে আমাকে সম্পূর্ণ নড়িয়ে দিয়েছে। আমার ভালো-মন্দ, দুঃখ-সুখ, ঘটনা-দুর্ঘটনা তিনরঙা ত্রিবেণীর জলের মতো সময়-মন আর জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে, বিচিত্র এক রঙ ধারণ করেছে, যেখানে আমি, রাজ এবং অসীম অনবরত একই আবর্তে পাক খেয়ে চলেছি।
রাজীবের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এখন কতটা মন্দ তার চেয়ে বড়, রাজের সঙ্গে আমার অতীতের সুন্দর দিনগুলো। রাজের মতো স্বামী দুর্লভ। ওর থেকে আমি কি পাইনি? তা সত্ত্বেও, পরবর্তী সময়ে একটা প্রশ্ন এসে উপস্থিত হলো। প্রশ্নটা হলো সময়ের সঙ্গে মানুষের মনের পরিবর্তন। আমি বিশ্বাস করি সময় মানুষের জীবনকে ধারণ করে। মানুষ, সময়কে ধারণ করে না। কিন্তু প্রথাভিত্তিক অধিকাংশ মানুষই ভাবে তার উল্টো। ফলে আমরা পিছলে পড়ি না শুধু, পিছিয়েও পড়ি। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমারও মধ্যে যে পরিবর্তন এসেছে তাকে আমি একেবারেই অস্বীকার করিনি। এবং করিনি বলেই, সেদিনের সেই আমি, আর আজকের এই আমি, এক নই। আমি সময়ের পরিবর্তনে বিশ্বাসী। এবং রাজের সঙ্গে শুধু নয়, পৃথিবীর সব প্রথাভিত্তিক মানুষের সঙ্গে আমার মূল ক্রাইসিস, এখানেই।
আমি এই সমস্যার নাম দিয়েছি, সময়ের কালসাপ। যা সময়ের ব্যবধানে অনেক রকম খেলা দেখায়। কেউ কেউ তা বোঝে, অধিকাংশই বোঝে না। আমার মধ্যে এক শিল্পীর সম্ভাবনা যা এত কাল সুপ্তই ছিল, অনিলের সঙ্গে পরিচয়ের পর তা প্রথম আবিষ্কার করলাম। এক অন্য আমি। যেন নিজেকে দেখে নিজেই চমকে উঠি। ভাবি একি সত্যিই আমি! নাকি আমার প্রেতাত্মা। জীবনে এরকম অনেক আচমকা ঘটনা ঘটে যায়। তবে আমরা তা চিনতে ভুল করি। রাজ আমার এই হঠাৎ পরিবর্তনে চমকে ওঠে। আমার সঙ্গে ওর একান্ত পৃথিবীতে অনিলের উপস্থিতি ওকে ঈর্ষান্বিত করে তোলে। এবং রাজের এই চমকে ওঠাই স্বাভাবিক। এটা ওর দম্ভের রাজত্বে কুঠারাঘাত। আমাকে নিয়ে ওর একার রাজত্ব। একচ্ছত্র। কিন্তু তা সত্ত্বেও, প্রশ্ন থেকে যায়। প্রশ্ন, রাজের মধ্যে কেন এই সঙ্কীর্ণতা? ওতো আমার সঙ্গেই কাটিয়েছে, জীবনের অনেকটা সময়। তাহলে কেন এই, প্রথার বাড়াবাড়ি! এখন বুঝি সব মানুষের বোধ এবং ধারণ ক্ষমতা এক নয়। যদি হতো তাহলে সংসারে কেন এত বিচ্ছেদ, এই শান্তি হীনতা!
রাজ একাধারে আমার জীবনে অনিলের উপস্থিতি এবং আমার সৃজনশীলতা দুটোকেই প্রত্যাখ্যান করলো। সেজন্যে দায়ী, রাজ। সেজন্যেই আমি আর অনিল আজ এক সমান্তরালে দাঁড়িয়ে। অনিল আর আমার একমাত্র ভাষা, এবং আমাদের একটি মাত্র ভাষা এবং তাহলো, শিল্প।
অনিলের স্ত্রী অপর্ণা, পক্ষাঘাতে অসুস্থ। ভীষণ খিটখিটে, দজ্জাল এক মহিলা। দীর্ঘদিনের অসুস্থতায় অনিলের জীবনটাকে সে এক আস্ত নরকে পরিণত করেছে। কিন্তু অসুস্থ বলে ইচ্ছে সত্ত্বেও ওর প্রতি কোনওরকম অমানবিকতাও অনিল দেখাতে পারে না। অপর্ণা বিশ্বাস করে অনিল ভুল পথে চলেছে। তাকে সে দেখতে চায় গৃহস্থ স্বামীর চরিত্রে। অপর্ণার সঙ্গে যন্ত্রণার জীবন অনিলের বৌদ্ধিক যন্ত্রণাকে তীব্র করেছে বলেই সে এতদিন উল্লেখযোগ্য কোনও কাজ করতে পারেনি। সুতরাং একথাই কি সত্য নয় যে সংসার সবার জন্যে নয়? তাহলে একথাই কি সত্য নয় যে সৃষ্টিশীল মানুষদের সংসারে জড়াতে নেই! কারণ সংসার, সময়কে ধরতে দেয় না। বুঝতেও দেয় না। সময়, দিনের আলো পরিবর্তনের মতো এসে মিলিয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে সংসার শুধু বৃদ্ধি পায়। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা ওসব স্বীকার করতে শিখিনি। তার কারণ, সংসার যা তার নিজের সময় অনুযায়ী জীবনের সঠিক সময়কে ফেলে চলে যায়। সমুদ্রে জোয়ার আর তার তরঙ্গ যেমন, নির্ভর করে আকাশের চন্দ্র সূর্যের ক্ষণের ওপর, জীবনের তরঙ্গ তেমন নির্ভর করে, সময়ের জোয়ারের ওপর। সময়, দেয়। সময়, নেয়ও। সময় যেমন মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। তেমনি সবচেয়ে বড় অভিশাপও। সবচেয়ে বেশি সুন্দর, সর্বাধিক নরকও।
পারিবারিক জীবন বলে একটা কথা আছে। একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই জীবনেরও একটা প্রয়োজন রয়েছে। এই সময়টুকুতে ওরা যৌথভাবে সৃষ্টি করে, সংসার এবং সন্তান। একসঙ্গে তারা উপভোগ করে তাদের এই সৃষ্টিকে। একসঙ্গে এই হেঁটে যাওয়ার সময়টা বড়জোর জীবনের পনেরো থেকে কুড়ি বছর, তবে অজস্র ফুল আর কাঁটা বিছানো পথ ধরে। যখন তাদের সন্তান-সন্ততিরা বড় হয়। তখন তাদের কিছু সামাজিকতা পালন করতে হয়। তখন তাদেরকে একে অপরের পরিপূরক স্বামী-স্ত্রী হতে হয়। তবে এখানে কিছু প্রথার নষ্টামো, কিছু ভণ্ডামো, কিছু-অতিরঞ্জিত ব্যাপার স্যাপারও থাকতে পারে, থাকবেও। বিয়ের প্রথম কুড়ি বছর পরেও গৃহস্থ প্রথাগত মানুষের বিশ্বাস করতে থাকে যে, আগামী কুড়ি বছরও একই সমতলে থাকবে। মানুষ যে বদলে যেতে পারে একথা তারা বুঝতেই চায় না। প্রকৃত সমস্যা এখানেই। বার্ধক্যে তার কৈশোর, থাকবে কি করে? আর ভরা বার্ধক্যে, যৌবন? সেও ভাবলো সাধারণ সবাই যা ভাবে।
তারপরেও সংসারী মানুষগুলো কি সুখে আছে? দিনরাত তাদের হা-পিত্যেশের কি শেষ আছে? এই হলো না, সেই হলো না। এ অসুখ, সে অসুখ। টাকা নেই–দুঃখ আছে। সুখ নেই, টাকা আছে। কত রকমভাবে মানুষ যে সংসারে অসুখী, তার কি কোনও শেষ আছে! সংসারে অসুখী মানুষের যেমন শেষ নেই, তেমনই শেষ নেই তাদের চাহিদার। চাহিদা আর অসুখী মানুষেরা পাশাপাশি হাঁটে।
শুধু চেয়ে চেয়েই এরা গরিব হয়। এবং এই চাওয়ার সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে এরা শত পেলেও যা পায়নি তারই খোঁজে আজীবন ভাসতে থাকে। কূল দেখা যায়। কিনারা দেখা যায়। তবু অসুখী মানুষেরা কূল-কিনারা পাওয়ার সুখ না নিয়ে, দুঃখ পেতে অকূলে ফিরে ফিরে আসে। ওদের চাওয়া, ওদের অসুখীপনার কোনও শেষ নেই। যেমন ছিল না রাজের। ওকে আমি সংসার দিয়েছি–সন্তান দিয়েছি। সামাজিকতা দিয়েছি, কুড়ি বছর একটানা। কিন্তু ওর মনে তবুও সুখ হলো না। যা দিয়েছি তা নয়। যা দিইনি বা দিতে পারিনি তার জন্য সারাক্ষণ সে অসুখী। অথচ যা আছে যতটুকু আছে তা কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় প্রচুর। তারপরেও যা নেই, সেটুকুর জন্যেই–ওর কাঙালপনা। সংসার থেকে আমার কিছুটা বিরতি ওকে করে তুলেছে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পৃথিবীর সবকিছুই আপেক্ষিক। সবকিছুই অস্থায়ী। রাজ আর আমার সম্পর্ক হয়ে গেল স্থায়ী থেকে অস্থায়ী। আমার বাবা-মায়ের সম্পর্ক ছিল স্থায়ী। কিন্তু বাবা যেদিন মাকে ছেড়ে চলে গেল, সেদিন ওদের সম্পর্কটা হয়ে গেল অস্থায়ী। বাবাকে হারিয়ে মা একা হলো। ছেলেমেয়েরা তখন কেউ কাছে নেই। মাকে এভাবে দেখে মনে হলো মানুষ কত অসহায়! বিয়ের মাধ্যমে মেয়েরা সংসার গড়ে তোলে, সন্তান সৃষ্টি করে, বহুজনকে ঘিরে যে রকম গড়ে ওঠে সে তেমনি, তাকে ঘিরে গড়ে ওঠে বহুজন। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে, সেই মানুষই, যেমন আমার মা, আবার একা হয়ে ফিরে যায়, কুমারী জীবনের একাকিত্বে। যখন বাবা ছিল না। আমরা ছিলাম। যখন সংসার ছিল না। সময় বৃত্তাকারে ঘোরে। তাহলে বল, কেন এই দুঃখ পাওয়া! চলে তো একজন যাবেই প্রথমে। হয় রাজীব! না হয়, আমি! যদি সঙ্গেই না গেলাম, তবে সাময়িক এই হারানোর জন্য কেন এই দুঃখ পাওয়া!
জীবন যখন সাময়িক, তাহলে দুয়ে দুয়ে মিলে যদি চার হয়, দুয়ে দুয়ে বিয়োগ দিলে তো শূন্যও হয়। সংসারে দুয়ে দুয়ে কেন সবসময় যোগ দিতে হবে। যদি মেলাতেই হয় তাহলে দুয়ে দুয়ে বিয়োগ দিলেও তো মিলে যায়। অধিকাংশ মানুষ দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে সুখী। এবং এই চার যখন মিলে যায় তখন চাহিদা আরো বেড়ে যায়। কোটিপতি দাশবাবুর তেতলা প্রাসাদের আঙিনায় এখন গরু ঘাস খায়। মিত্র বাড়িতে আলোর বদলে আলেয়া জ্বলে। চৌধুরী বাড়িটা এখন মদ্যপদের স্বর্গ। তাহলে এত কিছু করে শেষ পর্যন্ত কি হলো! ‘চার’ না ‘শূন্য’। আমি তো দেখি শুধু শূন্যতা। সংসারে শূন্য মেলানো খুব সহজ! এবং তাতে শান্তি আসে। তা, না বুঝলো অনিল না বুঝলে রাজ। না বুঝেছিল আমার বাবা। মারা যাওয়ার মাত্র দু’বছর আগে মাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন অন্য নারীর কাছে ‘৪’ মেলাতে। কিন্তু ‘৪’ তো আর মেলেইনি বরং উল্টো ‘শূন্য’ ঘরে এসে, মাকে হারিয়ে এক মহা শূন্যতায় নিমজ্জিত বাবা, অবশেষে গলায় কলস বেঁধে গাঙিনার জলে ডুবে মরে যায়।
রূপালি তোকে আমি বোঝাতে পারবো না যে সমমনা সঙ্গী না হলে বিয়েটা কতবড় ব্যর্থতা! সমমনা না হলে প্রেম জাগে না। আর প্রেম না জাগলে শরীর জাগে না। অন্ধত্ব যে কারণে কষ্ট পাচ্ছে রাজ, পাচ্ছে অনিলের স্ত্রী। রাজের কষ্ট আমি বুঝি। দোষ রাজের নয়, দোষ আমারও নয়। দোষ, সময়ের। আসলে কি জানিস, সৃষ্টিশীল মানুষের সংসারে জড়াতে নেই। এই অনন্য মানুষগুলোর জন্যে সংসার একটি ভুল চৌরাস্তার মোড় যেখানে এসে সে কষ্ট দেয় নিজেকে, তার চারপাশের মানুষদেরকে। কুলিয়ে উঠতে না পেরে কত প্রতিভাই তো নষ্ট হয়ে গ্যাছে! কত সৃষ্টিই তো বৃথায় পর্যবসিত হয়েছে। ঘুম থেকে উঠে একজন অনন্য মানুষকে যখন অন্য দশটা মানুষের। অন্ন জোগানোর জন্য কাজে যেতে হয় তখনই সেই মানুষটির সর্বনাশের আর বাকি থাকে কি? তার প্রয়োজন নিরঙ্কুশ-অব্যাহত সময় এবং মন। দাম্পত্যে, গৃহস্থে পেলেও তা যথেষ্ট নয়।
যাই হোক, একটা সময় ছিল প্রথম যৌবনে, যখন ভাবাবেগ স্থান পেয়েছিল সবার ঊর্ধ্বে। সময়োচিত তখন তার সবটুকু করেছি। আমি আজ আমার নিজের জন্যে সময় ব্যয় করতে চাই। সেখানেই বিরোধ এবং সেজন্যেই আমাদের জীবনের মোড় ঘোরানোর সিদ্ধান্ত। কারণ আমি গতানুগতিক মেয়েদের মতো হতে পারি না, ভাবতে পারি না, চাইও না। যেমন আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না আমাদের মেয়েদের সময়। অপচয়ের মাত্রা! শিক্ষিত মাস্টার্স ডিগ্রি পাস মেয়েগুলো যখন কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় শাড়ি-গয়না-রান্না-সিনেমা-রেস্টুরেন্ট-ফ্যাশনের। মতো আষাঢ়ে সব গল্পে মেতে ওঠে। নিজের সব সময়গুলোকে অপচয় করে সন্তানের জন্য। আর যখন এই মেয়েগুলো স্কুল থেকে ঘরে ফিরে সংসারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তখন শিক্ষিত মেয়েদের পুরুষগুলো সব অফিস করছে। তখন আমার মনে প্রশ্ন জাগে-কেন ওদের সন্তান হয়? কেন সংসার হয়? মনে হয়, মরে যাক সেই ‘জরায়ু’। চুলোয় যাক ওদের ‘চুলো’। আবার ভাবি, ওরা তো নির্বোধ! কিন্তু নির্বোধই যদি হবে। তবে, ভার্সিটি পাস ওরা করলো কি করে! জানিস, আমি সত্যিই বিভ্রান্ত!
মৃত্যুকেও কৌশলে ফেরানো যায়, সময়কে নয়। সময় ক্ষমাহীন এবং নিষ্ঠুর। যারা পরিবর্তন বুঝতে পারে, পেরে তাকে স্বাগত জানায় বৌদ্ধিক অর্থে তারা জীবিত। বাকিরা, মৃত।
আমি এই মৃতদের দলে থাকবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যা শুনেছিস ঠিকই শুনেছিস। মনে রাখিস জীবন একটি সাময়িক পত্রিকার মতো। যতক্ষণ ছাপা হরফে চোখের সামনে থাকে, মানুষ পড়ে এবং যতক্ষণ চোখের সামনে থাকে, মনে রাখে। ভাঙা-গড়ার জোয়ারে জীবনের এই সাময়িক যাত্রাও ঠিক তাই। এতকাল তো কেবল গড়েইছি। না হয় এবার ভাঙলাম! দেখি না কি হয়। ভাঙায় যদি কিছু মেলে। শূন্য না হলে পূর্ণ হবো কি করে। জায়গা লাগবে তো! জীবন বৈচিত্র্য চায়। জীবন–সুধা চায়। মাধুরী–স্বর্ণলতা, চায়। জীবন, এমনি করে করেই তার বৈচিত্র্য, খুঁজে পায়। তার প্রকৃত ঠিকানা খুঁজে পায়। সন্ধান পায় সত্যের। যে সত্যের জন্যে তার জন্ম। সময় খুঁজে পায় তার পরিবর্তনের গতি, আরেক ধাপ বিবর্তনের। মধ্য বয়সে, যৌবন আর বার্ধক্যের সন্ধিক্ষণে এখন আমি এই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলেছি। আশা করি তোর উত্তর মিলবে।
আদরের, তোরই মৌ
১৫. মেয়েদের ক্রাইসিস পুরুষ
ক. মানুষের ক্রাইসিস নিয়ে লেখার বিষয়গুলোর মধ্যে হৃদয়ের ক্রাইসিস আমার সবচেয়ে পছন্দের। হৃদয়ের ক্রাইসিস, যা অন্য সব ক্রাইসিসকে ছাড়িয়ে যায়। ক্ষুধার যন্ত্রণার চেয়েও তীব্র। অকাল বিধবার রাতজাগা কামার্ত শরীরের অনুভূতির চেয়েও যন্ত্রণার। আমি ক্ষুধার্ত থেকে দেখেছি। হৃদয়ের ক্রাইসিস জাগিয়ে তোলে শরীর। জাগায় স্নায়ুকোষ। জাগায় অপ্রাপ্তির, মৃত্যুযন্ত্রণা। মাসের পর মাস, স্বামীর কাছে থেকে, দূরে থেকেও দেখেছি। কিন্তু হৃদয়, সেখানে ক্রাইসিসের মুচড়ে ওঠা ব্যথা, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল ব্যথার চেয়েও একমাত্র মৃত্যুযন্ত্রণা বাদে ছাড়িয়ে যায়। দুঃসহ এই ব্যথার কোনও ওষুধ নেই। কোনও ডাক্তার-বদ্যি নেই। সুতরাং কোনও নিরাময়ও নেই।
মেয়েদের হৃদয়ের ক্রাইসিস জাগে, পুরুষের প্রতারণা থেকে। প্রতারণা, পুরুষের স্বভাব। ওরা খেলুয়া পুরুষ, খেলে যতদিন খুশি। ওদের সুবিধে, ওদের পেট ফোলে না। ফোলে নারীর। পুরুষ পালিয়ে যায়। আর ভগ্ন হৃদয় নিয়ে নারী পড়ে এক মহা-সঙ্কটে। ভীষণ ভারি! ভীষণ বোঝা! কি যেন একটা পাথরের মতো ভারি সর্বক্ষণ চাপা দিয়ে রাখে হৃদয় নামের অদৃশ্য যন্ত্রটিকে। এই যন্ত্রণা যার হয় শুধু সেই বোঝে এর ভার! তার অন্য সকল সুখ এমনকি কোটি কোটি টাকাও তখন ভীষণ নগণ্য হয়ে যায়। তৃপ্ত হৃদয়, প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো। তার দু’চোখ দেখলেই বোঝা যায় হৃদয়ের আবহাওয়া। আর্ত না আনন্দ। চোখই সে কথা বলে। দু’চোখের তারা। ব্যর্থ প্রেম, প্রতারণা, স্বপ্নভঙ্গ, হৃদয় নিয়ে খেলা, ক্রাইসিসের শত কারণ, চোখেই প্রথম প্রকাশ পায়। যে চোখ অন্ধকারে ভরা। চোখ, যা মৃত।
একথা জানা যে পুরুষের হৃদয় মেয়েদের তুলনায় কঠিন। পুরুষ, অপেক্ষাকৃত পাষাণ প্রকৃতির এবং আবহাওয়া বুঝে প্রতারক। প্রয়োজনে নির্মম ও নিষ্ঠুর। মেয়েদের নম্রতা, কমনীয়তা, আবেগ, অনুভূতি, সমর্পণ এবং বিশ্বস্ততা। পাশাপাশি, পুরুষের কিন্তু সেসবের কোনও বালাই নেই। হয়তো-বা এগুলো নারীর জন্যে তার স্বভাবজাত সম্পদ। তবে পুরুষ যে অপেক্ষাকৃত কঠিন হৃদয়ের সেকথা আর ঘটা করে না বললেও চলে।
মেয়েদের মিডলাইফ ক্রাইসিসের অন্যতম একটি কারণ, তার হৃদয়! যেখানে বোধ খুব কমই কাজ করে বা কখনই কাজ করতে পারে না। তার মহাসমস্যা তাকে নিয়ে পুরুষের ছিনিমিনি খেলা। মেয়েরা ওদের চরিত্র বুঝে উঠতে পারে না। ফলে মুহুর্মুহু ওদের নিষ্ঠুরতার জালে ফেঁসে যায়। পাষাণ হৃদয়, কঠিন চরিত্রের পুরুষ। পুরুষের প্রতারণার শিকার হয়ে কত মেয়েদের যে সর্বনাশ হয়ে গ্যাছে তার কি কোনও পরিসংখ্যান আছে? নেই। কোনও পুরুষ হয়তো কদিন বেমালুম লজ্জা লুটে পালিয়ে গ্যাছে, কাউকে গর্ভবতী করে, কাউকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে, কথা না রেখে, কেউবা অন্য মেয়েকে বিয়ে করে। সন্দেহ নেই যে, পুরুষ নিষ্ঠুর! তবে সবাই নয়। কিন্তু যারাই এধরনের অপকর্মের আওতায় পড়ে, তাদের সংখ্যা নেহাৎ কমও নয়। পুরুষের টিপিক্যাল চরিত্র। হাত ঝেড়ে-ঝুড়ে ভুলে যেতে পারে সবকিছু, যেন কিছুই হয়নি।
আমাকে বলবে, ভালোবাসে। ওকেও। তাকেও। সততা, স্থিরতা, নিমগ্নতা, সমর্পণ, ওরা দায়ভার অস্বীকার করতে পারে নিমেষে। না হলে ওরা হয়তো মনে করে এগুলো না থাকলে পুরুষের সংজ্ঞায় পড়বে না। ওদের এই মুখোশ সম্পর্কে যে নারী অবহিত তিনি নিরাপদ। আর যে চেনে না সে অবহেলিত। ছেলেদের থেকে তাকে কতটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হয়! এই না-জানা ভুলের মাসুলও গুণতে হয় প্রচুর। কিন্তু চাইলেও কি আর দূরে থাকা যায়? মেয়েরা স্বভাবজাত কারণেই পুরুষের ভালোবাসার প্রত্যাশী। তারা পুরুষ চায়; পুরুষদের বুক চায়। তার ওম ওম বুক চায়। দিতে চায় আবার পেতেও চায়। পুরুষ ছাড়া তাদের চলে না। বিয়ের পর স্বামী ছাড়া সে যেন কিছুই বোঝে না। কত সহজে তারা ত্যাগ করে পিতৃগৃহ। সব আপনজন ছেড়ে চিরতরে অচেনার এই ত্যাগ, শুধু মেয়েদের জন্যে প্রযোজ্য। পিতৃগৃহ ত্যাগ তারই। কি নিষ্ঠুরতা! কত ব্যথা! তারই। কি যদিও তা ঠিক নয়, কিন্তু এটাই নিয়ম। বিয়ের পর পুরুষ কখনো যাবে না আপন ঘর ছেড়ে, নারীর ঘরে। প্রশ্ন হয়, কেন যাবে না? কেন নারীকে দিতে হয় এই নিষ্ঠুর মূল্য। নিমগ্নতা, সততা, শুদ্ধিও মেয়েদেরই। ওদের অধিকাংশেরই কুৎসিত চরিত্র আমি দেখেছি তৃতীয় চোখ দিয়ে। হ্যাঁ, তবে ব্যতিক্রমী ভালো পুরুষ যে সেই তাও নয়। আছে। তবে খারাপ পুরুষ নিয়ে আমাদের বিড়ম্বনারও শেষ নেই। আমাদের সুরঞ্জনাদের ঘরে ঘরে, পুরুষ এখন একটা চরম নিষ্ঠুরতার নাম।
আমি প্রচুর মেয়েদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলে দেখেছি মধ্য বয়সের সঙ্কট নিয়ে। শুনে বুঝি যে মেয়েরা তাদের চিরাচরিত সমস্যার কথা, না কাউকে বলতে জানে, না সইতে জানে। নপুংসক স্বামী, নিজের যৌন অভ্যেস, সমকামিতা, বিকার, অতৃপ্ততা, পছন্দ, অপছন্দ। পারলে জীবন অনেক সহজ হতো। কিন্তু বলতে পারার সেই ভাষা সেই সাহস মেয়েরা আদৌ রপ্ত করতে পারেনি আজও। অন্তত আমাদের মেয়েরা। মেয়েদের ক্রাইসিস, পুরুষ। ক্রাইসিসের কারণ তার শিশুসুলভ নির্মল হৃদয়। ক্রাইসিসের ফল, মানসিক ও মানবিক যন্ত্রণা। ক্রাইসিসের শেষ পরিণতি, মাথার গোলমাল দেখলে যখন রাস্তার লোকেরা ঢিল ছুঁড়ে মারে। তবে এ কথা প্রযোজ্য শুধু খেলুড়ে প্রেমিক এবং নির্যাতক স্বামীদের বেলায়।
খ. কিছু পুরুষ আছে যারা খুব সহজে মেয়েদের কাছে রীতিমতো ভীতিকর দুঃস্বপ্ন। খেলুড়ে প্রেমিক ওরা। হৃদয় নিয়ে খেলার প্রেমিক ওরা। মেয়েদের সবচেয়ে গোপন, সবচেয়ে নরম জায়গা নিয়ে ওরা মজা করে। মুখে ভালোবাসা বললেও, আসলে ওরা ভালোবাসে না। শুধু ভালোবাসার অভিনয় করে এবং মেয়েরা ওদেরকে বিশ্বাস করে করে অনেকদূর এগিয়ে যায়। মেয়েরা যেহেতু সঙ্গত কারণেই পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে চায় সেহেতু ভালোলাগার পুরুষ মানুষটিকে সে তার মনপ্রাণ এমনকি শরীরও দিয়ে দেয় খুব সহজেই। তাকে খুশি রাখতে। তার ভালোবাসা পেতে। পুরুষ বলে দাও না হলে চলে যাবো। মেয়েরা দেয়। তা সত্ত্বেও অধিকাংশই পালিয়ে চলে যায় নেয়া শেষ হলে।
আশ্চর্য যে, এমনকি খেলুড়ে পুরুষদেরকেও মেয়েরা জেনেশুনে বিশ্বাস করতে চায়। ইচ্ছে করে সত্যকে অস্বীকার করবে। নিজেকে ইচ্ছে করে ভুল বুঝতে চায়। নিজেকে ভুল বুঝে ভাবতে চায়, না! না! সে খেলুড়ে নয়। সে সত্য। সে শুধু আমাকেই ভালোবাসে। আমি তাকে ভুল বুঝেছি। এই যে বিভ্রান্তি, নিজেকে অস্বীকারের এই যে বিড়ম্বনা এরই নাম সর্বনাশ। রবীন্দ্রনাথ একে বলেছেন দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশ। কথাটি মেয়েটির বেলায় ধ্রুব সত্য। তখন মন হয় এলোমেলো, দিশেগুলো হয় দিশেহারা, উদ্দেশ্য হয় উদ্দেশ্যহীন। পুরুষকে বিশ্বাস-অবিশ্বাস করতে করতেই সুরঞ্জনারা শেষ হয়ে যায়। চোখে দেখছে, কানে শুনছে কাজে কর্মে বুঝছে, সে প্রতারক। তা সত্ত্বেও হৃদয়ের ব্যাপারে সে অবুঝ। সে শিশু। এতদ্সত্ত্বেও সে তাকেই ভালোবাসে।
প্রকৃত ভালোবাসা আর ভালোবাসার খেলা, দুটো দুই জিনিস। বিভ্রান্তিতে ভুগতে ভুগতে মেয়েরা এই দুটোকে এক সময় আর আলাদা করে চিনতে পারে না। তবে সন্দেহ তাদের যে নেই তাও ঠিক নয়। কোথায় যেন একটা কিছু গোলমেলে ব্যাপার মনে হতে থাকে। মনটা মাঝে মাঝেই উদাসীন থাকবে। বুকে, হাহাহার। খারাপ লাগবে, কান্না পাবে, সর্বক্ষণ একটা সন্দেহ। একটা বিচ্যুতি, কি যেন! কোথায় যেন! এই যে সন্দেহ, এখানেই সমস্যা। এটাই প্রথম চিহ্ন, তার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার। কিন্তু দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে পড়ে মেয়েরা এ কাজটা সহজে পারে না। প্রতারক পুরুষটির প্রতারণাও তার ভালো লাগে। তাকে কিছুই নিরুৎসাহ করে না। ভালোবাসা তাকে তাৎক্ষণিক অন্ধ করে দেয়। বিশেষ করে যখন তা একতরফা। একতরফা ভালোবাসায় দুইয়ের মানসিক সংযোগ না থাকায়, শুধু শরীরের কারণে হলে তা, ধসে পড়তে বাধ্য।
হঠাৎ একদিন সব নিয়ে বা ছেড়ে উধাও হয়ে যায় খেলুড়ে পুরুষ। খেলুড়ে পুরুষ, যাকে ঘিরে মেয়েটি স্বপ্ন দেখেছে। স্বপ্ন নামের গাছ বুনেছে। বুনে তাতে আগাম ফল ও ফুল দেখেছে ছোট্ট সংসারের। জল সিঞ্চিত করে যত্ন করেছে পুরুষটিও তার সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বপ্নের পথ ধরে হেঁটে হেঁটে তার সর্বস্ব চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে। মেয়েটি যে কিছুই টের পায়নি তা ঠিক নয়। সে জেনেশুনেই ফাঁদে পড়েছে। কিন্তু ইচ্ছে করেই সে সন্দেহকে সন্দেহাতীত করে ভেবেছে। খেলুড়ে পুরুষ পালিয়ে গেলে স্বপ্নভঙ্গ মেয়েটির অবস্থা তখন কেমন হতে পারে? মানসিক রোগ! আত্মহত্যা! হয়তোবা। না হয় ফের সে স্বেচ্ছায় পা বাড়াবে, অন্য আরেক খেলুড়ে পুরুষের কাছে। কেননা দুর্বল হৃদয়ের মেয়েরা, একবার পা পিছলে পড়লে, বারবার সেই ভুলের দিকেই পা বাড়ায়। ভাবে, না এবার সে ঠিক মানুষ খুঁজে পেয়েছে। একবার পা পিছলে পড়া মেয়েগুলো বারবার যায়, পিছল খেতে। এটা মেয়েদের অভ্যেস বদভ্যেস! এরই নাম দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ভ্রান্তি-পা-শ! হৃদয়ের ক্রাইসিস কুলিয়ে ওঠার মতো মানসিক শক্তি সব মেয়েরই একই তরঙ্গের হবে এমন কোনও কথা নেই। সব মেয়ের মানসিক আবহাওয়াও এক মৌসুমের নয়। আমাদের সমাজ বুঝতেই চায় না মেয়েদের সমস্যাগুলোকে। এ ব্যাপারে সমাজ এখনো জাহেলিয়াতের যুগে। সেক্ষেত্রে বিপদগ্রস্ত নারীর পারিবারিক সমর্থন বা সহানুভূতির আশাও বৃথা। যে মেয়ের মানসিক শক্তি আছে, তাকে নিয়ে আমার ভাবনা নেই। কিন্তু যার নেই, তাকে নিয়ে আমার যত দুশ্চিন্তা। পশ্চিমে যে কোনও হৃদয়ের ক্রাইসিসকে জরুরি বলে বিবেচ্য ধরা হয়। ফলে মানসিক কাউন্সেলিং পারিবারিক সমর্থন সবই সম্ভব। ফলে ব্যর্থ প্রেমের কষ্ট, ওরা পরিবার বন্ধু এবং ডাক্তারদের সহায়তায় কাটিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজ ঠিক সেরকম নয়। কৈশোর বা যৌবনের কোনও প্রতারণা, খেলুড়ে প্রেম একটা। মেয়ের বাকি জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তাকে বাকি জীবনের জন্য মানসিক রোগী বানিয়ে রাখতে পারে। সে আত্মহত্যাও করে।
গ. প্রত্যেক সমাজেই রয়েছে, নারী নির্যাতক পুরুষ। পুরুষের শাশ্বত চেহারা, ঘরের বৌদেরকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। ধরুন একজন বিবাহিত পুরুষ। সেও খেলে ঘরের নারীর হৃদয় নিয়ে। তাকে ভালোবাসার কথা বলে যায়, অন্য নারীর কাছে। তাকে মিথ্যে বলে, গোপনে আশ্রয় নেয় অন্য নারীর শয্যায়। গেস্ট হাউজ, পতিতালয়, পরকীয়া। বাড়ির কাজের মেয়ে। ঘরে কাজের মেয়েরা সবচেয়ে বড় নাগালের। ওদেরকে মায়া বড়ি খাইয়ে, কিছু হাত খরচা দিলেই ঢুকে যাওয়া সম্ভব ওদের মশারির তলায়। পেট হয়ে গেলে অস্বীকার তো হাতের পাঁচ আছেই! নইলে কিছু টাকা হাতে দিয়ে মিটিয়ে দেয়া এমন কিছু অসম্ভব নয়। এমন ভগ্ন হৃদয়ের নারীর সংখ্যা কি খুবই কম, যাদের প্রতারক স্বামী বারবার তাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করেনি। কাজের মেয়ে, গেস্ট হাউজ, পতিতালয় করেনি! আছে! অনেক আছে। সন্দেহের, সবটাই মিথ্যে নয়। যা রটে তার কিছু তো বটে। বিবাহিত পুরুষগুলোকে নিয়ে মেয়েদের সন্দেহ, অবিশ্বাস, সবটাই মিথ্যে হয় না। স্ত্রীকে ভালোবাসে না, এমন পুরুষ যদিও বিরল নয়, কিন্তু স্বামীকে ভালোবাসে না এমন নারী বিরল। স্ত্রীর মৃত্যু হলে, ক’জন পুরুষ মেয়েদের মতো আমৃত্যু বিধবা থাকে! স্ত্রীর মৃত্যুর মাসখানেক পরেই শুরু হয় নারীর সন্ধান। বলে, ধৎ, একা থাকা যায় না-কী? আমি বলি, যায়। অধিকাংশ মেয়েই বৈধব্য জীবনে, মৃত স্বামীর কথা ভেবে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। কিংবা নিষ্ঠুর সমাজের তুচ্ছ সংস্কারের কাছে ওরা বাধ্য হয় বৈধব্য জীবন কাটিয়ে দিতে। তবে মধ্য এমনকি বৃদ্ধ পুরুষদের মতো নারী কখনোই বিয়ের জন্য এমন খোলামেলা হয় না। হতে পারেও না। মধ্য বয়স্ক একজন বিপত্নীক পুরুষ নিঃসন্দেহে বিয়ে করবে। এমনকি বৃদ্ধ পুরুষও। কিন্তু নারী সেকথা ভাবে না। ভাবতে জানেও না। সে স্বপ্নও তার নেই।
অবিশ্বাসী স্বামীর আচরণে মানসিক কষ্ট একটা মেয়েকে মানসিক নরকে পৌঁছে দিতে পারে। রাতের ঘুম হারাম করে দেয়ার জন্যে যা যথেষ্ট। বিশ্বাসের বুকে ছুরি চালিয়ে তার জীবনটাকে রূপান্তর করতে পারে, নরকে।
ঘ. হৃদয়ের ক্রাইসিস নিয়ে খোলামেলা কথা বলা আমার স্বভাবজাত অভ্যেস। বারবার মেয়েরা যে ভুলটা করে, তা হলো, পুরুষকে বিশ্বাস করার যত আত্মঘাতী প্রবণতা। এই প্রবণতা তার স্বভাবজাত। কারণ মেয়েরা নির্ভর করতে চায়। খেলুড়ে পুরুষেরা খেলতে খেলতে হঠাৎ যখন সেই জগৎটাকে ভেঙে নিয়ে চলে যায়, কিংবা বিবাহিত স্বামী যখন দিনের পর দিন গেস্ট হাউজে নিয়মিত খদ্দের হিসেবে স্থায়ী সদস্য হয়, তখন ঘরের বৌয়ের হৃদয়ের ক্রাইসিস কোথায় দাঁড়াতে পারে? সবসময় সন্দেহ, সর্বদা শঙ্কাগ্রস্ত। অন্য নারীর গন্ধ, স্বামীর শরীরে পেয়ে সে শিউরে ওঠে। আস্ত একটি মানসিক নরকে বাস করতে শুরু করে। মানত, তাবিজ, কবজ, দোয়া, ফুঁ, পীর ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে ভাবে, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। আশা-ভরসা শেষাবধি তার অপূর্ণই থেকে যায়। এমনই নির্বোধ সে।
স্বপ্ন ভেঙে সারাক্ষণ শূন্যতা। কিছুতেই কিছু ভালো লাগে না। অর্থ, আনন্দ, সুসংবাদ ভালো লাগে না। বুকে নিরন্তর কষ্ট, অন্য সব সুখ নষ্ট করে দেয়। কষ্টগুলো খুঁজে বেড়ায় সেই পাথর, সেই খেলুড়ে, সেই অবিশ্বাসীকেই। হয়তো সে তখন আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া বা কানাডায় অন্য নারীর বিছানায় মজা করছে। তখন তাকে কে পায়? সব ধরাছোঁয়ার বাইরে সে তখন। হায় নারী! সেসবে তার খেয়ালই নেই! সে তবুও তাকেই দেখে তার অন্ধ চোখে।
হৃদয়ের কান্নাগুলোকে কোনও না কোনওভাবে গুছিয়ে তবুও, জীবন-যাপন করতে হয়। মাতৃহারা শিশু যেমন। যেভাবেই হোক সে বেঁচে থাকে। একদিকে হৃদয়কে শান্ত করা, অন্যদিকে পৃথিবীর মোকাবিলা। সকাল হলেই রাত অবধারিত। ভোর হবে রাতটাকে টেনে নিয়ে যেতে। এই দিন আর রাত টেনে নেয়াই তো নারীর কাজ।
খেলুড়ে পুরুষ বা অবিশ্বাসী স্বামীর নিষ্ঠুরতাগুলো যৌবনে যেরকম অনুভব হয়, মাঝ বয়সে তার অনুভূতি অন্যরকম। অনুভূতি, অনুভবের। অনুভব, তার কৈশোরের যৌবনের লাভক্ষতি, দুঃখ-কষ্ট। অনুভব তার সুখ। অতীতের ভালোমন্দ, মধ্য বয়সে সে অন্য চোখে দেখতে পায়। দেখতে পায় দূর থেকে। দূর-যা অতীত। অতীত, যার সঙ্গে তার বিচ্যুতি ঘটেছে। অতীত, যা নেই তার বর্তমানে, নেই তার ভবিষ্যতে।
মধ্য বয়সে ক্রাইসিসের এই অনুভূতি সত্য। নিষ্ঠুর কখনো কখনো সুন্দরের সাক্ষী। এই ক্রাইসিসও সুন্দর। নিষ্ঠুর কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর। সবচেয়ে বাস্তব। যেহেতু সে বাস্তব। বাস্তব সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করে, কুৎসিত থেকে জীবনটাকে আলাদা করে। আমি এই অনুভূতির, একজন ধারক ও সেবক। মধ্য বয়স আমাকে দিয়েছে অনন্ত অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির অফুরন্ত সম্ভার। নারীকে তার যৌবন আর বার্ধক্যের এই সন্ধিক্ষণে, তার সকল সাফল্য আর ব্যর্থতা উপলব্ধির আমন্ত্রণ জানাই, বার্ধক্যের পথে হাতেগোনা বাকি ক’বছর ভুলভ্রান্তি ছাড়া, সুন্দরভাবে এগিয়ে যেতে। বাঁচতে।
ঙ. দেবদাস ছবি দেখে বই পড়ে অনেক আগেই আমার এই অনুভূতি হয়েছিল যে, শরৎ বাবুর দেবদাস কল্পনার পৃথিবীতে শুধু একবারই জন্ম লয়। যে দেবদাসরা পার্বতীর বিরহে মরে যায়। এই কি আসল সত্য? সত্যিই কি নিরীহ প্রেমিক পুরুষ। এতই নিরীহ এতই প্রেমিক যে নিষ্ঠুর পাষাণ পার্বতীর জন্য সে মদ খেতে খেতে মরে যায়! এই পাষাণ পার্বতী যদি সত্য হয় যে পুরুষকে অমন কষ্ট দেয়, তবে আমি তার মৃত্যু কামনা করি। যে অমন সোনার মতন, নরম হৃদয়ের প্রেমে টইটম্বুর দেবদাকে কষ্ট দিয়েছে। আহা! এই পুরুষের জন্যে আমার কান্না পায়। দেবদা বললো–”পারু! পারবি তুই আজ রাতে আমার সঙ্গে পালিয়ে যেতে?” পার্বতী বললো,”তা হয় না দেবদা!” আহা! কি ভালো এই দেবদাস! কি। মানবিক! কি বঞ্চিত! হায়!
না-না উচ্ছ্বসিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। কারণ এই দেবদাস বাস্তবের পুরুষ নয়। এই দেবদাস কখনো বাস্তবে জন্ম নেয় না। নিতে পারে না। কারণ ওরা পুরুষ। এরা শরৎ বাবুর গল্পের গুজব। মিথস বা ইউএফও। নাগরিক বিশ্বাসে এই দেবদাস সত্য নয়। রুচিতেও নয়।
তবে প্রকৃত অর্থে দেবদাস যদি কেউ হয়, সে নারী।
বাস্তবে, আমার দেবদাসী = শরৎ বাবুর দেবদাস।
বাস্তবে, আমার পুরুষ = শরৎ বাবুর পার্বতী।
বাস্তব কঠিন। আমার ইচ্ছে হয় শরৎ জেঠুর দেবদাস যদি কালেভদ্রে কখনও সত্যি হয়! অহো! বড়ো দুরাশা আমার!
১৬. মধ্য জীবনের দোলাচল
সেলিমের কথা
সেদিনের পর থেকে সেলিমের শুধু মরে যেতে ইচ্ছে হয়। পৃথিবীর কোনও কিছুতেই তার আকর্ষণ লাগছে না। রুচিও নেই। কি নিরন্তর লেগে থাকা কষ্ট তার বুকের গভীরে। দুই পাজরের তলে। কষ্টের অতল সাগর। মন নেই অগাধ বিত্তে। কি রিক্ত মনে হয় নিজেকে তার! অথচ কি নেই! তার যা আছে অনেকেরই নেই। তবু মরে যেতে ইচ্ছে লেগে থাকছে সারাক্ষণ। এত বিত্ত মনে হয় রক্তহীন পানসে জামরুল। এই দালান ধূসর বালি! কি নিঃস্ব পৃথিবী তার যেখানে এত আলোর জগতে তার হৃদয় জুড়ে বসে থাকছে বাদুড়ের ডানায় লেগে থাকা কালো কালো অন্ধকার।
বাঁচা কী শুধুই, বেঁচে থাকা? শরীরটাকে ঘুম থেকে ওঠানো, ঘুমোতে যাওয়া! জীবন মানে কি শুধু ঘৃণা আর অবিশ্বাসের অভিজ্ঞতার পুঁজি করা! এই যে আরেকটি দিন গড়িয়ে যায় জীবন থেকে শুষ্ক, প্রেমহীন! দাম্পত্যের চিহ্ন নেই। দু’জনের দু’বিছানা।
দোলা, থেকেও সে নেই। এই যে সে আছে শুয়ে-বসে একই ঘরে, এক ছাদের তলে, কিন্তু নেই। থেকেও নেই। সে মিশে আছে অন্যে। তার অনুভূতি জুড়ে অন্য পুরুষে। সেলিমের কষ্ট হয়। সেদিন নিজ চোখে সে যা দেখেছে তারপর দোলার ছায়াও ওকে যন্ত্রণায় দগ্ধ করে। আত্মপীড়নে, পেষে। তাপিত বুক, আরও জ্বলে ওঠে। মরতে ইচ্ছে করে। ওদের প্রেমের বিয়ে। মধ্য বয়সের অতৃপ্ত শরীর তারুণ্যের সুখের সময়গুলোকে নিষ্ঠুরভাবে ছাড়িয়ে যায়।
বিয়ের পর থেকে দোলাকে সেলিম ভালোবেসে কাটিয়ে দিয়েছে বারোটি শীত বসন্ত। সেলিম দোলা ছাড়া কাউকে জানতে চায় না। দোলা জানে অন্যকে। এবং সেই জানা না জানার সঙ্গে বাঁচার কারণ দোলার বাড়লেও, সেলিমের দিন দিন কমতে থাকে।
আজকাল দোলাকে সেলিম এড়িয়ে যায়। কেন যাবে না? এই দোলা যে অন্য দোলা! প্রেমহীন। ভালোবাসাহীন। তার সব প্রেম অন্য পুরুষে। তার হৃদয়ে লেগেছে নববসন্তের ছোঁয়া। অনভ্যস্ত শরীরের স্বাদ। নতুন শয্যা।
কিন্তু সেলিম এত অবিশ্বাস আর ঘৃণার পরেও আজও দোলা ছাড়া কাউকে ভালোবাসতে পারছে না। এবং সমস্যা এখানেই। যদি সেও ভালোবাসতে পারতো, তবে সেও জুড়োতে পারতো। এবং জুড়োতে পারলে ভুলেও যেত। দোলা ছাড়া পৃথিবীতে, তার নিঃস্ব হয়ে যায় সবকিছু। স্বর্গসমেত সম্পূর্ণ অতীত বৈভব। দাম্পত্য অবিশ্বাস প্রতিষ্ঠা পেলে, তা শত্রুতায় রূপান্তর হয়। তখন তার বাতাসটুকুকে বিষ। দোলার বাতাসও সেলিমের কাছে বিষ লাগছে। কারণ সে বাতাসটুকুতে মিহিরের ঘ্রাণ থাকে। তার স্পর্শ থাকে। না চাইলেও সে ঘ্রাণ পায়। মিহিরের ছোঁয়া পায়। দোলা যেখানে দাঁড়ায়, বসে, শোয়, সেলিম মিহিরের স্পর্শ পায়। কতবার সে চেষ্টা করে এই গন্ধ থেকে মুক্তি পেতে, কিন্তু দোলা আর সেলিমের সম্পর্ক দাম্পত্যের বারো বছর শেষে, ঘুণপোকা। এবং দু’জন পরস্পর পরস্পরের থেকে যতদিন যায় দূরে সরে যেতে থাকছে। এই দূর ক্রমশ দীর্ঘতর হয়। এরপর একদিন স্বচক্ষে সেই ঘটনা। যার পর সেলিম প্রস্তুত হয়, বিবাহ বিচ্ছেদের।
কারণটা খুব অস্বাভাবিক নয়। সঙ্গতও নয়। তবে মানবজীবনের কোনও এক সময়ে হঠাৎ ফের অনুভূতির বদল হলে, হতেই পারে। তার মানে এই নয় যে, দোলা ভুল করেছে। তারপরেও সম্পর্কটা ধুকে ধুকে হলেও টিকে ছিল।
সেলিমের যে হঠাৎ মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল তার কারণটা একটু বিশেষ। সেদিন রাতে সেলিম, দোলাকে দেখেছিল, মিহির নয়, শান্তনুর বিছানায়। মিহিরের পর শান্তনু! অবিশ্বাস্য! শান্তনু ওদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিহির, তারপর শান্তনু! দোলা কি সেফ পাগল হয়ে গেছে! বিকারগ্রস্ত! কিন্তু দেখে তো মনে হয় না। দোলা ঠিক আগের মতোই চঞ্চল ও ধীর একইসঙ্গে। কোমল ও কঠিন এক পলকে। বার্ধক্য আর কৈশোর এক মুহূর্তে। একি! সেলিম ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারছে না।
ঠিক তার দু’মাস পর। সেলিম, ডিভোর্সের কাজ সম্পন্নশেষে বাড়ি ফিরে এলো। দোলা কিছুই জানে না। মধ্যরাত। খোলা জানালা দিয়ে উত্তরে বাতাস ঢুকছে। সেলিম চুপচাপ বসে উদাস চোখ মেলে আকাশে তাকিয়ে আছে। রাতটা বড় বেশি ঘন লাগছে ওর কাছে। অসংলগ্ন লাগছে। ভাবছে…। আকাশে তারা আর মেঘ এক সাথে। উড়ে যাচ্ছে তারা। মেঘ থাকছে। উড়ছে না।
সে ভাবছে। এরপর, দোলাকে সে ধীরে ধীরে ভুলে যাবে। দোলার জন্য বুকে কষ্ট আগলে রাখা ভালোবাসা, সে ভুলে যাবে। শুধু দোলাকে ভালোবেসে বেঁচে থাকা ভুলে যাবে। যেতেই হয়। যেতে হয় কারণ আজ ডিভোর্সের কাগজে সই করে কোথায় যেন এক পুঞ্জীভূত রাগ আর ঘৃণা থেকে সে হঠাৎ মুক্ত হলো। চুলে তার একগুচ্ছ বাতাস লাগে। মুখেও লাগে। তারপর গায়ে। সে ভাবছে, এরপর হয়তো দোলার সাথে হঠাৎ দেখা হলে মনে হবে কৃষ্ণচূড়া। মনে পড়বে সময়। ভোরবেলাকার উথিত শক্ত পুরুষে দোলার দুষ্টুমি। পেটে ‘দ’ হয়ে থাকা। কিংবা দোলার চেঁচামেচি শীকার, সঙ্গমের সময় কি সব আবোল-তাবোল। সে অনর্গল বলে যেতো! ইস। সেলিমের হাসি পায়। মনে পড়ে হাসি হাততালি, দোলার গর্ভাবস্থায়, বাধ্য হয়ে হাত দিয়ে নিজের পুরুষ পেষণ মৈথুন করে নিজেকে মুক্ত করা। ওতে দোলারই প্ররোচনা ছিল। তখন যে দোলার সব সব কথা শুনতো। ইস কি লজ্জা। দোলাকে আজ ওর লজ্জা লাগছে। ভারি লজ্জা লজ্জা। কেন? আগে লাগেনি তো! লজ্জা শুধু তাকেই হয় যে আপন নয়। আজ দোলা তার আপন নয়। বুকের মধ্যে সেই ভালোবাসা কোথাও আর অনুভব হয় না। কোথাও কিছু আর টানে না। সেই টান আর নেই। কোথায় যেন সব সব হারিয়ে গেল। স্মৃতি ছাড়া বাকি সব যা, মুছে গেল জলে ছাপা অক্ষরের মতো মুছে গেল।
আজ মনে হচ্ছে দোলা ওকে শিখিয়েছে। অনেক শিখিয়েছে। বিয়ে দাম্পত্য সংসার মানে একসঙ্গে আজীবন আবদ্ধ থাকা নয়। মনের পরিবর্তন হতেই পারে। তখন ছেড়ে দিতে হয়। কষ্ট না পেয়ে বরং সিদ্ধান্ত নিতে হয়। দুটো ব্যক্তিত্বকে এক করা অসম্ভব। দোলাই ঠিক। সেলিমের নিজের নির্বুদ্ধিতায় তার লজ্জা বোধ হয়। সে তাকায় আগামীর দিকে। উত্তরে হাওয়ায় সে আচ্ছন্ন হয় নতুন সম্ভাবনায়। পৃথিবীতে কোথাও কারও জন্যে কিছু আটকায় না। শরীরে তার নতুন পুলক হচ্ছে, বহুদিন পর তার পুরুষ উত্থিত হয়ে প্যান্টের বোতাম ছিঁড়ে ফুড়ে ওঠে এসে দাপিয়ে সে নীলিমাকে চায়! মনের কোণায় দেখা দেয় কোনও, নীলিমা। কে সেই নীলিমা! কোথায় সে! সেলিম জানালা খুলে বাইরে তাকায়। তারপর দোলার দিকে একবার তাকালো সে। কোথায় সেই অনুভূতি! সব মেকি। সব গুজব। মনে হয় সেলিমের। মনে হয় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন পৃথিবীতে কে কার। তাইতো! পৃথিবীতে কে কার?
দোলার কথা
আজ আমার স্বামী বুঝতে পেরে বিশাল এক সঙ্কীর্ণতা থেকে নিজেকে মুক্ত করলেন, যা মানবদর্শনের নিয়ত সত্য। আমি দোলা যে কথাটি আমার স্বামী সেলিমকে এতদিন ধরে বোঝাতে চেয়েছিলাম আজ তিনি স্বেচ্ছায় তা বুঝে নিলেন। বিবাহ বিচ্ছেদের কাগজে আমার অজান্তেই সই করে এসে আজ প্রথম তিনি আমার সঙ্গে যে দূরত্ব অনুভব করেছেন, যে দূরত্ব থেকে তিনি আজ প্রথম আমায় স্পষ্ট করে দেখছেন–সেই দূরত্ব, জীবন সম্পর্কে তার পৌরাণিক দৃষ্টি আর বদ্ধমূল ধারণাগুলোকে পাল্টে দিয়েছে। এখন থেকে তিনি একজন মুক্ত মনমানসিকতার মানুষ। বোধের অন্ধত্ব ছেড়ে মুক্ত স্নায়ুর মানুষ। মুক্ত জীবনদর্শনের প্রকৃত রূপ দেখতে পারার অপারগতা থেকে মুক্ত মানুষ। দূরত্ব, যা তাকে দিয়েছে দেখার ক্ষমতা দূর থেকে। আজ আমার জয় হলো। আজ আমারও জীবনদর্শনের জয় হলো যে আমরা বনের পশুপাখির চেয়েও মূর্খ। কারণ আমাদের দাম্পত্য জীবনে রয়েছে ১৪৪ ধারা।
আজ আমার স্বামী স্বীকার করলেন, ১৪৪ ধারা ভুল। দোলাকে ধরে রাখার চেষ্টা করে করে শুধু কষ্ট পাওয়া। শুধুই কষ্ট পাওয়া। তিনি বুঝলেন, বিবাহ কখনো আমৃত্যু আজীবন হয় না। হতে পারে না। প্রেম ভালোবাসা অনুভূতি বিবাহের মাধ্যমে তাকে আমৃত্যু আবদ্ধ করা যাবে না। করা যায় না। সম্ভবও নয় তার প্রমাণ, বিবাহ ভাঙে। কলমে না ভাঙলেও এক বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে শুয়েও বিচ্ছেদ হয়। নীরবতার অন্ধকার। দূর দূর তফাত। পাশাপাশি শুয়েও মাঠ মাঠ দূরত্ব।
এই যে একটার পর একটা শয্যা পাল্টাচ্ছি, পুরুষ পাল্টাচ্ছি, এটা যেমন আমার একটা ফ্যান্টাসিতে রূপান্তর হয়েছে, তার চেয়েও এটা ছিল আমাকে ধরে রাখার ব্যাপারে তার অক্ষমতা। যা সৃষ্টি হয় দোহের মধ্যে ভিন্ন ব্যক্তিত্বের দুই মানুষের মধ্যে বিবিধ অসমতার কারণে। এবং যাকে উন্মোচন করতে পারে শুধু সময়। অক্ষমতা। যা নিশীথের আঁধারে রচিত হয় ঘরে ঘরে নারী আর পুরুষের মিলনে, যখন তারা দু’জন স্নায়ুযুদ্ধ করে করে ক্লান্ত হয়। এবং সত্যকে লুকিয়ে যাচ্ছে বেমালুম আর নিয়ত দোষ দিয়ে যায় তাদের ভাগ্য, বয়স আর পরিস্থিতিকে। তারা অনুভব করছে তবে স্বীকার করছে না। তারা অতৃপ্ততায় মারা যাচ্ছে তবু মুখ ফুটে বলছে না। তবে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যখন তারা সত্যিই বুঝলো তাদের মধ্যে নেই ভালোবাসা, নেই প্রেম, ইটস টু লেইট। আজ সেকথাই সেলিম ধুকে ধুকে অবশেষে বুঝতে পেরেছে যে নিশীথের অন্ধকারে এই যে আমাদের অতৃপ্ততার অভিনয় আসলেই তা বানানো, সাজানো। আমাদের ছিল গভীর সমস্যা দূরের ও কাছের। আর অবশেষে সে আমার অসুবিধের চিহ্ন চিনেছে। সেজন্য বিচ্ছেদের পরেও আজ সে ধীর। ধীর স্থির শান্ত। এবং আমি এজন্যেও সুখী যে এখন তার ভাবনাকে আন্দোলিত করবে অন্য নারীর অস্তিত্ব। যে হবে তার সমমনা। এই ভাবনা ভালো। নতুন অলঙ্করণ। নতুন উজ্জীবন। এবং আমি তাতে সুখী। ঈর্ষা নয়, শাসন নয়, শাস্তি নয়, দাম্পত্যে গোপন ও করুণ তবে নিষ্ঠুর সত্য গ্রহণ করার মধ্যে যে শান্তি আছে সেই ত্যাগ সেটাই খুঁজে নেয়া আমাদের কাম্য। বিবাহ মানেই কি আমৃত্যু? সম্ভব কী? প্রতিটি নারী-পুরুষ বিবাহ বন্ধন সত্ত্বেও যে যে যার যার মতো আলাদা। এবং চলার পথে এমন কিছু পরিবর্তন তার মধ্যে ঘটতে পারে যখন একটি সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ যে বিবাহ সূত্রে এক যুগ ধরে এক, হঠাৎ সে নিজেকে খুঁজে পায় আবার আলাদা করে। যখন বিবাহ বন্ধন তাকে আর বাঁধে না। তার রোচে না। কুলোয় না। নাগরিক রুচি ও অভ্যেস। যখন দাম্পত্য তাকে আর টানে না। যখন তার মধ্যে হঠাৎ পরিবর্তন সবকিছু ধুলো নস্যাৎ করে দেয়। চিড়ে চ্যাপটা। যখন দাম্পত্য হয় ঝড়ের সম্মুখীন। যখন বিবাহ ভাঙে। যখন মানুষ না পেরে আত্মহত্যা করে এবং নিরুপায় সে পাল্টায়। শয্যার পর শয্যা। দাম্পত্যে এমন ঝড় স্বাভাবিক। ফুসলে ওঠা না ওঠা নির্ভর করে ব্যক্তির ওপর।
আমি আর সেলিম সত্যেরই জ্বলন্ত প্রমাণ। আমাদের জীবনের শুরুতে ওর মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলাম দারুণ কৌতূহল। তারুণ্য। সব-সবই যখন ভালো। সুন্দর সেক্সি। কোথাও কোনও একটু অপূর্ণতা আমাদের ছিল না। সময় যেতে থাকে। হঠাৎই এক দমকা হাওয়ায় একদিন প্রথম যৌবনের নিমগ্নতা ধরা পড়লো, দুর্বলতায়।
এত বছর ধরে আমি অভিনয় করে চলেছি, বিছানায়। সেলিমের হাতের বলে নিজেকে ঠিক ফুটিয়ে তোলা বা অলঙ্করণের অভিনয়। আমি যে নিজের সঙ্গে অভিনয় করে যাচ্ছিলাম, জানতাম। তবে জেনেশুনে এই ভালোমানুষটিকে আমি কষ্ট দিতে চাইনি। তাই কল্পনার আশ্রয় নিয়ে কষ্ট পার হতাম। কল্পনার সুখে ভাসলাম বহু বছর সমমনা পুরুষের সঙ্গে যেখানে আমার শয্যা রচিত হয়, মনে, শরীরে। গীতিময় রেণু রেণু সুখে, সুখ সঞ্চারিত হয় স্বর্গে। কিন্তু বাস্তব তো, বাস্তব। কল্পনার সুখ শেষে দুস্থতা আবার গ্রাস করে আমার শূন্য পৃথিবী। আমি কাঁদি। নিতান্ত প্রয়োজনে সেলিমের সঙ্গে ফের শরীর হয়। এবং আমি ওর থেকে অপেক্ষা করতে থাকি আরও অন্য কিছুর। এই করে করে মনের বিনিময়বিহীন অতৃপ্ত শরীর এক সময় ক্লান্ত হয়ে যায়। সেলিমের অতৃপ্তি আসে না কারণ সে বিনিময় জানে না। কারণ সে, সে-গভীরের মানুষ নয়। ক্রমশ আমার ক্লান্তি বাড়ে। আর আমি অধিক আশ্রয় নেই কল্পনায়। ধীরে ধীরে সেলিমের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা হয়ে ওঠে মেকি। স্রেফ উগরে ফেলা। আর বন্ধনটি আলগা হতে থাকে। তবুও সেলিম আমাকে দেখে বুঝতে পারে না। আমি নিরন্তর অভিনয় করে চলি। অতৃপ্ত থেকেও তৃপ্ততার অভিনয়। এবং যা পেরে তাই শুরু হলো বিকল্প এবং অন্যান্য সম্ভাবনা…।
আমার গোপন জীবনের ঘটনার শুরুতে। সেবার একটা কনফারেন্সে যেতে হয়। সেলিমকে যেতে বললাম। কিন্তু সে যাবে না। মিহির আমাদের বন্ধু। সেও যাচ্ছে। আমি মিহিরের সঙ্গেই গেলাম। কনফারেন্সটা হচ্ছিল আপস্টেইট নিউইয়র্কে। জায়গাটা সবুজে ঘেরা জল-কাদায় প্রকৃতির অকৃপণ শোভা। আমার সমস্যা আমি একা একা থাকতে পারি না। আমার মধ্যে একটা দারুণ অনিশ্চয়তা কাজ করে। একা ঘরে আমার ঘুম হয় না। তাই দু’জন মিলে এক হোটেলে এক ঘরে উঠলাম। বন্ধু মানুষ। যথারীতি মধ্যরাতে দু’জন দু’বিছানায়। স্তব্ধ রাত। বাইরে অন্ধকার। ঘরে রোমাঞ্চময় নীরবতা। শুধু শোনা যায় দুই নারী ও পুরুষের শ্বাসের গন্ধ। দুই অতৃপ্ত। এবং আমি কি কৌতূহলে যেন পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে মিহিরের দিকে তাকিয়ে রইলাম দীর্ঘ-দীর্ঘ রাত। কি সুন্দর সে! কি আকর্ষণ! দেখতে দেখতে নামলো আবছা ভোর। হঠাৎ কি যেন হলো! এই প্রথম আমার অনুভব হলো, পরপুরুষ! হ্যাঁ, আমার মিহিরকে চাই। অতৃপ্ত শরীর কাঁদলো। হু-হুঁ করে কাঁদতে শুরু করলো। রোমাঞ্চ। আমাকে অবাক করে দিয়ে ওপাশ থেকে মিহিরও নেমে এলো আমার দিকে। এক অলৌকিক আহ্বান। অসম্ভব টান। ওর চেহারায়, রিক্ততা। ওর শরীরও কাঁপছিল। আমি নিরুপায়, তবে উচ্ছ্বসিত। কাঁধে, ঠোঁটে দু’হাত নামিয়ে দিলাম, রাতের মতো, নীরবে। আমি, মুহূর্তেই শুষে নিলাম কল্পনা।
সেই রাতে। সেই গভীর রাতে। কেউ জানলো না শুধু দুটো তৃষ্ণার্ত–আর্ত মানুষ ছাড়া। যাদের মানসিক সমতা ছিল। যাদের চোখে বিনিময় ছিল। প্রতিটা মুহূর্ত যেখানে প্রেমের আবিরে আবিরে লাল হয়ে যেতে থাকে অশান্ত দুটি শরীরে, কেউ জানলো না কি সুখ রচিত হয়েছিল সেই শয্যায়। এবং সেই প্রথম আমি সম্পূর্ণ মুক্ত হলাম নিজের অনুভূতির দায় থেকে অন্য কারো হাতের তলায়, আবিরে বসন্তে, যেখানে ফুল ফুটলো তার সবগুলো পাপড়ি মেলে বসন্ত শরীরের সম্ভার। মিহির আমাকে প্রথম বুঝিয়েছিল নারী। ওর শয্যাতেই প্রথম নিজেকে এমন করে উন্মোচিত হতে দেখলাম। সেও। নব আবিষ্কারে আমি অভিভূত।
কনফারেন্স থেকে ফিরে আমরা আরও গম্ভীর হতে থাকি। মনের বিশাল এক সমতা আমাদের তীব্র টানে। টেনে আরও নিয়ে আসে কাছে। না হলে, না দেখলে, পাগল পাগল লাগে। পাশাপাশি সেলিমকে এত দেখি তবুও দেখি না। মিহিরের স্ত্রী মালা কাজে গেলে আমি লুকিয়ে চলে যাই ওর বাড়িতে। সেখানে ওর সঙ্গে ধুম আড্ডা হয়। হাতে হাত রেখে ভাব বিনিময় হয়। একটু ছুঁয়ে থাকা কোথাও কখনও। এই করে করে ও আমাকে শেখায়–শরীরবিহীন প্রেম। যৌনতা ছাড়া দাম্পত্য। আমি ও মিহির যে দাম্পত্যে পুরোনো হয়েছি, ক্ষয়েও গেছি। এবং সেজন্যেই কোনও অপরাধ বোধ হয়নি আমাদের।
তার একবছর পর। একদিন হঠাৎই মিহির এলো অসময়ে। এমন চেহারা নিয়ে আমার অফিসে এলো যেন ওর কেউ মারা গেছে। একেবারে ঝুলে পড়া, চোখ গাল ঠোঁট। বললো, বিদেশে ওর পোস্টিং হয়েছে। যেতেই হবে। উপায় নেই। আমি একেবারে নিরুপায়। কি বলবো! যেও না? তাতো সম্ভব নয়! এবং সে যথারীতি চলে গেল।
এরপর। আবার শুরু হলো শূন্যতার সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধ তার কল্পনার স্বর্গসন্ধান। কষ্ট পেরুবার স্বর্গপথের কল্পনা। মিহিরের সঙ্গে মানসিক বন্ধন আমার এমন গম্ভীর হয়েছিল যে ওর চলে যাওয়ায় রিক্ত আমার বিভ্রান্তি আরও বাড়লো। কি করি নিজেকে নিয়ে, কিছু ভালো লাগে না। শূন্যতা সৃষ্টি করে গভীর কুয়ো। সেলিম ততদিনে একটি জীবন্ত মূর্তি। ওকে দেখলে মায়া হয় তবে কোনও রকম ইচ্ছে জাগে না। আমি ওকে এড়াতে অভ্যস্ত হই। তবুও না পেরে ওর শরীর নিই। আমি অনিচ্ছায় দাঁতে দাঁত আটকে রাখি।
পা একবার ঘরের বাইরে গেছে। শরীর একবার প্রেম জেনেছে। এবং মিহিরের পর এই সুবিধে-অসুবিধেগুলো নিয়ে সেলিমের সংসারে এরপরের কাহিনী দ্রুত এবং সংক্ষেপ। এরপর এলো শান্তনু। তার…। সব কারণ ফুরিয়ে গেলে, একমাত্র যাওয়া ব্যতীত, গন্তব্য নেই। আমি তা সমূহ অস্তিত্ব দিয়ে বুঝলাম। সমমনা না হলে অতৃপ্ততা কখনো যাওয়ার নয়। এবং এই অতৃপ্ততা মোটেও শারীরিক নয়। এবং এসব সমূহ কারণেই হয় দাম্পত্য ভাঙে, নয়, মানুষ অসুস্থ হয়। কেউ বিকার, কেউ কেউ পরকীয়া আবার কেউ মানসিক ভারসাম্যহীন। আর আমি যাচ্ছিলাম মানসিক ভারসাম্যতার দিকে।
যে কারণে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রুমা ভোররাতে ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। যে কারণটা কেউ খুঁজে দেখেনি। সবাই জানলো রুমা হেলালের শয্যায় গিয়েছিল। হেলালের সঙ্গে তার পরকীয়া ছিল। সে দুই সন্তানের জননী। কি করে করলো! কি করে করলো অমন কাজ! মাসি একেবারে ছেনাল অমন স্বামী থাকতেও, মাসি ছেনাল। অমন কলঙ্কের চল্লিশায় যাওয়া যাবে না। গেলে গুনাহ্ হবে। না-না-না। মারা যাওয়ার একবছর পরেও কেউ বুঝতে চাইলো না অমন সোনার স্বামী ফেলে মাসিটা কেন হেলালের কাছে গেল!
রুমার জীবনের প্রকৃত ঘটনা, জানতো একমাত্র ওর মা। মাকে রুমা সব বলেছিল। বলেছিল শরীফের নিষ্ঠুরতার কথা। বিয়ের তিন বছর পর থেকে একযুগ সময়, এই এক যুগ সময়, শরীফ ওকে আর ভালোবাসলো না। এক বিছানায় ওরা যেন অতিথি। এবং মাঝে মাঝে শরীফ যখন শুধু ওর শরীরটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে মধ্যরাতে এগিয়ে আসতো, রুমা ভুল বুঝতো। আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নময় জগতে যা হয়। ভাবতো এই বুঝি ঠিক হয়ে যাবে। যাচ্ছে যাবে। ঠিক হয়ে যাবে। রুমাকে সে উতলা করে ফালাফালা করে নিংড়ে নিতো শরীর। এবং পরমুহূর্তেই সে ফের অচেনা এবং এই বিড়ম্বনা চলে বছর তিনেক।
রুমা কাদলো মায়ের আশ্রয় চেয়ে। কিন্তু মা কিছুতেই রাজি নয়! রুমা চেয়েছিল বিবাহ বিচ্ছেদ। আমাদের সমাজ যেখানে মা-মাসিরা পুরানো মনের মানুষ। মা রুমাকে বাধা দিয়ে বললো, ভালো না বাসলে কি দুটো সন্তান হয়! যদি তুই ডিভোর্স করিস তবে তোর দুটো মেয়েরই বিয়ে হবে না। হবেই না। মা বলেন, রুমা ভয়ে পিছিয়ে যায়। তাই তো!
নববিবাহের শরীর মিটে গেলে, দু’জনের মানসিক দূরত্ব দাম্পত্যে ফাটল জোগায়। আর রুমা সেই ফাটলে আটকে যায়। আর এমনি করে একযুগ সময় নিষ্ঠুরতায় কেটে যায় পাশাপাশি শুয়ে যখন দুটো মানুষ যারা স্বামী-স্ত্রী যারা সমস্ত রাত নীরব থাকে। আর সেই বিছানায় তোশকের আশপাশ থেকে পুরোনো দীর্ঘ-দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে এক অতন্দ্র নারীর বুকের তলা থেকে কি গভীর বেদনায়! আর গভীর বেদনা থেকে সৃষ্টি হতাশায় একদিন সে আলিঙ্গন করে নেয় যাকে সমাজের তথাকথিত সতী-সাধ্বীরা, নিজেরাও যারা গোপনে মেলে শরীর, পরকীয়া।
অবৈধ প্রণয়। রুমা সুস্থ হতে থাকে হেলালকে ঘিরে। নতুন স্বপ্ন নতুন আগামীর কুঁড়ি বাঁধে ওর মনে। শিশুসমেত হাসি উঠে আসে তার ঠোঁটে। জাগে, বেঁচে থাকার নতুন তীব্রতা। দাম্পত্যে, স্নেহ প্রেম ভালোবাসাবিহীন রুমা নতুন অভিজ্ঞতায় উজ্জীবিত হতে থাকে যেখানে সে স্পষ্ট দেখতে পায় শরীফ আর ওর কেউ না। শূন্য সাদা খাতা। এক ঘর এক বিছানা দুটো সন্তান সত্ত্বেও ওরা মাঠ মাঠ দূর। এদিকে ছিছিক্কার পড়ে যায় পাড়ায়। পাড়া ছাড়িয়ে শহরে। মানুষ হাতের কাজ ফেলে উৎসুক হয়ে যায়। এক মুখ থেকে অন্যমুখ। এক ঘর ছেড়ে অন্য ঘর। কাজ ফেলে যেচে জানিয়ে যায় হায় খোদা! একি! দু’সন্তানের মা! একি? কি করে পারলো! কি নির্লজ্জ! হায় খোদা কি বেহায়া কেমন বেহায়া! ঘরে অমন সুন্দর স্বামী রেখে অন্য পুরুষে যার চোখ, সে নির্ঘাত নরকে যাবে। দোযখে যাবে। যা-বেই। মুখে মুখে রটে যায় রুমার নষ্টামো যা, ছেনাল।
রুমা পারলো না এই সমাজের সঙ্গে যুদ্ধ করে। শরীফ ওকে গরু পেটা করে। প্রতিবেশীরা জানালা খোলে, সামান্য দেখে পাপ হবে তাই বন্ধ করে, আবার খোলে। মা এসে তিরস্কারশেষে নির্লজ্জ মেয়ের ঘরের মাটিতে নিতান্ত লজ্জায় আর দাঁড়াতে না পেরে মুখে কাপড় ঢেকে চলে যায়। মেয়ে দুটো মুখে কাপড় খুঁজে ছেনাল মায়ের দিকে পিঠ ফিরিয়ে চোখে চোখে কাঁদে।
গরু পেটা রুমা, ছুটে গেল মায়ের কাছে। একমাত্র মা-ই তাকে আশ্রয় দিতে পারে এই দুঃসময়ে। কিন্তু মা সব জেনেশুনে নির্লজ্জ মেয়েকে পাঠিয়ে দেয় স্বামীর হাত-পা ধরে সব পাপের ক্ষমা চেয়ে নিতে। রুমা সেসব কিছুই করে না। সে সহজ পথ বেছে নিতে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে মরে যায়।
জীবনপ্রবাহে এ ধরনের বিচ্যুতি সত্য। সত্য যা সত্য। এবং সত্য যে দাম্পত্য। নিতান্তই মনের ব্যাপার, যা কখনো সামাজিক নয়, তবে নিশ্চিত মানবিক। যা মানুষের মনের আবহাওয়াসাপেক্ষে।
আমাদের বিচ্ছেদের সেই রাতে। আমি সেদিন একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ কার হাত অনুভব করলাম আমার মাথায়। ভারি কোমল। স্পর্শটা অচেনা ছিল না। তবে তার গভীরতা ছিল বিশাল। আমি মুখ তুলে আর্ত তাকালাম তার দিকে। অশ্রুসিক্ত দুটি চোখ দিয়ে সে আমায় স্নেহ দিল। প্রগাঢ় মায়া দিয়ে বললো, দোলা তুমি আমায় অনেক শিখিয়েছে। আজ আর আমার মধ্যে ক্রোধ-ক্ষোভ নেই। তোমার এই পরিবর্তন আমি গ্রহণ করে, তোমায় মুক্ত করে দিয়ে এলাম আজ। আর নয় এই অস্থিরতা। নয় লুকোচুরি। আমরা শত্রু নয়, বন্ধু। আমরা ভুলে যাবো না। সেই দিন। আমরা অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। যেদিন আমার জীবনটা সহজ করে দিয়েছিল। মনে হলো সেলিমের মতো সবাই যদি বুঝতো! কেন বোঝে না? বুঝলে দাম্পত্যে এত ক্রটি। থাকতো না। রুমা, কলি, অর্চনা, নদী ওরা জীবন রেখে মৃত্যু নিতো না। আজ আমি সুখী পৃথিবীর সব সেলিমদের জন্যে। আর দুঃখী, সব রুমাদের জন্যে।
বিবাহ বড় কঠিন। দুটো মানুষ সম্পূর্ণ দু’রকমের ব্যক্তিত্ব সত্ত্বেও সব বিষয়ে তাদেরকে এক হয়ে দেখতে হয়। দাম্পত্যের কাছে এটা বড় বেশি প্রত্যাশা, যা নিষ্ঠুর। দুরূহ এবং অবাস্তব। দাম্পত্য একটি মঞ্চ, বিবাহ একটি বিষয়। দুটো মানুষ, প্রধান চরিত্রের দুই অভিনেতা, অভিনেত্রী প্রচণ্ড প্রতিকূলতা ছাপিয়ে লুকিয়ে স্নায়ুযুদ্ধ করে যায় সুখের। না পেরে, ভাঙে অঙ্কের পর অঙ্ক, শুধুই ফুরিয়ে যাওয়ার তাগিদে নাটক ফুরোয়।
প্রতিটি হাততালির শেষে –নীরবতা।
প্রতিটি মিলন দৃশ্য–বিষাদের সূচনা।
প্রতিটি সুখ–অসুখের প্রসূতি রচনা হয়।
একদিন –কোনও একদিন এই নাটকের একটি কথাও কেউ আর মনে রাখবে না। কিন্তু নাটকের পর নাটক রচনা হয়। হতেই হয়। এটাই নিয়ম। এবং এজন্যেই আমরা তথাকথিত সামাজিক জীব।
১৭. মধ্য জীবনের সঙ্কট, ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে
১. নিজের সমস্যা অন্যকে বলতে না পারলে কি প্রাণ জুড়োয়! আমরা ফুলের কোমল পাপড়ি। চাই গন্ধ বিলাতে। নিজেদের সমস্যা সবসময় নিজের থাকে না। সঁইসাঁই সীমানা অতিক্রম করে ওরা পৌঁছায় অন্যের সীমানায়। নাগরিক বিশ্বাস ও সংস্কার, সমস্যা ছাড়িয়ে যায় সবরকম সামাজিক বাধ্যবাধকতা। রুচি। আমরা সামাজিক প্রাণী। মানুষকে ঘিরে সৃষ্ট হয় সমাজ আর সভ্যতা। আর মানুষের জন্যে, মানুষকে দিয়ে এবং তার শত্রুও মানুষ। মানুষ একে অপরকে মানিয়ে নিতে পারে না। আবার ছাড়া, চলতেও পারে না। সুখে দুঃখে মন্দে ভালোয় দুধে ভাতে আমাদের একে অন্যের প্রয়োজন হয়। দুটো কথা বলার জন্যে কাউকে চাই। শ্বাসের গন্ধ পেতে-চাই। জানাতে বেঁচে আছি, আমি একা নই। নিঃসঙ্গও নই। আমাদের মানুষ চাই। সে অর্থে নিঃসঙ্গ সন্ন্যাসী, বা নির্ঘাত ব্রহ্মচারী–ওরা মৃত। ওরা নিশ্চিত জীবন্ত। ওরা শ্মশানাচারে অভ্যস্ত। আর আমরা গৃহী। কথায় বলে জীবনটাই ক্রাইসিস। বয়স যত এগিয়ে যায়, সমস্যা তত বড় হয়। আর সবরকমের সমস্যা মানুষকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরতে থাকে। তার কারণ আমরা সামাজিক প্রাণী। সমাজে বাঁচতে হলে সমাজের নিয়ম পালন করতে হয়। এবং এই নিয়মের মধ্যে লুকিয়ে থাকে বাধা-ধরা প্রচুর সমস্যা। ক’জন মানুষ আর সন্ন্যাসীর ধর্মাচারের সৌভাগ্যে মহিমান্বিত হতে পারে যেখানে গৃহ নেই! আমাদের পরিচয় ঘটে তথাকথিত সংসারের সঙ্গে। জন্ম-মৃত্যুর মতো সত্যের সঙ্গে। এখানে ছে দাম্পত্য সন্তান সমাজ কতকিছু! এক সময় সঘন আনন্দ। কখনো দুঃখের সাইক্লোন। তবে সুখের চেয়ে দুঃখই অধিক অনুভূত হয় তার কারণ সংসার করতে করতে যেতে হয় বহু বিরহ বিচ্ছেদ রোগ শোক মৃত্যু দারিদ্র্য অপূর্ণতার মধ্য দিয়ে। সুতরাং সুখ যদিও আসে বা, সে এলেও তা তাৎক্ষণিক। এবং তা যৎসামান্য সময়ের জন্যে। সুখ যেন পাখির মতো ডালে বসতে না বসতে উসখুস্। আপন ডানা মেলে ফুরুৎ। উড়াল আর দুঃখ যেন বিষময় ভারি পাথর অনড়, অটল। বিবাহের কথাই ধরা যাক। এই ঐশ্বর্য মানবজীবনের একটি দারুণ যাচিত সুখের সময়। অথচ বিবাহের উল্লাসটা কত ক্ষীণ! কি ভীষণ সামাজিক! দু’দশ দিনের উৎসব। বছর না যেতেই দায়িত্ব কর্তব্য সংসারের চাপ এসে ঘাড়ে চাপে যখন, শুরু হয় মা মাসিদের পুরোনো অভিযোগ, কলহ। দাম্পত্যে, বাস্তবের অত্যাচারে সুখ গিয়ে ওঠে মাচায় মগডালে। তবে বিবাহ না করে শুধু প্রেমের মধ্যে যদি সম্পর্কটা সীমাবদ্ধ থাকে, তবে সমস্যা নেই। সমস্যা নেই কারণ শুধু প্রেমের সম্পর্ক হলে তাতে দায়িত্ব নেই। এত লুকোছাপি এত সতর্কতা আর ভয়! আর এতসব সঙ্কট বুকে পুষে, বাহ্যিক উল্লাস এবং স্বেচ্ছায় এই দুঃখ ধারণ।
মানুষের সমস্যাগুলো কোনওরকমেই অন্তত দশ হাজার রকমের কম নয়। তার মধ্যে মৃত্যু, রোগ-শোক, দারিদ্র্য, বিচ্ছেদ ইত্যাদি প্রাচীন ও পরিচিত সমস্যা। এবং প্রতিটি সংসারেই এদের অবশ্যম্ভাবী আনাগোনা থাকে। এসব সমস্যায় মানুষ মানুষের জন্যে এগিয়ে আসে। এসব সমস্যায় মুখ ফুটে বলা যায়। চিৎকার করে কাদাও যায়। তবে যে কথা বলা যায় না বা বলা সহজও নয় তাহলে মানুষের ব্যক্তিগত বা একান্ত জীবনের সঙ্কট, যা লজ্জার। যা হলো গিয়ে আসল সমস্যা। এর সবটুকু লিঙ্গজনিত। মধ্যরাতের সঙ্কট। হৃদয় ও অনুভূতিসমেত যা রচিত হতে পারে নারী ও পুরুষের মিলনে, শয্যায়। দোহের একান্ত যৌনজীবন। তার দেবতা। তার মনমানসিকতা। যেখানে শুধু দু’জন নারী-পুরুষই জানে তাদের ব্যর্থতা কিংবা সার্থকতার সংবাদ। কিন্তু তার কাঙ্ক্ষিত স্বর্গেও কখনো কখনো দেখা দেয় অমোঘ সঙ্কট। নৃশংসতা। বিজলীর যৌনজীবনের তাপিত সমস্যা। সর্বনাশের চাষাবাদ। এবং এই সমস্যাগুলোই পরবর্তীকালে ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা অসুস্থতার মূল হয়ে দাঁড়ায়। দুঃসংবাদ যে, আজও পর্যন্ত সতীদাহ–মানসিকতার সমাজে যৌন সমস্যা নিয়ে কথা বলা অশ্লীল। কাম, রতি, লিঙ্গ, যৌনতা বিষয়ক এসব সমস্যাগুলো যদিও মানুষের জীবনের অঙ্গ, কিন্তু ভুক্তভোগীরা এ সমস্যাগুলো বুকেই পুষে থাকতে হচ্ছে, কারণ যৌনজীবন যে একটি সুন্দর শিল্পও এই বোধ আমাদের নেই। বরং একে ঘিরে আছে শ্লীলতার চেয়েও অশ্লীলতা। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য। একথা অবশ্যই বাস্তব যে, যৌনজীবন ব্যক্তির অন্যান্য সুখের মতোই বিনোদন, যা মানুষের বার্ধক্য ঠেকায়, মানুষকে উজ্জীবিত করে। তবে সমাজে এই সত্যের লজ্জা, লজ্জা, যা নিষিদ্ধ। ছিঃ…। বা ছি ছিক্কারে ভরা। অবৈধ প্রণয় হলে হবে তার কঠোর শাস্তি। কখনো দোররা, কখনো মৃত্যুদণ্ড। কেউ কেউ একঘরে। কেউ আমৃত্যু ছেনাল অপবাদ বয়ে বেড়ায়।
ওরা বলে অশ্লীল। ছেনাল। পুরুষ এবং নারী দেহের মিলনের সুখ সত্যই কি ছেনালি বা না? হোক সে ঘরে না হয় চৌকাঠের বাইরে। ক্ষণিক কিন্তু অফুরন্ত যার ঝরনাধারা, উজ্জীবিত করে যায় মন প্রাণ দেহ কল্পনা সব সবকিছু। যা মানুষের মস্তিষ্ক কোষে দেয় তাড়না। বাঁচার জন্যে যা একান্ত প্রয়োজন। তা কি করে ছেনাল? বিছানায় রতি সুখের অনুভূতি বিত্ত দিয়ে মাপা যায় না। এই সুখ প্রকৃতির গভীর থেকে ওঠে আসা। মানব দেহের গভীর, যেখানে সমুদ্র আছে। যে সমুদ্রে মুক্তো আছে। এখানে সবাই সমান। হোক বস্তিবাসী বা প্রাসাদবাসী। মাস্টার বা স্লেইভ। রানী বা গৃহহীন। এবং এখানে সমস্যা হলেই সকলেরই হবে সমূহ গণ্ডগোল। সব উল্টে-পাল্টে যায়। রাজত্ব, রাতের ঘুম, সব যায়।
বিজ্ঞান অনুযায়ী যৌনজীবনে বহুরকমের সমস্যা হয়। হতেই পারে। এবং এই সমস্যার জানলা খুলে দিলে কেন যে এখানে অশ্লীলতা কাজ করবে তা আমার জানা নয়। কেনই-বা তা নিষিদ্ধ জানা নয়! পিন আপ, কেন? কোন হিসেবে। তার কিছুই আমার জানা নয়। কারণ আমি বুঝি যে প্রক্রিয়া ছাড়া সন্তান সৃষ্টি হয় না, সেই প্রক্রিয়ার কোনও কিছুই নিষিদ্ধ, লজ্জা বা অশ্লীল হতে পারে না। সন্তান সৃষ্টির পূর্বশর্ত দোহের যোনি আর লিঙ্গের, স্নায়ুভিত্তিক সুখ ও পেষণের শারীরিক আনন্দ। ”ক্ষণিক তবে সুদূর প্রভাবিত।” পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই তাদের বাবা ও মায়ের কামের চিহ্ন শরীরে বয়ে বেড়ায়। অর্থাৎ জন ডো বা রাইসু সেই ব্যক্তি যার বাবা এবং মা লিঙ্গ আর যোনিতে মিলে তাকে সৃষ্টি করেছে। এমন স্বর্গীয়, এমন সত্য, তা কি করে অশ্লীল?
যেখানে সমস্যা এত গভীর, নিত্যদিনের, এত সর্বজনীন, এতই মানবিক সেখানে লুকোবার কী আছে? যৌনজীবনের বিবিধ সমস্যার মধ্যে কেউ নপুংসক, কেউ বিকারগ্রস্ত, কেউ সমকামী আবার কেউ উভকামী, কেউ বিপত্নীক, কেউ কেউ আজীবন অবিবাহিত, যাদের মুক্ত বিহঙ্গের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কারো সঙ্গী বা সঙ্গিনী দীর্ঘ বছর ধরে দূরে দূরে। এখন কারো মধ্যে যৌবন, কেউ বার্ধক্যে। সমস্যা অন্তহীন সব বয়সেই সব জীবনেই। বার্ধক্যেও যা মরে যায় না। কম বেশি থাকেই। নিভু নিভু বাতির মতো। তবে মধ্য বয়সের নারী উত্তাল তার মেনোপজের আগে আগে। আর ষাটের শুরুতে পুরুষ উত্তাল তার শিথিল শরীর ও বীর্যে ঘাটতি পড়ার আগে।
বয়স হরমোন ব্যক্তিত্ব এবং রুচির প্রভাবে পরিবর্তন হয় সময়ের দু’হাত ধরে। অতৃপ্ততা নাকি অনিচ্ছা! দাম্পত্য বাদ দিয়ে পরকীয়া। শীতল শিথিল অথবা অসুস্থ লিঙ্গ বা যোনি। অভ্যস্ত শরীর। অগণিত জানা-অজানা কারণে ব্যক্তির যৌনজীবন হতে পারে দুস্থ। এবং এই দুস্থতা প্রভাবিত করতে পারে জীবনের অন্যান্য অনেক কিছু। এমন কি বিবাহ। সমস্যা থেকে বিচ্ছেদ। সুতরাং এই সমস্যা ফেলনা নয়। অশ্লীলও নয়।
মানুষের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো যা এত গভীর তা আর রাখঢাক নয়। হোক তা বসার ঘরে, সিনেমা দেখতে দেখতে পরিবারের সবাই মিলে অন্যান্য যে-কোনও আলোচনার মতো।
.
২. ব্যর্থ যৌনজীবনের সদস্য সংখ্যা কত? দুস্থ যৌনজীবন! বার্ধক্যে বিপত্নীক যারা! মধ্য বয়সে হরমোনের তাণ্ডবে দিশেহারা যারা। বিকারগ্রস্ত কিংবা অকেজো যৌনাঙ্গ। দাম্পত্যে অরুচি বা অভ্যস্ত ছেড়ে, অনভ্যস্ত শরীরের প্রতি তীব্র আকর্ষণ।
বিকার বা দুস্থ বা নিঃসঙ্গ বা বদলে যাওয়া যৌনজীবনের রাক্ষুসীতরঙ্গ একটি সুস্থ জীবনকে সম্পূর্ণ অকেজো করে দিতে পারে। বাইরে থেকে বোঝা যাবে না। কিন্তু তার অন্তরে যে অন্ধকার তাকে ক্রমাগত গ্রাস করে চলেছে, বিছানায় তার এই দুস্থতা? সে। খবর ক’জন রাখে!
একজন বিধবা বা বিপত্নীকের স্নায়ু যন্ত্রণা, কে জানে! এক নপুংশকের স্নায়ুযুদ্ধ কে বোঝে! অসমমনা দাম্পত্যে মনের আদান-প্রদানের শূন্য সাদা খাতা কে খুলে দেখে! কে বোঝে এর নিরন্তর দুঃখ বহতা! ভগ্ন হৃদয়! ভীষণ ভারি! ক’জন জানে, জানতে চায়, যে, মন না হলে জোর করে প্রেম হয় না। প্রেম, যা না হলে শরীর জাগে না! ফোটে না বসন্ত শরীর যেভাবে ফোঁটা উচিত! না বলুক মুখে, কিন্তু যুদ্ধ, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কার নেই! নিজের হলে কিছু না। সমস্যা, অন্যের বেলায়। সংসারে সুখীদের সদস্য সংখ্যা কত?
নিজের তৃপ্তি-অতৃপ্তির কথা কি মুখ ফুটে এত বলা যায়। কখনো কখনো যায়। যায়। তবে একসঙ্গে হলে যায়। নিশ্চিত যায়। কারণ অনেকের সমস্যা তখন নিজের মনে হয়। নিজেরটা অন্যের। সমস্যাগুলো সার্বিকভাবে আলোচনার গ্রহণযোগ্যতা পায়। সহজ-সরল-সুন্দর পানীয় যেমন।
আমাদের ব্যক্তিগত সমস্যা, অন্তহীন। শুধু কি বুক? মুখ ও ফোটে যদি ফোঁটানো যায়। ফুটতে দেয়া যায়। আমাদের মূল সমস্যা যে আমরা, শ্লীলতায় অন্ধাবদ্ধ হয়ে গেছি। শ্লীলতা গ্রাস করেছে আমাদের মানবিকতা। বোধ। বলতে না পারার যন্ত্রণায় দগ্ধ হওয়া। শ্লীলতায় আবদ্ধ আমরা, অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয়ভাবে সামাজিক। সামাজিক ধর্মবোধ। যা অমানবিক ধর্মান্ধতা। অবিচার।
আজ প্রয়োজন আমাদের এই জটিল জীবনকে, সমাজের বাধ্যবাধকতার ওপর আর না জড়িয়ে একে বিজ্ঞান ও শিল্পসম্মত হিসেবে আখ্যায়িত করে তুলে একে মানবিক রূপ দেয়া। আর কিছু না হোক, কিছুই না থাক শুধু বলতে পারার মধ্যে যে প্রশান্তিটুকু তা ক্ষুদ্র সূক্ষ্ম হলেও মনের চাপা নর্দমায় নিশ্চিত কিছু মুক্ত বাতাস এনে দিতে পারে। এক টুকরো রুদ্ধশ্বাস থেকে মুক্তি! আহা! আহ! এই কি! সে প্রশান্তি! সে বোঝে সেই বোঝে, এই নিরাময়।
.
৩. যৌনজীবনে ব্যাঘাত ঘটলে কিংবা সমস্যা হলে মানুষ ক্রমশ উত্তাল হয়ে যায়। বিবেচকেরা বিবেচনাহীন হয়। বয়স্করা, শিশু হতে থাকে। সমস্যা হলে কিশোর, বয়স্ক হয়। পিতৃ এবং মাতৃত্ব তুচ্ছ হয় বা বুঝ অবুঝ হয়। কতরকমের বিকল্প খুঁজে নেয় বিপত্নীক বৃদ্ধ বা যারা যৌবনে বিধবা। বা মধ্য বয়সে পরকীয়ায় আক্রান্ত রমণী। আবার কেউ কেউ নীরবে ভুলে যেতে থাকে।
আমার মার মুখে শোনা। সব বারো বছর বয়সের নিচে বা ওপরে, বিদ্যাসাগরের যে-কোনও বিধবা পিসিরা, অন্তত বারোবার গর্ভপাত ঘটাতেন। কেন এরকম হয়? কত উদাহরণ? পাশে জলজ্যান্ত রূপসী বৌ রেখে হিরু প্রতিদিন যেত কুৎসিত শেলীর কাছে। ওরা মাগ ভাতারে। বিপত্নীক ফারুক ভাই শুধু গার্লফ্রেন্ড খুঁজে বেড়ান আর একে ওকে বিরক্ত করে। ছেলেদের হাতে মার খাওয়ার আগেই চুপে চুপে কাজ সেরে ফেলে বিপত্নীক চর্চা, কাজের মেয়ে রোকেয়ার সঙ্গে। রোকেয়া, মেয়ের বয়সী। ফিরোজ, ঘরে বৌ রেখে হস্তমৈথুনে অধিক তৃপ্ত। শামীমও। রিতাও। কালামের মায়ের বয়সী নারী না হলে রোচে না। শিল্পী, রুবেলের মধ্যে আজীবন রবীন্দ্রনাথ দেখলো। আর শেতুলী দেখলো, কবি নজরুল। সত্য হলো না তাই –ভগ্নহৃদয়ে ফিরে গেল। প্রবাসী রুমার আর আনস্মার্ট বঙ্গপুরুষ ভালো লাগে না। বিধ্বস্ত যৌনজীবনের সেলিমা, মাঝ বয়সে এসে প্রথম আবিষ্কার করলো, সে বাইসেক্সয়াল। সলিল ইচ্ছা করেই ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়, গাউছিয়া মার্কেটে মেয়েদর স্তন আর যোনি পিষতে। প্রদীপ, কামনা করে সন্তানসমেত কিশোরীকে। সাইফুল চায় একসঙ্গে একাধিক শরীর। সেজন্যে সে অনেক টাকা খরচা করে। তার আনন্দ, শৃঙ্গারের দৃশ্য। রচনার চাই একসঙ্গে একাধিক পুরুষ। বৃদ্ধ বয়সেও চার্লি সেক্সের চেয়েও সেক্সের দৃশ্য উপভোগ করে। চার্লির ঘরে ব্লু ফিল্মে ঠাসা। পর্নো ম্যাগাজিন। প্রতি সপ্তাহে ন্যুডবার। আর সমীর সারাদিন বাসে চড়ে বেড়ায়। মেয়েদের স্তন পিষতে পিষতে সে সিট বদলায়। আর ইচ্ছে করে ভিড়ের মধ্যে বাদুর ঝুলতে ঝুলতে লিঙ্গটা ঠেকিয়ে রাখে ভদ্রমহিলার অকুস্থলের সই সই। এরিক গার্সিয়ার প্লাস্টিকের নারী না হলে হয় না। মানেকার, প্লাস্টিক পুরুষ। মুনির চাচা তার ষাটের শুরুতে দারুণ উত্তাল। সে ওরাল ছাড়া কিছু বুঝতে চায় না। নাম্বার ৬৯’ তার নেশা। মিসেস সেন তার ষাটের শুরুতেও উত্তাল। তিনি শুষ্কতার কারণে বিদেশ-দেশে ভালো ভালো দামি ক্রিম, পিচ্ছিল, আনিয়ে রাখেন। একাধিক স্ত্রীর সঙ্গে কাম, হস্ত মৈথুন, বেশ্যাবাড়ি, সত্ত্বেও সালামতের যথেষ্ট হলো না।
এর কোনটা বিকার বা অশ্লীল জানা নেই। তবে সমস্যাগুলো নিঃসন্দেহে সামাজিক। এবং সামাজিক সাপেক্ষে, অসামাজিক(!) হলেও যা, –মানবিক।
১৮. কত অজানারে!
দুঃখ-সুখ
সংসারী মানুষের সুখ-দুঃখ থাকবেই। আর তা নির্ভর করে চাহিদার ওপর। সন্ন্যাসীদের ওসব বানানো বালাই নেই কারণ ওদের দাম্পত্য নেই। গৃহীর আছে। গৃহীর জীবনে, হয় দুঃখ, না হয় সুখের। এই করে করে শেষে পরমায়ু ভেসে যায় স্রোতের মতন। আর এই পরমায়ু কিছু আঁচলের তলে না কিছুর প্রভাবে, গৃহীর দুঃখ সুখ আমৃতুও প্রভাবিত হয়। এবং প্রভাবিত করেও। এবং তার মানে খুঁজে কোনদিনও পাওয়া যায় না। মানুষ তার আগেই মরে যায়। তবে বেঁচে থাকা অবস্থায়। মানুষের জীবনে সঙ্কটের কোনও শেষ নেই। তবে সমাধান, সুখ, ভালোলাগা সমস্ত কিছুর শেষ আছে এবং এরা উল্কার মতন। এই আছে এই নেই। সুখ! মনে করতে হয়। কতক্ষণ! স্মৃতিতে জেগে থাকে। অতিথির মতো, ওহ! এসেছিলেন। তিনি এসেছেন! বেশ তবে।
আমি সর্বাণী রায়। ব্যর্থ দাম্পত্য শেষে আজ বিধবা। অলস দুপুরে হা-হুঁতোশ বসে আজ অতীত সুখের মুহূর্তগুলো আমিও স্মরণ করছি। হ্যাঁ, তিনি এসেছিলেন। নিশ্চয়ই এসেছিলেন তিনি! তবে এসে বিশেষ বসেননি। এতই দেমাকি তিনি যে এসেই চলে যেতেন। অহঙ্কারী অধ্যাপিকা শাশুড়িসমেত। ভীষণ দেমাকি আর অস্থির প্রকৃতির। জোয়ারের চেয়েও, ঘূর্ণির চেয়েও, বিদ্যুৎচমকের চেয়েও দ্রুত। তিনি কমেট। একশ’ বছরে একবার উদয় হন। অস্ত যাওয়ার আগে দান করে যান প্রচণ্ড স্বর্গীয় আলো। দুধে ধোয়া চৈত্রের খাঁ-খাঁ রোদ্দুরের আলো। …তখন আমার সমস্ত পৃথিবীটা পাল্টে যেতো। তখন আমি স্পষ্ট দেখতে পেতাম আমার মস্তিষ্কের ভেতরে স্নায়ুস্থল যা আমার সহসা চঞ্চল অন্ধকার মনটাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এবং সেই আলোর স্মৃতি মনে করে আমি আজও স্পষ্ট দেখতে পাই সেই স্বর্গ, আমার স্বর্গীয় অনুভূতি। তখন আমার কাউকে ভালো লাগে না আর। সুখ এমনই। জ্যোৎস্নার আলপনায় বোয়া আলো। নীরবে চলে যায়। এবং আমি এই তাৎক্ষণিক সুখে আরও অধিক বিভ্রান্ত হই। ভাবি এইতো সে। এই তো। আমি ভুল বুঝি। ভাবি তিনি চলে যাবেন না। কিছুতেই না। কারণ তিনি আমার জন্যেই এসেছেন। তিনি থাকবেন। এই সঘন সুন্দর শ্যামলিমায় মহিমান্বিত তিনি কখনোই আর যাবেন না। কিন্তু…চলে যান। তিনি চলে যান। চাঁদের আলোর মতোই তিনিও, ধরা দিয়েও না দিয়ে সব নিয়ে নিভে যান। তবুও, আবার উদয় হবেন এই আশায় মানুষ অপেক্ষায় রয়। আমি এস রায়। আমিও, সেই আশাতেই, হাঁ-মুখো বসে রই।
তিনি যান অসুখী মানুষদের ঘরে ঘরে তার যেখানে কর্মব্যস্ততা। বিশেষ করে পৃথিবীতে ধর্ম আসার লগ্ন থেকে। নেই বলেই তো তাকে পাওয়ার এমন তীব্রতা। থাকলে হতো না। এই কান্না! আহা! বটে! তিনি এলেন তবে? এলেন যদি, তবে কেন। তিনি এমন ক্ষণজীবী!
যা যাচিত, যাহা কাম্য, পৃথিবীতে সেই-ই হয় ক্ষণজীবী। যা চাই না, তা লেগে থাকে যার প্রয়োজন নেই, সেই-ই চোখের সামনে। যাহা চাই তাহা পাই না। সুখ তাদেরই একজন। সুখ! আছে বলে কোনও কথা নেই। ছিল, সেই-ই স্মৃতি। সেই সুখের স্মৃতি আগলে থাকা। অনুভবে তাকে পাওয়া। এইটুকুর নামই সুখ।
স্বামী স্ত্রী সন্তান নিয়ে গড়ে ওঠে একটি পরিবার। জীবিত অবস্থায় একজনের বিরুদ্ধে অন্যের সর্বক্ষণ অভিযোগ। কিন্তু হঠাৎ একজন ইহজগৎ ছেড়ে চলে গেলে সেখানে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, সকল কষ্ট উপেক্ষা করে বড় হয়ে দেখা দেয় তখন তার অতীতের যা কিছু সুখ। তার সঙ্গে কিঞ্চিৎ মধুর স্মৃতি বড় হয়ে দাঁড়ায়। সব মন্দ তুলে রেখে ভালো। সুখ অতীতের। যখন তিনি বেঁচে ছিলেন। মনে হবে মাতালটা যখন বেঁচে ছিল তখন তার উপস্থিতি সহসাই এনে দিতো অভিযোগ আর কলহ। আর তার মৃত্যুর পর সব ছাপিয়ে শুধু তার বেঁচে থাকার মধুর স্মৃতিই সবচেয়ে বড় উপলব্ধি হয়ে দাঁড়ায়। মনে হয়, না হয়, পেটাতো! না হয় মদ খেয়ে গভীর রাতে এসে ছিন্নভিন্ন করতে শরীর। ক্রোধে আক্রোশে ঘৃণায় না হয় ফালাফালা করতো এই না খাওয়া দুর্বল দেহটুকু। তবুও তো মাতালটা বেঁচে ছিল! দিন শেষে বাড়ি ফিরে এই যে পেটাতো, তবুও তো চিৎকার করে জানাতাম বেঁচে আছি। আর আজ এই নিঃসঙ্গতার উপকূলে এত নির্জনতা মনে হয়, মৃত্যু। কাঁদি মনে করে। তখন বাবা বেঁচে। ভাইবোন সব এক ঘরে, এক সঙ্গে বড় হচ্ছি। মার মাথা ভর্তি কালো চুল। ভরা যৌবন তার। ক’টি শিশু আমরা হাঁসের মতো কৌতূহলে চষে বেড়াই পুকুর পাড় থেকে সি এন্ড বি রাস্তার ওপাশে কাঁচা ট্যানারির দুর্গন্ধ ঘরে। কাঁদি কৈশোরবেলার সুখে। মনে হয় বিয়ের রাত্রির কথা। চিত্ত উথলে ওঠে সুখে। বাসর রাতের স্মৃতি যখন তিনি বলেছিলেন আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছে! তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি এক ভীত মেষশাবকের মতো, স্তব্ধ। মনে আছে তিনি হেসে, আমাকে তার বুকে অনেক্ষেণ চেপে ধরে বসে বসে কি যেন সব বলছিলেন। আর আমি ক্রমশ শীতল থেকে তাপিত আগুন হচ্ছিলাম। তারপরই সব উধাও। কি যেন হলো। তিনি চলে গেলেন চিরদিনের জন্যে। আমি নিরন্তর একা! সুখের মুহূর্তগুলো এমনই ক্ষণিক হলো। এমনই অপার্থিব। নশ্বর।
সুখ শুধু সময়ের গায়ে তীব্র আঁচড় কেটে রক্তাক্ত করে চলে যায়। আর সেই ক্ষত আগলে বসে আমরা বাকি জীবন সুখের আক্ষেপ করে করে শুধুই দুঃখ পোহাই। জীবটা শুধু দুঃখসার।
সুখের সীমানা যদি হয় পুকুরের তল, দুঃখ তবে অতল সমুদ্র। সুখ যদি হয় জলাশয় হঠাৎ বৃষ্টি, দুঃখ তবে বৃষ্টির অভাবে তাপিত স্থবির জলাশয়।
কৈশোর ও যৌবনের কত অজানা
কিছু কিছু বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া, কৈশোর বা যৌবনের প্রারম্ভে মনে যে বসন্তের আঁচড় লাগে তাকে বড়ই স্থায়ী বলে ভাব হয়। জীবন মুহুর্মুহু রঙ বদলায়। নীল-হলুদ-খয়েরি। কৈশোর ও তারুণ্যের শরীরে বসন্ত খুঁজে পায় তার নিকেতন। এই বসন্তের রঙ সবুজ, লাল, নীল, কমলা।…মন হয় রঙধনু। প্রিয়ার কণ্ঠের সাতনরী। বা কমলার কোয়ার মতো তার ঠাসা পুরু এক জোড়া অর্ধচন্দ্র ঠোঁট। এই তো কৈশোর। এর মানেই কণ্ঠস্বর ভাঙা। মানেই বয়োসন্ধির আয়োজন। স্বপ্নে জাগরণে রতি সুখ। কিশোরের ঠোঁটে গোফের রেখা। কিশোরীর বক্ষে এক জোড়া পর্বত চূড়ার আগাম আবছা আভা। কিংবা নাইকুন্ডুলীর নিচের অমসৃণ উপত্যকায় মাতৃত্বের ফাটলে মাসিক শিশুর লাল রঙের চিৎকার। শরীরে ইলেকট্রিক শকের মতো সুখ যন্ত্রণা যা মাথা থেকে পা অবধি কালো পশমাবৃত উপকূল বেয়ে নেমে যায় কত রিক্টার স্কেলে কে জানে! ভেজে নিম্নভূমি। ভেজে পুরুষ। ভেজে নারী। সব ভালো। সব ভালো লাগে। তখন সবকিছুই ভালো লাগে যখন স্বপ্নসুখে আমূল উত্তাল হয় পুরুষ, হয় নারী। এই মধুক্ষণে মনে হবে পৃথিবীর সব অন্যায় ক্ষমার যোগ্য। মানুষই দেবতা। সব মানুষ, দেবতা। মনে হবে পৃথিবীর সব সুখ শুধু শরীরভিত্তিক।
অবৈধ কাম
নিষিদ্ধ বলে যা অশ্লীল। অবৈধ বলে যা লোভনীয়। অবৈধ কাম! যদিও সামাজিক নয় কিন্তু সুখের তাড়না রতির তাড়নাকেও ছাড়িয়ে যায়। ফলে রতির সুখ সম্পূরক হয়ে দাঁড়ায় অন্য অন্য সার্বিক সুখভোগের। কিসের বৈধতা! রতির তাড়না মানে কী, কোনও বৈধ-অবৈধতা? এই সুখের পেছনে শুধু সুখানুভূতি ছাড়া চাওয়া-পাওয়া নেই বলে সুখের স্থায়িত্ব প্রগাঢ়। কিন্তু যখনই রতি সুখকে বৈধতা দিতে বিবাহ বন্ধনে তাকে আবদ্ধ করা হয়, চাওয়া-পাওয়া তখন রতি সুখের চেয়েও অন্যদিকে প্রাণ পায়। দাম্পত্যের সুখ, ক্ষণজীবী। এখানে থাকে সংসার সন্তান সমাজ ও সংস্কার। এই চার স’ মিলে ক্রমাগত। উৎপাটন করতে থাকে সুখের সকল চাষাবাদ।
আমি সর্বাণী রায়
প্রেমের বিষয়ে পৃথিবীতে অবৈধতার প্রশ্ন, প্রশ্নই থেকে যাক। কেননা প্রেমের বৈধতা নিয়ে বিতর্ক আমার সাধ্যে সাহসে কুলোবে না। আমি সর্বাণী রায়। প্রেম আমি খুব ভালো করে চিনি। কারণ আমি প্রেম করেছি। একাধিকবার। একাধিক জন। তার মানে একাধিক ব্যক্তিত্ব আমায় প্রেমের অনুভূতি দিয়েছেন। সে অর্থে আমার অভিজ্ঞতা ফেলনা নয়। প্রেমের অনুভূতি দিয়েছেন। সে অর্থে আমার অভিজ্ঞতা ফেলনা নয়। প্রেমের ব্যাপারে প্রতিটি ব্যক্তিত্ব আসে যার যার নিজস্বতা নিয়ে। প্রেমে, একেকজনের চাওয়া, প্রকাশ, রুচি, অভ্যেস, সংস্কার ভিন্ন যেমন কোনও কোনও মানুষের কাছে প্রেমের অনুভূতিই সব। কেউ, শরীর। কারো শরীরই সব, কারো অনুভব। কারো দুটোই আবার কেউ প্রেমই বোঝে না। কেউ বোঝে স্বর্গীয় আলোকে। কেউ কেউ হতাশায় শুধু রিক্ত ও ক্লান্ত হতে হতে। এবং এও সত্য যে-যে-কোনও প্রেম, ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে। বৈধ-অবৈধতার বিতর্কের ঊর্ধ্বে। পরকীয়া, সেও প্রেম। প্রকৃত প্রেম। হৃদয়ে নব-যৌবন। স্বামী-স্ত্রী, সেও। লেসবিয়ান হোমো বাইসেক্যুয়াল ওরাও প্রেম করে।
প্রেম অনন্য। প্রেম ছাড়া মানুষ বাঁচে না। যে বেঁচে আছে, সে সত্যিই বেঁচে নেই। সে অন্ধকার। নিয়তই মানসিক ও শারীরিক নিষ্ঠুরতার চাবুকে বিধ্বস্ত। সে নিয়ত মরে যেতে চায়।
মানুষের বিচিত্র জীবনে বিচিত্র সব ঘটনা ঘটে। আমি সর্বাণী। আকাল বিধবা। তবে এখন অবৈধ প্রণয়। পরকীয়া কি আমি তা বুঝি না। এই মুহূর্তে বুঝতে চাইও না। বুঝি, প্রেম। বুঝি প্রেম বদলে যায়। এক মানুষ থেকে, অন্য মানুষে। এক দেহ থেকে অন্য দেহে। যেতেই পারে। কারণ বিষয়টা বহুমাত্রিক। আমরা ক’জন জানি যে প্রেমের রয়েছে নিজস্বতা, যা মানুষের নিজস্বতার উর্ধ্বে। সুতরাং সমাজ, পরকীয়া বলে যাকে সহজেই ভুল বোঝে, বুঝে তাকে কঠোর সব প্রাচীন অবাস্তব শাস্তির কাছে আজও হেনস্তা করে, বাস্তবে তা প্রমাণ করে কতিপয় ব্যক্তি –তাদের বীর্য ও সমাজে, বুদ্ধির নিরক্ষরতা।
প্রেম পাল্টায়। তার মানেই পরকীয়া নয়। স্রেফ প্রণয়। সে অর্থে পরকীয়া আসলেই পরকীয়া নয়। বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী পরবর্তীকালে অধিকাংশ সময়েই তারা শরীর, যা মিটে গেছে। তা সত্ত্বেও দাম্পত্যের সীমানা। এর বাইরে গেলেই অবৈধ। এবং যে প্রেম শুকিয়ে যায়, সঙ্কটে, বিচ্যুত বিধ্বস্ত দাম্পত্য সে, বিকল্প খুঁজে নেয় অন্য মানুষে, অন্য শরীরে, যেখানে প্রেম আছে। শরীরের প্রকৃত সুখ আছে। আছে দুস্থ রতি ও কামনার স্থলে, স্বর্গময় সুখভোগ। যা থেকে শরীরসর্বস্ব প্রেমবিহীন স্বামী-স্ত্রী বিচ্যুত বহুদিন। সংস্কার চৌকাঠ পেরোলে তা, অবৈধ কেন হবে?.খুব সঙ্গতভাবেই প্রেম শুকিয়ে গেলে, পরকীয়ার প্রশ্ন আসে। সমাজের অন্যদের মতেই এটাও জীবনের অঙ্গ। না চাইলেও বেঁচে থাকার অন্যতম উপাদান। অনেকের জন্যে পরকীয়াই একমাত্র উপাদান। কারণ, ঘরে ঘুণধরা দুটি সম্পর্ক যা শুধু দুটি, থাম।
প্রেম শুকিয়ে যায় কেন তার কি কোনও হিসেব আছে? সমমনা না হলে শরীর কদিন ধরে রাখবে দুটো উল্টো মনের মানুষ! পা যায় তখন ঘরের বাইরে। হাত বাড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয় নিষিদ্ধ ফুল। সেই দুর্গন্ধ ব্লাউজ সেই বিবর্ণ পেটিকোট যার গন্ধে, পেট উগরে বমি আসে। সেই অমসৃণ উপত্যকা যার চামড়ায় নাক ঘষলে নাকে উঠে আসে তীব্র গন্ধ, যা মোটেও পরিচ্ছন্ন নয়। অথচ ঘরে পরিচ্ছন্নতা রেখে অপরিচ্ছন্ন নিষিদ্ধ পরিবেশে পতিতার আড্ডা তার শরীর সমাজের সব কঠিন প্রশ্ন, প্রশ্ন এড়িয়ে সত্য হয়ে দাঁড়ায়। কিসের এত প্রশ্ন যখন নারী তার পুরুষের পুরুষ বৃন্তের শৈথিল্যে মানসিক যুদ্ধে পরাস্ত। যখন সে মাসের পর মাস অনুপস্থিত। স্বামী যখন প্রবাসে। স্ত্রী যখন প্রবাসে। যখন ঘরের চেয়ে সুখ টানে পতিতালয়! স্ত্রী নয়। যখন পতিতাই উজ্জীবিত করে তার প্রয়োজনীয় সৃষ্টিশীল মনমানসিকতা! যখন পরকীয়ার তীব্রতা বৈবাহিক বন্ধনকে ছাড়িয়ে যায়। যখন তার নিষ্ঠুরতা, অমনোযোগ, আকর্ষণ করে অন্য প্রেম। যখন তার হাতের তলে সে ফোটে না বসন্ত মহিমায়! অসম মনমানসিকতা যখন দু’জনের মধ্যে ফুটে বের হয়, দূরত্বে। যখন দূরত্ব এত দীর্ঘ হয়, যা অতিক্রম করে দু’জনে আর পৌঁছতে পারে না দু’জনের কাছাকাছি তখন, যখন একটি ছোট বিছানায় পিঠ ফিরিয়ে শোয় দু’জন মানুষের মধ্যেকার দু’হাত ফাঁকে, অনন্ত ফাঁক! হাহাকার। হাজার হাজার মাইল ফাঁক। যখন তার তারুণ্য তুঙ্গে। আর অপরপক্ষ শীতল। যখন সে কণিকায়, মল্লিকা দেখে। সে দেখে অরূপে, শিশির। যখন দোহের মিলনে সৃষ্ট সন্তান সংসার দশ বছরশেষে তাকেই হঠাৎ মনে হবে আগন্তুক, এবং পরম তিতিক্ষার আবেগ প্রেম মাধুর্য বসন্ত, নতুন করে মেলে দেবে তার কুঁড়ি, খুঁজে নেবে প্রেমের প্রকৃত সম্ভার, অন্যজনে! যা নতুন! যা যাচিত! যা স্বর্গীয়! যা জীবনে কখনো এর আগে ঘটেনি বা এমন সৌরভে, মহিমায় ফেটেনি!
মধ্য বয়সের নিঃসঙ্গতা
যখন অপরপক্ষ মারা যায় বা চলে যায়, বিচ্ছেদ রচনা করে! যখন সমাজ ও ব্যক্তি দুটি প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় নৈতিক ও মানসিক প্রশ্নে! যখন সত্মা বা সৎপিতা কিংবা গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড ইত্যাদি জাতীয় সম্পর্ক কোনওরকমেই সন্তানের হৃদয়ে গ্রহণযোগ্য নয়, তখন! কিংবা কন্যার বিবাহ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় অমন দ্বিতীয়বার বিবাহিত নষ্ট বিধবা মায়ের চরিত্রের কারণে!
মধ্য বয়সে, বা যে-কোনও বয়সে, যে-কোনও কারণে মানুষ একা হয়ে গেলে, সমাজ সন্তান সংসার ও সংস্কার যখন তাকে সেই অবস্থাতেই বিশুদ্ধ বিধবা নারী বা বিপত্নীক পুরুষ দেখতেই অধিক উদ্গ্রীব থাকে তখন ব্যক্তির জীবনে নিঃসঙ্গতায় যে মৃত্যুর চেয়েও অধিক নিষ্ঠুর অন্ধকার নেমে আসে, এবং সেই অন্ধকার থেকে সৃষ্ট হতাশায় আসল মৃত্যুর প্রত্যাশা, সেই কি ভালো?
তার পাঁজরের তলে রুদ্ধ হয়ে আসা শ্বাস, রাতের অন্ধকারে তার স্নায়ুযুদ্ধ, নিঃসঙ্গতায় ভেঙে আসা বুকে, সঙ্গী বা সঙ্গিনীর স্পর্শ প্রেম আদর ভালোবাসাহীনতায় সৃষ্ট মানসিক শুষ্কতা, প্রত্যহ হারিয়ে যেতে থাকা মানসিক উজ্জীবন! তার প্রতিদিন! তার নিষ্ঠুর রাত্রি! সৃষ্টিশীলতা!
একটি হাতের ছোঁয়া! একটু ছোঁয়া। পাশে এসে বসা। শরীরে স্নেহের আঙুল। তৃষিত, এক জোড়া ঠোঁটের কি করুণ সুধাপান পিঠে হাত রেখে, পায়ে পা ঘষে। মনন্তরের ক্ষুধায় কাঙাল শরীরের, কি নিবিড় বিনিময়!
কোনটি ভালো? নিঃসঙ্গতা ক্যান্সারের চেয়েও কঠিন ব্যামো। দীর্ঘ-দীর্ঘ দিন বিধবা বা বিপত্নীকদের দ্রুত মানসিক ভারসাম্যহীনতার পরিসংখ্যান সে কথাই কি প্রমাণ করে ছাড়েনি? কেন জানবো না যে পঁয়ত্রিশের পর যে-কোনও নারী, বা পঁয়তাল্লিশের পর যে-কোনও পুরুষ মানসিক ভারসাম্যহীনতার মুখোমুখি দাঁড়ায়! জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় ইতোমধ্যেই চলে গেছে। নতুন করে দেখার পাওয়ার চাওয়ার কিছু নেই। জীবনের রঙ সব জলে গেছে। জীবনের সুখ সব ঝরে গেছে। ফিকে আকাশ। সমুখে তাকিয়ে শুধুই পড়ন্তবেলার সূর্য ছাড়া কিছু নেই। আর নতুন কোনও ভোর হবে না এই বয়সের পর। যা হবে তা অস্ত। এবং এর সঙ্গে যখন জমা হয়, মধ্য বয়সের নিঃসঙ্গতা সেখানোই সমূহ সর্বনাশ। মধ্য বয়সের মন এবং শরীর যখন নদীর টলটলে জল, যখন জলের উৎস সরোবর থেকে সৃষ্ট ঝরনাধারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। তখন সে নদীর কি দশা?
বার্ধক্যে নিঃসঙ্গতা
মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর। অন্ধকার আকাশের চেয়েও, কালো। বার্ধক্যে যারা বিধবা বা বিপত্নীক তাদের নিঃসঙ্গতার কষ্ট যৌবনের নিঃসঙ্গতার চেয়ে আরো গভীর কালো। এবং শুধু সেই বোঝে, যার এ দশা হয়। বার্ধক্যে একটা সঙ্গীর প্রত্যাশা সবকিছু ছাড়িয়ে যায়। একজন কথা বলার সঙ্গীর বিকল্প নেই তাকে ডাক্তার, ওষুধ কাউন্সিলিং থেকে দূরে রাখতে। একজন রক্তমাংস, যৌবনে তাকে যত নয় প্রয়োজন তার উপস্থিতি, বার্ধক্যে যা লক্ষগুণ অধিক যাচিত।
কর্মবিহীন জীবন যখন সঙ্গীবিহীনতার সঙ্গে যুক্ত হয় তখন সে ঘোলা নরকের মুখোমুখি। জীবন তখন বোঝ। তার বেঁচে না থাকা, সমান। বেঁচে থাকাটাই অপচয়। ঈশ্বরকে সে মাথা কুটতে কুটতে দোষ দিয়ে বলবে কেন সে বেঁচে আছে! কেন? কি পাপ করেছে সে! মনে হবে। বোঝ। সার্বক্ষণিক পাথরের পাহাড়, পাহাড়, পাঁজরের তলায় চেপে বসে শুধু কষ্টই দেয়। যার তলায় চাপা পড়ে থাকে, রুদ্ধশ্বাস। কখনো যা পুরোপুরি বের হয় না, মনে হয় কে যেন তার গলা টিপে তাকে চব্বিশ ঘণ্টাই শুধু কষ্ট দিচ্ছে। তার কষ্ট হয় হাঁটতে, বসতে, শুতে, খেতে, বলতে, নিশ্বাসে, প্রশ্বাসে…।
যদি কেউ ভুল করেও ভাবে বার্ধক্যে, পুনর্বিবাহ বা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা অসামাজিক এবং নিন্দনীয়, তবে সে জীবন সম্পর্কে কিছুই জানে না। বরং বার্ধক্যে বিধবা ও বিপত্নীক হয়ে দ্রুত তাদের পুনর্বিবাহ বা স্থায়ী বন্ধুত্ব, যৌবনের কারণের চেয়ে এতটুকুও কম নয়, যখন মানুষ পরনির্ভরশীল। প্রায় বৃদ্ধ। এবং অপরের বিরক্তি। সেই বোঝা বিরক্তির জন্যে তাকে চাই যে নিজেও অন্যের বোঝা বিরক্তি। সঙ্গীবিহীন বার্ধক্য=ওষুধ+মানসিক অসুখ+অভিযোগ। অতএব বার্ধক্যের সঙ্কট, এই পুরুষ বোঝ বিরক্তি+নারী বোঝা বিরক্তি=সমাধান। অর্থাৎ মাইনাসে মাইনাসে প্লাস (- – = +) বিছানায়, শূন্যতার বদলে উষ্ণ ওম। ঘরে নিস্তব্ধতার বদলে, কোলাহল। টেবিলে একাকিত্বের বদলে মুখোমুখি নিশ্বাস। এতে সমাজেরই-বা কি সমস্যা, সংস্কারেরই-বা বলার কী? সমাজ কি মানুষের প্রকৃত সঙ্কট, জানে? জানলে, ছিছিক্কারে কেন ভরে ওঠে বাতাস, যখন কোনও বৃদ্ধ বিধবা বা বিপত্নীকের বিয়ে হয়! কেন সন্তানেরা তাদেরকে এত দ্রুত ত্যাগ করে? কেন আত্মীয়েরা ঘৃণায় মুখে দেখে না? কেন পড়শিরা ঘরে ঘরে রটিয়ে দেয় কোন দুশ্চরিত্র বা দুশ্চরিত্রার গল্প! কেন শ্বশুড়বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়, কারো ছেলের বৌ ছেনাল বাপের জন্যে? অলস দুপুর কেন অলস থাকে না, কেন বৃদ্ধ ছেনালের গল্পে। নিঃসঙ্গতার নরক সংবাদ কি কেউ রাখে?
বার্ধক্যে নিঃসঙ্গতার সঙ্কট, যতটুকু জানি, যা ভাবি, তার চেয়েও গভীর। অন্ধকারে কত পথ হাঁটা যায়? চেনা পথটুকুও, অন্ধকারে ভুল হবে।
কেই-বা বুঝতে চায় বয়স্কদের সমস্যা! সে সময়, কার আছে? তবুও বুঝতে হয় যে বার্ধক্যে মানুষ আরো বেশি অসহায় আর পরনির্ভরশীল। অনেক বেশি বাঁচাল। হরমোনের শুষ্কতায় শরীরে ও মনে তারা অনেক বেশি জটিল। তাদের মৃত্যু দুয়ারে। বিরক্তি লাগে, দেখলে এড়িয়ে যেতে হয়, মুরুব্বির চেয়েও তারা অধিক বোঝ। কোন পুত্রবধূর সংসারে ওরা ওষ্ঠাগত প্রাণ। হায় খোদা কেন বেঁচে আছে, মরে না কেন? মনে হয়! মেকি আদর। মেকি ভদ্রতা। মেকি সম্মান। মেকি সব মেকি। যাচিতের চেয়ে তারা বরং অযাচিত। কার সময় আছে! ওষুধ পথ্য খেলো কি খেলো না, এত কে দেখে? গু-মুতের কাপড় কে ধোবে? কেন এসব অতিরিক্ত বালাই! খেয়ে কাজ নেই? সংসার নেই। স্ত্রী নেই? স্বামী নেই! ছেলেমেয়ে নেই? এই প্রশ্নগুলো, প্রশ্ন যা যথেষ্ট সামাজিক। কিন্তু কেউ এর সমাধান খুঁজে নিলে তা ‘অসামাজিক।’ হয়, ‘অযাচিত’ বা ‘ছেনাল’।
এবং দেখা গেছে সবশেষে এই অসামাজিক ও অযাচিত দু’জনই শেষ পর্যন্ত দু’জনকে বাঁচিয়ে রাখে। সন্তান নয়, আত্মীয় নয় এই দু’জনই শুধু দু’জনের, যারা অযাচিত, যারা অসামাজিক। যে সঙ্কট সমাজ বোঝে না তার উত্তর এই অযাচিত দু’জন।
ওরা শিথিল ওরা শীতল। ওরা ফানি, ওদের চাওয়া, যৌবনের লিঙ্গ যোনির চাওয়া-পাওয়া থেকে ভিন্ন। ওরা সঙ্গী।
তা সত্ত্বেও বার্ধক্যে, শুষ্ক নারী আর শিথিল পুরুষ, দুই পাটি দাঁত খুলে রেখে বিছানায় ওরাল সেক্স আর সুগন্ধ ভেসেলিন বিকল্প নিয়ে ওরাও যে মাতে না অবিনশ্বর। আনন্দে, কে বলে? যে বলে সে ঘুণ কাঠ। ঘুণে খাওয়াই নয়, অন্ধও বটে। প্রেম বার্ধক্য ঠেকায়। মৃত্যু দূরান্বিত করে। প্রেম ভালোবাসা, পরকীয়া অউর, নো। পরকীয়া=পেয়ার জিন্দেগি হ্যাঁয়। যে-কোনও বয়সে। যে-কোনও সমাজে। এখানে সবাই, মানুষ।
১৯. তৃষাদীর্ণ
কিছু কষ্ট আছে, যে কথা কাউকে বলা যায় না। কিছু যন্ত্রণা যা অযাচিত, তবুও আমরা তা মেনে নিতে বাধ্য। কিছু সময়, যা ক্ষমাহীন। কখনো, কারো কোনও ব্যবহার যা অশোভন শুধু নয়–গা কামড়ে ওঠা। কোনও আলো, যা অন্ধকারের চেয়েও ভয়ঙ্কর। মা আর মাতৃত্ব। যা কখনো কখনো ক্ষমার অযোগ্য। এমন হলে কি তার উত্তর, সেই প্রশ্ন হয়ে ওঠে জীবনের সবচেয়ে বড় লজ্জা।
রাত গম্ভীর হয়ে গ্যাছে। শহরের নববিবাহিত মানুষ-মানুষীরা তখন, একে অপরের বুকে শরীরের উষ্ণ ওমে আচ্ছন্ন। নববিবাহিত হারুনের শরীরটাও তখন সবেমাত্র শিথিল হচ্ছে। শরীরের তলে ওকে জাপটে ধরে শুয়ে আছে সোহাগিনী নেলী। দু’জনেরই শরীর প্রচণ্ড ঘামে কুলকুল করছে। সপসপে দু’হাতের শেকল খুলে গেলেও, নেলী কষ্ট করে সে শেকল বারবার আরও জোরে বাঁধবার জন্য উত্তাল ঢেউয়ের মতো আছাড়ি-পিছাড়ি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে অনুভব, অনুভূতির ব্যাপারটা গভীরতর হয়। দু’জনেরই চোখ বন্ধ। উন্মত্ত অধীর ভালোবাসায় চোখের পাতা ভারি। কণ্ঠ-বেসুরো। ঠিক তখনি শব্দ হলো দেয়ালের ওপাশ থেকে দুটো পায়ের। কে যেন হাঁটছে। থপ-থপ…।
–কে? কে ওখানে? নেলী, হারুনকে এক ঝটকায় ফেলে দিল ওর শরীরের ওপর থেকে। চোর! চোর! বলতে বলতে সে উঠে দৌড়ে বাথরুমের দিকে ছুটে গেল। আওয়াজটা খুব স্পষ্ট। থপ থপ থপ। দ্রুত অপসৃয়মান পায়ের স্পন্দন। হারুন বাথরুমে গেল না। চাঁদর দিয়েই ওর পিচ্ছিল অঙ্গ মুছে কাপড় পরে ফেলো। পরক্ষণেই দরজা খুলে বাইরে এসে জোরে হাঁক-ডাক দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো–কে কে ওখানে? এরপর বাইরের সব বাতিগুলো সে একে একে জ্বালিয়ে দিলো। পেছন পেছন এলো নেলী। ভয়ে ওর সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে। নেলী হারুনের পেছন পেছন ওর শার্ট ধরে কম্পমান পা ফেলছে। ভয়ে বিহ্বল নতুন হাঁটা শেখা এক শিশুর মতো লাগছে তাকে। হারুন ঘরের প্রতিটি কোণ খুঁজে খুঁজে কিছুই না পেয়ে অবশেষে মায়ের ঘরে গিয়ে মাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে বললো, মা ওঠো, ওঠো-ও-ও-ও–না। ঘরে চোর ঢুকেছে।
–মা, ওপাশ থেকে এপাশে ফিরে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বিরক্ত কণ্ঠে বললো–কি বলছিস!
–চোর! চোর ঢুকেছে! ওঠো!
–মা উঠলেন স্বাভাবিকভাবে। কি বলিস! চোর! তেমন আশ্চর্য হয়েছেন বলে মনে হলো না। যেন এটাই স্বাভাবিক।
শাড়িটা তার গুছিয়েই পরা ছিল। তিনি বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ছাদে দেখেছিস?
–না-মা! বলেই হারুন দৌড়ে ছাদে গেল আর সেখান থেকে ফিরে এসে বললো,, কেউ নেই।
নেলী বললো, চোরই যদি হবে, তবে তো একটা কিছু চিহ্ন থাকবে। কই, সে রকম কোনও আলামতই তো দেখা যাচ্ছে না। পালিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে অন্তত দৌড়ঝাপের শব্দ বোঝা যাবে। তাই নয় কী? তেমন কিছুই তো টের পেলাম না!
–ঠিকই তো। কে বলে বুদ্ধি নেই নেলীর! বললো হারুন।
–শাশুড়ির বিচারে নির্বোধ এই মেয়েটির কথায় মনে হলো একটু নড়ে উঠলেন শাশুড়ি স্বয়ং নিজেই। সেই সঙ্গে ছেলের মুখে বৌয়ের সামান্য প্রশংসায় কেমন যেন বিচলিতও মনে হলো।
অকাল বিধবা অধ্যাপিকা নার্গিস বেগম, ওরফে নার্গিস। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে তিনি এই অযাচিত শাস্তির শিকার হন। স্বামীর অপমৃত্যুর পর থেকে এই একটি মাত্র সন্তানকে ঘিরে শুরু হয় তার জগৎ। অত্যন্ত মায়া মমতা স্নেহ দিয়ে মানুষ করেছেন একমাত্র ছেলেটিকে। এবং এই স্নেহটুকু সম্বল করে, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে দেখে কাটিয়ে দিয়েছেন তার যন্ত্রণাদগ্ধ একাকিত্বের দুঃসহ জীবন। এই জীবনের বাইরে, ছেলের এই বিয়েতে তার বিশেষ ইচ্ছে ছিল না বলে বৌয়ের সাথে কখনোই তার তেমন সমঝোতা গড়ে ওঠেনি।
সে রাতে মন থেকে না চাইলেও, নেলীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে একই সুরে তিনি বললেন, তাইতো! সেরকমভাবে ভাঙচুরেরও তো কোনও শব্দ শোনা গেল না। তাহলে নিশ্চয় চোরটোর নয়। এরপর আরো কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি চললো। দরজা-জানালা কোনওটাই তো ভোলা দেখা গেল না। এমনকি একটা ফুটো বা ভাঙা দেয়ালও কোথাও দৃষ্টিগোচর হলো না। নেলী বললো মনে হয় নিশ্চয় কোনও বেড়াল-টেরালের কাজ হবে নিশ্চয়। দুধ-টুধের খোঁজে। হারুন সঙ্গে সঙ্গে বললো, হতেই পারে। প্রয়োজনে মানুষ স্বস্তির জন্যে সবসময় অজুহাত খুঁজে পায়, হারুনও পেলো–বললো, পাশের বাড়ির হুলোটা তো বেজায় জ্বালাচ্ছে।
এরপর সবাই আরেকবার ব্যস্ত হয়ে, এদিক-ওদিক তদারকিশেষে বাতি নিভিয়ে যে যার ঘরে শুতে চলে গেল। হারুনের মাও ঘরে যাওয়ার আগে আরেকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–মনে হয় বেড়ালই হবে। তবে বেড়াল শব্দটার ওপর যেন একটা সবিশেষ জোর ছিল।
নেলীর সঙ্গে হারুনের বিয়েটা সহসাই। এক মাসের পরিচয়ে। নেলীকে ওর কাকাই পরিচয় করিয়ে দিলো হারুনের সঙ্গে। তাতে প্রথমেই বাধা দিলেন নার্গিস বেগম। এক্ষুণি বিয়ে কিসের? মাত্র তো পাস করে বের হলো! আগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুক। জীবন চিনুক। বিয়ে হলে তো হয়েই গেল। এরকম কথা হারুন এর আগেও আরো অনেক শুনেছে। যখনই কেউ ওর বিয়ের কথা বলেছে–মিসেস নার্গিস বেগম প্রথমেই সেখানে বাধা দিয়েছেন।
মাকে যমের মতো ভয় পায় বলে হারুন এতকাল চুপচাপই সব সহ্য করে গেছে এবং যাচ্ছে। কিন্তু ইদানীং মায়ের এই বাড়াবাড়িতে সে নিজেও অধৈর্যবোধ করছে। চায়ের টেবিল থেকে সব লজ্জা ভুলে এবার বললো, মা আমার বিয়ের বয়সই শুধু হয়নি, পারও হয়ে যাচ্ছে। মনে রেখে ত্রিশ হবে আর তিনদিন পর। বলো আমি কি এখনো কিশোর?
চার দেয়ালের ঘরে শুধু মাকে নিয়ে থাকতে থাকতে এই একাকী জীবনে হারুন আজকাল দারুণ হাঁপিয়ে উঠেছে। চা খেতে খেতে সে কথাই তুলো হারুন। অফিস থেকে ফিরে মা আর ছেলের প্রতিদিন একসঙ্গে চা খাওয়া, এ বাড়িতে একটা নিয়ম। এক কাপ চা, ঠিক সন্ধে সাতটায়। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায়। হারুনের এই ঘড়ির কাঁটা জীবনের প্রতি বিরক্তি এসে গেছে। কিছু বলার আগে, সাদা নিঃসঙ্গ দেয়ালের দিকে একবার তাকালো হারুন। একটা টিকটিকি। সেদিন নেলীর সঙ্গে বিয়ের কথা ওঠানোর আগে একটু হালকা হাস্যরসের প্রয়োজন ছিল। বললো, আচ্ছা মা বলতো, টিকটিকিটা কি আমাদেরকে উল্টো দেখছে! গুরুগম্ভীর মাও হেসে উঠলো। আর সেই সুযোগে হারুন মাকে জড়িয়ে ধরে বলেই বসলো, নেলী খুব ভালো মেয়ে মা। তুমি অমত করো না। ওকে দেখলে তোমার পছন্দ হবে।
কথাটা শুনে, মা যে খুব খুশি হলেন না, তা তার মুখ দেখেই বুঝে ফেলো হারুন। -বিয়ে করছিস তুই। আমার ভালোলাগা না লাগার তুই কি পরোয়া করিস। মন। তো দেখছি ঠিকই করে ফেলেছিস, তো আবার আমাকে জিজ্ঞেস করার কি দরকার। বলে তিনি উঠে অন্যদিকে চলে গেলেন। কথাটা শুনে হারুন খুব খুশি হলো না। হোক না তিনি অধ্যাপিকা। হোক না স্বনামধন্যা এক ত্যাগী, সংযমী, সংগ্রামী অকাল বিধবা, যিনি তার একমাত্র ছেলেকে কোলে পিঠে বুকে করে দৃষ্টান্তস্বরূপভাবে গড়ে তুলেছেন। সমাজ ও ধর্মের অনুশাসনে মানুষ করেছেন। ছেলেকে নিয়ে দারুণ কষ্ট করেছেন, তবুও কারো কাছেই মাথা নত করেননি। কিন্তু এখন তো সে প্রাপ্ত বয়স্ক, তারও তো ভালো লাগা না-লাগার ব্যাপার থাকতে পারে! মুহূর্তের জন্যে ভাবলো হারুন। মায়ের সাথে ইদানীং কথা যেটুকু হয়, তা বিতর্ক। আর সে বিতর্কও একটুক্ষণ পর ফুরিয়ে যায়। তারপর দু’জন যে যার ঘরে। মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর মনে হলো, নেলীকেই সে বিয়ে করবে। এক ধরনের ক্ষোভ। শুধু স্ত্রী নয় এই বাড়ির নীরবতা ভাঙাতে প্রয়োজন হবে একটা বড়সড় প্রলয়ঙ্কর ঝড়।
রাতটা কারোরই ভালো যায়নি। হারুনের চোখের তলে কালি। সে সারারাত জেগেছে। পরদিন মা তার স্টাডি রুমে বসে চা খেতে খেতে লেকচারের জন্য তৈরি হতে বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিলেন। হারুন দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে ঢুকলো। ঢুকেই সাহস করে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, মা তুমি বুঝতে চেষ্টা করো। অন্তত একটা কথা বলার লোক আমার চাই। মা, চায়ের কাপটা নামিয়ে এবার। কিচেনে যেতে যেতে বললেন, আমি তো বলেইছি।
দু’বছর অপেক্ষা কি সম্ভব! এভাবে চলতে থাকলে নিঃসঙ্গতায় সে পাগল হয়ে যাবে। অসহায়ের মতো আর্তকণ্ঠে মাকে বললো, নেলীকে বলেছি তুমি ওদের বাড়িতে যাবে। হারুন মাকে জড়িয়ে সেই ছেলেবেলাকার মতন আদুরে গলায় বলতে থাকে আমার লক্ষ্মী সোনা মা।
মা অনেক কষ্টে শেষমেশ রাজি হলেন।
ত্রিশ বছরের ছেলের বিয়েতে মা রাজি হবেন না, বাঙালি সমাজে এমন ঘটনা বিরল। কিন্তু হারুনের বেলায় এই ব্যতিক্রমের কারণ, মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে এক কচি শরীরের বিধবা, যার স্বপ্ন, স্বপ্নই রয়ে গেল, যিনি স্বামীর অপমৃত্যুর পর চারপাশের মানুষদের মধ্যে লোভ-লালসা আর ধৃষ্টতা দেখে নিজের দেহ-মনকে এক অদৃশ্য শেকলে বেঁধে সঙ্কল্প করলেন আর নয়। অনাথ ছেলেটাকে মানুষ করাটাই জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করাই হবে কাজের কাজ। অন্তত এই জন্তু-জানোয়ার আর পাশববৃত্তির দেশে। যে দেশে বিধবা বিবাহ মানেই চাই তার স্বামীর রেখে যাওয়া অর্থ-সম্পত্তি এবং তারপরে তো শরীরের লোভ আছেই। এখানে প্রেম-ভালোবাসা বলে কিছু নেই।
স্বামীর মৃত্যুর পর নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যে তাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা। হলেন নামকরা শিক্ষক। আর পাশাপাশি এক আদর্শ মা। আগে কোনও সাহায্য চাইতেই, আত্মীয়-স্বজন বিয়ের উপদেশ দিতেন। কিন্তু ধীর স্থির, সমাজ ও ধর্মীয় অনুশাসনে বাধা এই নারী, পরিমিত জীবনে অভ্যস্ত হতে হতে বিয়ের সমস্ত সম্ভাবনাই নাকচ করে দেন। স্বেচ্ছায় নিভিয়ে দেন শরীর এবং যাবতীয় অনুভূতির কোষ, স্নায়ুর যন্ত্রণা।
এই ছেলেকে আর রাখা যাবে না। এবার ছাড় না দিয়ে আর নিস্তার নেই। তিনিও জানেন। আর এক ঘরে দু’খাট ফেলে শোয়া নয়।
এবার খাট যাবে আলাদা ঘরে, নেলীর ঘরে। তাই নেলীর সঙ্গে, বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে এলেও সেকথা মনে করে তিনি বারবার অস্থির হয়ে উঠছেন। একটা উটকো মেয়ে এসে ছিনিয়ে নেবে তিল তিল করে নিজের রক্তমাংস দিয়ে গড়ে তোলা তার ছেলেকে! ঈর্ষার আগুনে সেঁকা রুটির মতো ঝলসে যান তিনি। তার ছেলে, যার জন্যে জীবনে সবরকম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তাকে। তাই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে আসার পর থেকেই তিনি অন্যরকম অনুভব করতে শুরু করেন।
বিয়ের দিন মা ঘরেই রইলেন। উৎসব আছে ঘরে। আনন্দ নেই। ঠিক আছে, তুমি যাও, ছেলেকে অনুমতি দিয়ে তিনি বিছানা নিলেন। সব সত্ত্বেও বিয়েটা হয়ে গেল নির্বিঘ্নে। মা যে অসুখী হারুন জানে। নেলী জানলো, কিন্তু পরে। হারুনের নতুন খাট, ড্রেসিং টেবিল, সোফা, ওয়ার্ডড্রব। সব আলাদা। জীবনে এই প্রথম হারুন অন্য ঘরে ঘুমোবে। তবে মায়ের ঘরের পাশাপাশি। নেলী তার ঘরটি গুছিয়ে নিতে শুরু করলো তার পছন্দমতো জিনিসপত্র দিয়ে।
বিয়ের তিনদিন পর, শাশুড়ি দিনদুপুরে শুয়ে আছেন। মুখের হাসি তার উধাও হয়ে গ্যাছে। তিনি খুব বিরক্ত। এদিকে নেলী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ঘরের প্রতিটি জিনিস আসবাবপত্র। দেখে রোমাঞ্চিত বোধ করে। এই তার স্বামীর ঘর। নেলী স্বপ্নসুখের ফেরে পড়ে। স্বামীর ঘরে তার সবকিছু বড় আপন লাগে।
বুকে দুর্বোধ্য যন্ত্রণা। হারুন আর নেলীর দিকে তাকিয়ে একটি কথাও তিনি আর বলতে চাইলেও পারেন না। গোটা বাড়ি জুড়ে সে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। নেলী ভয়ে তাকিয়ে থাকে, স্বামীর মুখের দিকে। একি!
-তিনি শুয়ে আছেন। শাশুড়িকে খুশি রাখতে নেলী চেষ্টা করে। মা আপনার কি শরীর খারাপ! নেলী ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে।
-বলছি তো না। বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। নেলী চলে গেল নিজের ঘরে। হারুন বুঝিয়ে বলে, ঠিক হয়ে যাবে সব। একটু সময় দাও। মায়ের কষ্ট তুমি নিজেও একটু চেষ্টা করো বুঝতে লক্ষ্মীটি। কিন্তু দিন যত যায়, বাড়ির পরিবেশ তত অশান্ত হয়ে আসে। নেলী অপেক্ষা করে। আর ঝড়, একটার পর একটা, যা আসছেই।
গভীর রাতে সমস্ত বাড়িটা নিস্তব্ধ। ওরা টেলিভিশনে খবর শুনছে। ঠিক এমন সময় আবার কার পায়ের শব্দ! দেয়ালের ওপাশে।
-কে! কে! হারুনকে ঘুম থেকে ওঠায় নেলী। কেউ নেই। চোরের কোন চিহ্নই নেই। ওরা বিড়ম্বনায় পড়ে। কিন্তু মা, নির্লিপ্ত থাকেন।
-সেই ঘটনার তিনদিন পর, ফের সেই পায়ের শব্দ! ওরা বাইরে যায়! গিয়ে চোর খোঁজে, বেড়াল খোঁজে। চোর নেই, বেড়ালও নেই। এরকম প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে।
-কার পায়ের শব্দ! কে হাঁটে! কার দীর্ঘশ্বাস! ভূত! পিশাচ!
মধ্যরাতে কে এই চলমান অশরীরী যিনি সারা বাড়িতে হেঁটে বেড়ায় হারুন! আমার খুব ভয় করছে। নেলী কাঁদে। প্রতিরাতেই নিয়মমাফিক মাকে ওঠানো হয়। কিন্তু তিনিও কিছু বুঝতে পারেন না। বলতেও পারেন না। আর হারুন, প্রতিরাতেই আরেকটু আরেকটু সন্দেহ পুঞ্জিত হয়–কে! কে তিনি! বা কে-সে?
দারুণ এক রহস্য শুরু হলো এই বাড়িতে। তা সত্ত্বেও নার্গিস বেগম এক সময় ছেলেকে বলেই বসলেন, মাঝে মাঝে তার ঘরে গিয়ে তার আগেকার বিছানায় শুয়ে ঘুমোতে। বললেন, তার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু নেলী শাশুড়ির ঘরে কিছুতেই ঘুমোবে না বলে জানিয়ে দিল। যদিও বিষয়টা অস্বাভাবিক কিন্তু নেলী খুব বেশি কিছু মনে করলো না এই ভেবে যে এতদিনের অভ্যেস, ঠিক আছে। এরকম হতেই পারে। তবে নিজের মাকে ঘটনাটি জানালো।
কি বলিস! বললেন মা। তার কাছেও বিষয়টি ভালো না লাগলেও তিনিও ভাবলেন এরকম তো হতেই পারে! তারপরেও নার্গিস বেগমের মধ্যে এক ধরনের অস্বাভাবিকতা দিনকে দিন বাড়তেই থাকে। তিনি নেলীকে কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না। বিভিন্ন অজুহাতে শুরু হলো, সারাক্ষণ গাত্রদাহ। যার প্রথম আর শেষ কথা, নেলী তার ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে।
-নেলীর ঘুম আসছে না। গতরাতেও দারুণ ঝগড়া হলো হারুনের সঙ্গে। তা সত্ত্বেও, আবার সে মায়ের ঘরে শুয়েছে। হারুন অপারগ।
বললো, মা অকাল বিধবা। প্লিজ সহ্য করো। সব ঠিক হয়ে যাবে। একথা তো আগেই পুরনো হয়ে গেছে। আর কতদিন! সন্ধে হলেই এ বাড়িতে শুরু হয় একটা চাপা অস্থিরতা। একটা দারুণ টেনশন। হারুনের শোয়া নিয়ে। দুই নারীর মধ্যে ক্ষমতার যুদ্ধ। আর নয়। ন্যায্য-অন্যায্যের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত নেলীর মাথায় ঢুকলো ডিভোর্স।
মায়ের সঙ্গে ঘুমোনোকে কেন্দ্র করে দু’জনের মধ্যে একসপ্তাহ ধরে কথা একদমই বন্ধ। ঝগড়ার পর কেউ কারো রাগ ভাঙালো না। হারুনের জন্যে আজ মায়াও লাগছে। তাকে সে গতকাল জুতোপেটা করেছে। হারুনই-বা কি করবে! কাকে অবজ্ঞা করবে সে! একদিকে মা আর অন্যদিকে স্ত্রী। আপন-পরের দ্বন্দ্ব এবার।
ওঠো, বলে বিছানায় শোয়া নেলী হারুনের বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে দিলো, সদ্য বিবাহিতের দীর্ঘ বিরহ যেমন সুখের হয়। অম্লমধুর! রক্তে মাতন, উষ্ণ আবেগ, বুকের সব মধু নিংড়ে নিয়ে ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। হারুন তিনরাত ধরে মায়ের ঘরে শুতে যায়নি। বলেছে আর শোবেও না। তার পক্ষে সম্ভব নয়।
মা চেয়েছিল কিন্তু তা সত্ত্বেও সে এবার অনড়। নেলী, আজ সেকথা নিজ কানে শুনেছে। সুতরাং নেলীর হৃদয় সঙ্গে সঙ্গে গলে গেল। রাগ চলে গেল। অভিমান ঝরলো। ঝরলো কামের প্রত্যাশা।
তিনরাত পর সে হারুনের শরীর স্পর্শ করলো। আর সে স্পর্শ পেয়েই ঘুমের মধ্যে একটু একটু করে জাগ্রত হতে শুরু করে শরীরের একখণ্ড শিথিল মাংস। ক্রমে তাতে প্রাণ সঞ্চার হলো। জেগে উঠলো পৌরুষ তার আপন বিক্রমে। হারুন তৈরি। ঘুমের মধ্যে যেন তারও অধীর অনন্ত অপেক্ষা। আর অলক্ষ্যে, অপেক্ষা যেন আরো কার! দেয়ালের ওপারে সেই পায়ের শব্দটির অশান্ত আনাগোনা! সন্ত্রস্ত পদক্ষেপ। কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে। কে যেন অস্থির শ্বাস নিচ্ছে। বিশ্রী এবং নিঃসন্দেহে তা কোনও বেড়ালের নয়।
হারুন বললো, কেউ না। নেলী, এসব আমাদের ভুল শোনা। দু’জনের শরীর সবকিছু ভুলে এগিয়ে যেতে থাকে। আর ঠিক তখনই, সেই পায়ের শব্দ আরও শব্দ করে কাছে, যেন একেবারে শিয়রে এসে দাঁড়ায়! শব্দ, দাঁড়ায় দেয়ালের একটি ফুটোর কাছে। শব্দ–চোখ বুজে দেখে। শব্দ অস্থির উত্তাল হয়ে দৌড়ে পালাতে গিয়ে দেয়ালে ধাক্কা খায়। শব্দ মিলিয়ে যায়।
ছত্রিশ বছরের বিধবা শরীরে আজ রাতে যেন আগুন লেগেছে। মৃত স্বামীর ছবিটা হাতে নিয়ে অধ্যাপিকা নার্গিস বেগম হঠাৎ এক জ্বলন্ত অনুভূতির প্লাবনে ধসে গিয়ে সেই রাতে অন্য এক নার্গিসে রূপান্তর হয়। যার সামনে কোনও অনুশাসন নেই। না ধর্মের, না সমাজের। তিনি তার মৃত স্বামীকে ছবির অ্যালবাম থেকে জাগানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে গিয়ে তার সার্টের কলার মিছে চেপে ফিরে আসেন শুধুই মুঠো মুঠো শূন্যতা নিয়ে। তার কোঁকড়া কোঁকড়া চুল ধরতে গিয়ে ফিরে আসেন নির্জনতা নিয়ে। অস্থিরতায় ঘাম সমস্ত করতল জুড়ে তার। গায়ে তার আগ্নেয়গিরির মতো লাল কালো তরল পাথুরে আগুন। তিনি কি চান, নিজেও জানেন না। স্বামীর ছবিটাকেই প্রশ্ন করেন, কেন চলে গেলে? কেন? কেন? তিনি চান তৃষ্ণার জল। তাকে ফিরিয়ে চান। সংশোধন করতে চায় অতীতের সব ভুল। শরীফকে ফিরিয়ে আনতে চায়, বৈধব্য সত্ত্বেও তার কামনা হয়। ইকবালের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দিতে এলে বৃদ্ধা মাকেও সে অপমান করেছিল। কত ভুল যে সে করেছে! কত ভুল! কাঁচি দিয়ে কুচি কুচি করে ঘরের পর্দা কাটতে শুরু করে। নিজের পরনের শাড়িও কাটে। অতীতের গহ্বরে হারানো এই ক্ষতি সে কি দিয়ে পূর্ণ করবে। সবই তো অতীত। সময়, সে কি আর বসে থাকে!
তার সব রাগ নেলীর ওপরে। ঈর্ষা! দারুণ ঈর্ষা! নেলী, হ্যাঁ নেলী নামের নির্বোধ মেয়েটি, সে সুখ করছে তার সুখের বিনিময়ে, যার কারণে সে তার নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়েছিলেন, ত্রিশ বছর আগে। তা হয় না। হবে না। কিছুতেই না। অবশেষে শরীর ও মনের ভীষণ সঙ্কটে আক্রান্ত অধ্যাপিকা নার্গিস বেগম ঝড়ের বেগে তার রতি ক্রীড়ায় মগ্ন সন্তানের ঘরে ঢুকেই একটি অবুঝ শিশুর মতো আলুথালু চুলে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। হারুনের পুরুষবৃন্ত মাত্র তখন সবে শৈথিল্যে ফিরছে। তখনো দুই পা বিযুক্ত নেলী অন্ধকারে তার কাপড় হাতড়াচ্ছে। আর অনন্যোপায়, অন্যলোকের বাসিন্দা দু’জন অসহায় স্বামী-স্ত্রী ওরা যেমন ছিল তেমনি গায়ে গায়ে লাগা অবস্থায় পড়ে রইলো। স্বাভাবিক জ্ঞানবুদ্ধি হারিয়ে অধ্যাপিকা নার্গিস বেগম, তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে! একচুলও সরলো না। নড়লো না পর্যন্ত। যেন অনড় পাথর।
২০. ভ্রান্তিপাশ
রিমিকে এই বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে। মিতু আসছে! মিতু, উত্তীয়র স্ত্রী! সুটকেস গোছাতে গোছাতে রিমির বুক ফেটে যাচ্ছে রাগে, দুঃখে। তাহলে উত্তীয়র সঙ্গে কাটানো এই সাত সাতটি বছর? এই সাত বছর কি এক্কেবারেই জলে গেল! এই যে প্রতিদিন সকালে উঠে কাজে যাওয়ার আগে সে উত্তীয়র জন্যে ময়দা ডলে ডলে কাই থেকে হাতে বেলা রুটি আগুনে সেঁকে, তাতে একটু ঘি-মধু মাখিয়ে খেতে দিতো, এই যে ময়লা আন্ডার গার্মেন্টসগুলোকে পর্যন্ত সে সাবান দিয়ে তার দু’হাতে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে দিয়েছে দিনের পর দিন এর কি কোনও মূল্যই থাকবে না। এমনকি ব্লাডপ্রেশারের বড়িগুলো পর্যন্ত নিয়মিত সে মুখে তুলে দিয়েছে। সেজন্যে এতটুকু কৃতজ্ঞতাও কী নেই? কত প্রশ্ন আজ রিমির মনে যার কোনও উত্তর, সামাজিক অর্থে তো দূরের কথা আজ যেন সবই অর্থহীন। মূল্য তো-নয়ই। পৃথিবীটাকে ওর কাছে মনে হচ্ছে এক বিরাট প্রহসন। আর মানুষগুলোকে অমানুষ। তাহলে মানুষের মনুষ্যত্ব, ধর্মবোধ, সবই কি গ্যাছে? রিমি কাঁদে তার নিজের জিনিসগুলো সুটকেসে ভরে। ভরতে ভরতে একসময় লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে।
মেয়ে মানুষের শরীর, যা না হলে উত্তীয় ঘরে না থেকে বেশ্যাপাড়ায় লুটাতো এই যে নিজেকে সে এত বছর ধরে অকাতরে বিলিয়ে গেল, সাত সাতটি বছর খুব কি কম কথা। সেই কৃতজ্ঞতায় ন্যূনতম সহানুভূতিও কি ওর প্রাপ্য নয়! স্রেফ হাত ঝেড়ে ফেলা! এ কি ধুলোকণা শুধু। দু’হাত দিয়ে ঝাড়ছে তো ঝাড়ছেই। যতক্ষণ না তার চিহ্ন এ-ঘর থেকে শেষ হয়ে যায়। ঝাড়ছে দেয়াল থেকে। ঝাড়ছে টেবিল থেকে। ঝাড়ছে বিছানা থেকে। রিমির পড়ে থাকা এতটুকু জিনিসও, যা সন্দেহের সামান্য চিহ্ন হয়ে দাঁড়াতে পারে। একটি চুলের ক্লিপ হঠাত্র উত্তীয় ড্রয়ার থেকে বের করে রিমির হাতে দিয়ে বললো, সর্বনাশ! এসব তুলে নিয়ে যাও! মিতু দেখলেই ভীষণ গণ্ডগোল লেগে যাবে। আর শোন শেষ মুহূর্তে সব। চেক করে নাও, যা যা আছে। লাস্ট মিনিট চেক।
রিমি ভাবছে ওর জায়গায় পরদিন মিতুকে বসাবে উত্তীয়। সোজা এয়ারপোর্ট থেকে এনে বলবে, এই নাও তোমার সংসার বুঝে নাও। বুঝে নাও তোমার আদরের পরবাসী স্বামী রত্নটিকে। সেই রাতেই ওরা দু’জন একখাটে একসঙ্গে শোবে। অথচ এই খাটেই সে উত্তীয়র সঙ্গে কাটিয়ে দিল ব্যক্তিগত একান্ত জীবনের কত কত না উত্তাল, উচ্ছ্বাসভরা মুহূর্ত। কখনও সরবে, কখনও নীরবে। পরম সুখানুভূতিতে, যখন দু’জনের মাঝে অন্য কেউ ছিল না। এবং ভবিষ্যতে যে থাকবে কোনওদিন মনে হয়নি তাও। তখন ওরাই স্বামী স্ত্রী। ওরাই সব। উত্তীয়র যে দেশে কেউ আছে মনেই হলো না ওর ব্যবহারে না আচরণে। একদিনও না।
সযত্নে সাজানো-গোছানো এই সংসার রিমির নিজের হাতেরই তৈরি। এই যে থালাবাসন পর্যন্ত তারই কেনা। উত্তীয়র এই শার্ট, এই গেঞ্জি, এই কলম ওরই দেয়া। মশলার হলুদ রঙ লেগে থাকা প্লাস্টিকের হাতা পর্যন্ত ওরই কেনা। কিন্তু আজকের পর থেকে ওর অস্তিত্বের সব-সবটুকু-এখান থেকে ধুয়েমুছে একাকার হয়ে যাবে। আসন্ন আগামী কাল-পরশু-তরশু… এই দিনগুলোর কথা ভেবে অচেনা নতুন এক জায়গায় মনে হয় ওর জীবনের একাকিত্বের কথা ভেবে রিমি ভয়ে গুটিশুটি হয়ে যায়। নতুন যে বাড়িতে সে যাবে আজ সেখানে অগ্রিম কিছু টাকা জমা দিয়ে এসেছে। বাকিটা দেবে ওঠার পর। এক বেডরুমের একটি ঘরে একটি বাঙালি মেয়ের সঙ্গে শেয়ারে থাকবে সে। সেখানে উত্তীয়বিহীন জীবন তার। যে জীবন ওর অচেনা, সে জীবনে কি করে সে অভ্যস্ত হবে? আদৌ হতে পারবে কি! রিমি ভাবতেও পারছে না আর। মাথাটা এবার লাটিমের মতো বনবন করে ঘুরছে। ওর এই চলে যাওয়া এ যে কতবড় অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ কে বলবে সে কথা! কিন্তু প্রথা, যা মানুষেরই তৈরি। প্রথার প্রতিকূল স্রোতের বিরুদ্ধে সে একা লড়বে কি করে! সে যে উত্তীয়র কিছু নয়! কেউ নয়! স্রেফ বান্ধবী যা সমাজের চোখে সম্পূর্ণ মূল্যহীন, অবান্তর। একসঙ্গে ওদের একটি নয়, দুটি নয়, সাত সাতটি বছর, এত সহজেই মূল্যহীন হয়ে পড়লো! এই যে এত আদর সোহাগ, হাসি-খুশি, কানে কানে গুনগুন সবই কি মিথ্যে। হায়রে জীবন! এত নিষ্ঠুরতার ভেতর মানুষ বেঁচে থাকে কি করে?
উত্তীয় থম মেরে চেয়ারে বসে দেখছিল সাত বছর একটু একটু করে, কি করে অতীত ইতিহাস হচ্ছে। পকেট থেকে পাঁচশ’ ডলার রিমিকে দিয়ে ভেজা ভেজা গলায় বললো, রেখে দাও। আর শোন, প্রয়োজনে যোগাযোগ করবে আমার কাজের জায়গায়। খুব জরুরি না হলে ফোন করবে না। জানই তো মালিক একটু অন্যরকম। বরং তোমার নতুন বাড়ির ফোন নম্বর আমাকে দিও। আমিই যোগাযোগ করবো। ওর কথা শুনে এবার সুটকেস গোছানো বাদ দিয়ে রিমি মাথা নিচু করে খাটের ওপর বসে রইলো। পুরো ব্যাপারটাই ওর মনে হচ্ছে, অন্যায়! হাত থেকে টাকাগুলো ওর মুখে ছুঁড়ে ফেলে বিস্ময়ভরা চোখ দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা উত্তীয়, এই কি শেষ! আমাদের সংসার সংসার খেলা! এই যে এতদিন প্রতিদিন তুমি আমার সবকিছু ছিলে! এই যে কাছ থেকে খবর নিতে, কেমন আছি! কোথায় আছি। কখন ফিরবো! এই যে আমার অসুখ হলে শিয়রে বসে মাথা টিপে দিতে। একটি রাতও গত সাত বছর ধরে এই যে আমাকে অন্য ঘরে ঘুমোতে দিলে না। কিন্তু আজ! এই সাত বছরের মানেটা কি একটু বুঝিয়ে বলবে! রিমি উত্তীয়র চোখের দিকে তাকিয়ে ভীষণ সব অস্থির প্রশ্ন তুলে বসে আছে।
উত্তীয় যার একদিকে রিমি আর অন্যদিকে মিতু। একদিকে ধর্ম, অন্যদিকে পাপ! রিমির প্রশ্নের কোনও জবাব আছে কি? থাকলে সে দিতে পারছে না কেন? –উত্তর দাও। বলো! এই কি শেষ! উত্তীয় তার কি জবাব দেবে? বিয়ে হলে তার অধিকারই সবচেয়ে বড় হয়। সেই সত্য হয়। এই সত্যের বিরুদ্ধে কি জবাব সে রিমিকে দিতে পারে? বিস্ফারিত দুই চোখে দূরে তাকিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো–হা-রিমি …। এই-ই আমাদের শেষ। সংসার সংসার খেলার এখানেই সমাপ্তি।
–দেখতেও আসবে না আমাকে!
–উত্তীয় চুপ করে থাকে। কোনও কথা বলে না।
–কি, কথা বলো! দেখতেও আসবে না, আমি কেমন আছি! বলো!
–হ্যাঁ, মানে! বলছি তো সময়-সুযোগ পেলেই যাবো। জান তো ওরা আসছে, এখন থেকে আমাকে প্রতিটি পদক্ষেপ সাবধানে ফেলতে হবে, তুমি বোঝো না!
–বুঝি-বুঝি–সব বুঝি উত্তীয়। না বোঝার কি আছে। বলে সে ওর দুই পা জড়িয়ে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। যেন সে তার স্বামীর সংসার ফেলে অন্য কোথাও যাচ্ছে। যেন ওর বুকে চিরকালের বিচ্ছেদ ব্যথা, সত্যি সত্যি স্বামীর মৃত্যুর চেয়েও যার আঘাত ঢের বেশি।
আজ খালি তার গলা ছেড়ে বলতে ইচ্ছে করছে ”ন্যায়-অন্যায় জানি নে, জানি নে, জানি নে–শুধু তোমারে জানি, তোমারে জানি…” যে গান ওরা একসঙ্গে, পাশাপাশি শুয়ে গাইতে গিয়ে কেঁদে কেঁদে ভিজিয়েছে–একে অপরের বুকের সুগন্ধ, কত কত রাত! আগামীর বিচ্ছেদ আর বর্তমানের সুখের মাঝে, দুলতে দুলতে, কত-কত রাত!
পৃথিবীতে কে কার কষ্ট বোঝে? সে সময়টুকুও কারই-বা আছে? মানুষ নিজেকে নিয়েই। বরং ব্যস্ত। যার যার নিজের ভালোমন্দ, নিজের স্বার্থ, সেখানে চুল পরিমাণ ছাড়া কেউ দিতে চায় না। কেউ না উত্তরীয়ও না। রিমির চেয়ে বেশি এই সত্য হাড়ে হাড়ে আর কে বুঝতে পারবে।
–উত্তীয় আমি কিছুতেই যাবো না। আমার বুক ভেঙে আসছে। পারবো না আমি। আমি এখানেই থাকবো। যেমন ছিলাম।
–কি পাগলামো করছো? তাড়াতাড়ি গুছিয়ে ফেল।
–পাগলামো নয় উত্তীয়। এভাবে আজ কেন কথা বলছো? আমাকে উচ্ছিষ্টের মতো ফেলে দিচ্ছো কেন? মনে আছে–মাথায় ব্যথা পেয়ে একবার প্রায় মরতে বসেছিলে। বলেছিলে, তুমি না থাকলে যমও আমাকে ছাড়তো না। কথা দিচ্ছি তোমাকে ফেলবো না। তোমারই থাকবো। -হ্যা বলেছিলাম। কিন্তু সে তো তখন। বললো উত্তীয়। মানে? –মানে সেটা তখনকার একটি মুহূর্তের জন্যে প্রযোজ্য, একটা ইমোশন। কিন্তু আমাদের সমাজ আছে। তাকে তো মানতে হবে! তুমি থাকবে এ আর বেশি কথা কি! আমিও চাই তুমি থাকো। কিন্তু মিতু তা হতে দেবে না। এক পুরুষের ঘরে দুই নারী সম্ভব নয়, তুমিও জানো।
–জানি, কিন্তু তবুও আমি যাবো না। আমি পারবো না উত্তীয়, তোমাকে ছেড়ে। আমি কিছুতেই পারবো না। আমি মানুষ তো! শুনবে, একদিন আমি আত্মহত্যা করছি। কে স্বামী, কে স্ত্রী, বুঝি না। মন্ত্র পড়িনি, কিন্তু আমাদের এই সম্পর্ক তারও ঢের ঢের ঊর্ধ্বে। আমি কি মিথ্যে বলেছি?
–এখন ওসব কথা বলো না। যাও, তৈরি হয়ে নাও। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমি কাজে যাব।
একটা সময় এলো যখন উত্তীয় রিমিকে ধরে ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে গেল। সে এক দৃশ্য! গাড়িটা চলতে শুরু করলো। নতুন এক ঠিকানার উদ্দেশ্যে। আর গাড়িতে বসে এই নারী যে অন্য দশজনের মতো সাধারণ কোনও প্যাসেঞ্জার নয়, স্রেফ প্রথার শিকার, এক ভগ্ন হৃদয়। সে আড় হয়ে বসে রইলো। দু’চোখে অনিশ্চিত জীবনের মাঠ পার। প্রথার বিরুদ্ধে সে একা, নিরস্ত্র এবং নিরুপায়। সে নারী। পরকীয়া নারী।
পরের দিন উত্তীয়র বৌ, ছেলেমেয়ে এলো। প্রায় আট বছর পর দেখা। রিমিকে নিয়ে মিতুর বড় বেশি কৌতূহল। সে বিষয়ে যে-কোনও প্রশ্ন উত্তীয় এড়িয়ে যায়। মিতু ঘরের প্রতিটি কোণা ঘুরে ঘুরে খোঁজে। রিমির কোনও চিহ্ন। কোনও গন্ধ। রঙ। উত্তীয়কে সে হিংস্র জন্তুর মতো ধরবে, সব সত্যি কথা ওর জিভ টেনে বের করে আনবে। যা সে এতকাল শুনে এসেছে, যা উত্তীয় নিজেও এতকাল টেলিফোনে অস্বীকার করে এসেছে।
রিমির সঙ্গে উত্তীয়র সম্পর্ক বরং আট বছর পর স্বামীকে দেখার সুখের চেয়েও বড় হয়ে উঠলো। মিতুর গায়ের রোম পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ঘরের প্রতিটি ইঞ্চিতে–পা দিতে দিতে। বারবার শুধু একই কথা। উত্তীয়, এবার প্রায় ধমকের সুরে বলে উঠলো, পাগল হয়ে গেলে নাকি? মাত্র এলে, আর এরই মধ্যে এ কি শুরু করেছ! দেখছো তো আমি ছাড়া বাড়িতে কেউই নেই। আর আমি তো তোমারই আছি যেমন ছিলাম। মাঝখানে কি হয়েছে সেসব কথা ভুলে যাও। তা সত্ত্বেও মিতুর মাথায় শুধু, রিমি।
–ওই বেশ্যা, সেই হারামির বাচ্চা যে ওর স্বামীর বুকে শুয়েছে। স্বামীর পুরুষ ছুঁয়েছে। কোথায় সে! মিতুর একটাই কথা। কোথায় …!
রাতের পর রাত তাকে যে কাঁদিয়েছে। বলো! কোথায়! উত্তীয় আদর করে কাছে টেনে নিয়ে বলে আট বছর পর দেখা হলো। আজ ওসব বাজে কথা থাক। উত্তীয় ওকে চুমু খেতে যায়, আর মিতুর দুই চোখ তখন কপালে। উত্তীয় এবার মাথায় হাত দিয়ে বসে। কিছুতেই সে পারছে না, মিতুর সঙ্গে। অন্য নারীর হাতে গোছানো এই ঘরে ঢুকেই মিতু বুঝতে পেরেছে, এই নিপুণ হাতের কাঁচের জানালার পর্দা কোনও পুরুষ কিনতে পারে না। এই বিছানার চাঁদর কোনও পুরুষের পছন্দের নয়। পরদিন সকালে এত সুন্দর গুছিয়ে রাখা মশলার পিরামিড কোনও পুরুষের কাজ নয়। গোছানো চাল-ডাল-মশলা! রান্নাঘরে গিয়েই মিতু ভীষণ ক্ষেপে গেল। পিরামিড ফেলে দিলো। জানালার পর্দা কাঁচি দিয়ে কুচি কুচি করে ফেলো। সব-সব ফেলে দেবে সে। কিছুই রাখবে না। উত্তীয়র বুকে ওর মাথার চুলের গন্ধ। উত্তীয়র রুমালে তার স্পর্শ। এবার মিতু পাগলের মতো চিৎকার শুরু করলো। দিন গিয়ে এমনি ঝড়-তুফান তুলে রাত এলো। আর সইতে না পেরে, ওকে থামাতে উত্তীয় প্রবাসের এই দ্বিতীয় দিনেই -ঠাস করে চড় কষালো মিতুর গালে। চড় খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ কখন যেন বাধ্য শিশুর মতো সে ঘুমিয়ে গেলে পৃথিবীটা বড় শান্ত মনে হলো। উত্তীয় যেন এতক্ষণে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, উফ! কি ভয়ঙ্কর।
রিমিকে সে দু’সপ্তাহ দেখেনি। সাত বছরেও যা হয়নি। রিমিকে সে হৃদয়ের গভীরে অনুভব করছে তীব্রভাবে। স্মৃতি উত্তীয়কে কষ্ট দেয়। রিমির প্রসঙ্গে কোনও কথাই সে তুলতে চায় না। অনেক কষ্ট করে, অনেকটা মদ খেয়ে খেয়ে গোপনে সে রিমির কথা ভুলে থাকার চেষ্টা করছে। যা মিতু জানে না। মিতুকে ওর ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে যেন অচেনা এক অতিথি। অযাচিত। বরং না এলেই ভালো ছিল। মনে হচ্ছে পারলে ও এক্ষুণি রিমিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এমনটি লাগবে, সে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। উত্তীয়র কষ্টগুলো না জানে রিমি, না জানে মিতু।
বিকেলবেলা, আনমনে বসে ভাবছে। হঠাৎ সেলিম এসে ওকে ডেকে বাইরে নিয়ে গেল। কানে কানে বললো রিমি খুব অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। কেমন আছে?
–ভালো নয় বিশেষ। তোর যাওয়া দরকার। উত্তীয়র মন চাইছে ওকে দেখতে যেতে। রিমি কেন অসুস্থ হলে কি পেলে ভালো হয়ে যাবে, সে খবর ওর চেয়ে ভালো এ বিশ্বভুবনে আর কে জানে! অস্থির চিত্ত, দুর্বল মন, প্রগাঢ় অনুভূতি নিয়ে সে মস্ত হাঁফ ছাড়ে। তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয় সেলিমকে জানিয়ে দিল। গেলেই সর্বনাশ হবে। এই কষ্টের সংযম, নষ্ট হয়ে যাবে। সেলিম চলে গেল, ভীষণ রেগে। তারও ভালোলাগেনি এত নিষ্ঠুরতা।
সংসারে মন বসে না। বাড়িতে ফিরতে ভালো লাগে না। মিতুকে ভালো লাগে না। মাতালকে মদ-ছাড়া করলে যা হয়। মাতাল অসুস্থ বোধ করে। সেদিন কাজ থেকে ফেরার পথে, ট্রেনে বসে মনে হলো বাড়ি না গিয়ে আজ হাসপাতালে রিমির কাছেই যাবে। রিমি অসুস্থ। গেলেই হাতের মুঠোয় তার প্রিয়তমা। গিয়ে বলবে, দেখো আমি ফিরে এসেছি। তোমার সাত বছর মিথ্যে নয়। তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো। আমি তোমাকে স্নেহ দেবো। প্রেম দেবো। শুধু তুমি একবার সুস্থ হও। যেমন আমাকে তুমি একদিন সব দিয়েছিলে। এমনকি, মাতৃস্নেহ পর্যন্ত যখন আমি মরতে বসেছিলাম। যেদিন তুমি আমাকে তোমার দুই স্তনের মধ্যে খুঁজে, লেপ দিয়ে আমাকে জড়িয়ে, শরীরের সমস্ত ওম দিয়ে জ্বরের প্রচণ্ড কাঁপুনি থামিয়েছিলে! সেদিন তুমি আর তুমিতে ছিলে না। আজ আমিও তাই হবো। প্রলাপের মধ্যে আমাকে তুমি আর খুঁজো না। আমি স্বয়ং নিজেই এসেছি তোমার কাছে। চোখ খোল, রিমি! লক্ষ্মী! মানিক সোনা আমার! উত্তীয়র দু’পা কাঁপছে। ঠোঁট কাঁপছে। বুকের তলে, ভূকম্পন হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্ত।
উত্তীয়র দৃষ্টি প্রসারিত। চোখে দেখছে হাসপাতালের বেডে রিমি শুয়ে আছে। দশদিন হয়ে গেল। রিমি দশদিনেও চোখ খোলেনি। শুধু নাকি ঘুমের মধ্যে একবার দু’বার উত্তীয়’র নাম বলে কেঁদে উঠেছিল। আর হাসপাতালের ডাক্তারও কোনও এক ‘উত্তীয়’কে খুঁজছে। তাকে পেলে রোগী সেরে উঠবে। উত্তীয়র পৃথিবীটা চরম অশান্ত। ঝড়ে, ডালপালা ভাঙার মতো ওর সব ভেঙে ভেঙে পড়ছে। হৃদয় ভাঙছে! বিয়ে ভাঙছে। কাকে বাঁচাবে? রিমিকে সে ভালোবাসে। কিন্তু প্রথা, একজনকে দিয়েছে অপার ক্ষমতা, অধিকার! আর অন্যজনকে করেছে রিক্ত, ভিখিরি।
‘এফ’ ট্রেনের পরবর্তী স্টপ, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল। এখানেই রিমি ভর্তি হয়ে রয়েছে। নামবে কি নামবে না ভাবছে সে। সেলিম বলেছিল দয়া করে অন্তত একবার ওকে দেখে আসতে। সে জানে রিমির মাথায় হাত বুলোলেই রিমি জেগে উঠবে। রিমি ওর গন্ধ চেনে। রিমি ওর স্পর্শ চেনে। মৃত্যু মুহূর্ত হলেও ওর স্পর্শ একমাত্র রিমিই অনুমান। করতে পারে। কারণ তার নিখাদ প্রেম। এসব ভাবতে ভাবতে অজান্তেই ট্রেনটা কখন যেন হাসপাতালের স্টপ পার হয়ে ফোরটি সেকেন্ডের দিকে চললো। উত্তীয় আনমনা হয়ে তখনো ভাবছে, সে কি যাবে? গেলেই তো সব ওলট-পালট হয়ে যাবে তার বোতলে বোতলে মদ খেয়ে ভুলে থাকার সব প্রচেষ্টা, ব্যর্থ হবে।
–নামবে কি নামবে না। নামবে কি-না, নামবে না। ওকে দেখলেই মনে হবে মিতু মিথ্যে। অনেক কষ্ট করে এই নতুন জীবনে সে অভ্যস্ত হতে যে যুদ্ধ করে চলেছে!
হায়! এই সেই ভ্রান্তিপাশ! যাকে কবিগুরু পোস্টমাস্টার গল্পে উল্লেখ করেছিলেন, কি নিপুণভাবে। উত্তীয়, এই ভ্রান্তিপাশের কথা মনে করতে করতে ভুলে যায় কখন সে ট্রেনের লাস্ট স্টপে এসে পৌঁছয়। নিজেও সে সেকথা জানে না। স্টেশনের দিকে তাকিয়ে ওর চৈতন্য হয়। সেখান থেকে ওর বাড়ি অনেক অনেক পেছনে। ভুল করে সে অনেকটা পথ পেরিয়ে চলে এসেছে। আবার তাকে উল্টো ট্রেনে সেখানেই ফেরত যেতে হবে, যেতেই হবে। যে জায়গাটা সে ফেলে এসেছে।
২১. নীলাঞ্জনা মেয়েটি
শনিবারের রাত। উইক এন্ডের পার্টি নাইট। ম্যানহাটানের ইটালিয়ান বারে পলাশ যে টেবিলটায় বসে, ঠিক তার উল্টোদিকেই, সুনয়না এক শ্বেতাঙ্গিনী মদের গ্লাসটা ডান হাতের তিন আঙুলে ধরে হালকা সিপ দিতে দিতে ওর দিকে বেশ কয়েকবার তাকিয়ে মুচকি হাসলো। পাশেই হাতের চামড়ায় আঁকা লাল-কালো জোড়া ঘোড়ার টাটু! স্লিভলেস কালো গেঞ্জি পরা ঘাড় অবধি কালো চুলের তরঙ্গ। স্বাস্থ্যবান এই সাদা পুরুষটি মেয়েটির বয়ফ্রেন্ড, নাকি শুধু বারের ক্ষণকালীন কোম্পানি, পলাশ তা নিশ্চিত নয়। তবে খুব ভালো লাগছে মেয়েটির তাকানোর ভঙ্গিটি। সুন্দরী আর কাকে বলে। এককথায়, অপূর্ব। গলার দু’পাশে কলার বোন দুটো তীরের মতো খাড়া। চিবুকের মাঝখানে গাঢ় তিল। গালে টোল। কালো স্কিনটাইট গেঞ্জির ভেতর দিয়ে হাতের মুঠির মাপে সুডোল একজোড়া স্তনের উঁকিঝুঁকি। জিনসের প্যান্ট আর গেঞ্জির মাঝখানে ছ’আঙুল মাপের মেদবিহীন সমতল নাভিমূল। মেনিকিওরড হাতের আঙুলে দু’রঙের নেইল পলিশ দিয়ে ডিজাইন করা নোখ। ক্ষীণ কটিদেশ। কাম জাগানো ভারি নিতম্ব আর পাকা কামরাঙার মতো রসালো পুরু দুটো ঠোঁট। সব মিলিয়ে তন্বী মেয়েটির তত শরীরে যাদুকরী সৌন্দর্য। এত সুন্দরী মেয়ের তো পুরুষের অভাব হওয়ার কথা নয়। টেবিলের সামনে দিয়ে যেতে যেতে প্রায় সবাই এই গভীর নীল চোখের নীলাঞ্জনার দিকে একটু হলেও আড়চোখে তাকাচ্ছে। কিন্তু সোনালি চুলের এই নীলাঞ্জনা কেন শুধু তার দিকেই তাকিয়ে মুচকি হাসছে! আবারো! হ্যাঁ, সে আবারো দু’বার তিনবার তাকিয়ে মুচকি হাসলো! পলাশ মদের গ্লাস হাতে, একা বসে। সেও তাকিয়ে দেখছে, নীলাঞ্জনা মেয়েটির মতিগতি। এইতো আবার সে তাকালো! আড় চোখে, না তেরচা চোখে বোঝার উপায় নেই।
সমস্ত দিন ক্যাব চালিয়ে শরীর ক্লান্ত হলেও শুধু রোববার রাতেই সে বারে মদ খেতে আসে। কোনওদিন দল বেঁধে। কোনও দিন একা। আজ রাতে সে একা। বারে। এসে মদ খেতে আড্ডা দিতে ভালো লাগে। লাইট আর ওয়েস্টার্ন মিউজিকের এ্যাফেক্টে মন চাঙ্গা মচমচে মুড়ির মতো হয়ে যায়। মনে হয়, গান আর মদের এই। পৃথিবীটাই আলাদা। বলা চলে, ক্ষণিকের বেহেশত। প্রবাসের নিঃসঙ্গতা ভোলার বেহেশত। এ বেহেশত দেশে যেতে না পারায় রিতা এবং ছোট দুটো মেয়ের বেদনাবিধুর আর্তনাদের বাইরের বেহেশত। এ বেহেশত রুমনোকে ভুলে যাবার …।
ম্যারেড ব্যাচেলর, জেনুইন ব্যাচেলর, উইন্ডো ব্যাচেলর, সব ধরনের বাংলাদেশি ক্যাবি ব্যাচেলর, বন্ধুগুলোর সাথে বারে উইক এন্ডে বসে প্রবাসী পলাশেরা আড্ডা দেয়। সারা সপ্তাহ ওরা নিজের শরীরের চামড়া পিটিয়ে, হাড্ডি মাংস খুইয়ে পরিবারের দায়িত্ব পালন করে। দেশে প্রায় সবারই পরিবার আছে। পরিবার থাকলে স্বপ্ন আছে। ওরা পরিবারের স্বপ্ন পূরণ করতে এ দেশে থাকে। বাবার জন্যে কমোডসহ দালান বাড়ি। দশ বিঘে বন্ধকী জমি ছাড়িয়ে অতিরিক্ত আরো বিঘে দশেক কেনা। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে যৌতুকের রসদ জোগানো। জামাইয়ের জন্যে লার্জ স্ক্রিন টিভি, ডিভিডি, রোলেক্স ঘড়ি। বেকার দুটো ভাইয়ের বিয়ে। ওরা অর্থাৎ পলাশ নামের এই তরুণ যুবকগুলো পরিবারের স্বপ্ন পুরো করতে স্টুডেন্ট ভিসা, ভিজিটর ভিসা, বিজনেস ভিসা, ডিপ্লোমেট ভিসা ইত্যাদি নিয়ে নিউইয়র্কের এই মেট্রোপলিটন শহরে এসে অধিকাংশই ইল্লিগ্যাল, লিগ্যাল ক্যাব ড্রাইভার কিংবা নির্মাণ কর্মী ইত্যাদি হতে বাধ্য হয়। ওদের পাঠানো অর্থ দিয়ে পরিবারের অবস্থা ভালো হয়। দেশে আর কোনও অভাব-অভিযোগ থাকে না। তবে চাহিদাটা স্থায়ী। পলাশ এবং ওরা দেশে বাবা-মা ভাই-বোন-স্ত্রী-সন্তান-বন্ধু-আত্মীয় পরিচিতদের এই অন্তহীন চাওয়ার ফাঁদে আটকা পড়ে, আটকে গেছে হলুদ রঙের ট্যাক্সিগুলোর ড্রাইভার সিটে। দূর থেকে যাত্রীরা হাত দেখিয়ে বলে ট্যাক্সি! পলাশ এবং ওরা প্রতিদিন বারো ঘণ্টা মিডটাউনে ওদের ডাকে সাড়া দিয়ে এভাবেই কাটিয়ে দেয়। যতবার যাত্রী বদলায়, ততবার টিপস। দিনশেষে খাইখরচা বাদে থাকে দেড় থেকে দুশো ডলার। অর্থাৎ ষাট দিয়ে গুণ দিলে দিনে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা। এমন বেহেশত কি বেহেশতেও আছে? শাহীন বলে, না। পলাশ এবং ওরা মোল্লাদের খোতবার বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ করে বলে, বেহেশত যদি কোথাও থাকে তাহলে সেটা আছে আমেরিকাতেই।
পলাশ বিবাহিত। দেশে আছে দুই মেয়ে এবং স্ত্রী। এক ভাই, তার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে। তিন বোন তাদের স্বামী এবং ছেলেমেয়েরা, গ্রামের বাড়ি ভোলা, বরিশাল। নদী-নালার শহর। পলাশের বাবা রিটায়ার্ড পোস্টাল ক্লার্ক। মা ধর্মভীরু গৃহিণী।
পলাশ এসেছিল লায়ন্স ক্লাবের মেম্বার হিসেবে কনভেনশনে যোগ দিতে। দেশে অনার্সসহ বি.এসসি পাস করে দর্জির কাজ কিংবা কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাদের অ-আ শেখাতে সে রাজি হলো না বলে বাবা অসন্তুষ্ট। তিনি বললেন একটা কিছু করে টাকা তো আনতে হবে! বাচ্চা পড়াতে দোষ কী? বাচ্চা তো বাচ্চা। ওরা তো কাঁদবেই। পলাশ সেসব কিছুই করবে না। রাগ করে বাবা একদিন বললেন, বাড়ি থেকে বের হয়ে যা। বেকার হারামজাদা। যে অবধি কাজ করে টাকা আয় না করতে পারবি তদ্দিন। বাড়ির কথা ভুলেও মনে করবি না। এরপর পলাশ প্রায় মরিয়া হয়ে উঠলে একলোক তাকে লায়ন্স ক্লাবের মাধ্যমে ভিসার খবর দিলো। দু’লক্ষ টাকা হলে আমেরিকার ভিসা পাওয়া যাবে। পলাশ বাড়ি ফিরে বাবা-মা-স্ত্রীকে বুঝিয়ে বললো দু’লক্ষ টাকার কথা।
পলাশ এবং তার পরিবার জানে পলাশ আমেরিকাতে গিয়ে ইল্লিগ্যাল হয়ে যাবে এবং অন্য আরো অনেকের মতো আর হয়তো দেশে নাও ফিরতে পারে। জেনেশুনেই পলাশকে প্লেনে তুলে দিলো ভিসার জন্যে নগদ দু’লক্ষ টাকায় জমি বিক্রি করে। সে নিউইয়র্কে এসে উঠলো এক বন্ধুর বাড়িতে।
পলাশ, ওর বন্ধুর ওখানে থাকা অবস্থাতে প্রায় দু’মাস পর ব্রুকলিনের একটা বাংলাদেশি গ্রোসারি স্টোরে কাজ পেলো। মিট কাটারের চাকরি। গরুর বিশাল দেহ কাটা ওর কাজ নয়। দু’চারদিন পরই সে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে অন্য চাকরি খুঁজে নিলো। এভাবেই সে গ্রোসারি স্টোর, নির্মাণ, রেস্তরা বিভিন্ন জায়গায় কাজ পরিবর্তন করতে থাকলো। কোনওটাই ওর ভালো লাগছে না। ইতোমধ্যেই নিউইয়র্কের অনেক বাংলাদেশির সাথে পরিচয় হলো। অধিকাংশই বললো ট্যাক্সি চালানোর কথা। চালাবে কি করে! ওর তো লাইসেন্স নেই! পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে ভুয়া আন্তর্জাতিক লাইসেন্স আনিয়ে সে গেল ওয়াশিংটনে। সেখানে দু’শ ডলার দিলে কুড়িটি গত্যাধা আররি প্রশ্নপত্র পাওয়া যায় মোটর ভেহিকল ডিপার্টমেন্টে। নিজেকে আররি ভাষাভাষী বলে পরিচয় দিয়ে, সেগুলো মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাস করলো। তারপর ভুয়া গ্রিনকার্ড হলো। ধরা পড়লে জেল। পলাশ ফেইক গ্রিনকার্ডটি তোশকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে, যদি কখনো কাজে লাগে। এতসব ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আজ পার্টি, কাল বিয়ের দাওয়াত, পরশু সোসাইটির মিটিং এই করে এরই মধ্যে পলাশের অনেক বন্ধু-বান্ধব জুটে যায়। নিঃসঙ্গতা কাটাতে উইকএন্ডে এ-বাড়ি সে-বাড়ি করতে করতে হঠাৎ করে একদিন বন্ধুত্ব হয়ে গেল রুমনোর সঙ্গে।
রুমনো ওরফে রুমা, বাংলাদেশের মেয়ে। ডিভোর্সি। একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে সেলস গার্লের চাকরি করে। রুমনো স্মার্ট, সুন্দরী। মজিদ সাহেবের বিয়ের পার্টিতে রুমনো যেচে এসে পলাশের হাতে একটা পেপার প্লেট দিয়ে বললো”খাবেন না? সবাই খাচ্ছে!” পলাশ নড়েচড়ে উঠলো। হঠাৎ এত সুন্দরী চকমকে একটা মেয়ে এসে খেতে বলছে! আসলে পলাশ তখন দেশে ওর স্ত্রী রিনার কথা ভাবছিল। চোখে দু’ফোঁটা জল। মুছতে না পেরে গিলে খেল। ”নিন, ধরুন। ঐ যে কত সব খাবার পড়ে আছে। কি ভাবছেন এত!” বলে রুমনো পলাশের প্লেটটা নিয়ে চোখ দিয়ে বড়শির মতো ওকে টেনে নিয়ে গেল। কি খাবেন বলুন!’ পলাশ অবাক হয়ে মেয়েটার স্বতঃস্ফূর্ততা আর স্মার্টনেস দেখে। ‘কি নাম আপনার?’ ‘পলাশ। পলাশ রায়হান।’ ‘বৌ ছেলেমেয়ে!’ পলাশ ঢোক গিলে হঠাৎ কি ভাবলো। তাৎক্ষণিক উত্তরে বললো, ‘নেই। কেউই নেই।‘ রুমনো মুচকি হেসে খাবারের প্লেটটা হাতে দিয়ে বললো, ”যাবার আগে একবার দেখা করে যাবেন, কেমন!”
রূপের কি বাহার কি মাদকতা মেয়েটির সমস্ত শরীর আর চেহারায়! কত কমনীয় সে! কে সে!”ওহ ভুলেই গেছি। পরিচয় দিচ্ছি। আমার নাম রুমনো। এই নিন আমার কার্ড।” বলে, মেয়েটি ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল। কার্ডটা হাতে নিয়ে পলাশ খাবার প্লেট হাতে বাড়ির কোণায় গিয়ে বসলো, একা। রিনার মুখটা আর মনে এলো না। অপরূপা সুন্দরী, রহস্যময়ী, স্মার্ট রুমনো নামের এই মেয়েটিকে ভালো করে জানতে হবে। কার্ডটা প্যান্টের পকেটে ভালো করে ঢুকিয়ে রেখে তাকিয়ে রইলো ভিড়ের মধ্যে। রুমনো বেশ ক’বার তাকালো ওর দিকে।
রাত গম্ভীর হলো। বিয়ের পার্টিতে রুমনোকে সে শুধু আরেকবার দেখছিল খুব তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেতে। কি এতো তাড়াহুড়ো করে চলে এলেন কেন! কার্ডটা দিয়ে কোথায় উধাও হলেন। কত খুঁজলাম! পরদিন ঘুম থেকে উঠেই পলাশ রুমনোকে ফোন করলো। সারারাত সে ছটফট করেছিল এই সকালটুকুর জন্যে।
–ব্যাগ খুলে দেখি চাবি নেই। ভাবলাম, ঘরের দরজায় হয়তো ভুলে ফেলে এসেছি। সর্বনাশ! ভেবে, ভয়ে ছুট দিলাম। কিন্তু কি জানেন! পরে দেখি চাবিটা ব্যাগেই পড়েছিল। হাউ সিলি! থাক, অন্য কথা বলি। গতকাল আপনাকে দেখলাম খুব একা একা। স্ত্রী বাচ্চা নেই বললেন, কিন্তু বান্ধবী! রুমনো পলাশকে সুধোয়।
–বন্ধু আছে। কিন্তু বান্ধবী নেই। আপনার!
–সবই আছে। আবার কেউ-ই নেই। একা। খুব একা। কাউকে ভালোলাগে না। স্বামী ছিল। মনের মতো কোনদিনই মেলেনি, মিশ খায়নি। তাই ডিভোর্স হয়ে গেছে।
পলাশের হার্ট ডাব লাব ডাব ডাব করতে শুরু করলো। একদিন আসুন আমার গরিবালয়ে। খুব খারাপ অবস্থা। এলে বসতে দিতে পারবো।
–বেশ ভালো। ঠিকানা দিন। টেলিফোন নম্বর?
–সত্যিই আসবেন!
–‘বাহ! না আসার কি আছে। বললে কাজশেষে আজ বিকেলেই আসতে পারি। কাজের পর কি করছেন? আমি ফ্রি।’ পলাশ চমকে উঠলো। প্রস্তুতির অভাব ছিল মনে। চট করে বলতে পারলো না। বললো ‘কাল আসুন। আসবেন?’ মনে মনে ভাবলো একদিন সময় হাতে থাকা ভালো। একটু ভাবা যাবে। একটা অপরিচিত সুন্দরী মেয়েকে চট করে এভাবে আসতে বলাটা যে রিস্কি, অন্তত সে ভাবনার সময়টুকু পাওয়া যাবে। মন না চাইলে মানাও করে দেয়া যাবে। মুহূর্তের জন্যে ভাবলো সে। ওকে, কাল আসবো। ঠিকানাটা লিখে নিচ্ছি বলুন।
–রুমনো ফরিদপুরের মেয়ে। এখানে একটা এপার্টমেন্টে একজনের সঙ্গে রুম শেয়ার করে থাকে। সিটির চাকরি করে। স্বামী কলকাতায় গিয়ে ডিভোর্সের পর সে আবার বিয়ে করেছে। রুমনো আমেরিকায় চলে আসে সমীর বাবুর সাথে ডিভোর্সের পর। রুমনো আলট্রা মডার্ন। কিন্তু সমীর চ্যাটার্জি ঠিক তার উল্টোটা। ভারিক্কি আর আধ্যাত্মিক ধরনের পুরুষ। মন মেজাজে রক্ষণশীল। তাই বিয়ে ভেঙে গেল মাত্র তিন বছরের মাথায়। এ দেশে রুমনোকে অনেকেই বিয়ের প্রস্তাব দিলেও সে প্রত্যেকটি প্রস্তাবই নাকচ করে দিয়ে বলেছে ভালো আছি। স্বাধীন জীবন। নাক গলাবার কেউ নেই। তাই বিয়ের কথা বললেই হো-হো করে হাসে এই দারুণ অহঙ্কারী মেয়েটি। কিন্তু পলাশের এক ডাকেই সে চলে গেল পরদিন সোজা ওর এপার্টমেন্টে। কেন! ভেবে নিজেও সে অবাক হয়।
–আসুন। গরিবের ছোট ঘর। মনে কিছু নেবেন না কিন্তু।
–এতো আদিখ্যেতার কোনও দরকার নেই। আমারটা দেখলে নিজেরটাকে গরিব বলবেন না। বলতে বলতে রুমনো পলাশের ঘরে ঢুকলো। পলাশের মনে হলো সে যেন নির্ঘাত স্বর্গ থেকে আসা এক অপ্সরী। দু’জনে ড্রয়িং রুমে বসে গল্প বলতে শুরু করলো।
–চা খাবেন?
–আপনি! খাবেন! চা খাবেন!
–খাবো, বসুন। বানিয়ে আনছি।
–আপনি বসুন। আমি বানিয়ে আনছি। বলুন টি ব্যাগ কোথায়! চিনি! দুধ!
–দেখিয়েই যদি দিতে হয় তার চেয়ে বরং নিজে তৈরি করাই কি ভালো নয়। হাসতে হাসতে পলাশ বললো, আবহাওয়াটা একটু হালকা করতে।
একসময় দুজন দুজনের জীবনের গল্পে মেতে উঠলো। সেই দিনের পর থেকে নিঃসঙ্গ দু’জনের মধ্যে দ্রুত গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব একদিন ভালোবাসায় রূপ না নিয়ে পারলো না। তিন মাস পর রুমনো পলাশের সঙ্গে একই এপার্টমেন্টে মুভ করলো। তারপর থেকে ওরা একসাথে এক এপার্টমেন্টে স্বামী-স্ত্রী জীবন যাপন শুরু করে। এমনি করে পলাশ, রিনার কথা ভুলেই যায়।
–আবার বিয়ের কথা কখনো ভাবিনি। যদি চাও তাহলে নতুন করে ভাববো পলাশ!
–কি দরকার রুমনো! এমনিই ভালো আছি। তুমিই বলেছ। নাক গলাবার কেউ নেই! ফ্রি! বিয়ে হলেই বলবো এটা করো। ওটা করো। এখন তুমি যা ইচ্ছে করতে পারো। তখন পারবে না।
–পলাশ তুমি তো অবিবাহিত। কোনওদিন হয়তো পালিয়ে যাবে। নিশ্চয়ই তোমার বিয়ের ইচ্ছেটা মরে যায়নি। বললো রুমনো।
–‘বলেছি তো পালিয়ে যাবো না। হলো তো!’ রুমনোর মাঝে মাঝেই ভয় হয়। ভয় হয় পলাশ একদিন সত্যি সত্যি চলে যাবে। তাই এরকম প্রায়ই সে পলাশকে হুট করে কথায় কথায় বিয়ের কথা বলে ফেলে, প্রতিবারই প্রত্যাখ্যাত হয়ে লজ্জা পায়। কিন্তু ওর গোপন ইচ্ছেটা কিছুতেই মন থেকে যায় না। পলাশকে ও প্রাণ থেকে ভালোবাসে। শিশুর মতো।
পলাশ বিবাহিত, রুমনো সেকথা জানে না। কিছুদিন পর পলাশ এক কাপ কফি নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ভাবছে রিনার কথা। বাচ্চাদের কথা। রুমনোর কারণে তাকে লুকিয়ে ফোন করতে হয়। রুমনো, শুনলে কষ্ট পাবে। কিন্তু আর কতদিন এভাবে! রিনা ওর স্ত্রী। রুমনো তাহলে, কে! বান্ধবী! এই বন্ধুত্ব কি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের চেয়েও গভীর নয়! দু’জন একসাথে থাকছে। স্বামী-স্ত্রীর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাতে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। শরীর খারাপ লাগলে স্ত্রীর কোমলতা দিয়ে শিয়রে বসে রুমনো রাত জাগে। এই সম্পর্ক কি মেকি? ভাবতে ভাবতে পলাশ এসে ধড়াস্ করে শুয়ে পড়লো চারপেগ নির্জলা হুইস্কি খেয়ে।
এমনি করেই আরো দু’বছর পার হয়ে যায়। রুমনো যদি চলে যায়! তার চেয়ে বরং ওকে বলাটাই ভালো নয় কি! রুমনোকে সে ছেড়ে থাকতে পারবে না। রিনাকে সে কি দোষে ডিভোর্স দেবে! বরং রুমনোকে সব কথা খুলে বলবে। বলবে, রুমনো–কে সে রিনার চেয়েও বেশি ভালোবাসে। নিশ্চয়ই সে তা বুঝবে।
–কি ভাবছো! চোখে জল কেন! এ কি, পলাশ!
–তোমাকে একটা কথা বলা প্রয়োজন।
–বলো। হাতে চায়ের কাপটা কেঁপে উঠলো। ‘বলো, কি বলবে?’
–বলছি। চলো ভেতরের ঘরে গিয়ে বসি।
–রুমনো, আমার অপরাধ নিও না। আর পারছি না, না বলে থাকতে। তোমার মতো সুন্দর মনের মানুষ আমি জীবনে কাউকেই দেখিনি। তোমার মতো ভালোও কাউকে দেখিনি। লোকে তোমাকে ভুল বুঝে, বুঝুক। আমি কিন্তু জানি, তুমি ভালো। খুব ভালো।
–রুমনো আমি বিবাহিত। দেশে আমার স্ত্রী এবং দুই মেয়ে আছে। রুমনো পলাশের কথার কোনও উত্তর দিলো না।
–কি কিছু বলছে না যে! রুমনো! কিছু বলো! বলো আমি নষ্ট! খারাপ।
–‘কি বলবো বল। সবই ঠিক আছে।’ বলেই রুমনো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
সেই রাতেই মিডটাউনের ক্রসিংয়ে বিরাট এক গাড়ি এক্সিডেন্টে রুমনো মাতাল অবস্থায় মারা গেল। ওর মৃত্যু নিয়ে পত্রপত্রিকায় হৈ-চৈ। পুলিশ এসে পলাশকে মর্গে নিয়ে গেল। দেহ সনাক্ত দাহন ইত্যাদি সব পলাশই করেছিল। দাহনের আগে বিয়ের কাজটুকু ফিউনারেল হোমেই পলাশ মন্দির থেকে ব্রাহ্মণ ডেকে এনে সম্পন্ন করলো। ওকে শাখা সিঁদুর পরিয়ে দিলো। রুমনো হিন্দু, পলাশ নয়। কিন্তু ওর কাছে বিয়েটা ভীষণ জরুরি মনে হলো। রুমনোর ইচ্ছা ছিল পলাশের স্ত্রী হওয়ার। এই ইচ্ছে সে অপূর্ণ রাখবে না। কিছুতেই না। হলই-বা বিয়েটা এক মৃতের সঙ্গে। তবুও সে, তার। রুমনোর মৃত্যু ওকে শূন্য করে দিয়েছে। সেই শূন্যতা পূরণ করতেই বারে যাতায়াত। তারপর থেকে যথেষ্ট সুযোগ পেলেও আর কোনও মেয়ের সঙ্গে সে বন্ধুত্ব করতে রাজি নয়। এই আগুনের তাপে একবার সে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ঐ যে মেয়েটি মুচকি হাসছে! দেখতে স্বর্গের অপ্সরীর মতো। দেখেই ইচ্ছে হচ্ছে জড়িয়ে ধরে ওর কামরাঙা ঠোঁটে চুমু খেতে।
–‘হাই’! মেয়েটা ওর টেবিলে এলো। ইংরেজিতে বললে, সেই থেকে কি এতো ভাবছো কি! তুমি কি ভারতীয়? ভারতীয় পুরুষদের আমার খুব ভালো লাগে। ওরা খুব ভালো। ওহ নামই বলা হয়নি। আমার নাম ডেলোরেস! তোমার নাম?
–পলাশ। আমি ভারতীয় নই। বাংলাদেশি, কেমন।
–খুব সুন্দর নাম। তোমার পাশে কি বসতে পারি?
–হ্যাঁ, কিন্তু! কিন্তু তোমার সঙ্গে ঐ যেলোকটা এসেছে সে কিছু মনে করবে না? আমি কিন্তু কোনও ঝামেলা চাই না।
না না। ওর সাথে পরিচয় বারে আসার পর। সে আমার কেউ নয়। জাস্ট কম্পোনি। ভেবেছিলাম চতুর, কিন্তু এক্কেবারে গাধা। এবার বলো তুমি কেন এত গম্ভীর। কি হয়েছে! জানো, তোমার চোখ দুটো ভীষণ বিষণ্ণ। সেই থেকে তোমার দু’চোখ আমাকে তাড়া করছে। তোমার চোখে কি যেন একটা রহস্য আছে। তুমি কি জান?
–জানি। আরেকটি মেয়েও আমাকে বলেছিল। তার নাম রুমনো। যেচে এসে তোমার মতোই পাশে বসেছিল। একদিন ফুরুত করে কোথায় যেন পালিয়ে গেল। তা বলো তুমি কি জন্যে এসেছো?
–এমনিই। না চাইলে চলে যাবো।
–না-না বসো। মানে, তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে ক্লাবে এতো সুন্দর ছেলেদের রেখে আমার পাশে…!
–‘সিগ্রেট খাবে?’ বলে জাদুকরী হাসিতে দাঁড়ালো ডেলোরেস।
–খাবো। আছে?
–‘আছে। মার্লবরো। রেগুলার। এই নাও।’ বলে ঠাস করে লাইটার জেলে সিগ্রেটটা ধরিয়ে দিল। নিজেও একটা সিগ্রেট খেতে খেতে বললো, রুমনো কি তোমার স্ত্রী না বান্ধবী! পলাশ আঁতকে উঠলো। কি কঠিন প্রশ্ন। সর্বনাশ! একথা তো সে ভাবেনি কখনো! কি উত্তর দেবে? স্ত্রী? আমার স্ত্রীর নাম তো রিনা। কিন্তু যাকে সিঁদুর পরালাম! ছি! এসব কি ভাবছি? আমি কি পাগল হয়ে গেছি! একটা মানুষ ক’জনকে ভালোবাসে!
–কি, বলবে সে!
–স্ত্রী, রুমনো আমার স্ত্রী। হলো! কেন জানতে চাইছো? তোমার সাথে আমার সামান্য পরিচয়ে এতো কথা কেন জিজ্ঞেস করছো? তুমি খুব নাকগলাও।
স্যরি, আমি এতো কিছু ভেবে বলিনি। ইটস ওকে। আমিই বরং স্যরি। আসলে কি জান। রুমনো মরে গেছে। আমার খুব কষ্ট হয় ওর জন্যে, তাই চেঁচিয়ে উঠেছি।
–আমি খু-উ-ব দুঃখিত। যাচ্ছি।
–না, তুমি বসো। তুমি বসে থাকবে। কিছুক্ষণ অন্তত। তোমাকেও আমার ভালো লেগেছে। অনেকটা রুমনোর মতোই তুমিও। রুমনো একদিন আমার জীবন জুড়ে এমনি করেই এসে বসেছিল…। তোমার মতোই সুন্দরী সে। কমনীয়। স্মার্ট। শুধু ওর চুলগুলো ছিল কালো এবং কোকড়ানো। বলে রুমনোর ছবিটা ওয়ালেট থেকে বের করে দেখালো।
–অদ্ভুত সুন্দরী। আমি দুঃখিত যে সে বেঁচে নেই। তোমার দুর্ভাগ্য।
–ডেলোরেস এবার তোমার কথা বল।
এবার একটু পজ দিয়ে হাতের সিগ্রেটটা নিবিয়ে ফেলে বললো–আমি সুন্দরী এবং ধনী, কিন্তু নিঃস্ব। তাই বারে আসি। বন্ধুর খোঁজে। এক বছর ধরে প্রকৃত বন্ধু খুঁজছি। অনেকের সঙ্গে বসেই মদ খাই কিন্তু মনের মতো কাউকেই পাচ্ছি না, যাকে সত্যিকারের বন্ধু বলা যায়। ঐ যে লোকটার সঙ্গে মদ খেলাম, সে একটা স্টুপিড। পরিচয়ের পরেই বলে চু-উ-মু খাবে। আই হেইট হিম।
–আমার বাবা-মা ডিভোর্সড। পোর্টোরিকো থেকে এখানে এসে ওয়াল স্ট্রিটে কাজ করেছি। সেখানে ট্রেনিং নিয়ে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং শিখেছি। এখন আমি ওয়াল স্ট্রিটে চাকরি করছি খুব উঁচু পদে। নাসডাক স্টকের সিম্বল নিয়ে টিভি-তে যে ফিতে নড়ে, আমি সেসবের দায়িত্বে। তুমি স্টক করো?
–করি না। কিন্তু বুঝতে পারি তুমি কি বলছো। এই কাজ তো খুব গুরুত্বপূর্ণ। দাও আরেকটা সিগ্রেট দাও। তোমার কথা আরো বলো। ভালো লাগছে।
বারে তখন জমজমাট আড্ডা পিং-পং টেবিলের জন্যে লাইন ধরে লোক। ড্যান্স ফ্লোরটা দারুণ মেতেছে। জোড়ায় জোড়ায়-যৌবনের তরঙ্গ পুরো বারটা জুড়েই। মধ্য বয়সের সব যুবক-যুবতী। যৌবন তরঙ্গে–উত্তাল সমুদ্রের জোয়ারের মতো শ্বেতশুভ্র ঢেউয়ের মতো আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্ছে জোড়ায়-জোড়ায়।
–নাচবে! ডেলোরেস জিজ্ঞেস করলো।
–নাচতে জানি না।
–দেখিয়ে দেবো।
–আরেক দিন, আজ না।
–চলো প্লিজ! আমি তোমার সাথে নাচতে চাই। তোমার চোখ সুন্দর। আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে ভাসতে চাই।
–পরে যাবো, আরো বলো তোমার কথা। তোমার স্বামী-ছেলেমেয়ে।
–আমি ডিভোর্সড। ছেলেমেয়ে নেই। মাতালটা শরীরের লোভে বিয়ে করে দু’বছর পরে অন্য মেয়ের সঙ্গে চলে গেল। আমি তখন গরিব। এতো সুন্দরীও ছিলাম না। আমি এই অবিচারের প্রতিশোধ নিয়েছি। এখন আমার অনেক টাকা। ম্যানহাটানে এপার্টমেন্ট। লোকটা ফিরে আসতে চায়। ইউ কিডিং! আমি খুউব ভালো আছি একা। কিন্তু নিঃসঙ্গতা মাঝে মাঝে কুরে কুরে খায়। আমি একজন ভালো সঙ্গীর অপেক্ষায় আছি পলাশ। যাই হোক এবার চলো নাচবো।
–চলো। তবে আগেই বলেছি, আমি নাচতে জানি না।
–বলেছি তো শিখিয়ে দেবো।
ডেলোরেস হেসে পলাশের হাত ধরে টান দিল।
ডি-জের নিয়ন্ত্রণে ড্যান্স ফ্লোরে তখন মাকারিনা বাজছে। ফ্লোরে সবাই ভীষণ মুডে। ডেলোরেস ওর পেন্সিল হিলের ওপর পাক দিয়ে পলাশের কোমরে হাত দিল। পলাশের ডান হাতটা নিজের বাম হাতে ধরে নিজের ডান হাত পলাশের কোমরের পেছনে দিয়ে ওকে ঘুরপাক খাওয়াতে থাকলো। পলাশ ওকে ফলো করলো। ডেলোরেস প্রতিটি স্টেপ ওকে ধরিয়ে দিল। আধ ঘণ্টার মধ্যে পলাশ ওর ডান পা বাম পা-তে ঠিকমতো বিট মিলিয়ে সবার সঙ্গে মাকারিনা নাচতে থাকলো। এবার ডি-জে স্লো ড্যান্সের মিউজিক দিলো। লাভ সং। ভীষণ স্লো। শুধু বুকে মাথা আর হাতে হাত রেখে ঢেউয়ের মতন দুলে দুলে নাচা ছাড়া করার কিছু নেই। পলাশের বুকে আচমকা ডেলোরেস ওর মাথা রাখতেই পলাশ, আঁতকে উঠে মনে মনে বললো, সর্বনাশ।
–পলাশ, আমার নিঃসঙ্গতা ঘোচানোর জন্যে তোমার মতো সুন্দর আকর্ষণীয় সুপুরুষ আমি দু’বছর ধরে খুঁজছি। আমি কামার্ত! আমি রিক্ত! আমি … আমি …। জানো! আমার অনেক অর্থ। দেখো আমার কানের দুটো হীরের দাম পঞ্চাশ হাজার ডলার। আর শরীরে এখন দুশো হাজার ডলারের হীরে আছে। ব্যাংকে আমার লক্ষ লক্ষ টাকা। কিন্তু শান্তি নেই। আমি রাতের বেলায় কারো বুকে মাথা রেখে দু’বছর ঘুমোইনি। মাঝরাতে বুকের ভেতর নিঃসঙ্গ সমুদ্র গর্জে ওঠে। এই অর্থবিত্তের কি মূল্য, বলো! তুমি যদি চাও আমরা ডেইট করে দেখতে পারি যে, আমরা একজন আরেকজনকে ভালোবাসতে পারি কি, পারি না।
পলাশ, এসবের কিছুই বুঝতে পারছে না। এতো দ্রুত সব ঘটছে। অথচ ডেলোরেসের মতো মেয়েকে ‘না’ বলাটাও বোকামো। সেতো একটা সোনার হরিণ!
–ডেলোরেস বাড়ি যেতে চাই। মদ আর খাবো না। বমি আসছে।
–আমার বাড়িতে চলো। যত্ন করবো।
–না ডেলোরেস। নিজের বাসায় না ফিরলে রুমমেট দুশ্চিন্তা করবে।
–ম্যানহাটানে-আমি তোমাকে যে একা ছাড়তেই চাই না। তুমি মাতাল। রাস্তায় পড়ে যেতে পারো।
–ডেলোরেস আমি ভালো থাকবো। ভেবো না। আজ যাই।
–ঘরে গিয়ে ফোন করবো।
–হ্যাঁ।
–এই নাও কার্ড। সব নম্বর দেয়া আছে। ফিরেই কল করবে, প্রমিজ! তোমার নম্বরটা!
–‘নেই ডেলোরেস। রুমনো সেটা ওর চিতায় নিয়ে গেছে। আসি।’ বলে পা দুটো কোনরকম টেনে পলাশ হাঁটতে শুরু করে।
ডেলোরেস তাকিয়ে দেখলো পলাশ সামান্য দুলছে। রাস্তায় বাতির নিচে এক কোণায় দাঁড়িয়ে হাতের কার্ডটা কয়েক সেকেন্ড পড়লো। ডেলোরেস রড্রিগ্যাজ। সিনিয়র কন্ট্রোলার। এস ই সি। সর্বনাশ! এই কার্ড যদি সত্যি ওর হয়ে থাকে তবে ও কত বড়মাপের মানুষ। কিন্তু পরিস্থিতির কাছে কত তুচ্ছ, অসহায়! এই মেয়ে তো সোনার হরিণ!
না–না এ আগুনে আর ঝাঁপ দেয়া নয়। এবার পালাতে হবে। জীবন নিয়ে। রুমনো আমার সব নিয়ে গেছে।
কার্ডটা ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে দিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে পলাশ দ্রুত বাড়ি ফিরে গেল। পরদিন রাতে সে রিনাকে ফোন করলো। বাবাকেও। সবাইকেই জানালো ওর দুর্বিষহ প্রবাস জীবনের কথা। ‘বাবা এবার দেশে ফিরতে চাই। আর পারছি না। কত বছর রিনা আর মেয়েদের দেখিনি। এবার ফিরে একসঙ্গে বাঁচতে চাই।’
কি বলিস পলাশ! লোকেরা একটা আমেরিকার ভিসার জন্যে মরে যাচ্ছে। খবরদার! এই চিন্তাও করিস না। জানিস দেশের কি অবস্থা! বসে খেলে রাজার ভাণ্ডারও ফুরিয়ে যায়, তুই নিশ্চয়ই পাগল হয়ে যাসনি। দেশ, দেশ নেই। চুলোয় গেছে। সরকার একটা আস্ত জানোয়ার! একটা এঁটো শুয়োর! আমি গাজীপুরে দশ লক্ষ টাকার জমিতে সামান্য বায়না দিয়ে দিয়েছি। বাকি টাকা এক বছরের মধ্যেই লাগবে। ওসব চিন্তা মাথায় কিছুতেই জায়গা দিবি না। তুই দেখ কি ভাবে টাকাটা দ্রুত পাঠাতে পারিস। পাগল না হলে কি কেউ আমেরিকা থেকে ফিরে আসতে চায়। রিনাও নির্লিপ্ত রইলো।
‘না বাবা পাগল হয়ে যাইনি। তবে হবো। শিগগিরই হবো।’ বলে, পলাশ ফোন নামিয়ে আনমনা হাঁটতে হাঁটতে সেই বারে গেল।
ভাবছে, বাবা-চাচা, স্ত্রী কেউই রাজি হলো না ওর দেশে ফিরে যাবার সিদ্ধান্তে।
ইস! কার্ডটা থাকলে ডেলোরেসকে আজ একটা ফোন করা যেতো। বারে তিন আঙুলে মদের গ্লাস ধরে রাজ্যের ভাবনা মাথায় নিয়ে সে একা বসে আছে। ডেলোরসের কথা ঘুরেফিরে মনে পড়ছে। কিন্তু নম্বর নেই। ভাবলো, সেই বরং ভালো। কী প্রয়োজন এই মায়ার খেলার! ডেলোরেস ক্ষমা করো। তুমি সুখী হও। তোমার ইচ্ছে পূর্ণ হোক। তুমি কাউকে খুঁজে নাও। ভাবতেই ডি-জে লাইটটা কমিয়ে দিয়ে স্লো ড্যান্সের মিউজিক ছাড়লো। ফ্লোরে সে একা নাচতে থাকলো। আবছা আলো আঁধারে ওর চোখ গিয়ে পড়লো অন্য কোথাও। রিনা আর তার দুই মেয়ে। দৌড়ে আসছে ওকে দুয়ারে দেখে। কল্পনায় সে দেশে ফেরে। আবছা আলোয় নাটকীয়ভাবে খেলে যাচ্ছে ওর চোখের সামনে রিনা, মলি আর মেঘনার আলো-অন্ধকার মুখ।
সেই ছায়ায়–ওরা সবাই ঘুরতে থাকলো দুয়ারের একটা গাছের নিচে। মাথার উপর পূর্ণিমার মস্ত চাঁদ। গাছে দুটো ফুল, ডালপালাগুলো সবুজ পাতায় ছাওয়া। ওরা ঘুরে ঘুরে নাচছে। এর মধ্যে ফুলকির মতো হঠাই কোত্থেকে ডেলোরেস এলো। পলাশ শুধু দুই বাহুতে ওকে জড়িয়ে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ঘষলো। মুখে কেউ কোনও কথা বললো না। ফ্লোরে তখন, স্লো মিউজিক। দু’জনেরই চোখে অল্প জল–ক্লাবে নিভু নিভু সোনালি আলো। ডেলোরেস কখন থেকে যে ওর বুকে মাথা রেখে নাচছে, কিছুতেই সে মনে করতে পারছে না। একবার ভাবলো একি সত্যি! নাকি কল্পনা। হঠাৎ দু’চোখে কিছু একটা অনুভব হলো। ডে-লো-রে-স …।
২২. পর্নো কুটিরে কুটিরে
ক.
নগরকেন্দ্রিক জীবনের আরেকটি দিক, যা দারিদ্রের নয়। পুঁজিবাদ বা বিত্তবাদ যাই বলা যাক।
এই জীবনের সঙ্গে জড়িত লক্ষপতি, কোটিপতি, যারা আপার ক্লাস। নিরাপত্তা প্রহরী-ঘেরা প্রাসাদতুল্য আধুনিক স্থাপত্যশিল্পের সৌন্দর্য ও শোভামণ্ডিত নয়নাভিরাম আবাসনে যারা থাকে। যাদের গ্যারেজে একাধিক এস.ইউ.ভি, ইম্পোর্টেড এবং অবশ্যই ব্র্যান্ড নিউ। এয়ারকন্ডিশন অফিসে যাদের বিদেশি ডেলিগেটরা পর্যন্ত এল.সি. কিংবা ফরেন এক্সচেঞ্জ কমিশনের পলিসি নিয়ে কোনও বাঙালির কৃপাধন্য হতে ভৃত্যের মতো করুণ মুখ করে বসে থাকে। পানির বদলে ইম্পোর্টেড জার্মান বিয়ার কিংবা প্রাচীন দামি স্কচ অথবা ইম্পোর্টেড বয়স্ক চিজ সঙ্গে রাশ-শ্যান কেভিয়ার! মহাখালী সিগনাল থেকে অদূরেই গুলশান, বনানী, বারিধারা। জি-হ্যাঁ, আমি সেই এলাকার সব ভাগ্যবান বাঙালি বিত্তশালী যুবাদের কথাই বলছি, যারা সংখ্যায় স্বল্প তবে সেক্রেটারিয়েট টু সংসদ এবং আরও অনেক কিছুই যাদের নাগালে।
প্রধানত গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকাগুলোই বেছে নেন এইসব বিত্তশালী এবং গজিয়ে-ওঠা আরো নব্য বিত্তশালী বা বিদেশ থেকে যেসব কোটিপতি দেশে আজকাল বাড়িঘর কিনতে চান বা ব্যবসা করেন, তারাও এই তিনটে এলাকাকেই টার্গেট করেন। এবং এই এলাকার বাসিন্দাদের চলাফেরা এবং তাদের আনুষঙ্গিক অন্য ব্যাপার স্যাপারগুলো দেখলে বুঝতে কিছুতেই কষ্ট হবে না-ওরা আপার ক্লাস। এবং নিরঙ্কুশ আপার ক্লাস, যেখানে পশ্চিমি হাওয়া, অর্থনৈতিক বিপ্লব-পাল্টে যাওয়া সমাজ ও তার রুচি, নাগরিক সভ্যতা এবং সংস্কার তার নব্য অঙ্গসজ্জার অলঙ্করণে কাজ করে চলেছে।
যাদের জীবনযাত্রা বাংলাদেশের মিডল ও লোয়ার ক্লাসের মানুষদের সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু একটি মূল আধ্যাত্মিক জায়গায় এসে সবার সঙ্গে তাদের অভিযান তীব্রভাবেই লক্ষণীয়। তাদের যৌনজীবন এবং যৌনজীবনে ক্রাইসিস। পার্থক্য তার-স্বাতন্ত্র, শোভা ও অলঙ্করণে, ক্লাস বুঝে। –কাম ও রতির অনিবার্য ক্ষুধা-কামার্ত শরীরের প্রহরে প্রহরে পীড়ন। পেষণের আকাক্ষা, অনুভূতি। দ্রুত ক্রিয়াশীল হৃদয় ও মন, লিঙ্গবিশেষে, জায়গামতো গজে-ওঠা দুটি সুউচ্চ পর্বত চূড়া-একটি যযানি ও একটি লিঙ্গ। এই নেটওয়ার্কটি, যার কেন্দ্রস্থল হলো দশ বিলিয়ন কোষ সমৃদ্ধ মস্তিষ্কের নার্ভাস সিস্টেম, সেখানে ক্লাস বলে কিছু নেই। না বিত্ত, না ক্ষমতা। এখানে সঙ্কেত ধ্বনি পড়লে অবস্থা সবার জন্যেই এক, ও একরকম জরুরি।
সুতরাং সেক্স ক্রাইসিস সব ক্লাসের মধ্যেই একরকম। এবং ক্রাইসিসের নিরাময়ও এক। শুধু রাস্তা ভিন্ন। একজন রিকশাচালক বা দিনমজুরের জন্যে যদি হয় সস্তায় ভাসমান পতিতা, তবে একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের চাকরিজীবী পুরুষটির জন্যে আজকাল শহরের মধ্যেই গজে-ওঠা যে-কোনও সুবিধেমতো একটি গেস্ট হাউজ। কিন্তু যারা উচ্চবিত্ত? সো-কলড-আপার ক্লাস?
শুধুই কি মিডলাইফ? আর্লি-ওল্ড, ক্রাইসিস কার হয় না? এমনকি চৌদ্দ বছরের কিশোর-কিশোরী–পঁয়তাল্লিশের বিবাহিত যুবক-যুবতী এবং পঁয়ষট্টির বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। হতে পারে বিধবা বা বিপত্নীক। এক কথায় যে-কোনও মানুষ, যে-কোনও বয়সের, যতক্ষণ তাদের মন-অনুভূতি ও শরীর, ক্রিয়া ও সংবেদনশীল থাকছে, যতক্ষণ তাদের শরীরের প্রয়োজনীয় সেক্সজনিত হরমোন রক্তে বইছে এবং যতক্ষণ তারা সুস্থ, কাম এবং রতির তাড়না ততক্ষণ জীবন্ত। আর এই তাড়নাগুলো পরিস্থিতি ও পরিবেশ বুঝে কখনো কখনো বিবাহিত জীবন ছাড়িয়ে চলে যায় বিবাহের বাইরে। এবং গিয়ে তারা প্রাণ পায় ক্রাইসিস বুঝে অবৈধ প্রণয়ে কিংবা পতিতালয়ে। তবে আভিজাত্য যেখানে, যারা আপার ক্লাস। তাদের বেলায় আর্লি মিড বা ওল্ড লাইফ ক্রাইসিসের নিরাময় আসে অন্যান্য ক্লাসের চেয়ে ভিন্ন ক্যাপসুলে এবং এই ক্যাপসুলগুলো বেশ দামি বলে ওরা রিকশাওয়ালা বা কেরানি বাবুদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু সব সত্ত্বেও মাঝে মধ্যে যে এই আপার ক্লাসের বাবুরা ভাসমানদেরকে একেবারেই যে ধরে বা ছোঁয় না সেকথাও ঠিক নয়। তবে দামি ক্যাপসুলই তাদের জন্য অধিক প্রযোজ্য।
বছর কুড়ি আগেও যার অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ। বছর দশেক আগে যে হাওয়া উত্তরে হাওয়ার বসন্ত মত্ততায় আভিজাত্যের জানালা দিয়ে শা-শা করে ঢোকে আর আজ, যে হাওয়া প্রায় সব স্তরের ধনী মানুষগুলোর জীবনযাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে, সেই হাওয়া, পশ্চিমের সেই উতলা হাওয়া দখিনে বয় আমাদের মুক্ত বাতাসে। ফ্রি সেক্স লাইফ। আজ তাই বাংলাদেশের রাজধানী শহর যার মডেল কন্যা, সেই ফ্রি সেক্স লাইফ–অল্প বা মাঝবয়সী সুন্দরী বঙ্গললনা দেশি-বিদেশি প্রশ্নবোধক সব ‘ভায়েগ্রা’ এবং সম্প্রতিকালে ব্যাংকক থেকে আমদানিকৃত ইয়াবা ট্যাবলেট আর অবাধ যৌন ক্ষুধাদগ্ধ সব-সব বয়সের বিত্তশালী পুরুষ এবং তাদের সন্তানেরা, এই জোয়ার লেগে গ্যাছে বাংলাদেশের সব-সবখানে। বিত্তশালীদের আবাসনগুলো আজ একেকটা-পর্নো কুটির, ঘরে ঘরে পর্নো কুটির। বিশেষ করে রাজধানীর গুলশান বনানী-বারিধারা যেখানে আইন তার কোমর সোজা করে দাঁড়াবার স্পর্ধা রাখে না, যেখানে আইন প্রয়োগকারীদেরকে কিনে গোলাম বানিয়ে ছাড়া হয়। ওরা দেখলেও, পকেট ভর্তি হয়ে, চোখ বুজে এড়িয়ে বেরিয়ে যায়।
শুধু পুরুষ কেন–যৌবনের এই ‘পশ্চিমিকরণের’ বসন্ত মত্ততায় কি নারীরা পিছিয়ে? মোটেও নয়। পশ্চিমিকরণের জোয়ারে অনেক পর্নো কুটিরে, নারী ও পুরুষের ক্রাইসিস সমানতালে চলছে। আর আজ –পশ্চিমি হাওয়ায় ভাসা বঙ্গদুহিতাদের অবস্থা এমন যে, কখনো কখনো দ্রুত যেন তারা খোদ পশ্চিমা নারীদেরকেও অতিক্রম করে যাচ্ছে তাদের পোশাক, চালচলন, ব্যভিচার, নেশা এবং মুক্ত অবাধ যৌনতার চালচিত্রে।
ঘরে ঘরে গড়ে উঠছে পর্নো কুটির চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে। ঘরে ঘরে আজ অশান্ত অবাধ যৌবন জোয়ারে টালমাটাল। আজ কি যুবা, কি যুবতী, ইন্টারনেট সেক্স পর্নো কুটির–ভায়াগ্রা বা ইয়াবা ট্যাবলেট যাদের হাতের নাগালে–অতীতের সংরক্ষণশীল রাখঢাক যৌনজীবনের আইডিয়ায় আজ যারা বিশ্বাসী নয়–অবাধ অর্থের আশীর্বাদে গাঁজা-চরস বিদেশি মদ যেখানে ফেনসিডিলকেও পুরোনো করে দিচ্ছে আজ সব দেখে সব শুনে মিডিয়ার পাতা ভর্তি এইসব চমক লাগানো পর্নো জীবনের পর্নোঘটিত সংবাদ কি একথাই বলছে না, ক্রাইসিস চলছে তার নব অলঙ্করণে পশ্চিমা স্টাইলে আজ বাংলাদেশের আপার ক্লাসের পর্নো কুটিরে কুটিরে।
.
খ.
মূলত তিনরকমের পর্নো-আবাস।
পৌরাণিক সময়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, পতিতা এবং তার পতিতালয় যা নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের অবাধ গমনাগমনের জায়গা। স্থানবিশেষে একেক জায়গার একেক নাম তার। রেডলাইট এরিয়া, বেশ্যাপাড়া, খানকিপাড়া।
আধুনিকতার বিপ্লবের যুগে প্রয়োজন ও পরিস্থিতিসাপেক্ষে গেস্ট হাউজ বা মধ্য বা উচ্চবিত্তদের।
পশ্চিমিকরণের হাওয়ায় নতুন সহস্রাব্দের নব্য মনমানসিকতায়–পর্নো কুটির যা উচ্চবিত্তদের প্রয়োজনে এখন ব্যাঙের ছাতার মতোই গজিয়ে উঠছে বিলাসবহুল সুরম্য প্রাসাদে।
.
গ.
একটি পর্নো কুটিরের গল্প নতুন কিছু নয়। আরবের ঘরে ঘরে এর উপস্থিতি এক অন্য কারণে। সেখানকার ইসলামিক আইন, যৌনজীবনের পক্ষে রুদ্ধশ্বাস। একচুল হেরফের হলেই, পরকীয়ার কোনরূপ গন্ধ হলেই, মুণ্ডপাত। যৌবন বা যৌনাঙ্গ, সে ভয় কি মানে? সে কি বসে থাকে? বিকল্প পথ খুঁজে নেয় না? নেয়। এবং নেয় বলেই আরবের ঘরে ঘরে এই গোপন পর্নো কুটিরে চলে চাকরির ছদ্মবেশী, রক্ষিতার সঙ্গে মাস্টার। আর রক্ষিতের সঙ্গে ঘরের নারীদের।
তবে আমাদের দেশে পর্নো কুটিরের আবির্ভাবের সঙ্গে জড়িত অন্য কিছু। আধুনিকতা-অর্থ-ক্লাস-প্রয়োজন।
একটি পর্নো কুটিরের প্রয়োজন হয়ে পড়া আপার ক্লাসের মানুষদের পক্ষে আজকাল খুব স্বাভাবিক। এবং গুলশান, বনানী ও বারিধারার মতো এলাকায় হোক সে বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়া-যারাই এখানে বাস করে তাদের সবাই মালদার বিত্তশালী। সুতরাং যৌন সম্ভোগের জন্যে এদের কোনও বাজেটের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজনে এরা চলে যায় সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, হংকং। কিংবা এমনকি বলিউড, টালিউড ও ঢালিউডের চিত্র তারকাঁদেরকেও ভাড়া করে নিয়ে আসে। কিংবা নিয়ে আসে সমাজের নেইম ব্র্যান্ড ম্যাডাম, বা ক্রাইসিসে আক্রান্ত যে-কোনও বন্ধু বা পরিচিতের মুক্তমনা স্ত্রী। আনে ঘর থেকে। আনে বাইরে থেকে। প্রয়োজনে এমনকি রাস্তা থেকেও। ওদের অগাধ অর্থবিত্ত। সুতরাং ওদের কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। পর্নো কুটিরের নিরাপত্তা, নিরাপত্তা ক্ষমতা ও অর্থের ক্ষমতায় ক্লাস সিস্টেমের প্রভাব। প্রতারণা, অপরাধ, অত্যাচার বিকার এবং ক্রাইসিস সব, সবকিছুতেই উতরে যায় এসব। আভিজাত্যের পর্নো কুটিরে তারাও আসে অর্থের প্রয়োজন যাদের, অতৃপ্ত দৈহিক সম্পর্ক যাদের, জীবনে ঝড় চলছে যাদের। যারা বিশ্বাস করে ফ্রি সেক্স, মুক্ত জীবন, পাটি, মদ, এক-একধরনের উদ্ধৃঙ্খল আপার ক্লাস কিন্তু অত্যন্ত আনন্দদায়ক জীবন, হোক সে দ্বিধাগ্রস্ত বা রোগগ্রস্ত। হোক সে বিপর্যয়ের শ্বাপদসঙ্কুল রাস্তা। সেক্স, ড্রাগ, মদ, পার্টি, মিউজিক এও একধরনের কাক্ষিত জীবন হতে পারে, যা সাময়িক হলেও সুন্দর। ভুলিয়ে দেয় জীবনের সকল গ্লানি মন খারাপ। স্বাধীনতা ও অর্থ হলে এগুলো এত সহজলভ্য যে তখন এই বিপর্যয়ের ভাবনা ভেবে কেউ সময় নষ্ট করে না। করলে কি আর হিপ্পিজীবন এত জনপ্রিয় হয়?
পর্নো কুটিরের বিকল্পই-বা কী? একজন ফরেন ডিপ্লোম্যাট বা সেক্রেটারিয়েটে বসেন যিনি বা মধুমতী প্লাজার মালিক তিনি কি ভাসমানে যাবেন? এর উত্তর না। যেতে পারেন কোনও পতিতালয়ে? এমনকি গেস্ট হাউজ? পর্নো কুটিরের নিরাপদ পরিবেশে না হলে এতগুলো ফরেন ডিপ্লোম্যাটদেরই-বা গতি কী? আর হাইফাই মুখ চেনা সাহেব? তার স্ত্রী? কিংবা সাহেবের ছেলেমেয়ে? বা তাদের সম্মানীয় অতিথি! লিস্টে কে নেই? পলিটিশিয়ান-হাইফাই সরকারি কর্মচারী, বেসরকারি এবং নেইম ব্র্যান্ড ঝানু ব্যবসায়ীরা কিংবা বিদেশি মেহমান!
অপরাধের স্বর্গরাজ্যে কত অপরাধের নেটওয়ার্কে জড়িত কিছু মানুষ। তাদের খানাপিনা আনন্দ-ফুর্তি, লেনদেন, ব্লু-ফিল্ম, বিকৃত কাম, নারী, মদ, গাঁজা, মারিজুয়ানা, ট্ৰিব, এর উত্তর পর্নো কুটির।
সাময়িক আনন্দের নেশাসক্ত কিছু দিশেহারা আধুনিক তরুণী বুঝে না বুঝে আজকাল নিজেরা বিপদ ডেকে আনছে। হঠাৎ তারা ব্লু-ফিল্মের নায়িকা হয়ে যায়। সেই ছবি প্রচার হয়ে যায়। বিভ্রান্ত তরুণীগুলো জানেই না সেই পয়সাআলা তরুণের বিছানায় সঙ্গমরত অবস্থায় কখন তার ছবি তোলা হলো। কে করলো? কখন? ততক্ষণে, ট্যু-লেইট। ততক্ষণে সেই ছবি প্রচার হয়ে গ্যাছে। ভিকটিম নিখোঁজ হয়ে যায়।
রিনা, পপি, দিলরুবার মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়। হত্যা না আত্মহত্যা এ নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। ব্লু-ফিল্মের প্রডিউসর কিছু ছদ্মবেশী তরুণ যাদের অধিকাংশই এই পর্নো কুটিরের সঙ্গে জড়িত, সাময়িক বিপদ কাটিয়ে উঠতে জানে। এই ছবির বাজার ভালো। এই ব্যবসাও এখন তুঙ্গে। কম খরচে বেশি মুনাফা।
এসব বড়লোকের সন্তানদের বন্ধুর অভাব হয় না। বিশেষ করে যারা ঠিক ওদের মতো বড়লোক নয়। দশজন না হলে পার্টি জমে না। আপার মধ্য বা লোয়ার অনুগত বন্ধুরা ডাকলেই চলে আসে। আর শিক্ষিত সুন্দরী মেয়েরা যারা অফিস নয়, বেছে নিয়েছে বড়লোকদের পার্টিতে ললিতাবৃত্তি, সহজ ও দ্রুত অর্থ পেয়ে পর্নো কুটিরগুলো, সাময়িক আনন্দের জন্যে ওদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। উইকেন্ড বা সান্ধ্যকালীন পার্টি বা উৎসবের সময়ে এরকম মদের আড্ডায় এইসব শিক্ষিত বড় ঘরের মেয়ে কলগার্ল পাওয়া আজ আর অভাব হয় না। এই মেয়েগুলো ভিড়ের মধ্যে এমন মুখ লুকিয়ে থাকে যে দেখে বোঝার উপায় নেই। এদের কেউ মা, কেউ অবিবাহিতা বঙ্গললনা। অনেকেই ভার্সিটি বা কলেজের ছাত্রী। স্বাভাবিক ও সাবলীল সংসার থেকেই এরা আসে। কিন্তু আধুনিকায়ন ও বিশ্বায়নের সাথে সাথে সমাজজীবনের চিত্রপটে দ্রুত যে বদল ঘটে যাচ্ছে তাতে করে, গুলশান বনানী ও বারিধারায় পর্নো কুটিরগুলোতে ক্রমবর্ধমান চাহিদা অনবরত সৃষ্টি করে চলেছে নতুন নতুন হাইফাই গণিকা, রিতু, পাপিয়া, নীলা, সন্ধ্যা, মৃত্তিকা…। এবং ঢালিউড টালিউড ও বলিউডের উঠতি ও পড়তি নায়িকারা তো এই লিস্টের হট-প্রোডাক্ট।
এবং একদিন আমরা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে জানতে পারি যে, আমাদের প্রতিবেশীর মেয়ে রিয়া যে ভার্সিটিতে পড়তো সেও এরকম হাই-সোসাইটির গণিকা। সঙ্গমরত অবস্থায় তার ব্লু-ফিল্ম নিয়ে বাজারে এখন তোলপাড় চলছে। মিডিয়ায় খবর ছাপা হচ্ছে। দু’জন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেকে এ্যারেস্ট করা হলেও গডফাদার নিখোঁজ। সর্বশেষ খবর: মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে।
আসলে সবকিছুর পেছনে রয়েছে অবাধ কামের জোয়ার। আর ঐ যে আরক্ষরোহিনী তারও তো অর্থেরই বশ। রাত একটায় দেখা গেল মধ্যপ্রাচ্যের এক দূতাবাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
স্যার, জায়গাটা ভালো নয়। বসের গললগ্ন বাঙালি ললনাটির ঝাঁঝাল জবাব। আপনারা আছেন কি করতে। কোথাও যে একটু প্রাইভেসি থাকবে তারও জো নেই। বেশি বাড়াবাড়ি করলে বাধ্য হবো যথা জায়গায় ফোন করতে। ঠ্যালা কিন্তু আপনাকেই সামলাতে হবে!
২৩. বয়স পঁয়ত্রিশ
বিভিন্ন যাচিত আয়োজনে বোঝার আগেই হৈ-চৈ করে ফুরিয়ে যায়, শৈশব-কৈশোর যৌবন। সর্বত্রই বসন্তের বিচিত্র রঙ। মালার মতো অফুরন্ত আনন্দ কত স্বপ্ন, কত আশা-আকাঙ্ক্ষা জড়িয়ে ওঠে কৈশোর থেকে। নেই, কোন দুঃখ বলে এখানে কিছু নেই। থাকলেও তার অনুভূতি নেই। নতুন রুপোর টাকার মতো চকচকে মন। দুপুরের খাঁ-খাঁ রোদ্দুরের আলো সেই মন জুড়ে। উঠতি বয়সের স্বাভাবিক সাবলীল আনন্দ, প্রেরণা, উৎসাহ আর মনোবল, বর্তমানের যে-কোনও হতাশা আর দুঃখের তিমিরে জ্বেলে দিতে পারে আলো।
কাম্য অতিথি বা পছন্দের ইষ্টিকুটুমের মতো জীবনের অর্ধেক সময় অর্থাৎ প্রথম পঁয়ত্রিশ বছর এসে চলে যায় সই-সাই যথেষ্ট দর্শন বাক্যালাপ বা ভোজনরস না তৃপ্তি বা হাস্যরসে পরিতৃপ্ত হওয়ার আগেই চলে যায়। দেখতে না দেখতে না জানতেই বুঝতে পারার আগেই এসে চলে যায় জীবনের প্রথম পঁয়ত্রিশ বসন্ত উন্মত্ততায়, রঙে রসে এতই পরিপূর্ণ যে শূন্যতা, একাকিত্ব হতাশা বলে জীবনের এই অর্ধেক অভিধানে কোনও শব্দ খুঁজে পাবার নয়। মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় এই সময়গুলোতে কেউ একা নয়। অন্যেরা তাকে ঘিরে, সে অন্যকে ঘিরে ব্যস্ত। মুহূর্ত সময় নেই জীবনের কতত অকারণ, অহেতুক, অস্থায়ী, অপ্রয়োজনকে প্রাণবন্ত করে তুলে বাস্তবে রূপ দিতে জেনেও এর সবকিছুই ক্ষুদ্র! সব মিছে! একদিন সব শেষ হয়ে বিলীন হয়ে যাবে। নিশ্চিহ্ন। সুখী হতে মানুষ মিছিমিছি কত ব্যস্ত থাকে। সুখকে ঘিরে মানুষ কত ব্যস্ত।
প্রথম পঁয়ত্রিশ বছর সখের অভিযানের এই যাত্রায় ধাপে ধাপে মানুষ খুঁজে পায় চিরাচরিত কত বিধিবদ্ধ সুন্দর! সুন্দর নিজেকে ঘিরে, সুন্দর অন্যকে ঘিরে।
সুখের শুরুতেই প্রথমে মানুষ খুঁজে পায় শরীরের অনুভূতি, যখন শরীর জুড়ে নামে কৈশোর। সুখানুভূতি, রতি, কামের অনুভূতি। শরীরে বিভিন্ন চাক্ষুষ পরিবর্তন। আর
জীবন গঠনের প্রক্রিয়ায় চলে লেখাপড়া। কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিতেই এই। চলমান প্রক্রিয়া গভীরতর রূপ নেয়, যার শেকড় বিদীর্ণ করে যায় জীবনের উর্বর আর গভীর পরিপূর্ণ মাটি। যৌবন এগিয়ে যেতে যেতে ছেলেদের মাঝ কুড়ি আর মেয়েদের কুড়ির শুরুতে জীবন তার গতি পাল্টায়। পাল্টাবেই। বিবাহ বন্ধন। অর্থাৎ প্রজাপতয়ে নমঃ। শুরু হলো সংসার। সং’ সর্বস্বতাই যার মূল চরিত্র। সং-সাজা। সব-সং, সংসার।
জীবনের প্রথম পঁয়ত্রিশ বছর ধরে এই যে অভিমান এর প্রাপ্তি সংসার-সন্তান ও স্থাবর-অস্থাবর সহায়-সম্পত্তি।
আর এই পঁয়ত্রিশ বছরের সমূহ অর্জন যা এলো হেসেখেলে পূর্ণিমার উঠতি চাঁদের মতো আলেকিত জ্যোৎস্নায়, অসম্ভব তৃপ্ততায় জীবন যখন ভরা বরষার পূর্ণ নদী-গভীর ভালোবাসা। ভালোবাসা ছড়িয়ে-ভরিয়ে থাকে সহসা সর্বত্রই, এই কি সব? এইটুকু সত্য? এই কি সেই প্রদীপশিখা, যার তলায় জমাট বাঁধে সমান অন্ধকার?
এই অর্জন যার সমান নিকটে বাজে বিসর্জনের বাদ্যি-বাজনা। এই পঁয়ত্রিশ, এখানেই শেষ। এই অর্জনের উল্টোটারও শুরু এখানেই। যত সন্তান-সংসার, স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি, সব সবকিছুর মূল উপলব্ধি, এখানেই।
নতুন করে অর্জনের আর কি থাকে? তাই নতুন করে সুখী হওয়ার আর কি আছে, চলে সেই সন্ধান। হাতড়ে, হাতড়ে এখান থেকে যা পাওয়া যাবে তা হতাশা, শূন্যতা আর একাকিত্ব, নতুন করে অর্জনের কিছু নেই। এরপর কিছু অর্জনের মানে–পুনরাবৃত্তি বৈ কিছু নয়। সুতরাং নতুন কোনও সুখের রঙ এখানে লাগবে না।
পঁয়ত্রিশের পর, পুনরাবৃত্তি কখনো সমান সুখ দেবে না। সময়, উদয়ের বদলে অস্তমিত হয়। বয়স অর্জনের বদলে কমতে থাকে।
এবং এই করে করে পঁয়তাল্লিশে পা দিয়ে মানুষ জীবনের এমন একটা অন্ধকার সময়ে পৌঁছায় যখন সে নিজেই নিজের জন্যে একটা বোঝা। নিজের কাছে একটা দায়িত্ব। পথ হারানো মানুষ সে। একজন অপ্রকাশিত লুকিয়ে থাকা মানসিক রোগী। অর্জনের কিছু নেই, শুধু বিসর্জনের প্রস্তুতি। বিসর্জন, যা কখনো সুখের নয়। বিদায় কখনো হাসির মুক্ত-ঝরিয়ে হেঁটে চলে যাওয়ার পথ আলোকিত করে না। দুঃসময়, ভীষণ দুঃসময়, নতুন করে পাওয়ার, জীবনদর্শনের, সুখী হওয়ার সব, সব শেষ। জীবনের এই এমন একটা সময় যখন মানুষ দিনের অধিকাংশ সময়–অসুখী। প্রথম পঁয়ত্রিশ থেকে প্রথম পঁয়তাল্লিশের –ঠিক উল্টো মনমানসিকতা, অনুভূতির শুরু এখানেই। পঁয়তাল্লিশের পর বাকি জীবনটুকুতে অর্থহীনতা থাকে। এর পুরোটাই অপব্যবহার। মানুষ এই অপব্যবহারে অভ্যস্ত হতে থাকে,-যা দিনদিন বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে গভীর থেকে আরও গভীরে যায়। হয়তো আমরা তা বুঝতে পারি না। কিংবা বুঝলেও পরোয়া করি না। হয়তো-বা এর কারণ সময়, যা পয়সা দিয়ে কিনতে হয় না, তাই এর অপব্যবহারও এতটা তীব্র বলে বোধ হয় না।
এরপর! নিজেকে দিয়ে কি করা! খাওয়ানো, ঘুমোনো, ঘুম থেকে ওঠানো, ব্যায়াম, নাতি-নাতনি, বিত্তের তদারকি, সমান পুনরাবৃত্তি! পুনরাবৃত্তি ছাড়া কোনও ব্যতিক্রম সম্ভব কী? যদি না হয় তবে, নিজের জীবন কি একটা সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু হয় না যখন প্রতিটি মানুষ নিজের কাছে নিজে একটা অঘোষিত অপদার্থ এবং মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ!
বাকি সবকিছুতেই ফিরে যাওয়া যায়। দেশ গ্রাম, বাবা-মা, স্বামী, ছোটবেলাকার স্কুল, উল্টো সাঁতার কাটা সেই ছেলেবেলার পুষ্করিণী। শুধু ফেরা যায় না বয়সে। যা, অতীত তা অতীত। যা গ্যাছে তা গ্যাছে। খরচ হয়ে গ্যাছে।
ছেচল্লিশ থেকে চৌষট্টিতে সম্ভব। কিন্তু চৌষট্টি থেকে ছেচল্লিশে আর কখনোই সম্ভব নয়। সাঁইত্রিশ থেকে তেয়াত্তর সম্ভব। চুয়ান্ন থেকে চল্লিশ, অসম্ভব।
মানুষ তার জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করে প্রথম পঁয়ত্রিশ থেকে প্রথম চল্লিশ পর্যন্ত। এরপরের জীবন প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত। নিজেকে খুঁজে না পাওয়া দুষ্কর জীবন। অর্থহীনতায় পরিপূর্ণ। নিঃসন্দেহে পঁয়তাল্লিশের পরের বাকি জীবন যত দীর্ঘ হয় মানুষ ততই নিজেকে আবিষ্কার করে, অপচয়। আর এই অপচয় এই ক্ষয়ে পড়া আমরা যারা মানুষ, তারা শুধু তার
–ধারক –
–বাহক –
–সেবক -।
২৪. পরকীয়াবিহীন বিবাহ ক্লান্তিকর
ক.
২০ এপ্রিল, ওয়াশিংটন পোস্ট, ২০০১।
চীনে, বিবাহিতের সহবাস সম্পর্কে প্রথাসিদ্ধ ধারণা ও নীতিবোধ বিষয়ে সামাজিক সমীক্ষার একটি সংবাদ বেরিয়েছে।
লিন্ডা হান, ২৮ বছরের এক চীনা যুবতী, তিনি একটি জীবন বীমা কোম্পানিতে কর্মরত। উদ্যমী, উন্নতিকামী–এই নারী চান মনের মতো একটি বিবাহ যদিও তার রয়েছে মধ্য বয়স্ক বিবাহিত এক প্রেমিক। যাকে প্রচলিতভাবে লোকে বলে–পরকীয়া। বলেছেন, মরে গেলেও তার পক্ষে পরকীয়া ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আবার এরই মাঝে নতুন স্বামীও তার চাই। এই হলো–একালের প্রেম, প্রীতি, প্রণয় ও ভালোবাসার স্বরূপ। রিপোর্টে বলা হয়েছে, শ্রীমতী হান একা নন বরং মেয়েরা যতদিন সম্ভব আজকাল অনূঢ়া থাকতে চান কিন্তু সঙ্গীহীন শয্যায় অবশ্যই নয়। রিপোর্টে আরো বলা হয়–”পরকীয়াবিহীন বিবাহ ক্লান্তিকর।”
বিবাহ এবং বিবাহ সম্পর্কিত চীনা গবেষণা কেন্দ্র এবং যুগপৎ নিখিল চীন মহিলা সংঘেরও নারী সম্পর্কিত গবেষণা সংস্থার উপাধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত চেন শিনশিন বলেছেন, মেয়েদের কত অংশ এবং কী, জাতীয় জনপদ ও নগরীতে এইভাবে দ্বিচারী সুখভোগের ভাবনা জন্মাচ্ছে তা এখনও ঠিক বলা না গেলেও অস্বীকার করার নয় যে
“পরকীয়াকামী মহিলার সংখ্যা
লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে চলেছে।”
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, চীনে আর্থিকভাবে প্রতিটি সমর্থ পুরুষ প্রাচীন সংস্কার অনুযায়ী কনকুবাইন’ অর্থাৎ রক্ষিতা রাখতে অভ্যস্ত ছিল। যে বিপ্লব ক্যুনিজমের মাধ্যমেও উড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বন্ধ করা সম্ভব হয়নি সঙ্গত কারণেই।
লিন্ডা হানের মতো মেয়েরা যারা দেঙ জিয়াও পেং-এর নতুন অর্থনীতির বিপ্লবে গত দু’দশক ধরে চীনের শহরাঞ্চল বিশেষ করে প্রধান প্রধান শহর যেখানে জীবিকার সম্ভাবনা, সেসব অঞ্চলের চেহারা দ্রুত পাল্টে দিচ্ছে। জনপদ কর্মস্থল, মনমানসিকতা, বৃত্তিপথ ও নারী-পুরুষ সম্পর্ক। এটা মাওয়ের কালের অববাহিকা থেকে ভিন্ন, যেখানে পার্টি নিযুক্ত নৈতিক প্রহরীর হুইসিল বা বাঁশি অনুযায়ী ছেলে ও মেয়েদের জীবন বাধা থাকতো একটি সুনির্দিষ্ট ছন্দ-লয় ও গতিতে। প্রহরের প্রতিটি কিবা দিবা কিবা রাত্রি।
আর দেঙ-এর অববাহিকায় লিন্ডা হানের মতো কর্মজীবী মেয়েরা আধুনিকতার হাত ধরে এসে দাঁড়িয়েছেন এমন জায়গায়, যেখানে তারা খোলাখুলি বলছেন দ্বিধারা জীবনের কথা।
শুধু পুঁজিবাদ নয় বিশ্বায়নের এই যুগে পশ্চিমি খোলামেলা জীবন আজ চীনেও প্রবেশ করেছে স্বাভাবিক নিয়মেই। এবং মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সাথে সাথে ছেলেদের মতো মেয়েদেরও এমন বাসনা জন্মাবে এতে আশ্চর্যের কী আছে?
আধুনিক চীনে গত দু’দশকে দ্রুত গড়ে-ওঠা এই নগরকেন্দ্রিক জীবন পৃথিবীর আনাচে-কানাচে প্রায় সবদেশেই গড়ে উঠেছে। এর বিবিধ কারণগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক কারণটিই হলো সবচেয়ে প্রধান।
বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে নারী ও পুরুষের দ্বিবিধ ধারার জীবন সম্পর্কে নতুন করে জানানোর কিছু নেই। তবে একটি কথা পরিষ্কার যে দ্বিধারা জীবন সেসব দেশেই অধিক স্বাভাবিক ও সাবলীল যেসব দেশে অর্থনৈতিক মুক্তি রয়েছে। তার মানে এই নয় যে অনুন্নত বা দরিদ্র দেশে দ্বিধারা জীবন নেই বা থাকতে নেই। আছে। বেশ জীবন্ত এবং বেশ জোরালো দাবি নিয়েই আছে, তবে এই দ্বিধারা জীবনের প্রকৃত রূপ, রুচি, প্রক্রিয়া ধনী বা উন্নত দেশের চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির। দেঙ জিয়াও পেঙ-এর নব্য অর্থনীতির আন্দোলনে আধুনিক চীনের চেহারা ভিন্ন। দরিদ্র আর অনুন্নত চীনেও আজ অঘোষিত পুঁজিবাদ, পশ্চিমি বিশ্বায়নের মওকামাফিক। ফলে মাওয়ের পর, চীনের প্রায় চল্লিশ ভাগ বাজার আজ বিশ্বের জন্যে উন্মুক্ত। ফলে গ্রাম ছেড়ে জীবিকার অন্বেষণে নগরকেন্দ্রিক এ নগরভিক্তিক জীবন যেমন বাড়ছে তেমনই বাড়ছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে যৌন স্বাধীনতার বিষয়টাও। তাহলে মানুষের বৈবাহিক জীবনের পাশাপাশি পরকীয়া জীবনের প্রয়োজনীয়তা কি সেই একই অর্থে ব্যবহার করা যাবে না? অর্থাৎ–
অর্থ+যৌনজীবন = বিবাহ+পরকীয়া জীবন।
.
খ.
চীনের মতো নগরকেন্দ্রিক জীবন, অনুন্নত এবং জনসংখ্যার অভিশম্পাতে জর্জরিত আরেকটি দেশ, যা চীন থেকে তেমন দূরে নয়, যে দেশের যে শহরটির কথা না। লিখলেই নয় সেই দেশটি, সেই শহরটি হলো, বাংলাদেশ এবং তার রাজধানী ঢাকা শহর।
গ্রামভিত্তিক, গ্রাম প্রধান মূলত কৃষিনির্ভর এই দেশ। আর কলকাতার চেয়েও প্রাচীন এবং শিল্পকলা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী দেশের এই ঐতিহাসিক শহরটির আয়তন মোট চার থেকে বেড়ে দশ মাইল ছাড়িয়ে গেলেও, জীবিকার অন্বেষণে গ্রামাঞ্চল থেকে ছুটে আসা বিশেষ করে দীন-দরিদ্র মানুষদের পরিসংখ্যানের সাথে মিলিয়ে বাড়তে পারছে না মোটেও। তাই বাংলাদেশের রাজধানী, এই শহরটি জনসংখ্যায় উপচে পড়ছে শুধু নয়, বরং প্রতিদিনই তা বাড়ছ। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর জনসংখ্যার হিসেবে মেগাসিটির পর্যায়ে পৌঁছতে আর সামান্য বাকি। কুড়ি বছর আগে চার মাইলজুড়ে ছিল কুড়ি লক্ষ মানুষ। আজ দশ মাইলজুড়ে রয়েছে প্রায় কোটির ওপর। জনসংখ্যা, শহরের আয়তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শতকরা একশভাগ বেশিই বেড়েছে। কেন বাড়ছে? কি কারণে বাড়ছে? এতটুকু শহরে এই উপচে পড়া মানুষগুলো কারা? এর কি কোনও উত্তর নেই?
প্রথমেই ধরা যাক শ্রমিক শ্রেণীর কথা। দরিদ্র শ্ৰেণী। এমনকি চীন বা ভারতেও বাংলাদেশের মানুষদের মতো এত সুবোধ বিকল্প কোনও শহর নেই, যেখানে তারা খেটে বেশি না হোক অন্তত জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন মিটিয়ে বেঁচে থাকবে। স্রেফ আলুসিদ্ধ আর কাঁচা লঙ্কা গালে দিয়ে দু’মুঠো ভাত। কোথাও না হোক রাজধানীতে। গ্রামে কাজ নেই। যা আছে থাকলেও, তা পছন্দের নয়। যেমন ক্ষেতের কাজ। লাঙল চালানো। হাল চাষ। ধানের রোয়া বোনা। এসব কাজ সর্বস্তরের বুভুক্ষুদের ঠিক পছন্দসই হয় না। সুতরাং ক্ষেতের কাজের জন্যে কৃষক পাওয়া বাংলাদেশে দুঃসাধ্য। আর এই মন্দাভাব চলছে বহু বছর ধরে। এবং গ্রামগঞ্জ থেকে অত্যন্ত সাধারণ শ্রমিক শ্রেণীর মানুষগুলো, যাদের প্রায় সবারই বিশাল পরিবার আছে তবুও গ্রামের এই একঘেয়ে ক্ষেতের কাজ হালচাষ–তাদের কাছে তেমন সুবিধের লাগে না। আর লাগলেও ঠিক মনমতো হয় না বলে তাদের গন্তব্য হয় রাজধানী শহর ঢাকায়। এমনকি কুলি-শ্রমিক বা মজুরশ্রেণী তারাও আর গ্রামে থাকতে চায় না। কারণ, রাজধানীর জীবনের অমোঘ আকর্ষণ তাদেরকে টানে। কারণ নগরজীবন। নগর দর্শন। শহুরে জীবন। যে জীবনে যথেষ্ট কষ্ট থাকলেও পাশাপাশি প্রচুর আনন্দ ভাণ্ডারও রয়েছে তার অফুরন্ত সম্ভার নিয়ে। গ্রামগঞ্জের এই আপাত নিরীহ শ্রমিক শ্রেণীর মানুষগুলো ক্রমে তাই ঢাকাকেই বেছে নেয় তাদের জীবিকার অন্বেষণে। জীবিকা ও জীবন যা পাশাপাশি হাত ধরে চলাফেরা করে।
সুতরাং ঢাকার এই দুর্বিষহ যানজটে বলতে পারেন, বলতেই পারেন এই রিকশাওয়ালাগুলো সব জ্বালিয়ে খেলো! শালারা সব কোত্থেকে আসে? কেন আসে? সবাই আসে ক্ষুধার তাড়নায়। ভাগ্য ফেরাবার আশায়। শহরের অলীক কল্প-কাহিনী শুনে। ঢাকার হাওয়ায় নাকি টাকা ওড়াউড়ি। শুধু ধরতে জানা চাই।
ঢাকা শহরের ডাকনাম রিকশা সিটি। বর্তমানে সেখানে রিকশার সংখ্যা লক্ষকেও ছাড়িয়ে গেছে। একেক সময় রিকশা ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। মনে হয় শহরটি রিকশাতে রিকশাতে উপচে পড়ছে। জনসংখ্যার পাশাপাশি যেন ভেঙেও পড়ছে। এবং জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাওয়া, মাথা মোটা এই রিবশাওয়ালাগুলো যাদেরকে আমরা সাক্ষাৎ উৎপাত বা উপদ্রব মনে করে না হয় দশটা গালিগালাজ করি। হ্যাঁ, এরাই কিন্তু গ্রামগঞ্জ থেকে আসা দীন-দরিদ্র। যে মানুষ গ্রামে তাদের সম্পূর্ণ পরিবার-পরিজন রেখে ঢাকায় চলে আসে শহরের মোহ আর আপাত চাকচিক্যের আকর্ষণে, তার প্রাথমিক বিভ্রান্তি কেটে গেলেই ওরা রিকশাচালক, রাজমিস্ত্রি বা দিনমজুরে কাজে নেমে গিয়ে অনিবার্যভাবেই বস্তিবাসী হয়ে পড়ে। এদেরই একটা অংশ লেগে যায় এপার্টমেন্ট তৈরির ও যোগালির কাজে। রিকশা সিটি নামের অলঙ্করণের সখে ঢাকা শহরের আরেকটি নাম হতে পারে এপার্টমেন্ট সিটি। যার মানে নিম্ন, মধ্য, উচ্চবিত্তদের আবাসন। এটাও এক ধরনের ব্যবসা। চলতি বাংলায় যাকে বলা হয় রিয়েল এস্টেট ব্যবসা। খুবই লাভজনক এবং সময়োপযোগী। এ ব্যবসার মধ্যে জমির মালিক, ডেভেলপার আর প্রোমোটাররা জড়িত থাকে। প্রত্যেকেরই নিজস্ব ভূমিকা। মূল উদ্যোক্তাদের মধ্যেও নানা রকম শ্রেণী বিভাগ থাকে। ফ্ল্যাটের দাম নির্ধারিত হয় আয়তন, অবস্থান ও পরিবেশের ওপর। এবং এই নিম্নবিত্ত শ্রমিক শ্রেণীর মানুষগুলোর কিছু অংশ যারা রিকশা চালাবে না চলে যায় ইট ভাঙা, সিমেন্ট মেশানোর কাজে। যার কোনওটাই মেধা নয়। পুরোটাই কায়িক।
রিকশা, বেবি ট্যাক্সি, টেম্পো চালক, নির্মাণ কর্মী এই বিভিন্ন ও বিচিত্র পেশার দীন-দরিদ্র শুধু কায়িক পরিশ্রমের বিনিময়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলো সত্য। এদেরকে অস্বীকারের উপায় নেই। সংখ্যায় এরা কয়েক লক্ষ। এবং শুধু এই একটুখানি শহর যার কোণায় কোণায় উপচে পড়ে তোক এমনকি যার শ্বাস ফেলার জায়গাটুকুতেও মানুষের উপচে পড়া ভিড়, এই শহরটিতে মানুষ কি করে কে জানে! বা কেমন করে কি এক আশ্চর্য যাদুকরী ক্রিয়াবলে তা সত্ত্বেও খুঁজে পায় তাদের জীবিকা, আর মাথা গোঁজার জন্য ঢাকার মুক্ত ফুটপাত বা বস্তি সিটি নামে খ্যাত এই শহরের বস্তি আবাসনে এক চিলতে মাটি। পাবেই। আর সেই প্রত্যাশায় প্রতিদিন আরও মানুষ গ্রাম ছাড়ছে গড়ে দিনে প্রায় পঁচিশ থেকে ত্রিশ হাজার। তারা জানে এলেই হয় রিকশা, না হয় নির্মাণ।
যথারীতি শহরের ভিড় আরও বাড়ে। আরো রিকশা, আরও ট্যাক্সি, আরও নতুন নতুন বিল্ডিং। শহর তার আয়তনে না বাড়ক মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদা বাড়ে। তাই পরিবার-পরিজন গ্রামে রেখে শুধু তাদের শরীরটা নিয়ে মেধাহীন পুরুষগুলো এভাবেই ‘একা’ এই শহরে চলে আসে। এখানে ওদের বিচিত্র জীবন। কঠিন ও করুণ জীবন। মানবেতর দুঃসহ জীবন। যে জীবন কোনও জীবনই নয়। কিন্তু তবুও যারা একবার এই নগর জীবনের স্বাদ পায় সেই যে ওরা একবার একা একা গ্রাম ছাড়লো আর সহজে ফেরে না। কেউ কেউ বছরে একবার যে যায় না তাও নয়। কখনো যায় না।
সর্বত্রই ওদের মানবেতর জীবন। বস্তিতে ঘুমটুকু বাদে সারাদিন রোদ-বৃষ্টিতে নেয়ে-ঘেমে কায়িক শ্রম শুধু। আমি ওদের বিচিত্র জীবনের গল্প শুনি। মাসে গড়ে ওদের আয় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। কিছুটা তারা দেশে পাঠায়। বাকিটা নিজের জীবিকা নির্বাহ। ওদের বয়স পনেরো থেকে পঞ্চাশ।
এই কয়েক লক্ষ মানুষ যারা নিম্ন মধ্যবিত্তরও ঠিক নয়, বলা যায় বিত্তের শ্রেণী –বিন্যাসে যাদের কোনও ক্লাস নেই অর্থাৎ এই নো-ক্লাস বা ধরা যাক সিক্সথ ক্লাসের এই শ্ৰেণীহীন মানুষগুলো যাদের পরিবার দূরে–তাই বলে যাদের শরীর মরে যায়নি, যাদের রতি-কাম-কামনা সম্পূর্ণ জীবন্ত–এই নগরজীবনে সমস্ত দিন ধরে যন্ত্রের সঙ্গে জীবন ঘষা শেষ হলে রাতের অন্ধকারে তারা বছরের পর বছর কি উপোস থাকতে পারে? সম্ভব? ওরা সংখ্যায় কয়েক লক্ষ। বয়স ওদের পনের থেকে পঞ্চাশ। জীবন, যৌবনে ভরা। দিনের শেষে ক্লান্ত দেহ। হাতে কিছু টাকা। নিঃসঙ্গ তবে কামার্ত শরীর। সঙ্গে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। কেউ নেই বাধা দেয়ার। সমাজ নেই বলে সামাজিকতার ভয় নেই। কে দেখলো! কেউ দেখলো, বৌ-ছেলে-মেয়ে…। কেউ? নেই-নেই কেউ নেই, দেখার। বাধা দেয়ার। অপরাধবোধের কোনও বালাই নেই। পাপ-পুণ্য নেই। ধর্ম অধর্ম নেই। বেঁচে থাকা, হ্যাঁ, স্রেফ বেঁচে থাকা। ন্যূনতম বেঁচে থাকতে যতটুকু যেটুকু মানসিক কিংবা মানবিক যা নিতান্তই না হলে চলে না, চলবে না। কতটুকুই-বা জীবন ওদের? এত অমানবিক পরিশ্রমের পর একটি রিকশা বা টেম্পো বা হাড়ভাঙা পরিশ্রমী দিনমজুরের আয়ুই–বা কত? পনের বছর টানা খাটুনির পর সে ভেঙে যায়। শরীর বসে যায়। আর পারে না। এই মাত্ৰ-এইটকুই না জীবন ওদের। যাদের কোনও বাবুগিরি নেই। আছে শুধু বাবুদর্শন। বাবুরা যাদের গাড়িতে বসে। যারা বাবু টানে।
এই কয়েক লক্ষ পুরুষ, যাদের অধিকাংশেরই দিন শুরু হয় ন’টার বদলে সকাল ছ’টায়, চেয়ার-টেবিলে বসে নয় যারা দুই পা কচলে রিকশার চাকায় ঢেলে দেয় তাদের দেহের সমস্ত শক্তি, ঘামতে ঘামতে ভিজতে ভিজতে ক্লান্ত পরিশ্রমে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হলেও যারা অভিযোগ বা দুঃখ’ এই বর্ণ বা এই ভাষা কোনও উচ্চারণেই যারা বলতে জানে না! জানে না, কারণ তারা অনভ্যস্ত এবং অনভ্যস্ত বলেই নির্বিকার। এবং মেধাহীন বলে নির্বিকার হতে হতে সব অমানবিকতায় অভ্যস্ত এবং বোধহীন, যারা কাজের শেষে সাজানো-গোছানো লিভিং রুমে না ঢুকে ফুটপাতের আবর্জনার সামনে বসে শরীরের বর্জ্য পদার্থ নিক্ষেপ করতে করতে গল্প করে আর বিড়ি টানে অন্যদের সঙ্গে। যারা ফ্যানের নিচে শুয়ে রাতের সংবাদ শুনতে শুনতে ক্লান্ত শরীর মেলে দিতে পারে না। স্ত্রীর করুণা ও স্নেহের করতলে বা গভীর রাতে শান্তি খুঁজে পেতে নেই বিশাল বক্ষ জুড়ে এক জোড়া স্তন, যেখানে মুখ খুঁজে পড়ে কি নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায়। নেই একখানা গরম ভাত বেড়ে অপেক্ষারত স্নেহময়ী মা কিংবা আদরের ছোট মেয়েটি। ওদের কি আছে? কোন ছাই! কিছু কি আদৌ আছে?
তাই দিনের শেষে ওরা কোথায় ফিরবে? সোজা–নোংরা আবর্জনাভরা বস্তি? সেতো অনিবার্য। ওদের ফেরার দ্বিতীয় জায়গা কোথায়? ওদের স্ত্রী নেই, ঘর নেই, গরম ভাত নেই। তাই ওদের স্থির করতে হয় ফেরার জায়গা। কেননা আর কিছু না থাক, ওদের মন তো আছে! মন থাকলে অনুভূতি আছে। আর অনুভূতি যা এমন সঙ্কটে সবচেয়ে আগে সাড়া দেয় তার দুর্বল জায়গাগুলো। আর এই একাকিত্ব–এই ক্লান্তিতে সবচেয়ে দুর্বল জায়গা যেখানে মুহূর্তেই খুঁজে পাওয়া যায় অপার আনন্দ, তা ব্যক্তির যৌন আনন্দ। একটি কমনীয় নারী শরীর। তার সঙ্গে, তাকে নিয়ে কিছুক্ষণ খেলা পারস্পরিক বিনোদন। এবং এই আনন্দ সন্ধানে বা অন্য কোনও সুখানুভূতির মধ্যে যা সবচেয়ে আদিম–এইসব পুরুষ এইসব রিকশাওয়ালা বা ইটভাঙা মানুষেরা রক্ত জল করা হাতে সীমিত পয়সা নিয়ে ছুটে যায় পতিতালয়ে কিংবা ভাসমান যেখানে তার প্রবৃত্তিকে প্রসন্নিত করতে পারবে সহজেই। এবং ওদের সংখ্যা কোনমতেই হাজারে নয়।
সে নিজেই ভাসমান। সুতরাং সে ভাসছে সবচেয়ে সহজলভ্য শিল্প, পতিতা পল্লীতে। ভাসমান পতিতারাও আছে। ওরা হাতের নয় শুধু। ওরা নখেরও নাগালে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই ওরা বস্তির আশপাশে এসে ভিড় জমায়। ওরা জানে এবং চেনে কারা ওদের খদ্দের। একঝাক রঙিন পায়রার মতো। বিচিত্র রঙিন পোশাকে ওরা মুখে গাঢ় মেকাপ মেরে ব্যাগে রাখা কনডম নিয়ে প্রতীক্ষা করে বুভুক্ষুদের। অপেক্ষায়, যারা কামার্ত। অস্বাভাবিক যৌনাচারেও তাদের আপত্তি নেই। তাদের প্রয়োজন ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ। একেকটা বস্তি একেকটা অপরাধের স্বর্গরাজ্য। কিন্তু এই বস্তিবাসীরা এত শিক্ষিত নয় এসব সাফিস্টিকেটেড শব্দ বোঝার মতো। ওরা জানে আনন্দ। নির্মল আনন্দ। জানে, নারী দেহটি দলিত-মথিত করে উপচে পড়া ভাসমান পতিতার দ্রুত এবং সংক্ষেপ এবং অল্প খরচ। আর তাই রাতের অন্ধকারে কামার্ত পুরুষগুলো ছোটে। যে যেখানে যেভাবে পারে, একটু জায়গা করে নেয় আর কোনও রকমে দুই পা বিযুক্ত করে কিছুক্ষণ যৌন আনন্দশেষে স্থলন। ব্যাস্ ভাসমান বা চাইলে পতিতাপল্লী। যেখানে সময় ও আনন্দ দুটোই বেশি। তাই খরচও বেশি। আর রাজধানীর এই কয়েক লক্ষ নো-ক্লাস বা সিক্সথ ক্লাস যারা দিনমজুর, দীন-দরিদ্র হতভাগ্য রিকশা বা বেবি ট্যাক্সিচালক যারা গ্রাম ছেড়ে চলে আসে শহরে, তারা মানুষ কিন্তু তারা স্রোতের বাইরের মানুষ। তারা পাপ-পুণ্য, ধর্ম-অধর্ম, সমাজ-সংস্কারমুক্ত। স্বাভাবিকভাবেই তারা সরল, সাবলীল জীবনে বিশ্বাসী। তারা খেটে খায়। ফুর্তি করে তাদের ক্রাইসিস অনুযায়ী। যায় মন যেখানে যে জাহান্নামে যেতে চায়। নিজের ভালোমন্দে ওদের ভ্রুক্ষেপ কম। ভাসমান-পতিতাপল্লী, গেস্ট হাউজ, কিংবা কয়েকজন মিলে একজন ভাড়া করে কোথাও গিয়ে–কিন্তু সবই পকেটের রেস্ত বুঝে।
উপসংহারে বলা যেতে পারে–এই কয়েক লক্ষ স্বল্পায়ু শ্ৰেণীহীন হতদরিদ্র মানুষ, ওদের নেই কোনও সেক্স ইনস্পেকটর। রাজধানীতে এই কয়েক লক্ষ স্বাধীন ও মুক্ত মানুষ যৌনজীবনের ক্ষেত্রে বলতে হয় সবচেয়ে ভাগ্যবান। ওদের ক্রাইসিস অন্য দশজনের মতো। শুধু পার্থক্য এই যে, ওরা যৌনজীবনে এত বেশি স্বাধীন ও মুক্ত যে, কামের এই বসন্ত উৎসবে ওরা রাঙিয়ে মাতিয়ে দিয়ে দ্রুত চলে যায় পৃথিবী ছেড়ে। ওরা স্বল্পায়ু। অমানবিক এবং অসম্ভব কায়িক পরিশ্রম, অযত্ন, অপুষ্টি, বিভিন্ন অসুখ, অবিচার, অবাধ ও অধিক যৌন অত্যাচার ও রোগব্যাধি ইত্যাদিশেষে ওরা দ্রুত আর সংক্ষেপ।
২৫. পরকীয়া
বাইশ বছর আমি প্রবাসে। খোদ নিউইয়র্ক শহরে। বিগ এ্যাপেল সিটির একেবারে হার্ট বরাবর আমার বাসা। আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বলা যায় যে, প্রবাসের বাংলাদেশিদের জীবনে পরকীয়া, বিলাসিতার বদলে একান্ত প্রয়োজনীয় একটা ব্যাপার। পরকীয়া মূলত হয় প্রবাসের একাকিত্ব নিঃসঙ্গতাকে ঘোচাতে। নিঃসঙ্গতা, প্রবাসের একটি লাগোয়া অসুখ। এত সুখ, এত আছে তবুও, নিঃসঙ্গতা। যার সংসার আছে সেও ফিরে ফিরে বেলতলায় যায়, যেতে পারে, যায়ও। যার নেই, তার যাওয়া তো অনিবার্য। পরকীয়া–যা দেশের পরিবেশ থেকে দূরত্ব–প্রবাসের হতাশা আর শূন্যতা থেকে সৃষ্ট অনেক যন্ত্রণাদায়ক, নিঃসঙ্গ যান্ত্রিক জীবনে বেঁচে থাকার বিকল্প ব্যবস্থা। প্রবাসজীবনে পূর্ণিমার চাঁদের মতো। আলোর গভীরেও লুকিয়ে থাকে অনেক কালো গর্ত। আমরা বলি চাঁদের কলঙ্ক। ”জ্বলজ্বল বা চকচক করলেই সোনা হয় না” চাঁদ, এক পিঠে যার আলো, অন্য পিঠে অন্ধকার! প্রবাসও ঠিক তাই। স্বর্গ-নরক। চিত্ত এবং বিত্তের সুখ বিড়ম্বনা। হাসি-কান্না। জীবন-মৃত্যু। সব–সবই, একসঙ্গে এখানে লঙ্গরখানার খিচুড়ির মতো মিটে যায়। মানুষ খায় গোগ্রাসে।
প্রবাসের জটিল জীবন, অনেক দাম্পত্য জীবনকে ধ্বংস করে দেয়। বিত্ত আর নিরাপত্তার পাশাপাশি শূন্যতা আর হতাশা। সেই শূন্যতা আর হতাশা থেকে শান্তির সমাধান খুঁজতে প্রবাসে পরকীয়ার যেমন জুড়ি নেই, তেমনি নেই কোনও বিকল্পও। মনে, হৃদয়ে, ঘরে শান্তি না থাকলেও আছে কোথাও না কোথাও! দু’দণ্ড প্রাণ জুড়ানোর জায়গা, আছে! আজকের ব্যতিব্যস্ত নাগরিক জীবনে জীবনানন্দ দাশের মুখোমুখি বসবার মতো, বনলতা সেনদের অভাব, কী? তারা আজ আর শুধু নাটকেই আর সীমাবদ্ধ নেই। সময় কাটাবার জন্য তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র। বিকল্প স্বামী-স্ত্রীর অভাব অন্তত প্রবাসে নেই। বিবাহিত নয়, আবার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ফেলে দেয়ার মতনও নয়। কেউ দেখছে না। কেউ জানছে না। কারো কারো জানাজানি হলেও কিছু যায় আসে না। প্রবাসে অবাধ স্বাধীনতা। ডলারের অফুরন্ত শক্তি যা সব সামাজিক প্রশ্ন ধুয়েমুছে একাকার করে দিতে পারে। প্রবাসে পরকীয়ার পথ বড় খোলামেলা। পরকীয়া যা সবচেয়ে বেশি হয় মধ্য বয়সী প্রবাসী পুরুষদের বেলায়, যাদের স্ত্রীকে সন্তান নিয়ে দেশে থাকতে হয় কিংবা অপেক্ষায়, গ্রিনকার্ডের। প্রবাসের শ্লোগান–স্বল্পায়ু জীবনটাকেই যদি যথার্থভাবে উপভোগ করা না গেল তাহলে মানুষ জীবনের কোন মানেই থাকে না।
যাদের দেশে স্ত্রী, পুত্র-কন্যা সবই আছে, অথচ নিরুপায় স্বামী বেচারা। তাকে একা একা বছরের পর বছর জীবন সংগ্রাম করে যেতে হয়। নিয়মিত ডলার পাঠাচ্ছে দেশে। খরচা এখানেও কিছু করতে হয়। অনেক সময় এর মধ্যে গড়ে ওঠে দুটো সংসার। যার মধ্যে অবশ্যই একটা পরকীয়া। আর অন্যটা বৈধ স্বত্ব দেশে। যারা রক্ত-মাংসের মানুষ, তারা কি করে আশা করতে পারে যে, নিঃসঙ্গতা আর শারীরিক চাহিদা নিয়ে এই মানুষগুলো ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে শুধু পরিবারের অন্ন জোগাতেই বিদেশ বিভুয়ে নিজেকে নিঃশেষিত করে যাবে! আমার অভিজ্ঞতা বলে–এমতাবস্থায় শতকরা পঞ্চাশভাগ নারী ও পঁচানব্বই জন প্রবাসী পুরুষই অন্যের সঙ্গে একটা স্থায়ী-অস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলে। তাদেরও ন্যায্য যুক্তি, আমরাও মানুষ, পাথর তো নই। আপনারা কি চান আমরা চরিত্রবান থেকে থেকে হতাশায় শেষ হয়ে যাই? কি মূল্য এই মানবেতর জীবনের। তার চেয়ে কলঙ্কের ছিটেফোঁটা থাকা জীবন ঢের উপভোগ্য। আর আমিও ভাবি, তাইতো! আমি কি চাই না তা বড় নয়, পরকীয়া যাদের জীবনে ঘটছে, যারা নিঃসঙ্গ তাদেরটাই বড় কথা। প্রকৃত প্রস্তাবে এই সঙ্কট, অধিকাংশ সময়েই যা জীবন মধ্যাহ্নের।
প্রবাসজীবন, একটা ট্রেনের মতো একটা যন্ত্র। ট্রেন যা চলমান এবং একই সাথে অন্যের প্রয়োজনকেও নিজের শরীরে বহন করে চলে। প্রবাস। যেখানে একচুল ক্ষমা নেই, দয়া, মায়া কোনও অজুহাত নেই। এখানে পরিবারের প্রতি দায়িত্ব থেকে কোনও রকম বিচ্যুতির অবকাশ নেই। তবে দায়িত্ব তারা পালন করলেও পরিবারের কাছে তাদের এই পরকীয়া কোনওরকমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তবে এখানেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। শুধু পুরুষেরাই-বা কেন জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে? এ তো আর সচল মুদ্রা নয় যে চাহিবা মাত্র দিতে বাধ্য থাকিব। তারা কষ্টার্জিত দেশে ডলার পাঠাচ্ছে! ডলার, যার অন্য নাম হতে পারে সোনার কুলুপ, যা মুখে সেঁটে দিলেই, অন্য প্রসঙ্গ চুপ মেরে যায়। তাই ঘরের বৌকে এ ধরনের দুঃসংবাদ জেনেও হজম করতে হয়। তার স্বামী, যদি নিঃসঙ্গতার কারণে অন্য একটি মেয়েকে ঘরেই শুধু নয় বুকেও তুলে নিয়ে দিনাতিপাত করে তাহলে আটলান্টিকের দূরত্বে থেকে তার আর কি-ই-বা করার থাকে? বড়জোর টেলিফোনে কিছুক্ষণ গালমন্দ। খানিকটা কান্নাকাটি। হাত-পা যে সবদিক থেকে বাঁধা। খরচের কি শেষ আছে? স্বামীর চেয়েও বড় প্রয়োজন ডলারের! তাহলে ডলারই কি ওদের স্বামী? হয়তো-বা ফোনে কিছুক্ষণ গায়ের ঝাল মিটিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্দ করে, ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে এক সময় চুপ হয়ে যায়। এমনকি কান্নাকাটিও আর করে না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে যদি ডলার পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। ডলার ওদের মুখে সোনার কুলুপ সেঁটে দেয়। বাধ্য হয়েই স্বামীর পরকীয়া হজম করে যেতে হয়।
এই সমস্যা শুধু কি ছেলেদেরই! অনেক প্রবাসী নারীর জীবনেও পরকীয়া ঘটতে পারে। সন্তানতুল্য ছেলের সঙ্গে বয়স্কা মামির প্রেম। গড়ে উঠেছে শারীরিক সম্পর্ক। পরকীয়ার কি কোনও বিপরীতার্থক শব্দ আছে? সুতরাং দেশে থাকা সোনার ফ্রেমে বাধাই করা চরিত্রবান স্বামী ও স্ত্রীদের বলছি, পরকীয়ার কথা শুনে ওদের আজ আর অবাক হওয়ার কিছু নেই। বরং অভ্যস্ত হলেই স্বস্তি পাওয়া যাবে এবং অভ্যস্ত হওয়াই ভালো। কেননা ওরা শুধু পরিবারের আর অন্ন জোগানোর মানুষ নয়। ওরা পাথরেরও। নয়। অস্বাভাবিক এই পরিস্থিতিতে তাই ওদেরকে পরকীয়ার এই ছাড়টুকু দিতেই হয়। তবে পরিবার এ দেশে আসার আগেই ওরা নিজেকে পরকীয়া–মুক্ত করে ফেলে। সেই অর্থে প্রবাসজীবনটা যেন ম্যাজিক। মুহূর্তেই বদলে ফেলা যায় জীবনের চেহারা। ঝেড়ে ফেলা যায় পরকীয়া। যেন কিছুই হয়নি। কিছুই ছিল না। বেলা–মতিন, শাহীন, নিতু ওরা যেন ধুলো-বালি। স্রেফ হাত-পা ঝেড়ে নিলেই হয়। কিন্তু চাইলে কি সবকিছু এত সহজে মুছে ফেলা যায়? যেমন অনেক সময় পরকীয়ায় অভ্যস্ত, ওরা চাইলেও, দু’জন দু’জনকে ভুলতে পারে না। পারে না কারণ ওরাও তো রক্তমাংসেরই মানুষ। অনুভূতি আর দাম্পত্য এক নয়। এই যে এতকাল বৌ ছিল না বলে দশ বছর একসঙ্গে এক ঘরে, এক বিছানায় কাটিয়ে দিলো রীতি আর মাসুম। মাসুমের স্ত্রী দেশ থেকে চলে আসার সঙ্গে সঙ্গেই কি এই দশ বছর জলে ভেসে যাবে? দৈবাৎ কি এতই সহসা!
বিয়ের বাইরের সম্পর্কের নাম শুধু পরকীয়া নয়। আসল পরকীয়া সঠিক অর্থে অবৈধ প্রণয়। বিয়ে করা স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি যে মমতা বন্ধন পরকীয়া মমতা কখনো কখনো আরও অনেক বেশি গাঢ় এবং গম্ভীর হতে পারে। যেহেতু সেখানে একটা অনিশ্চয়তা কাজ করে। অনিশ্চয়তার যন্ত্রণা থেকে প্রেম আরো আকর্ষণীয় ও গম্ভীর হতে পারে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক কিছু শেষ হলেও, শেষ হয় না চার অক্ষরের ভালোবাসা। ফলে অনেক দোটানার সংসারেই নেমে আসে ধস। পরকীয়া হোক আর যাই হোক এই যে সোনার কুলুপ, এই ডলার, পাওয়ার, এই পুঁজিবাদ অনেক রকম তেলেসমাতি দেখানোর ক্ষমতা রাখে। এমনকি, দূরে বসে সবরকম কুকীর্তিও। যা অর্থনৈতিক বন্ধন, স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক বন্ধনকেও ছাড়িয়ে যায়। বৈধর চেয়েও অবৈধের টান প্রবল। অর্থ, বিত্ত, বিবাহ সামাজিকতাকে তুচ্ছ করে, পরকীয়া নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখে।
২৬. নারী খাদকেরা
(কাজের মেয়ে, সাধুসন্ত ও পীর ফকির)
ক. নরখাদক নয়। নারীখাদক। পুরুষ, যারা অনেকেই নারীদেহ থেকে নিজেকে আলাদা করে ভাবতে চায় না। পারেও না। কোনও না কোনওভাবে নারীদেহ তাকে উপভোগ করতেই হবে। তা সে যে-কোনও বয়সী হোক না কেন। মেয়ে। থেকে মায়ের বিভিন্ন বয়সী নারীদেহের প্রতি পুরুষের বিভিন্ন ধরনের বিকার থাকে। ছোটবেলায় মেয়েদের শরীরে পুরুষের এই বিকারের বিচরণ এত দেখেছি যে, তার সামান্য ক’টির উল্লেখই যথেষ্ট হবে বলে মনে হয়। এমন বাড়ি খুঁজে পাওয়া কঠিন, যে বাড়ির পুরুষ কাজের মেয়ের মশারির তলায়, ঢোকেনি! ক’জন। পুরুষ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে যে তারা কোনও না কোনও অজুহাতে, কাজের মেয়ের শরীর ছোঁয়নি! এমনকি নাবালিকার স্তনের কুঁড়ি আর সদ্য ফোঁটা প্রত্যঙ্গে জননেন্দ্রিয় ছলে-বলে-কৌশলে একবারও তার হাত ছোঁয়ানোর চেষ্টা করেনি এমন পুরুষ ক’জন আছেন বলা কঠিন! আমার বিশ্বাস, সংখ্যায় তারা নিতান্তই অঙ্গুলিমেয়।
একাধিক পুরুষের খবর জানতাম যারা একই বাড়িতে মা-মেয়ে দুজনকেই ভোগ করেছে। দেহ না দিলে ওদের চাকরি যাবে। কাজের মেয়েরা যারা অকাল বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা কিংবা যৌনজীবনে অতৃপ্ত, তাদের অনেকেই স্বেচ্ছায় না হলেও পেটের তাগিদে তাদের প্রভুদের সঙ্গে গোপন জীবনযাপনে অংশ নেননি এর সংখ্যা নিরূপণ করা বেশ কঠিন। আর যারা বাধ্য হয়ে দেহদানের মতো কুকর্মে লিপ্ত হয় তাদের বেশির ভাগই দুর্বলচিত্ত, অভাবী কিংবা বিপদগ্রস্ত নারী। ওরা জীবন সংগ্রামে অর্থের প্রয়োজনে অনন্যোপায়। তবে অধিকাংশই জোর-জবরদস্তি, লুকিয়ে-চুরিয়ে, গোপনে, আড়ালে-আবডালে বাড়ির কর্তা ব্যক্তিদের হাতে নাবালিকা ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধে অপরাধী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমন ঘটনা প্রতিপত্তির জোরে কখনওই বাইরে জানাজানি হয় না।
ছোটবেলায় আমার সমবয়সী কাজের মেয়ে যাদের নাম ছিল আকলি-রেনু-বুড়ি লতা ওদের মুখেও শুনেছি শহরের ছোটলোক-বড়লোক, একই বাড়িতে বাবা ছেলেদের মতো নষ্ট পুরুষদের গল্প। একই বাড়িতে কিংবা একই ঘরে মালিক, মালিকের ছেলে, কর্মচারী, প্রতিবেশী, অতিথি যে যেভাবে পারছে, করছে। ওদের সকলেরই চাহিদা তো স্রেফ একটি নারীর দেহপিণ্ড! ঘরে বৌ থাকলেও যা, নাথাকলেও একই রকম। আর বছরের পর বছর বা আজীবন, গ্রামে বৌ রেখে শহরে কাজ করতে এলে তো কথাই নেই। ওরা তো অতি সঙ্গত কারণেই যাবে। এটাই পুরুষের ধর্ম। ওদের নারীরাও জানে যে, এটাই সক্ষম পুরুষালির বড় পরিচয়। এবং এসব কাজের জন্যে বাড়ির নিরীহ কাজের মেয়েটিই সবচেয়ে সুলভ এবং নিরাপদ হিসেবে গণ্য হয়। উপরন্তু তুলনামূলকভাবে সস্তাও বটে। মা না হলে, মেয়ে। মেয়ে না হলে মা। অদল-বদলের একটা আলাদা স্বাদ। কচি-বুড়ো সবরকমের।
গ্রামের সুবিধে অতিরিক্ত। সেখানে রয়েছে ঝোঁপ-ঝাড়, পাটক্ষেত, গাছের আড়াল। রয়েছে অন্ধকার সঙ্গে নির্জনতা। কাজের শেষে সবাই ঘুমোতে গেলে ওরা যে যার সুবিধেমতো বেরিয়ে আসে। পা টিপে টিপে গীতার বাবা ঢেকে রেনুর মায়ের মশারির ভেতরে। রেনুর মা সব কাজশেষে নারকেল তেলের কৌটো নিয়ে অপেক্ষা করে বসে থাকে। শুষ্ক যোনিতে পুরুষাঙ্গটিকে তেল না খাওয়ালে কষ্ট হয়। কিংবা রেনুর মা যখন গভীর ঘুমে। মাত্র নতুন কাজে এসেছে। আর গীতার বাবা পা টিপে টিপে এসেই রেনুর মায়ের মশারি তুলে বলছে, চোপ, একটা কথাও কইবা না। কইলেই …, বলে বিশ টাকার নোটটি হাতে গুঁজে দিয়েই, স্তনে মুখ গুঁজে দেয়। আর রেনুর মাও স্বতশ্চল হয়ে যান্ত্রিকভাবে দু’পা বিযুক্ত করে দেয়। আর পুরুষটি প্রবিষ্ট হয় যোনিতে। রেনুর মা জানে কখন কি তার করণীয়। অবস্থা বুঝে। কারণ এই জীবন তার অজানা নয়।
প্রধানত অসহায়, গরিব, অশিক্ষিত বাপ-মায়ের মেয়েরাই পুরুষের এই নিষ্ঠুরতার শিকার। গ্রামে, শহরে, রাজধানীতে। পুরুষগুলোর নিরাপত্তা এই যে ওরা সহজেই নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারে। বিছানা ছাড়া মাত্রই ওদের আর ধরা যায় না। ওদের অপকর্মের তাৎক্ষণিক কোনও চিহ্ন থাকে না। পেট ফোলাফুলির ব্যাপারটাও নেই ওদের। ওটা শুধু মেয়েদেরই। অনেক বাড়িতেই দেখা যায় কাজের মেয়েটা, বলা নেই কওয়া নেই তিন মাসের পোয়াতি। সে শুয়ে থাকে আর ওয়াক ওয়াক করে। জানাজানি হওয়ার আগেই স্বয়ং মালিকের আত্মঘাতী পরনির্ভরশীল, স্বার্থপর স্ত্রী নিজেই বাচ্চা নষ্ট করার ব্যবস্থা করে দেয় স্বামীর দুর্নাম ঘোচাতে। কেননা পরনির্ভরশীল নারী, স্বামীর অর্থনৈতিক শক্তির কাছে শৃঙ্খলিত নির্বোধ প্রাণীর মতো। দিনকে ওরা রাত করে দেয়, রাতকে দিন বানাতেও ওদের জুড়ি নেই। কখনো কখনো এধরনের অনেক পোয়াতির অকাল মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশও হয় না। হলেও তা ভূতের আছর হিসেবেই প্রচারিত হয়। সঙ্কীর্ণ পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থার মাহাত্ম এরকমই।
মধ্যবয়সী কর্তার এই বিলাসিতার বিষয়টি প্রথমে জানে বাড়ির গিন্নিমা। পরে পাশের বাড়ি। তারপরে পাড়াসুদ্ধ। সবশেষে আস্ত গাঁয়ের লোক। তবে অনেক সময় অনেক মুখরা স্বভাবের কাজের মেয়েগুলোকে বাগে আনা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। কাজ থেকে অব্যাহতি পেলে তারা নিজেরাই এধরনের কুৎসা রটিয়ে মালিকপক্ষকে বিপাকে ফেলতে সচেষ্ট হয়। মধ্য বয়সী পুরুষদের এরকম সঙ্কটময় যৌনজীবনের বিড়ম্বনা নতুন কোনও ঘটনা নয়। এসব কুকীর্তির সংবাদ বেশিদিন চাপাও থাকে না।
একা এবং সুযোগ পেলেই নাগালের মেয়েগুলোর স্তন টেপাটেপি করতে যেন আর তর সয় না কামার্ত পুরুষগুলোর। তা সে দুই বছরই হোক ষোল বছরই হোক। আদর করার নাম করে ঘরের দরজা বন্ধ করে কোলে বসিয়ে নিয়ে নিজেদের পুরুষাঙ্গটি ঘষতে থাকে অপ্রাপ্ত বয়সীর যোনিদেশে। মেয়ের বয়সী শিশুটির হাফ প্যান্টের ফাঁকে পুরুষাঙ্গ ঢুকিয়ে কতই না রক্ত ঝরায়! অসহায় শিশুটির কিছুই বলার থাকে না; অনভ্যস্ত ব্যথায় চোখের জল ঝরানো ছাড়া। শিশুটির ফুলে ওঠা রক্তাক্ত, বিক্ষত যৌনাঙ্গ মায়ের চোখ এড়িয়ে যায়। সুযোগ পেলেই আদর করার ছলে, চাচা, মামা, নানা, অমুক ভাই ওরা মেয়েদের টেনে নিয়ে যায় একলা ঘরে। ছোটবেলার কত অভিজ্ঞতা। ক’টা বলবো? মনে পড়ে বুলবুলির মায়ের কথা। অকাল বিধবা। মাথাভর্তি কালো চুল। গড়িয়ে পড়া যৌবন। সাদা ধুতির নিচে পরিপুষ্ট স্বাস্থ্যের বর্তুল স্ফীতি হাঁটার সময় জোয়ারের জলের মতো দু’পাশে ডাইনে-বাঁয়ে দোলে। সুযোগ পেলে বুলবুলির মা নিজেই দালানের পেছনে যেত বাড়ির মালিকের সঙ্গে। আর বুলবুলি যেত কর্মচারী ছোঁড়ার সঙ্গে পায়খানায় প্রায় প্রতিদিনই। যথানিয়মে একদিন বুলবুলির মায়ের পেট ফুলে ওঠে। জানতে পেরে মালিকের বৌ তাকে নিয়ে যায় কবিরাজের কাছে। বুলবুলিরও পেট ফোলে। যায় পীর-ফকিরের কাছে। এ-রকম এক গোলমেলে পরিস্থিতিতে বুলবুলির মায়ের মৃত্যু সংবাদ কোনও সংবাদই হলো না। আপদ গ্যাছে। মা নেই তাই মেয়ের কথা কে বলবে! বুলবুলির পেট হলে তের বছরের বুলবুলি, মেয়ের মা হয়। জীবন সংগ্রামে ব্যর্থ হয়ে যোব বছর বয়সে বুলবুলি, পৃথিবীর সবচেয়ে পুরানো এবং সহজ কাজ খুঁজে পেতে বেশ্যা খাতায় নাম লেখায়।
খ. গ্রামের ফকিরগুলোকে কাজ দিতে চাইলে ওরা কিছুতেই রাজি হয় না। যদি বলা হয়, ‘জোয়ান বেডি কাম কর না কিল্লাই!’ বিরক্ত হয়ে মুখটা ঘুরিয়ে ভিক্ষের অপেক্ষা না করেই চলে যায়। দিনের বেলায় এদিক-ওদিক ঘুরে ফিরে। ভিক্ষে করাটাই ওরা স্বাধীন পেশা হিসেবে সম্মানজনক মনে করে। আর রাত্রিবেলায় শহরের এর-ওর হাত ধরে চলে যায় অন্ধকারে। কেউ চালার তলে। কেউ গাঙিনার পারে, কেউ পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির বিশাল দেয়ালের ওপারে। গ্রামে এগুলো কোনও ব্যাপারই নয়।
‘ভাত জোটে না। আবার পেড হইছে! ক্যান হইছে! আগে মনে থাকে না? ক এইডার বাপ কেডা।’ বিলকিস উত্তর দেয় না। ওর মুখ-চোখ ভাঙা। পেটটা মাটির দিকে ঝুলছে। মনে হয় এক্ষুণি প্রসব হয়ে যাবে। ভাত নিয়ে সে চলে যায়। এক সপ্তাহ পর ফিরে আসে বাচ্চা কোলে নিয়ে। আমরা উৎসুক হয়ে বাচ্চা দেখি। কাপড় দিই। দুধ দিই। দুধ না থাকলে কেনার পয়সা দিই। দিই আর অবাক হয়ে দেখি। দেখি শহরের অনেক ভিখিরির কোলের বাচ্চাগুলো যতই বড় হয় ওদের চেহারাগুলো ততই ধীরে ধীরে মনে হয় দীনু কাকা, নান্টু, বিন্দু, মিজান, মিন্টু ওদের মতো হয়। মকবুল যতই বড় হয় ততই ওর নাক-চোখ-ঠোঁট হয় চেয়ারম্যানের মতো। বিলু যতই বড় হয় দেখতে হয় আমার আপন কাকার মতো; অবিকল একই চেহারার।
ফকিরনিকে ধমকে জিজ্ঞেস করি। বলি, কাউরে কমু না। সে আমার কথার কোনও উত্তর দেয় না। শুধু বিস্মিত চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রাগ রাগ চেহারা করে তাকিয়ে থাকে। থেকে বলে, ভাত দিলে দ্যান। খালি খালি, এতো কথা জিগান ক্যান …।
গ. একবার আমাদের গ্রামে এক সাধু আস্তানা গাড়লেন। এসেছেন তিনি পাবনা থেকে সর্বরোগের নিরাময় করতে পারবে বলে ঘোষণা দিলে মানুষের ঢল নামে তার আস্তানার দিকে। পয়সার বিনিময়ে তিনি ঝাড়-ফুক, তাবিজ-জলপড়া ইত্যাদি দেন। মেয়েদের নিয়ে যান একলা ঘরে। একা, তাদেরকে সেখানে হিফাজতশেষে, স্বামীদের কপালে দেন লক্ষ টাকা আয়ের ফু-দোয়া-তাবিজ-কবজের গ্যারান্টি। নিঃসন্তান পিতামাতাকে দেখান ন্যূনতম পাঁচটি সন্তানের স্বপ্ন। মৃতপ্রায় রোগীকে দেখান গোলাপি জীবনের স্বপ্ন। আর তিনি নিজে হতে থাকেন বিত্তশালী। বাড়তে থাকে তার আস্তানা। বাড়ে ভিড়।
রোগী মরে যায়। সেসব নিঃসন্তান মহিলাকে দেখে ডাক্তার বলেন তার জরায়ুই নেই তো সন্তান ধারণ করতেন কি করে! আর যে মেয়েদের তিনি একা একা একলা ঘরে নিয়ে হিফাজত করেছিলেন, তাদের প্রত্যেকের পেটের পরবর্তী সস্তানের আদল সেই সাধুরই। আর গরিব পুরুষেরা বড়লোক হতে চেয়ে দক্ষিণা দিয়ে দিয়ে নিঃস্ব হতে থাকে। না দিলে বাবা-ভোম ভোলানাথ ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে অভিশাপ দেন। তাকে ভয় পাবে না এমন সাধ্য কার! তার অস্ত্র ধর্ম। ধর্মের দোহাই। সন্দেহ, যৌন অপকর্মকে উতরিয়ে যায়। ধর্ম, যৌন অপকর্মকে উতরিয়ে। যায়, মন্দির-মসজিদ-মাদ্রাসা-গির্জা-পেগোডায়, যায় ধর্মবোধের দোহাই দিয়ে। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে তখন ধর্মচর্চা হয়ে ওঠে মানবজীবনের একটি অন্যতম অলঙ্কার। আর সেই সুযোগে চলে যাবতীয় যৌন অপকর্ম।
পুরুষদের মধ্যে এই যৌনতার বিকার সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর। এবং বিশেষ করে নাবালিকাদের জন্যে তো প্রচণ্ড দুঃসংবাদ। ধর্ষণ এবং অন্যান্য যৌন অপকর্মের জন্যে বিকারগ্রস্ত পুরুষগুলো, অপেক্ষায় থাকে। এবং যে-কোনও সুযোগই তারা লুফে নেয়। অনেক সময় এই অতিরিক্ত যৌন ইচ্ছা তাদের নিজেদের জীবনেও অসহনীয় সঙ্কটে রূপ নেয়। ফলে সৃষ্টি হয় বিবিধ সামাজিক সমস্যা। তারা নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলেই শুরু হয় ত্রাস। এবং এরকম বিকারগ্রস্ত পুরুষদের এই ত্রাসের সংবাদ সহসাই শোনা যায়, লোকমুখে বা মিডিয়ায় সাবধানতার বাণী হিসেবে। পৃথিবীজুড়ে সবখানেই রয়েছে ধর্ষক। ওদের জন্যে অগণিত নারীর জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। ধর্ষণ, একটি ভয়াবহ প্রক্রিয়া। যে ভুক্তভোগী, শুধু সেই জানে তার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা।
পুরুষদের এই সঙ্কট পতিতালয়ের কারণে অনেকটা প্রশমিত হয়ে যায়। কিন্তু যারা পতিতালয়ে যায় না বা যাওয়ার সাহস পায় না সমস্যা তাদের নিয়ে। এবং এই সমস্যা মূলত মধ্যবয়স্ক পুরুষদের বেলায় অধিক প্রযোজ্য, যে বয়সে বিকারের অবস্থা থাকে তুঙ্গে। আমাদের ক্ষয়িষ্ণু, ধুকে ধুকে মরা পুরোনো সমাজের অযাচিত নিয়মকানুন আর কিছু অযৌক্তিক বাধ্যবাধকতা, সেকচ্যুয়াল ব্যাপারগুলোকে কোণঠাসা এবং অশ্লীল করে, ধর্মবোধ এবং সমাজবোধকে প্রতিষ্ঠার কারণে এই চরম মূল্য। আর তাছাড়াও, দারিদ্র্য-অশিক্ষা-পরনির্ভরতা-নারী নির্যাতন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, এসবের মূল্য দিতে ভাগ্যহীনা মেয়েদের চেয়ে উত্তম শিকার, কি আর হতে পারে সে আমার জানা নেই।
২৭. গেস্ট হাউজ
মেয়ে মানুষদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এক ধরনের ইন্ডাস্ট্রি। গোলার্ধের ওপারে সফিস্টিকেটেড হোটেল-মোটেল, কন্ডো-প্রাসাদ-স্যুইট ইত্যাদি। আর এপারে-ব্যাঙাচির মতো গড়ে ওঠা সস্তায় গেস্ট হাউজ এবং কিছু হোটেল-মোটেল। এই ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু যারা ওদেরকে আমরা ভদ্রজনেরা ভদ্ৰ ভাষায় বলে থাকি পতিতা। তা এই পতিতা কারা এবং তাদের কাজকর্মই-বা কি? কাঁদের বলা হয় পতিতা? পতিতাবৃত্তির রমরমা ব্যবসা বিশ্বব্যাপী সর্বত্রই। কলকজা, যন্ত্রপাতি ছাড়াই এ এক বিশাল শিল্প সংস্থা। ভদ্র ভাষায় বলা হয় যৌন পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন এবং আদিমতম ব্যবসাও বলা হয় একে। আর এতে জড়িয়ে যাওয়ার ইতিহাসও অভিনব, চমকপ্রদ। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর এই করুণ পরিণতি নতুন কিছু নয়। আমি এই পেশার বিরুদ্ধে নই। তবে তা অবশ্যই হতে হবে রুচি, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক স্বীকৃতিসম্পন্ন। বৈষম্যহীন তো বটেই। অন্যান্য কাজের মতো এটিও একটি কাজ, একটি পেশা। ঠিক আর ন’টা-পাঁচটা কাজের মতো।
একথাও অনস্বীকার্য যে, পতিতালয় রয়েছে বলেই আজ অনেক সংসার টিকে আছে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, ঘর ভাঙাভাঙির ব্যাপারটা অন্যায়ভাবে এদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে অনেকে পার পেয়ে যান। যৌনকর্মীরা যে অনেক নিন্দার ভাগী তাতে কোন সন্দেহ নেই। দৈহিক-মানসিক আনন্দ খুঁজতে যৌন শ্রমিকদের কাছে যাওয়া অনেক পুরুষেরই বিলাসিতা। কারো অভ্যেস, কারো বদভ্যাস, কারো অদম্য নেশা। আবার তাদের কেউ কেউ বিকৃত রুচির পুরুষ। ঘরে সুন্দরী বৌ রেখেও, ওরা বেশ্যালয়ে যাবে যাবেই। নোংরা পরিবেশ-নোংরা গন্ধঅলা পেটিকোট খুলে বা তুলে তাদের সেই পরম কাক্ষিত বহুল ব্যবহৃত নারীর নরম মাংসপিণ্ডের নিচে প্রেমবিহীন নিঃসাড় অঙ্গই হয়তো অধিক আনন্দদায়ক। কথায় বলে, আপরুচি খানা পররুচি পিননা। হোক না তবে কি? শুধু শরীর নয়, পতিতারা ভালো আচ্ছা সঙ্গী হতে পারে। সুন্দর সঙ্গ এবং ভালো ব্যবহার ওদের ব্যবসার অঙ্গ। তাৎক্ষণিক ভালো লাগার জন্যে। পতিতালয়ের টান অমোঘ। পতিতারা অন্তত ঘরের একঘেয়ে জীবন থেকে সাময়িক আমোদ-প্রমোদ দানে এক বিকল্প জীবন। নাচ, গান, হাসি, বিড়ি, মদ, গাঁজা, চরস, ভাং, মোক অবশেষে চাইলে অবশ্যই শরীরটাও। এই নিয়ে হলো–পতিতাদের সেই স্বর্ণালয়, যেখানে গেলে দুঃখ নামের জন্তুটাকে নিশ্চিত ভোলা যায়। অন্তত কিছু সময়ের জন্য সুখ কে না চায়! এবং কারো কারো জন্যে, সুখের অন্য নাম–পতিতাপল্লীতে।
পতিতা সঙ্গ–মহাত্মে যার নামকরণ করা হয় পতিতালয়, বেশ্যাবাড়ি বা খানকিপাড়া। এর আবর ব্যাখ্যা কী। মধ্যবয়সী পুরুষদের মধ্যে এই প্রবণতা বিভিন্ন কারণে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে পারে। তার মধ্যে একই নারীর পুরোনো শরীরের নিত্য ব্যবহার সবার ওপরে। এই নেশা অনেকটা মদ বা হেরোইনের মতো। না খেতে পারলে তীব্র শারীরিক কষ্টগুলো বাধ্য করে কোনও একটা আসক্তিতে ফিরে যেতে। পতিতালয়ও তাই। অনেক সংসার ভেঙে যায় সিনেমার রাধিকাঁদের সংসারের মতোই। এই অদম্য আসক্তির কারণে সেখান থেকে ফিরতে চাইলেও পুরুষ আর ফিরতে পারে না। অসুস্থ হয়, ঘর ভেঙে যায়। তবুও না। তাদের কাছে একমাত্র পতিতাই ধ্যান-জ্ঞান, পতিতাই ভালো। পতিতার শরীর ভালো। ওর গন্ধঅলা পেটিকোট, চুলভর্তি নোংরা সঁতসেঁতে ঘর্মাক্ত বগলের গন্ধ ভালো। ওর যোনিদেশের মসৃণ চামড়া ভালো। চামড়ার গন্ধ ভালো। ওর শিল্প ভালো। তার অলঙ্করণ ভালো।
একথা সত্য যে পুরুষদের এই চাহিদা না থাকলে অবশ্য পতিতাপল্লীর প্রয়োজনই হতো না। তবে এখানে একটা যুক্তির কথা থেকে যায়। বৈষম্য বা অধিকারের কথা। তাহলে আমরা কি এই বুঝে নেবো যে পুরুষদের মতো মেয়েদের একরকমের ইচ্ছে নেই বলেই তাদের জন্য পতিতাপল্লী নেই! কে বলেছে, মেয়েদের এই বিলাসিতা নেই! ছেলেদের মতো মেয়েদেরও থাকতে পারে অন্য পুরুষের দেহের প্রতি সমান আকর্ষণ! তীব্র আকর্ষণ। কিন্তু হ্যাঁ, মেয়েদের জগতে অন্তত আমাদের দেশে আছে অনেক সীমাবদ্ধতা, অনেক বিধিনিষেধের বেড়াজাল। পুরুষ যা পারে, মেয়েরা তার সিকিভাগও পারে না। কিন্তু যুক্তির কথাই যদি বলা যায় তবে দোহের মিলনে যদি হয় সঙ্গম, তাহলে বিকল্প জীবন খুঁজতে দাম্পত্য জীবনে অসুখী নারীরা কেন যেতে পারবে না। সংরক্ষিত সমর্থ যুবকপল্লীতে। এই পৃথিবীটা এখন মোড় নিচ্ছে–সমান অধিকারের পথে। কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেয়ার নয়।
বাংলাদেশে শ্রমের মূল্য অন্য দেশের তুলনায় ঢের কম বলে এখানে গার্মেন্টস শিল্পের বাজার গজিয়ে উঠেছে হাজার হাজার। কম-বেশি বিদেশি বিনিয়োগও বাড়ছে। বায়িং হাউজের ব্যবসা খুবই লাভজনক। বিদেশি বায়াররা আসছে দলে দলে। তাদের বিনোদনের জন্য চাই নারীদেহ। যার ফলে বাংলাদেশে গেস্ট হাউজের ব্যবসা এখন সবচেয়ে রমরমা। ব্যাঙের ছাতার মতো প্রতিদিনই গজাচ্ছে। বিশেষ করে অভিজাত পল্লী এলাকায়। মেয়েমানুষের দেহ বিক্রি ব্যবসার চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। শুধু এখানেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও। ঢাকা শহরেই শুধু নয়, সমস্ত বাংলাদেশের গ্রামেও এখন গেস্ট হাউজের এপিডেমিক। ছোট একটা রুম হলেই হলো। এর মধ্যেই যেনতেন প্রকারে একটা খাট ফেলে, দরজা-জানালা বন্ধ করে, কিছু পর্নো ম্যাগাজিন রেখে শুরু হয়, দেহ বিক্রির কায়কারবার। নাবালিকা, কচি যুবতী থেকে শুরু করে মধ্য বয়স্ক এবং বয়স্ক নারীরাও এই সস্তার কাজটি করে। কাজটা সস্তা, তবে মজুরি ভালো। সেখানে তো আগমন ঘটে ভিন্ন রুচির লোকদের। রুচি এবং চাহিদামাফিক সব বন্দোবস্তই রাখতে হয়। এমনকি সম বা উভকামিতাও। এক রাতে একশ, দু’শ, পাঁচশ’। খদ্দের বুঝে, বয়স ও শরীর বুঝে। গেস্ট হাউজ বন্ধ নয় বরং ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখার পক্ষের লোকেরাই বেশি। তার কারণ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এখন অসুখী পুরুষ। অসুখী কারণ, গেস্ট হাউজগুলোতে অন্য নারীর শরীরে এত সুখ যে, তার তুলনায় মাতৃত্বে ক্ষয়ে যাওয়া ঘরের বৌদের অতি ব্যবহারে জীর্ণ শরীর আর ভাল্লাগে না। এই সমস্যা কার নেই? মহামানব থেকে অস্পৃশ্য, সবারই। প্রেসিডেন্ট থেকে রিকশাওয়ালা। বুকে হাত দিয়ে বলুক–কার নেই। গেস্ট হাউজের যৌনকর্মীরা আমাকে গল্প শোনায়। গল্প শোনো মেয়ে। গয়না নয়, শাড়ি নয়। বাস্তবের গল্প শোন মেয়ে। আমি শুনি ওদের জীবনের গল্প। ওরা শোনায় আমারই চেনা, ভাই, চাচা, মামা, কাকাঁদের অন্যরকম গল্প। ঘর ভাঙছে। হৃদয় ভাঙছে। স্বপ্ন ভাঙছে। সঙ্গে গেস্ট হাউজের সংখ্যা আর পুরুষদের মিডলাইফ ক্রাইসিস, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। দুঃখ শুধু মেয়েদের বেলাতেই এই ক্রাইসিসগুলো সমান সমান সত্ত্বেও, উপেক্ষিত, অবহেলিত।
২৮. স্বামী আসে স্বামী যায়
তখন বয়স আমার বারো বা তেরো। শেরপুরে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে রোববারের হাটের সব দোকান বসে। রবি আর বৃহস্পতিবারে সেখানে ধুম বাজার। বাজারের বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল সারিবাধা ছোট ছোট টিনের চালা দেয়া ঘর। এই চালার নিচে দিনের বেলা দোকানপাট, আবার বাজার শেষ হলে রাতের বেলায় এখানে শহরের ফকিরগুলো ওদের বোচকা-বুচকি নিয়ে এসে যার যার নির্দিষ্ট চালার তলায় গিয়ে বসে খুলতো ওদের সারাদিনের সগ্রহ ভাণ্ডার। বোচকার মধ্যেই ওদের তাবৎ সংসার। এর মধ্যে ওদের ছেঁড়া নোংরা পুরোনো গন্ধআলা কাঁথা, পুরোনো কাপড় চোপড়, কারো কারো হয়তো কৃচিৎ একটি ছেঁড়া মশারি। চারপাশে উন্মুক্ত পৃথিবী। আর তার একটুকরো চালার নিচে কুপি জ্বালিয়ে ওরা গল্প করতে করতে বিছানা পাততো। কেউ ধরতো গান। ভিক্ষের ভাগবাটোয়ারা বা জায়গা নিয়ে কেউ নিয়মিত ঝগড়া, এমনকি এই অন্ধকারেও ওরা মাথার উকুন পর্যন্ত বাছতো। কেউ কেউ বাজারের কুড়োনো ঝড়তি-পড়তি জিনিস বেছে, রান্না বসাতো। ওদের সঙ্গে, একটা দুটো করে পাটশোলা, শুকনো পাতা, ভাঙা খড়ির টুকরো আমিও আগুনে দিতাম। ফকিরগুলো এই চালার তলে গান আর ঝগড়ার কলরবে জাগিয়ে দিতো ভিন্ন এক ধরনের জীবন, যা সকালের আলোয় আর দেখা যেতো না। কৌতূহলী আমরা বোনেরা পড়া-শেষে সবাই দল বেঁধে যেতাম এই কলরব শুনতে। যা অন্যরকম, যা নিশ্চিত গোছানো নিরাপদ জীবনের উল্টো। যে জীবন আমাদের নয়।
তবে মধ্যরাতের পর এ জগৎ আলাদা হয়ে যেতো। এই চালার তলায় ফকিরনীদের জগতে শুরু হতো আর একরকমের জীবন। যেন সম্পূর্ণ আলাদা আর এক জগৎ। বৌয়ের বিছানা ফেলে শহরের পুরুষগুলো বের হয়ে ফকিরনীদের কাছে যেত। চালার তলা থেকে নিয়ে ওদের যেতো কখনো বটগাছের তলে, কখনো পুকুরপাড়, কখনো কোনও গলির ভেতরে।
আর এই চালার তলেই, কালু মিয়া আর হাফিজার পাশাপাশি জায়গা। দু’জনেরই মধ্যবয়স। কালু মিয়া একা। হাফিজাও। দিনের বেলায় দু’জনেই ভিক্ষে করে যার যার মতো। রাতের বেলায় ওদের শোবার নির্দিষ্ট জায়গা দুটো ঠিক পাশাপাশি। এক সপ্তাহের মধ্যেই পাশাপাশি শুয়ে থাকা কালু মিয়া আর হাফিজার মধ্যে প্রেম হলো।
একদিন শুনি, ওদের নাকি বিয়ে হয়ে গ্যাছে। পোলাও-মাংস খেয়েছে। খাইয়েছে। নতুন শাড়িও পরেছে। শুনেই গিয়ে দেখি, হাফিজা নতুন লাল শাড়ি পরে কালু মিয়ার মশারির তলায় শুয়ে। ওমা! কখন ওরা স্বামী-স্ত্রী হলো। তার মানে ওদের এক বিছানা। এখন থেকে হাফিজা রান্না করবে আর কালু মিয়া খাবে। এটা-ওটা দিয়ে যত্ন-আত্তি করবে। পায়ের নখ কেটে দেবে। এবং পাঁচ মাসের মধ্যে হাফিজার পেট ফুলে যায়। আট মাসে সে আর হেঁটে ভিক্ষে করতে পারে না। কালু মিয়া যা আনে তাই। পোয়াতি হাফিজাকে কালু আদর করে, বটগাছের তলে বসিয়ে রেখে নিজে.ভিক্ষে করতে যায়। হাফিজা আর হাঁটতেই পারে না। ওর চোখ ভাঙে। চেহারা ভাঙে। শরীর নরম হয়ে ঝুল ঝুলি করে। কয়েকদিন পর চালার তলেই সমস্ত রাত চিৎকার আর দাপড়ানোশেষে ওর একটা ছেলে হলো। ছেলের নাড়ি কাটা হলো বাঁশের কঞ্চি দিয়ে। নতুন কাপড় পরানো হলো। আমরা দিলাম জামা, খেলনা, কাজল। শখ করে ছেলের নাম রাখা হলো মুহব্বতজান কালু। আমার মনে পড়ে মা। মুহব্বতজানকে কোলে নিয়ে আদর করেছিলেন। দুধ কেনার জন্যে ক’টি টাকা হাতে দিয়ে বলেছিলেন, বাচ্চার দিকে লক্ষ্য রাখিস। জঙ্গলে কিন্তু শিয়াল থাকে।
একদিন, নেই-নেই-নেই। কোথাও নেই। শুনি বাচ্চা আর হাফিজাকে ফেলে কালু মিয়া, চলে গেছে। হাফিজাও জানে না, কোথায়। সে শুধু হাউমাউ করে কাঁদে। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় বাপকে খোঁজে। সে আর ফিরলো না। কে বললো, দক্ষিণ গ্রামে সে বিয়ে করে সুখে-শান্তিতে আছে। রাবেয়া বললো, সে দক্ষিণ গ্রামেই থাকে। একমাস পর, হাফিজা আর কাঁদলো না। কালু মিয়া গেলে এবার এলো–মইনু মিয়া। চালার তলের জীবনের এমন অনেক গল্পকথা। রূপকথার মতো, স্বামী আছে, স্বামী নেই। স্বামী চলে যায়, স্বামী আসে। এলে দুই-তিন মাস থাকে। খেয়েদেয়ে পেট করে দিয়ে চলে যায়। চলে গেলে মেয়েগুলো গালমন্দ করে বলে আর এ ভুল করবে না। কিন্তু রতির তাড়না এমন যে, নাগর কাছে এলেই ওদের অতীত ভুলতে এক মুহূর্ত সময়ও লাগে না। মেলে দেয় শরীর। ওরা ফের পেট করে দিয়ে ফের গা ঢাকা দেয়। এমন উদাহরণ প্রচুর।
ফকির হোক আর বাদশা–শরীরের তাড়না সবারই এক। মধ্যবয়সে এসে, তাড়না। তুঙ্গে ওঠে।
২৯. মামির মিডলাইফ ক্রাইসিস
জীবনে এমন কিছু কিছু উদ্ভট ঘটনা ঘটে যার কোনও ব্যাখ্যা নেই। অতৃপ্ত, অসুখী যৌনজীবন বা শরীর বিষয়ে কৌতূহলীপ্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে দেখা হলে অনেক সময় সহজেই তারা বুঝে নিতে পারে তাদের ভাষা। তারা অপরিচিত। পরিচিত হতে কোনও সময় নেয় না। কারণ তাদের মূল প্রসঙ্গ শরীর। শরীর, যা কথা বলিয়ে ছাড়ে। রোমাঞ্চ বা বিকৃত যৌনরুচি–কামের গন্ধকে ওরা ঠিক ঠিক চিনে নিতে ভুল করে না।
গ্রামে আমার এক মামি ছিল। সে ছিল সাধারণ মেয়েদের থেকে একটু ভিন্ন। ধরনের। মামা, সেও সুদর্শন এবং বুদ্ধিমান। তবে মামির মতো নয়। মামা, শারীরিক দিক থেকে ততটা সুস্থ ছিল না। তার ছিল বহুমূত্র রোগ এবং কিডনির সমস্যা। আমি তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী। পাবনা থেকে মামি বেড়াতে এলো মামাসহ। ঠিক তখনি এলো আমার সেজো বোনের বিয়ের সম্পর্ক। ছেলেটি এম.এ. পাস। শ্যামলা রঙ আর। কোকড়া চুল। ছেলেটিকে দেখে কেন জানি না আমার প্রথম থেকেই পছন্দ হলো না। মনে হলো লোকটা আনস্মার্ট, মেকি, ন্যাকা, ভদ্রতার ভণ্ডামি … ইত্যাদি। কিন্তু ছেলেটির সাথে আমার মামির সহসাই একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। দু’জনে সুযোগ পেলেই বেশ রসিয়ে বসে গল্প করে। এমনি করতে করতে বিয়ের বদলে বরং লোকটা মামিকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
মেয়ে দেখতে এসে ওরা দু’দিন থাকবে। পরদিন সকালে ওদের প্রাতরাশ খাওয়ানোর দায়িত্ব পড়লো মামির ওপর। মামি ভালো রাধুনী। বেশ সেজেগুঁজে রান্নাঘরে এলেন। রান্না হলো লুচি, ছোট গোল আলুর তরকারি। গোল বেগুন ভাজা। সঙ্গে মুক্তাগাছার মণ্ডা এবং শেরপুরের ছানার পায়েস। একটা গোলমেলে কিছু টের পাচ্ছিলাম। মামি খেতে দিলো নিজ হাতে। আমি পাশে বসে দেখি মামির কাণ্ড। আমার মামি, তিন সন্তানের মা, দুপুরবেলাতেও বেঁধেবেড়ে লাঞ্চের সময় হলে সেজেগুঁজে ছেলেটিকে খেতে দিলো মাছের পেটি, মুড়িঘণ্ট, কালিয়া। আমার কৌতূহলী মন। আমি লক্ষ্য করি, অন্যেরা যা দেখে না।
বিকেলবেলা। এপাশে কদমতলার ঘরে কেউ নেই। সব যার যার মতো ওপাশে। মামি আর লোকটাকে দেখলাম বাড়ির শেষ মাথায় ছোট ঘরটায়, কদম গাছের ঠিক নিচে, ওখানে গিয়ে ওরা দু’জন নিবিড় হয়ে বসলো গল্প করতে। চৌকিটা ছোট এবং তাতে একটা পুরোনো তোশক বিছানো। বাড়িতে কারো চোখেই ধরা পড়লো না, দু’জনের মধ্যে একটা অস্থিরতা একা হওয়ার। ওরা ঘরে ঢুকে দরজা অর্ধেক চাপিয়ে দিল। আর আমি হামাগুড়ি দিয়ে অন্য দরজা খুলে লুকিয়ে গেলাম চৌকির নিচে। নিশ্বাস নিতে থাকলাম খুব আস্তে আস্তে। কান রইলো খাড়া। শুনলাম ওদের পর্নালাপ।
লোকটাকে মামি অবলীলায় বলছে মামার অসুস্থতার কথা। কি-কি কারণে তার জীবন সুখের নয়। বলছিল তার ঋতুর কথা। তার গর্ভাবস্থা। তার রাত্রিবেলার দুর্ভোগ। তার মিডলাইফ ক্রাইসিস। তার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত স্বামীর রাত্রিবেলার কঠিন স্নায়ু যুদ্ধ, যৌনজীবনের সঙ্গে। বললো স্বামীর শিথিল অঙ্গের কথা। লোকটিও জানালো তার অনুভূতি। তার অভিজ্ঞতা, গ্রামের দুই নারীর সঙ্গে। যাদের একজন বয়স্ক বিধবা, তারপর শুরু হলো দু’জনের মৃদু শারীরিক আদান-প্রদান। দরজার খিল লাগানো। এলো চুম্বনের শব্দ। প্রথমে ধীরে-সুস্থে পরে সজোরে। আমি যতই শুনি ততই অস্থির হতে থাকি। চুম্বনের শব্দে হৃৎপিণ্ড উত্তেজিত হয়। অজান্তেই শরীরের কোথাও কোনও স্পন্দিত আলোড়ন হয়। আমার পাজামা ভেজে, নাইকুণ্ডলীর নিচের ঢেকে-টুকে রাখা কোনও এক বিশেষ জায়গা থেকে। আর বসে থাকতে না পেরে দৌড় দিতে গিয়ে কিছুটা ভয়ে, কিছুটা উত্তেজনায় পেচ্ছাব করে দিলাম ওদের সামনে। সেই থেকে মামির চোখমুখ বিষণ্ণ। মামি জানে আমি ডানপিটে মেয়ে। সব বলে দেবো, জানে সে। রাতেই বোচকা বাঁধতে শুরু করলো চলে যেতে। এ নিয়ে অবশ্য আমি কাউকেই কিছু বলিনি। শুধু বাবাকে বললাম, এই ছেলের সঙ্গে দিদির বিয়া দিলে আমি বাড়ি ছাইরা যামুগা। বাবা বললেন, মনে হয় না এই বিয়া হইবো। ছেলেটা মনে হয় অলস। আমারও বিশেষ ভালো লাগে নাই, বললেন বাবা। বাবা বললেন এক কারণে আর আমি, সম্পূর্ণ অন্য কারণে। কিন্তু দু’জনেরই বটম লাইন-এক। অর্থাৎ, ছেলেটা ভালো নয়। শুধু কেউ কারোটা জানলো না।
৩০. মাথাব্যথা আর নেই
মাধবীলতা আমার ছোটবেলাকার বান্ধবী। লতা আর আমি ছোটবেলায় এক সঙ্গে বহু বিচিত্র এবং ভীতিকর সব অভিজ্ঞতা কুড়োনো দুই মেয়ে, যার মধ্যে রয়েছে নিষিদ্ধ-গোপন অপরাধ …। এরকম অভিজ্ঞতা গ্রামের মেয়েদের জীবনে স্বাভাবিক হলেও এসব ঘটনা অজানাই থেকে যায়। তার কারণ মেয়েদের জন্যে এসব অবিশ্বাস্য ঘটনা জানানোর ভাষা কখনোই হয়তো সৃষ্টি হবে না। তা সত্ত্বেও দু’একজন এর ব্যতিক্রম যে নয়, সেকথাও বলা যাবে না। মন্দিরের পেছনে। গোয়ালে। গ্রাম, শহরের অলিগলি। বেড়ার পেছনের ঘুপচি। পায়খানা। দেয়ালের ভেতরে। পরিত্যক্ত-বাসা। তিন বাড়ির মধ্যখানের লম্বা সুড়ঙ্গ হয় অপরাধের অলি-গলি। যেখানে জড়ো হয় পরিচিত অপরিচিত। আত্মীয়-অনাত্মীয়। প্রাপ্ত-অপ্রাপ্ত বয়স্করা, পর্নো দেখতে, পর্নো খেলতে। অপরাধ যার মূল পরিচয়। অপরাধ যা –ওপেন সিক্রেট।
আমাদের দু’জনেরই ভিন্ন দুই চরিত্র, দু’রকম স্বভাব। দু’জনের বিপরীত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমাদেরকে এতো দ্রুত কাছে টেনেছিল। যেন অনিবার্য চুম্বক।
অনেকেরই মুখে শোনা, ছোটবেলায় আমি ছিলাম ডানপিটে এবং অস্থির স্বভাবের। মা আমাকে শেখাতেন কাপড় ভাঁজ করা, রান্নার মশলা দেয়া। কার পরে কোনটা। মা বলতেন মেয়ে হতে, স্থির হতে। কিন্তু নারীর চিরাচরিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিপরীত আমি, মা যা বলেন শুনি। কিন্তু কি শুনি, মনে রাখি না।
মাধবীলতা আমার ঠিক উল্টো। স্থির এবং শান্ত। বিষণ্ণ চেহারা জুড়ে সুন্দর দুটো চোখ। চিবুকে বড় তিল। প্রতিমার মতো মুখে সুন্দরের অলঙ্কারে ভিড় না বাড়ালেও, বা গালে একটা রক্তজমাট দাগ। সব মিলিয়ে-মিশিয়ে মাধবীলতা আমার চোখেই শুধু নয় বরং শহরের সবার চোখেই পরমা সুন্দরী। ঘরে সত্য, বাইরে ভয়ানক নিষ্ঠুর পৃথিবী, দুটোই বিপজ্জনক। বন্ধুত্বের পাশাপাশি তাই মাধবীলতার ওপর থাকতো আমার অভিভাবকসুলভ দৃষ্টির ছায়া।
লতাদের বাড়ি আমাদের বাড়ির ডান পাশেরটা। দুই বাড়ির মাঝখানে কুল আর কদম গাছ। দীননাথ কাকার মনোহারী দোকানটা বাম দিকে। দোকানে অনেক কিছুর সাথে কাঠি লজেন্স পাওয়া যেতো। লাল-নীল-কমলা …। বাবা ছিলেন হাড় কিপটে বড়লোক। কাকা, বাকিতে বিশ্বাস করতেন না। বাকির নাম ফাঁকি, কাকার কথা। লজেন্সের দাম না দিতে পারলেও খেতে দিয়ে বিনিময়ে, লতা আর আমাকে যে প্রস্তাব দিয়ে বসততা, তা আমাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিল না। কাকার খুজলি ভরা পাছা চুলকে দিয়ে লজেন্স খাওয়ার মতো রুচি, আমাদের ছিল না। গ্রামের কাকা-জেঠাদের মধ্যে ছোটদের দিয়ে শরীরী কসরত করানোর এই প্রবণতা, ওপেন সিক্রেট।
মেয়েদের জামার মাপ দেয়া খুব বড় ধরনের একটা সমস্যা। খলিফাঁদের ফিতে বালিকাদের বুকের কাছে এসে আর নড়তে চাইতো না। সরতো না। ফিতে আর আঙুল, আমাদের সুপুরি বুকের আশপাশে ঝড়ে বিধ্বস্ত পাখির মতো স্থির হয়ে বসে থাকতো। পাখিটা নড়েচড়ে উঠলে, ব্যথায় কুঁকড়ে উঠতাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চেপেও যেতাম, ভয়ে। পোশাক তৈরি করতে গিয়ে, এমন অভিজ্ঞতা, প্রচুর। এ শুধু লতা আর আমার নয়। এ অভিজ্ঞতা অনেকের।
গ্রামে থাকলেও, সাধারণ গৃহস্থ ঘরের বৌ এক রক্ষণশীল স্বামীর স্ত্রী আমার, মা। তিনি ছিলেন একজন আধুনিক মনের মানুষ। দিনের ঝামেলাশেষে, বিকেল হতেই দুয়ারে বসতেন পান পাতা-জর্দা আর তাল পাখা নিয়ে। পাড়ার সধবা-বিধবা ওরাও সবাই আসতো। বসতো গল্পের বৈঠক। অকাল বৃদ্ধ রুনি মাসির স্বামী কি অসুখে মারা গ্যাছে, সে নিয়ে একদিন লাগলো তুমুল ঝগড়া। মাসি বলতে জ্বর। অন্যরা বলতো অন্য কিছু। বলতো, ভদ্রলোক মেথর পট্টির কাছের পতিতালয় থেকে জননেন্দ্রিয়ে গোলগোল চাকা চাকা ঘা নিয়ে এসেছে। যেখান থেকে রক্ত-পুঁজ এসব ঝরে। এক অজ্ঞাত কারণে পালিয়ে যাওয়া মাসির পুরোনো ঠোঁটকাটা এক প্রতিবাদী কাজের মেয়ে বুড়ি নাকি সেই কথা গ্রামসুদ্ধ সবাইকে ইচ্ছে করে রটিয়ে বেড়াচ্ছে। মাসি ওকে কিছু দিয়েই থামাতে পারছে না। অন্যদের তোপের মুখে টিকতে না পেরে মাসি কাঁদতে শুরু করলো। আমি আর লতা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে এসব গল্প শুনি। নীলু মাসি বারোটি সন্তানের পর না পেরে নিজেই স্বামীকে পতিতালয়ে পাঠিয়ে শারীরিক অত্যাচার থেকে বেঁচেছে। রচনা মাসি, এক নিশ্বাসে বলে যায়, বারো বছর তার স্বামী তার বিছানায় ঘুমোয় না। ঝগড়াটে একশ বছরের বুড়ি পিসি, প্রতিদিন এক কথা বলে। বিধবা মালতীর দশবার গর্ভপাতের কথা। পিসিমা মাকে কলিকাল শেষ হয়ে এসেছে বলে প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয়। পিসি নিজেও বিধবা হয় পঁচিশ বছর বয়সে। মার কাছে শুনেছি, বিয়ের সময় পিসে মশায়ের বয়স ছিল ষাট। পিসিমা বিধবা হলে, কটা গর্ভপাত তিনি নিজে করিয়েছেন একথা অন্য কেউ নয়, আশ্চর্য এই যে, বয়সের ভারে মেয়েদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য হারানো-পুরুষ পুরুষ চেহারার পিসি নিজের মুখেই হাসতে হাসতে অবলীলায় সবার সামনে বলে যান।
টুলি মাসিকে দেখে আমার খুব কষ্ট লাগতো। এত অল্প বয়সে, নারীত্বের ভরাট সব চিহ্ন শরীরে বয়ে, চুল কেটে, সাদা শাড়ি পরে, মাংস খাওয়া ছেড়ে কাম-রতি থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখতে তার সে কি প্রাণান্ত চেষ্টা! মাসির দিকে তাকাই আমি অন্য দৃষ্টিতে। কারণ বিদ্যাসাগর বা রাজা রামমোহন রায় তখন আমার পড়া হয়ে গেছে। এবং ছোটবেলা থেকে মেয়েদের জীবনের সঙ্গে আমি এভাবেই পরিচিত হতে থাকি। হঠাৎ হঠাৎ মাকে অদ্ভুত প্রশ্ন করলে মা বলেন, তুমি বুঝবা না। মনে মনে বলি, আমি কি বুঝি আর কি জানি, মা কেন কেউই সে খবর জানে না। কারণ আমি সেসব কথা। কাউকে কখনো বলি না। বলার ভাষাও জানি না। আমি জানি, অনেকেই যা জানে না। আমি জানি অন্ধকার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিন বাড়ির মধ্যখানে দখিনের চাপা গলির ভেতরে গ্রামের বালিকাদের অন্যরকম এক গোপন জীবনের কথা। যে জীবনে, ওদের সাথে নিয়মিত দেখা হয় কামুক বিশেষ করে, মধ্য বয়সের সব মামা, কাকা, দাদা, চাচাঁদের সঙ্গে। যেখানে কেউ কারো আত্মীয় সত্ত্বেও আত্মীয় নয়। পরিচিত সত্ত্বেও অপরিচিত। এক নীল রঙের জীবন।
আমার কষ্ট হতো দীনু কাকিকে দেখলে। কাকি প্রতিদিন একবার করে মার কাছে আসতো। মার সঙ্গে বসে পান পাতা খেতে খেতে কাকার চরিত্রের নিয়মিত দোষগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলে প্রতিদিন সে একই স্বস্তি খুঁজতো। কাকার এই দোষ; কাকার সেই দোষ কিন্তু নতুন কিছু নয়। পুরোনো অভিযোগ নতুন ভাষায়। ছোটবেলায়, কাকিকে আমি প্রথম দেখেছিলাম টকটকে সুন্দরী এক যুবতী। অথচ চোখের সামনে কি দ্রুত সে বুড়িয়ে গেল! কপালের চামড়ায় রুলটানা ভজ, চোখের তলে কালি। এ যেন অন্য এক কাকি। অকালে বুড়িয়ে যাওয়া কাকির শরীরে তখনো ঋতু হয়। শরীরে কামনা হয়; মনে অনুভূতি হয়। মাকে, কাকি গোপনে সেসব কথা বলে। বলে ছয়জন সন্তান-শেষে কাকা, কাকিকে আর স্পর্শ করেনি। মা, কাকিকে বুঝিয়ে বলেন, কুথাও তোর যাওনের। জায়গা নাই। মালতীর মায়েরে তুই তাড়াতাড়ি কৌশলে বিদায় কর। কাকি বলে, দীনু কইছে, তাইলে সেও বাড়ি ছাইরা চইল্যা যাবো। মালতীর মা, বাড়ির কাজের মেয়েলোক। আমার কানে বাজে অন্ধকার গলিতে সেদিন রাতে ফিসফিস গলায় মানুষের আওয়াজ। সেই গলিতে সেই অন্ধকার রাতে আমি আর লতা কাকে দেখেছিলাম। কি দৃশ্য দেখেছিলাম সে কথা কাউকে বলিনি এমনকি কাকিকেও না। মালতীর মায়ের শরীরের ওপরে দীনু কাকার অর্ধ উলঙ্গ শরীর।
গ্রামের অলিগলি। এক ভিন্ন জীবনের জন্য নিশ্চিন্ত জায়গা। এখানে আসে সময়ের বিভিন্ন প্রহরে ভিন্ন রকমের রকমারি মানুষগুলো। এখানে সবাই সবাইকে জানে, চেনে। জেনেশুনেও একজন আরেকজনকে না চেনার ভান করে। এখানে এসে তখন ওরা চাচা, দাদা, নানা, খালাত ভাই সম্পর্ক ভুলে যায়। এখানে সবাই কামার্ত জানোয়ার। এখানে। সবার শরীর থেকে বেরোয় কামের গন্ধ। চামড়ার গন্ধ। কে মামা, কে ভাই। এখানে সবার সঙ্গে সবার সম্পর্ক, দুটি মাত্র প্রত্যঙ্গ আর সেই সঙ্গে অধরোষ্ট, দাড়িম্ব আর কবি বর্ণিত অনন্ত রূপসুধা পান ইত্যাদি ইত্যাদি।
গ্রামে, বালিকাদের ঋতু এবং বালকদের কণ্ঠস্বর ভাঙার আগেই গ্রামের ছেলেমেয়েদের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, ওরা ছোটবেলা থেকেই অভিভাবকহীন জীবনে অভ্যস্ত বলে নিষিদ্ধ পথঘাটগুলো দ্রুত চিনে ফেলে। এভাবেই ওরা, অকাল পক্ক। এবং প্রায় বাড়ির পেছনের অব্যবহৃত আনাচে-কানাচে, গুদাম ঘরে, চিলেকোঠায়, অন্ধকারের একটা নির্দিষ্ট প্রহরে অনেকেই এসে জমা হয়। শরীরের সঙ্গে শরীরের অনুসন্ধান করে জানতে ও জানাতে তাদের কচি শরীরের অনুভূতি। কার কেমন প্রতিক্রিয়া। বালিকাগুলো উদোম করে দেয় তাদের সুপুরি স্তন। বালকেরা সেখানে নানা রকম কসরত করে। অনভিজ্ঞ বালকগুলো নোনতা জল ফেলে বালিকাদের মুখে। মধ্য বয়সের মামা, তালতো ভাই সম্পর্কের পুরুষগুলো যায় শরীরের আরো গভীরে। বিনিময়ে পয়সা, যথেষ্ট লজেন্স, চানাচুর এবং চিনেবাদাম, গলির মধ্যেই মেলে। অন্যের শারীরিক অনুসন্ধান দেখতে দেখতে বিকৃত রুচির একটা অভিজ্ঞতা খানিকটা তারা এখানেই অর্জন করে। মেয়ে-মেয়ে, ছেলে-ছেলেদের মধ্যেও অদ্ভুত মিলন এইসব চোরাগলিতেই সম্পন্ন হয়। অশিক্ষিত, আধুনিক, গ্রাম্য বা শহুরে জীবনের এই মানচিত্র, ছোটবেলায় অনেকেরই স্মৃতিতে চেনা পরিচিত বলেই মনে হবে।
রুমকিকে ওর মা গ্রাম থেকে আসা সত্তর বছর বয়সী চাচার সঙ্গে যাত্রা দেখতে পাঠাল। ফিরে এসে দেখে চাচা নেই। কিন্তু রুমকির সাদা হাফ প্যান্ট রক্তে লাল হয়ে গ্যাছে। এ নিয়ে রুমকির মা হৈ-হুঁল্লোড়ের তাগিদ অনুভব করেনি। কারণ এখানে ঘরের পুরুষের মান-সম্মান জড়িত।
বড়দের ধারণা ছোটদের সব কথা বিশ্বাস করতে নেই, কারণ ওরা ছোট। বড়দের ধারণা যে ছোটরা ঠিক বোঝে না, ওরা কি বলে। ছোটবেলায় জেনেছি, ছোট মুখে বড় কথা বলতে নেই। তাই বড়দের নষ্ট গল্প আমি আর লতা স্বেচ্ছায় চেপে যাই। কমল মামা আর কবিতার নষ্ট গল্প আমি জানি। কমল মামার কাছে কবিতাকে গছিয়ে দিয়ে কবিতার মা গীতা পাঠের আসর শুরু করলে সেই থেকে ওর যে অভিজ্ঞতার শুরু হলো, মামা চলে গেলে স্কুল কেটে নেশাগ্রস্তের মতো কবিতা, অলিগলিতে কিছু খুঁজে বেড়াতো। ক’মাস যেতেই, ওর মা গোপনে দু’-দু’বার গর্ভপাতশেষে ওকে, কোনওরকমে এক খোঁড়ার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বাঁচলো।
এক পাষণ্ড বাবা গলির অন্ধকারে, পেছন থেকে জাপটে ধরলো নিজের মেয়েকে। চিনতে পেরে ধরেই ছেড়ে দিলো। কিন্তু পরনের লুঙ্গিটা তখন মাটিতে। ঘরে ফিরে লোকটা আত্মহত্যা করলো।
আমি পড়ালেখা করি ক্লাসে ফার্স্ট হতে। তার মানে এই নয় যে এত দেখাদেখির পর একটা অস্থিরতা আমার মধ্যেও কাজ করে না। তবে আমি এও জানি যে, লতার মধ্যে সেই অস্থিরতা কাজ করে আমার চেয়ে বেশি। পড়া রেখে দীনু কাকার আলমারি থেকে চুরি করে আনা নরনারী, পড়ার বইয়ের পেটে ঢুকিয়ে লতা সেই ছবি দেখে হাসিতে ভেঙে পড়ে। আমি অপেক্ষা করি পড়া শেষ হওয়া অবধি। আর শেষ হতেই আমরা যাই, যেখানে জায়গাগুলো, চেনা। মানুষগুলো তার থেকেও বেশি। তোফা ভাই, মইনুল কাকা, অমলদা, নির্মল মাস্টার–। পাশাপাশি মন্টু-বিলি, উত্তম, মঈন সঙ্গে বিজলী, কবিতা, গৌরী, লিলি …। ভয়ে আমাদের গা কাঁপে। দূরে দাঁড়িয়ে আমি আর লতা এক অলৌকিক পুলকে কষ্ট পাই। কাকার দুই চোখ আমাকে ফেরায় সেই ভিড়ের আমন্ত্রণ এবং লোভ থেকে। কিন্তু কষ্ট কেউ ফেরাতে পারে না। আমি কষ্ট পাই, লতাও পায়। দু’জনেই বলি, দু’জনেই জানি। তবুও যেন না জানার একটা আদিখ্যেতা গোপনেই বয়ে বয়ে যাই।
ক্লাস সিক্সের পরীক্ষায় লতা দুই সাবজেক্টে ফেল করে বসলো। সৎ মা অকারণে ওর স্কুল বন্ধের ঘোষণা দিয়ে, পাড়ায় জানিয়ে দিলো–অর মাথায় খালি গুবর আছে। লতার মাথায় যে শুধু গোবর আছে সৎ মা না বললেও আমি জানি। এবং কেন আছে সৎ মা না জানালেও আমি জানি। জন্মেই মা মরা এই মেয়েটি, জন্ম থেকেই অযত্ন আর। অবহেলায় আগাছার মতোই বড় হয়েছে। সুতরাং ওর মাথায় গোবর না থাকাই অস্বাভাবিক। লতার স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলে প্রথম প্রথম আমারই কষ্ট হতো বেশি। কারণ গোবর মাথার লতা আমার প্রতিটি অবসর মুহূর্তের সঙ্গী।
মাধবীলতার সঙ্গে এই আচমকা বিচ্ছেদ, আমাকে নড়িয়ে দেয়। হৃদয়ে একটা ব্যথা প্রথম অনুভব করি যা আগে কখনো করিনি। এবং বুঝতে পারি পরবর্তীকালে আমার অনুভূতিগুলোর কুঁড়ি এখান থেকেই জন্ম নেয়। প্রথম, মাধবীলতাকে ঘিরে পরে জীবনে চলার পথে অন্য অনেককে ঘিরে। হৃদয়ের সেই প্রতিনিয়ত প্রেম ও ভালোবাসার ঘূর্ণি, এই সর্বনেশে সঙ্কট থেকে মুক্তি, মাধবীলতা পেলেও, জীবনে আমি কখনোই পেলাম না।
এভাবে কেটে গেল আরো দু’বছর। আমারও পড়ালেখার চাপ বেড়ে যায়। ক্লাস এইটে বৃত্তি দিতে হবে। সেন্টার পড়েছে, জেলা শহর ময়মনসিংহে। প্রায় সত্তর কিলোমিটার দূরে। বাসে, নৌকোয় ব্রহ্মপুত্রের ওপারে যেতে লাগবে প্রায় ঘণ্টা দশেক। এদিকে লতার বিয়ের জন্যে ওকে দেখতে ছেলের অভিভাবকেরা আসতে শুরু করে। এর মধ্যে দুইজনের বন্ধুত্ব আরেক ধাপ শিথিল হলো। আমি ব্যস্ত। বাধ্য হয়ে লতাও দূরে সরে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ এসে চুপ করে আমার পড়ার বইগুলো দেখে। আমি না বললে, সেও কোনও কথা না বলে চলে যায়। একটা অস্থিরতা ওর মধ্যে স্পষ্ট। কিন্তু আমি নিরুপায়। তার কিছু দিন পর। বেকার লতা একটা কাজ পেল। গুড় ভাঁজ করার কাজ। কাজটি ওকে দিলো দীনু কাকা।
মার মহিলা সমিতির আসরে অমনোযোগী স্বামীদের অবহেলিত বৌগুলোর সদস্য সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। অকাল বিধবা টুলি মাসি তার কাম-রতি পুরোপুরি নিবৃত্ত করতে এবার মাছ খাওয়া ছেড়েছে। কিন্তু সদানন্দকে সে ছাড়তে পারেনি। প্রতিরাতেই সদানন্দ আসে গলির পেছনে, আর লোক দেখানোর জন্যে চুল আরো কেটে, রঙিনের বদলে সাদা শাড়ি ধরেছে। অনেকগুলো শিবলিঙ্গ কিনে সে তার শোবার ঘরের পাশে ছোট মন্দিরটুকু ভরে ফেলেছে। মহিলাদের আসরে বসে মাসি নিয়মিত দাবি করে বলতো, মাঝ রাতে তার শিবলিঙ্গ দেবতার রূপ ধারণ করে। সে নিজ হাতে শিবকে খেতে দেয়। অনেকরকম জটিল চিন্তার মানুষ আমি কাউকেই বললাম না গভীর রাতে যখন সবাই ঘুম, আমি তখন পড়ার ফাঁকে জানালা দিয়ে টুলি মাসির ঘরে তাকিয়ে কি দেখেছিলাম। সদানন্দ কাকা কাকিকে বারবার জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে চলছে তো চলছেই। ওদের এরকম আদর দেখে প্রথম বুঝেছিলাম বিদ্যাসাগর আর রামমোহন রায়ের কথা। বুঝেছিলাম আমার সধবা মায়ের মতোই, বিধবার হৃদয়েও যে প্রেম আছে, থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কাম আর রতি আছে। একমাত্র আমি বাদে সবাই অবাক হয়ে মাসির দেবতার গল্প শোনে।
দীননাথ কাকি, একজন চির অসুখী। যার না জীবন, না যৌবন কোনওটাই সুখের হলো। তার অভিযোগ একগুণ থেকে লাফ দিয়ে তিনগুণ হলো লতাকে যেদিন কাকা গুড় ভাজ করার কাজটা দিয়ে দিল। এই কাজটা কাকিই করতো। করে হাতে কিছু পয়সা পেতো। কাকি এ নিয়ে অভিযোগ করলেই কাকা বলে, বাড়ি ছাইরা যাও। মা বলেন, তুই কুথায় যাবি। তর তো যাওনের কুনো জায়গা নাই। কাকির একমাত্র শান্তি, নিরন্ত কি কান্না। কাকি গানের সুরে, কাঁদে। কাকা দোকান থেকে জোরে ধমকে দিয়ে বলে, চোপ …।
মাঝখানে পেরিয়ে গেল আরো একটা বছর, ক্লাস এইটের বৃত্তি পাইনি। কিন্তু সেই থেকে যথেষ্ট পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তা আমি অনুভব করি। বিশেষ করে ক্লাস নাইনের ফাইনালেরও বেশ কিছু আগে থেকে তার সঙ্গে এমনকি প্রতিদিনকার নিয়মিত দেখাশোনাটিও তেমন হতো না। এদিকে তার বিয়ের যে সম্ভাবনা ছিল, সেটিও স্তিমিত হয়ে আসছিল যৌতুকের কারণে। একসময় ওর সৎ মা বিয়ের প্রসঙ্গটিও ইচ্ছে করেই ভুলে গেল।
আমি ম্যাট্রিকের প্রি-টেস্টের পড়া পড়ছি। মা দুটো অতিরিক্ত মাস্টার রেখেছেন। ম্যাট্রিকে ফার্স্ট ডিভিশন চাই বলে বাবা তার আগাম রায় দিয়ে দিয়েছেন। স্কুলের হেডমাস্টার তার আশা-ভরসার লিস্টে আমার নামটা ঝুলিয়ে দিয়ে প্রতিদিন একবার করে মনে করিয়ে দেন আমাকে কোন ডিভিশন পেতে হবে। লতা এলেও তেমন আর সুযোগ পায় না কথা বলার। বসে বসে শুধু বইয়ের স্তূপ ঘাটে। কিন্তু বেশ কদিন ধরে লক্ষ্য করছি ও যেন কি বলতে চায়। কিন্তু বলতে গিয়েও বলে না।
একদিন সৎ মার বাবা মারা যাওয়াতে সৎ মা দেশের বাড়িতে চলে গেল। সেখানে সম্পত্তি ভাগ করার কিছু ব্যাপারও আছে। লতা বাড়িতে একা। সৎ মা আসবে মাস তিনেক বাদে, সম্পত্তির ভাগ নিয়ে তবেই। এদিকে দীননাথ কাকি মার কাছে লতার নামে নালিশ করে নিজস্ব ভাষায় বলে যে, মেয়েটি বড় বেহায়া। কাপড়-চোপড়ের কোনও ঠিক নেই। লম্বা পা উদোম রেখে, যখন-তখন দোকানে যায়। মা জানেন লতা তেমন মেয়েই নয়। ঈর্ষা, যেহেতু ওর কাজটা লতা করছে ভেবে, মা কাকির অন্য অভিযোগগুলোর মধ্যে এই অভিযোগটিকেও উড়িয়ে দেন। মা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তুই কি কিছু দেখছস? আমি তো দেখি নাই। বললেন মা। মায়ের কথায় আমি সায় দিলেও, তার সবটুকুই মেনে নিতে পারলাম না। মা বললেন, ওইসবে কান দিয়ো না। লতা-ওইরকম মেয়েই না। কাকির মন থেকে সন্দেহ তবুও দূর হয় না।
এবার ক্লাস টেনের পড়াশোনা। প্রি-টেস্ট শেষ হয়ে টেস্ট শুরু। লতা গুড় ভাজ করছে নিয়মিতই, কিন্তু একটা অস্থিরতা ওর মধ্যে আমার কাছে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। ওর গলায় এক জোড়া ঠোঁটের লাল চিহ্ন মনে হয় আমি দেখেছিলাম। গলায় একজোড়া ঠোঁট যেন আকাশে চাঁদের মতো ঝুলে আছে। ওড়না দিয়ে ঢেকে লুকোতে চাইছিল কিন্তু আমার চোখ সে এত দ্রুত এড়াতে পারেনি। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক বলেই মনে হলো এবং সেই থেকে ওর দিকে আমি গোপনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখলাম। সৎ মা দেশে, বাবা ফেরে গভীর রাতে। রাতের অন্ধকারে ওকে বাধা দেয়ার কেউ নেই। থাকলেও পৃথিবীর অন্যান্য নিষ্প্রয়োজনের মতোই, কেউ তার প্রয়োজন মনে করে না। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে, শুধু আমারই গোপন চোখ, ওর পায়ে পায়ে, হেঁটে বেড়ায়। গলির ভেতরে, হাঁটে। এমনকি দীননাথ কাকিও সে খবর জানে না।
আমি সেদিন পড়ছিলাম, পরীক্ষার পড়া। কার পায়ের শব্দ যেন আমারই কানে আসে। অস্থির হাঁটা, একটু অস্বাভাবিক হাঁটার শব্দ, নিশ্বাস, পালিয়ে বেড়ানো অস্বাভাবিক নিশ্বাস, দৌড়ে যায় আমারই কানের পাশ দিয়ে। পেছন পেছন আমিও গেলাম, পরিচিত সেই চাপা গলিটার ভেতরে। লতা টের পেলো না। আমি গেলাম গোপনে, পা টিপে। হার্টের ড্রামপেটানোর শব্দগুলোকে একটা একটা করে গিলে খেতে খেতে।
লতা হনহন করে দ্রুত সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। পিঠভর্তি চুল। কুচি দেয়া গোলাপি রঙের ফ্রক, পরনে। যেন অন্ধকারে সে কিছুতেই লতা নয়। যেন শেওড়া গাছের ভূত। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আমি দেখছি, লতা কি দ্রুত অর্ধ উলঙ্গ হলো। যেন শেখানো। যেন স্কুল থেকে শিখে এসেছে। পাজামাটা ওর হাঁটুর নিচে। দীনু কাকার বিশাল শরীর ওর শরীরের ওপরে। কাকা গা দোলাচ্ছে। আমার চোখের সামনে নরনারী পত্রিকার ছবি, ছবির বদলে লতা আর কাকা। এরকম গা দোলানোর দৃশ্য আমার কাছে নতুন নয়। অন্যদিন কাকার সঙ্গে ছিল মালতীর মা। টুলি মাসির সঙ্গে সদানন্দ কাকা। ভোলাদা আর বেনুদি। মাসুদ, হেলাল, কাজল সঙ্গে সাথী, কচি, কবিতা। মালা আর মল্লিকা। শিশির আর হারাধন। আমি ফিরে এলাম হতবাক। বোকা। ঘামে ভেজা।
তার চব্বিশ ঘণ্টা পার না হতেই লতার মৃত্যু সংবাদ শহরে ছড়িয়ে পড়লো। বাড়িটা ভরে গেল অযাচিত মানুষের ভিড়ে। যারা শুধুই কৌতূহল খুঁজে বেড়ায়। লোকজন কি সব নষ্ট কথা সব বলতে শুরু করলো। শুনে, আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কি বলছে ওরা এসব! লতার পেটে বাচ্চা? আকাশে তখন মেঘ, সাথে দুর্যোগ। শুরু হলো, ঝোড়োবৃষ্টি, সঙ্গে বিজলি। দুয়ারে লতার মৃতদেহ নিয়ে বসে রয়েছে কয়েকজন বেকার মাতাল। কয়েক বোতল মদ ওদের জন্য অপেক্ষা করছে শ্মশানে। বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় ওরা মৃতদেহ সামনে রেখে মদের নেশার গল্পে ব্যস্ত। অন্যরা ব্যস্ত লতার পেটে ভ্রূণের গল্পে। ক’মাসের। কার ভ্রূণ। কোন পুরুষ এদিকে আসেনি দু’মাস! কাকে দেখা গেছে এড়িয়ে যেতে! কার মায়ের চোখের তলে কালি। কার মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারের বাড়ি যায় কে? কার সংসারে হঠাৎ দাম্পত্য কলহ শুরু হলো। কে কোন ঘরে-কোথায়…।
ক’দিন পরের কথা। সেই গলিতে আমি আবার ফিরে গেলাম। একা অজানা কৌতূহলে, গলির মধ্যে পরিত্যক্ত তোশক আর কয়লা ছাড়াও সেদিন দেখেছিলাম, বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাওয়া দু’টুকরো সাবানের অবশিষ্ট। আর একটা ছোট পিচকিরির মতো।
সেদিন বুঝিনি, এসবের অর্থ। তবে এখন বুঝি। বুঝি ওর মৃত্যুর কারণ। গর্ভপাতের ভুল চেষ্টা। পিচকিরিতে সাবানের জল ভরে। যা লতার জীবন কেড়ে নিয়েছিল। লতা নেই তবে দীননাথ কাকা আজো বেঁচে আছে। দোকানে বসে এখনো সে লাল-নীল কাঠি লজেন্স বিক্রি করে।
কাকার এই বৃদ্ধ বয়সে কাকির প্রতি অস্বাভাবিক রকমের মনোযোগের কারণে দীনু কাকি মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত হয়ে কিসব বলে। বুড়ো বয়সে পঙ্গু স্বামীকে টানতে হয় বলে অসুখী কাকি মাকে নিয়মিত অভিযোগ করে বলে, মরদ এহন যায় না গলির পেছনে! ক্যান যায় না? কাকি, আগের মতো আর অনুতপ্ত নয়। সে কষ্ট করে ওসব গলির পেছনে যায় না। বরং পাশের বাড়ির বৌ মরা গীতার বাবার সঙ্গে, চা খেতে খেতে ঘরের ভেতরেই দীর্ঘ সময় কাটায়। অর্ধেক পঙ্গু দেহী কাকার সেসবে কোনও মাথাব্যথা নেই।
৩১. নির্বোধের অনেক দোষ
পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষেরই বাঁচার অধিকার তার নিজস্ব, পৃথিবীর প্রতিটি নারীর স্বাধীনতা তার ব্যক্তিগত। আমি অনুভব করি, আমার অনুভূতিগুলো কোনও রকমেই পুরুষের চেয়ে ভিন্ন নয়। সোজা কথা এটা জীবনের অভিজ্ঞতা। এর চেয়ে বেশি কিছু কি আর বলার আছে! নারীর শরীরে অভ্যস্ত পুরুষ, নিজেই কি তা বোঝে না? সত্যিই বোঝে না! নারী ছাড়া কি পুরুষ, হয়? বনের পশুও তাড়না বোঝে। নদীর তৃষ্ণা হলে নদী, আকাশ বোঝে। পৃথিবী উত্তপ্ত হলে, পাহাড়ের নির্বাক গাছে বাতাস ফোটে। কামার্ত ঝিনুক পেটে বালির কনা ঘষে সঙ্গম মিটিয়ে তবে–গর্ভে ধরে, মুক্তো। আর নারী-পুরুষের সমান চাহিদা আছে বলেই দুটি হৃদয়ের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ যোনি আর লিঙ্গে ঘটে সঙ্গমের মতো একটা সুন্দর প্রক্রিয়ায়। সেখানে ঠিক সেই মুহূর্তে দুই বিপরীত লিঙ্গের মানুষ সম্পূর্ণ এক হয়ে, দু’জনেই একই সমতলে, এক সমান হয়ে যায়। মাস্টার অ্যান্ড স্লেইভ, সখিনা আর মনু মিয়ার কামের অনাবিল এই মুহূর্ত, কোনওরকম বিত্ত, মর্যাদা, অবস্থান ও যুক্তিতর্কের বাইরে। স্বর্গসুখতুল্য এই প্রক্রিয়া, এই অনুভব কোনও রকমেই নারী ও পুরুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। এতদসত্বেও নারীর অবস্থান কেন পুরুষের নিচে হবে তা আমাদের মাথায় আসে না। বহুবিবাহ কেন শুধু পুরুষের বেলায় প্রযোজ্য তাও আমাদের বোধগম্য নয়।
ইসলাম ধর্মে, পুরুষ মাত্রই একই সাথে চার চারজন স্ত্রীকে নিয়ে ঘর করতে পারে। প্রয়োজনে তালাকের বিষয়টি শুধু তিনবার উচ্চারণের এখতিয়ারে পুরুষের জন্য সহজ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া তিন তালাকের খড়গ ব্যবহার করে প্রতিবারই শুধু একজনকে হেঁটে দিয়ে সেই জায়গায় অন্য একজনকে দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করার পর একাধিক নারী সম্ভোগও আইনসিদ্ধ। অনেক মুসলিম দেশ বিশেষ করে তেল সমৃদ্ধ পুণ্যভূমি আরব দেশে তো একেকজন পুরুষ এমনি করে করে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশটা নারীদেহ আজও ভোগ করে থাকে হেরেম প্রতি পালনের সুবাদে। এবং দুর্ভিক্ষকবলিত আফ্রিকাতেও দুর্ভিক্ষের সুযোগ নিয়ে একেক সংসারে নারীর বাজার। এবং আফ্রিকাতে ইসলাম ধর্মের দ্রুত প্রসারের মূল কারণই ছিল চারটে বিয়ে। ধর্মের জনপ্রিয়তার কারণও তাই। চারটে বিয়ে। আজও, এখনও, আফ্রিকা-আরব। বিত্তে উল্টো কিন্তু নারীদেহ ভোগের প্রশ্নে, এক। ধর্মের জনপ্রিয়তা, যা ভৌগোলিক কারণে ও সংস্কৃতির প্রভাবে সব কন্টিনেন্টে ঠিক এক জনপ্রিয়তা পায়নি। পূর্বে, আমাদের তালুকে ও মুলুকে। পায়নি। তবুও প্রশ্ন থাকে। অনেক প্রশ্নই থাকে। থেকে যায়। নারী তার জৈবিক প্রয়োজনে অন্য পুরুষের সাথে সঙ্গম তো দূরের কথা সামান্যতম আসক্তি প্রকাশ করলেও, অনেক দেশেই ধর্মীয় মতে তাকে জ্বেনার অপরাধে দোররা মেরে হত্যা করা হয় এবং হচ্ছে। এবং রায়ের পর অপরাধিনীকে দু’এক মাসের বেশি সময়ও দেয়া হয় না। ফলে কোনওরকম আপিল বা অন্য কোন ধরনের হস্তক্ষেপের আগেই তাকে চলে যেতে হয় এই প্রিয় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। এ ব্যাপারে সরকারি কোর্ট বা ইসলামিক কোর্ট, কারো কথা শোনে না। প্রশ্ন, কেন, নারীর বিরুদ্ধে এই বৈষম্য? পুরুষের লিঙ্গের অবাধ স্বাধীনতামতো কেন নারীর যোনির অনুভূতি ও স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হবে না বা হয় না। এধরনের সঙ্কট বা ক্রাইসিস কি শুধু পুরুষের বেলাতেই সিদ্ধ আর নারীর বেলাতে হলেই যাবতীয় অশুদ্ধ। এ কেমন ধর্মাচার প্রশ্ন তোলা এবং জানার অধিকার মানুষ মাত্রেরই আছে।
পুরুষের মতো নারীকেও কেন দেয়া হয়নি একসাথে চারজন স্বামী রাখার অধিকার। এবং এই না দেয়ার পেছনে কোনও যুক্তিই যথেষ্ট নয়, যেখানে শরীর একাকি কথা বলার অধিকারী। শরীর যেখানে নির্দেশ করে। শরীর যখন বিদ্রোহ করে। তখন তার সমুচিত জবাব–শুধু শরীর ছাড়া না ধর্ম, না সমাজ, কেউ দিতে পারে কী? যাকে সহজ করে বলা যায় লিঙ্গের উত্তর দিতে পারে একমাত্র লিঙ্গই। পুরুষ যদি নারী চায়, তবে নারীও চাইতে পারে, পুরুষ। তাদের লোভ-লালসা, চাহিদা-ক্ষুধা এক। এবং এই নারী পুরুষই হলো, লিঙ্গ আর যোনি। ব্যক্তি নয় তাদের লিঙ্গ।
নারী কখন অন্য পুরুষের কাছে যায়!
ক. নপুংসক স্বামী : একজন সুস্থ শরীর এবং স্বাভাবিক অনুভূতিসম্পন্ন মেয়ের স্বামী যদি নপুংসক হয়, তখন যদি, তার শরীরে কামাবেগ সঞ্চারিত হলে স্বাভাবিক নিয়মে তা প্রশমিত না হলে নারীটির দৈহিক-মানসিক অবস্থা সহজেই অনুমেয়। বছরের পর বছর যদি এই একই অবস্থা চলতে থাকে তখন প্রশ্ন জাগে যৌবনবতী অতৃপ্ত সে মেয়েটির সামনে কোন পথটি থাকবে। সমাজপতিরা বলবেন আত্মসংযমের কথা। তখন ঐ ভণ্ড প্রতারকদের মুখে ঝটা মেরে বলতে ইচ্ছে করে কোন দোষে একটি সুস্থ সবল মেয়ের জীবন যৌবন এভাবে ব্যর্থ হবে? আর ব্যাপারটা যদি উল্টোটা হতো কথার কথা হিসেবে ধরা যাক মেয়েটি কামশীতল কিংবা গর্ভধারণের অনুপযুক্ত তখন সেক্ষেত্রে তারা কি বিধান দিতেন। পুং গর্দভটিকে নিশ্চয় আবার বিয়ে করানোর তোড়জোড়ে মেতে উঠতেন খোদ ছেলে পক্ষের মা-বোনেরা পর্যন্ত। অথচ এখন বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে অতি সহজেই সঠিক নির্ণয় করা সম্ভব সমস্যাটা কোথায় এবং কারণটাই-বা কি। -বোধহীন সমাজে সন্তানের আশায়, যা জেনেশুনে নপুংসক পুরুষকে একাধিক বিয়ে দিয়ে, একাধিক নারীর জীবন ব্যর্থ করার দৃষ্টান্ত কি কিছু কম? যেন সব দোষ নারীর।
নিরীহ মেয়েটাকেই পুরুষপ্রধান সমাজে বলি হতে হয়। এদিকে পূর্ণ সঙ্গম তো দূরের কথা স্বামী নটবরের পুরুষাঙ্গই উত্থান রহিত। দিনের পর দিন রাতের পর রাত অসুখী যুবতী স্ত্রীকে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকতে হয় তোকলজ্জার ভয়ে। মুখ ফুটে কাউকে বলতেও পারে না। বলতেও যে পারে না তাও নয় আসলে সাহস পায় না। তাই বলে মেয়েটির শারীরিক চাহিদার কথা তো আর অস্বীকার করা যায় না। এই সঙ্গে দাম্পত্য জ্বালা, সন্তান বাসনা, মাতৃত্বের মাধুর্য সবই কি বিসর্জন দিতে হয় একটি মানুষের অক্ষমতার জন্য। সুতরাং সে অবস্থায় মেয়েটি যদি সবাক হয়, আর জাতি ধর্ম নামক যাবতীয় সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করে কপট নিয়তি নির্ভর না হয়ে তার নিজের নারী জীবনের পূর্ণতা অর্জনে প্রয়াসী হয়; ভিন্ন পথ অবলম্বন করে তাহলে কে
বা কোন সমাজ তাকে দোষী সাব্যস্ত করবে। দেশে দেশে, যুগে যুগে নারীকে নষ্ট করে দেয়ার এরকম কত ঘটনা যে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা যায় তার ইয়ত্তা বোধ নেই।
খ. প্রথম দৃষ্টিতে তাকে ভালো লাগেনি হতেই পারে। ভিন্নরুচির লোক। বিয়ের আগে লোকটিকে হয়তো সে দেখেওনি। প্রথম রাতে দেখেই মনে হলো, কি কুৎসিত! তাহলে এই মেয়েটি কি করবে! যাকে দেখলেই বিশ্রী লাগে এমন একজন পুরুষ সঙ্গীকে তার এই অনুভূতি নিয়ে কি করে তার সঙ্গে সহবাস করবে?
গ. কামুক নারী হতেই পারে তার শারীরিক চাহিদা, পুরুষটির স্বাভাবিক ক্ষমতার চেয়ে বেশি। নারীর চেয়ে এই সমস্যা বেশি অবশ্য পুরুষেরই। কিন্তু এমন নারী আছে যার যৌন চাহিদা ঠিক মিটছে না। তারপরও বছরের পর বছর সে অতৃপ্ত যৌন জীবনযাপন করতে করতে একসময় যদি তার শরীর এবং দেহ মন বিদ্রোহ করে ওঠে তখন কি তার করণীয়। এমতাবস্থায় সে যদি কোনও পর পুরুষের সাথে দেহ মিলনে লিপ্ত হয় তাহলে তার অন্যায়টা কোথায়? স্বাভাবিক নিয়মে প্রকৃতির এই প্রয়োজনীয়তায় সাড়া দেয়াটাই কি তার অপরাধ! -ভাত কি কেউ মেপে খায়? যতবড় পেট, যত ক্ষুধা, ভাত, ততখানি লাগে।
মধ্য জীবনের সঙ্কট, বিদ্রোহ বিপ্লব কি শুধু স্বাধীনতা কিংবা নুন-পেঁয়াজ গ্যাসোলিনের দাম কমানোর বেলাতেই প্রযোজ্য?
শরীরী প্রয়োজন কেন বিপ্লব বিদ্রোহের বাইরে থাকবে? শরীরে যখন উত্তাল হরমোন এসে বয়ঃসন্ধিকালের টিনএজ শরীরটিকে টলিয়ে নড়িয়ে দিয়ে যায়, যখন কিশোরদের কচি মুখে গোঁফের হালকা রেখা কিংবা কিশোরীদের শরীরে কচি পেয়ারার মতো স্তনের উদ্দাম ঘটে, তখন এই শারীরিক পরিবর্তন কি প্রকৃতির ন্যায্য বিপ্লব নয়? যৌবনে, যখন নারী-পুরুষ রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হয় পরস্পর পরস্পরের সাথে, সেটা কি অনুভূতি বদলা-বদলির হার্দিক বিপ্লব নয়? দশ থেকে কুড়ি বছর বিবাহিত জীবনযাপনের পর মন-শরীর-অনুভূতি যখন বিগত কুড়ি বছর থেকে আলাদা হয়ে অন্য অনুভূতির পোশাক গায়ে চড়ায়, অন্যরকম কুড়ি বছরের জন্য তৈরি হয়, তাকে কি আমরা সময়ের বিপ্লব বলবো না!
মানুষ এক বাড়িতে চিরদিন বাস করে না। পোশাক, আহারের রুচি, অভ্যেস সবই পাল্টায়। এটাই নিয়ম। এটাই শাশ্বত। পুরুষ একাধিক নারীর কাছে যেতে রুচিবোধ করে। কিন্তু সমস্যা হলো নারীর মন-শরীর-অনুভূতি নিয়ে। এই ত্রয়ী’ যখন একসঙ্গে বিদ্রোহ করে বসে, সমাজ-ধর্ম এবং সংস্কার, তখন একযোগে বলে ওঠে–সর্বনাশ!
সর্বনাশ হোক আর বিপ্লব হোক একথা মিথ্যা নয় যে মধ্য জীবনের সঙ্কটে আক্রান্ত হয় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বিবাহিত নারী ও পুরুষ। পশ্চিমে বিবাহ বিচ্ছেদের হার যে পঞ্চাশ শতাংশ, এটিও তার একটি অন্যতম প্রধান প্রমাণ। কিন্তু পূর্বে, যেখানে বিবাহ বিচ্ছেদ –নারী স্বাধীনতা ইত্যাদির বালাই কম, কিংবা নেই বললেই চলে, সেসব দেশে এই সঙ্কটের আবর্তে পড়ে মুক্তচিন্তা বর্জিত অল্প ও অর্ধশিক্ষিত নারীরা কূপমণ্ডুক সমাজে এই বিপ্লব, না বুঝতে পারে, কিংবা বুঝলেও না তার কোনও সঙ্গত জবাব দিতে পারে। ফলে একগাদা সন্তানের জন্ম দিয়ে অকালে জীবন-যৌবন হারিয়ে আমাদের মধ্য বয়সী মা-মাসি-চাচি-মামি তারা নিজেদের অজান্তেই মধ্য জীবনের সঙ্কটে অনিবার্যতায় পড়ে যায়। শতকরা পঞ্চাশ ভাগই অল্প কিংবা বিস্তর মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভোগে। এই অসুস্থ মা-মাসি-চাচি মিলে আমাদের মেয়েদের জগৎটা আজও উপচে পড়ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে আমাদের এই মা-মাসিদের মধ্য বয়েসের নিঃসঙ্গতা-মানসিক কষ্ট-হতাশা-ব্যথা-বেদনা বোঝার মতন আশপাশে কাউকে দেখা যায় না।
অন্যদিক পুরুষের ক্ষেত্রে এই সব সঙ্কটের তেমন কোনও বালাই আছে বলে মনেই হয় না। পুরুষটির কাছে কেউ জানতে চাইবে না কেন তার ঘরে ফিরতে এত রাত হলো। কোথায় গিয়েছিল! কোন কাজে! কেউ অনুসরণও করবে না তার গতিবিধি। কারণ সে পুরুষ। তার জগৎটাই ঘরের সীমানার ঠিক বাইরে থেকে শুরু হয়। আর নারীর বেলায় পুরোপুরি উল্টোটা। তার সীমানা শেষ হয়, যেখানে পুরুষের শুরু।
যে-সব নারী জীবন মধ্যাহ্নের তাড়নায় আক্রান্ত হয়েছে বুঝতে পেরে সেটাকে স্বীকার করে নেয়ার মতো সাহস দেখাতে পারে, সমস্যা সেই সব নারীদের নিয়ে। সে যাবে তার কাছে, যাকে তার ভালো লাগে। সেজন্যে সে সবরকম মিথ্যাচার-অনাচারের মুখোমুখি হতে পারে, পথেঘাটে। যত শ্বাপদসঙ্কুল সাহায্য-সহযোগিতা নিতেও কুণ্ঠিত বোধ করবে না। হোক না কন্টক যেতে হলে সে যাবে। কারণ এই নারী আত্মঘাতী কোনও নারী নয়। এই নারী-সত্য। এই নারীকে আমার স্যালুট। কিন্তু সমাজ এই নারীর সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। তাতে নারীর কি কিছু আসে যায়? যায়। কোনও কোনও বর্বর সমাজে, যায়। এবং ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করে সমাজ। ধর্ম আবার সর্বাগ্রে কোণঠাসা করে নারীর অধিকার। অপচয় করে নারীর জীবন। সমাজ যা ধর্মভিত্তিক ধর্ম যা সমাজভিত্তিক দুটোই নারীর চরম শত্রু। এবং ধর্ম, সমাজ, প্রকৃতির বিরুদ্ধে। মধ্য বয়সের এই সমস্যার কারণ, প্রকৃতি! প্রকৃতির তাড়না। হরমোনের কেমিস্ট্রি। পরিবেশ এবং পরিস্থিতি। পুরুষ পারে–নারী পারে না। নারী নানান সঙ্কট শরীরে পুষে নিজে নিজে দগ্ধ হয়, পাকানো দড়ির আগুনের মতো ধীরে ধীরে, সে পুড়ে যাবে জানে বলেই, পুড়তে থাকে, নিঃশেষ না হওয়া অবধি।
৩২. হাত নয় যেন, সাপ
কখনো কোনও কাক্ষিত আনন্দ কি হঠাৎ বিষাদে পরিণত হতে পারে না? কখন, কার নিষ্ঠুরতায়, কিভাবে, সে আনন্দ যে ধুলোয় লুটায় তা কি কেউ অগ্রিম বলতে পারে? পারলে, পৃথিবীর সব আনন্দই কেন স্থায়ী হয় না? কেন নিশ্চিত হয় না? কখনো কখনো কোনও স্মৃতি কেন হয় আজীবন পরিতাপের? অভিজ্ঞতা হয় অসুন্দর।
বছরে একবার মার সাথে দাদুবাড়ি যেতে হতো শীতের ছুটিতে। দাদুবাড়ি পাবনা ছাড়িয়ে এক গহিন গ্রামে। সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থাটি ছিল খুব দুর্গম। প্রথমে ব্ৰহ্মপুত্র পার হয়ে ট্রেন। ট্রেন থেকে লঞ্চে নদী পার হয়ে ঈশ্বরদী। সেখান থেকে বাস নিয়ে মাসুন্দিয়ার দাদুবাড়ির ঠিক চার মাইল আগে। বাসটি থামতো। কাঁচা রাস্তা। এই চার মাইল বাস আর যাবে না। বাধ্য হয়ে হাঁটতে হতো গ্রামের ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে, দীর্ঘ পথ। কিছুক্ষণ পরপর পায়ে ফুটতো ছোট ছোট কাঁটা। কাঁটা টেনে ধরতো জামা, প্যান্ট। আমার তখন হাফ প্যান্ট আর ফ্রক পরার বয়েস। মা কেঁচড় ভর্তি গুড় আর মুড়ি দিয়ে দিতেন। মুঠোভর্তি করে গুড়-মুড়ি খেতে খেতে হাঁটতে থাকতাম বাড়ির দিকে। চার মাইল পথ। মা, কাকা, আর আমরা তিন বোন।
মার মাথার চুল তখনও কালো। দাঁত খুব একটা পড়েনি। মনে পড়ে মা তখন এক তেজী ঘোড়ার মতো। এইতো আরেকটু, এই তো। এই করতে করতে একসময় দেখতাম সত্যিই দাদুবাড়ি পৌঁছে গেছি। দিদিমা, বসে অপেক্ষা করছেন দুপুর থেকে ছোট মাছের চচ্চড়ি, দুধের ক্ষীর, ননী নিয়ে। দাদু, বারান্দায় বসে টাকার বস্তা নিয়ে সুদের হিসেব-নিকেশে ব্যস্ত। এই পৃথিবীতে কারো জন্যেই তার সময় নেই। দিদিমার জন্যে তো নয়ই। এই দুঃখ দিদিমার সারা জীবনের। এই দুঃখে দিদিমা–নিঃসঙ্গ পেঁচা। হতবাক-হতাশা-হৃদয়। তিন ‘হ’তে আক্রান্ত দিদিমা খুশি হন আমরা গেলে। দাদু আমাদের এসে শুধু একবার দেখে কাজে চলে গেলেন। চার মাইল পথ হাঁটার পর পেটে ভীষণ খিদে। দাদুবাড়িতে পৌঁছেই মনে হলো, ইস্ ভাত খেতে না জানি কত মজা! আজ অনেক ভাত খাবো। সন্ধ্যেবেলাকার ফুরফুরে বাতাস আসছিল বাড়ির চারপাশের গাছ আর দুয়ারের উল্টো দিকে বিশাল বাঁশ বাগান থেকে। মা বাগানটা দেখিয়ে বললেন, তার আড়াই বছর বয়সের সময়, ঠিক ঐখানেই একটা বিশাল বাঘ বসে ছিল। মা, বাঘের চোখের দিকে তাকিয়ে দুয়ারে বসে। সেদিন বাঘ যে কেন মাকে খেলো না আজো তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না। বাঘের গল্প শুনতে শুনতে সেই ফুরফুরে হাওয়ায় কুপির আলোতে, বাঘের ভয়ে, দুই পায়ে পা আড়াআড়ি চেপে, তবুও ভাত খেতে বসলাম রান্নাঘরের দুয়ার বরাবর। আমার চোখ-মুখ দেখে দিদিমা বললেন, ভয়ের কিছু নাই, ভাত খাও। ভাত এলো বড় বড় কাঁসার থালায়। এলো কাসার গ্লাসে জল। আর বসার জন্যে পুরু কাঠের পিড়ি যা এমনকি আমি শেরপুরেও দেখিনি।
রাতের বেলায় দিদিমার সাথে শুতে কাঠের পালঙ্কে গেলাম, তিনটে সিঁড়ি বেয়ে। খাটটি জমিদারদের থেকে কেনা। দাদুবাড়ির নতুন কেনা পালঙ্কের গল্প মার মুখে শুনেছি। উঁচু পালঙ্কে শুয়ে এবার মনে হলো, একি! কোন স্বর্গে এলাম! আসলে পালঙ্কটা সেভাবেই গড়া। মেহগনি কাঠে তৈরি খাট। অদ্ভুত হাতের কাজে তার চারটে দেয়াল। কি অপূর্ব জিনিস! জানি না এই পালঙ্কে দাদুর আগে কোনও রাজবাড়ির রাজকন্যা শুয়েছিল কিনা! যেখানে শুয়ে, সে প্রেম করেছিল তার রাজপুত্রের সঙ্গে। সেই পালঙ্কে শুয়ে শুয়ে দিদিমার কাছে ভূতের গল্প শুনতে শুনতে শুনি, রাতের বেলায় বেড়ার ওপাশ থেকে আসা শেয়ালের চিৎকার। ভয়ে আমরা জুবুথুবু। দিদিমা গল্প করেই যান, ভূত গান ধরলো। তারপর ভূত কি করলো,কারে ধরলো …। শেয়াল এবার আরো কাছ থেকে ডাকে, বেড়ার গা ঘেঁষে। দিদিমা বলেই চলেন, ভূতের পাঁচ পা! আমরা ভয়ে, বোনেরা সেদিন দিদিমার আরো কাছাকাছি জড়ো হতে থাকি।
তিনদিন পরে যেতে হবে মাসির বাড়ি সন্ন্যাসীবাধায়। এবারও পায়ে হেঁটে চার মাইল। যাবো মাসিকে আনতে। শুধু আমি আর কাকা। মা কোঁচড়ে আবার গুড়-মুড়ি দিলেন। মাসির বাড়ি একেবারেই ধুম পাড়া গাঁয়ে। মানুষ যে কি করে সেখানে বাস করে। যেতে যেতে সেটাই অবাক লাগলো। থাকার মধ্যে ফাঁকে ফোকরে দু’দশটা টিন আর মাটির বাড়ি আর ক্ষেতের পর ক্ষেত। আদিঅন্ত ক্ষেতে, ধান, মটর, ফুলকপি, সর্ষে শাক। চার মাইল হেঁটে মাসির বাড়িতে পৌঁছুলাম যখন, পা দুটো ফুলে ঢোল। মাসির সাথে কতদিন পর দেখা! আদুরে মাসি। নিজেও প্রচণ্ড আদর করলো তার আদুরে ভাগ্নীটিকে। খাওয়া-দাওয়া গল্প শেষে, গেলাম শুতে। মাসির কাঠের চৌকি। চৌকিতে ঘুমোতে গেছি, মাসি, মেসো, আমি। কাকা মাসির গদিঘরে। চৌকিতে একপাশে মাসি, মধ্যেখানে আমি, আর অন্যপাশে মেসো।
মাসি দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। তার কোনওদিন বাচ্চা হয়নি, হবেও না। ডাক্তার বলেছে ওর জরায়ু নেই। মেসো, মাসির সঙ্গে অতৃপ্ত জীবন সত্ত্বেও মাসিকে ফেলে দেননি বা দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। আত্মীয়দের অনেকেই তাকে দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা বলেছিল। কিন্তু মেসো কিছুতেই বিয়ে করলো না। সে জন্যে গ্রামসুদ্ধ মানুষ, মেসোর প্রশংসা করে নিজেদের ভাষায় বলতো, সত্যই কি ভালো! -হা সত্যি! নীলু সারাটি জীবনই দিলো পাগলি বৌয়ের জন্যে। অমন সোনার পুরুষ দেবতা কুলেই মেলে। নীলরতনের সুনাম, সমস্ত গ্রাম জুড়ে। আর নীলরতনের জন্যে। ঘরের বৌয়ের কাছে জব্দ হয় অনেক পুরুষ, তাদের কু-অভ্যেসের কারণে।
তখন গভীর রাত। মাসি ঘুমে অচেতন। বাইরে ঝিঁঝি আর শেয়ালের সরব উপস্থিতি, ঘরে কালো কুচকুচে অন্ধকার। আর এই গভীর আকাশ কালো রাতে, আমি ঘুমাতে পারছি না। পারছি না কারণ, কার সঙ্গে যেন আমার যুদ্ধ হচ্ছে। কিসের যেন এক প্রতিযোগিতা অথচ প্রতিযোগীকে আমি দেখতে পারছি না। সে হাত দিয়ে কিছু ধরতে চায়। হাতের সঙ্গে যুদ্ধ করে হাত ফেরাই। মাসির ওপাশ থেকে, মাসিকে ডিঙিয়ে আমার বুকের ওপর দিয়ে হাত হাটে। যতবারই সরিয়ে দিই, হাত সরে না। বরং ফিরে ফিরে বুকের উপর মুঠি পাকিয়ে এলেই হাতটা জাপটে ধরি। ফিরে যায়। আবার ফিরে আসে। হাত দুটো, আমার হাত এড়িয়ে, বুকের ওপর দিয়ে, এঁকেবেঁকে যায়। বুকে বাধা খেয়ে হাত যায় তলপেটে। পেট থেকে যায় আরো গভীরে-নিচে। কি করে একে থামাই! মনে তখন শুধু লজ্জাই নয়, ভয়ও। যদি সবাই জেনে যায়! এবার মেসো শুলো ঘুরে। আমার দিকে আরো এগিয়ে মাথাটি উল্টো করে দিয়ে। ওপাশ থেকে এবার একটা শক্ত লাঠির মতো কি যেন আমাকে তো দেয়। সারারাত যুদ্ধ এবং এমনি যুদ্ধ করে করে না ঘুমিয়ে সকাল হলো। মাসি উঠে দুয়ারে গেল। মেশো আগেই। উঠে গেছে। আমার মন ভীষণ খারাপ।
সকাল হতেই দাদুবাড়ি ফিরে আসার জন্য জেদ ধরলাম। মাসি বললেন, আজ না, কাল যাবি। আমি বলি, না। মেসো দাঁড়িয়ে। ওর দিকে তাকাতে ঘেন্না হচ্ছে। মনে হলো পা থেকে জুতো খুলে মারি! কিন্তু চুপ করেই রইলাম। বলার ভাষা জানা নেই। মাসি দুঃখ করে বলল, আমি না তোর মাসি! কেন যাবি এত তাড়াতাড়ি! মাসিকে আমি তবুও বললাম না, কেন চলে যেতে চাইছি। মেসো একটি টাকা হাতে দিয়ে লোকটি বললো, এই নেও। রাস্তায় তিলে খাজা কিনা খাইও। আমি টাকাটা নিলাম না। অনেক সাধলো। শেষ পর্যন্ত জোর করে খুঁজে দিলো। আমি ফেলে দিলাম। মাসি আমার দুর্ব্যবহারে কাঁদতে শুরু করলো। আমার বুকে টনটনে ব্যথা। আর মুহূর্তও বেশি দেরি না করে রওনা দিলাম। কাকা আর আমি হাঁটছি আর হাঁটছি। চার মাইল পথ কি সেদিন আমার আর শেষ হয়? যেতে যেতে পায়ে আটকে ধরে ছোট ছোট কাঁটা। আমি কাঁটার সাথে যুদ্ধ করে দাদুবাড়ির দিকে এগোই আর ভাবি গেল রাতের দুঃস্বপ্নের কথা। একটা হাত। হাত নয় যেন, সাপ। এঁকেবেঁকে হাঁটে সমস্ত শরীরে। দাদু বাড়ির আনন্দ, এভাবেই সেদিন বিষাদসিন্ধু হলো।
মাসি সারাজীবনই অসুস্থ। মেসো, তবুও বিয়ে করলো না। যার মাসুল জানি না, আমার মতো গ্রামের কত নাবালিকা-সাবালিকাকে দিতে হয়েছে! আজ ভাবি, ভালো ছেলে নীলরতনের কথা যার ত্যাগে সমস্ত গ্রাম প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমি জানি সে কেমন ত্যাগী পুরুষ। বরং সে যদি ফের বিয়ে করতো, সেটাই ভালো ছিল। অনেক অনেক পরে জানলাম, গ্রামের একাধিক ছেলেমেয়ের চেহারা ছিল নাকি অবিকল মেসোর মতো। এবং মেসো সেসব গরিব পরিবারে নিয়মিত আর্থিক সাহায্য দিতো। নিন্দুকেরা গোপনে বলতো, ওগুলো সব নীলরতনের সন্তান।
আমি জানি, এমন অভিজ্ঞতা আমার একার নয়। নাবালিকা-সাবালিকা, শিশু কিশোর, যুবতী মেয়েরা সবসময়ের জন্যেই, পুরুষদের বিকারের শিকার। নাসিমা, আকলিমা, ইন্দিরা, ললিতা, মিলি, শশী…। ওদের মধ্যে ললিতার বয়স আট বছর, যেদিন ওর এক দূর আত্মীয় ওর প্যান্ট খুলে আঙুল ঢুকিয়েই ক্ষান্ত হলো না। ওকে, ধর্ষণ করে রক্তাক্ত করে ফেললো। এ ধরনের অভিজ্ঞতার ঝুড়ি আমার উপচে পড়ে।