মা আমাকে ছোটবেলা থেকেই বলতেন, মেয়ে হয়েও ওর খুব বুদ্ধি। গাছের মতো মা আমাকে সর্বক্ষণ তার ছায়ায় রাখতেন। আমাকে নিয়ে তার একটি বিশেষ অহঙ্কার ছিল। বিদ্যুৎবিহীন গ্রামে বসেও তিনি বলেছিলেন এই মেয়েটি একদিন অনেক বড় আর ভালো মানুষ হবে। তার এই অসম্ভব বিশ্বাসের ভিত্তি বা সম্ভাবনা নিয়ে কেউ বিশেষ সন্দেহ করেনি। এবং বড় হয়ে আমি তার আশা পূর্ণ করেছিলাম। সবাই বলে আমি নাকি একজন ভালো মানুষ, সহজ-সরল। আজ মনে সন্দেহ জাগে এই সারল্যই কি আমার অভিশাপ? এই সারল্যেরই কি তবে প্রয়োজন ছিল? যদি তাই হবে তাহলে, রমা এবং বাবার এই কষ্ট, মা একাই কেন ভোগ করলেন? -কেন আমি সেদিনই সংসার ত্যাগ করিনি? কেন? এর উত্তর, প্রিতু। তুমি আমাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করেছ। একাকিনী মা। তার একটা চোখে ছানি। দু’পায়ে গিঁট বাত। তুমি সবই জানো। কিন্তু পুরুষত্ব–অন্যদের মতো তোমাকে পশুত্বে রূপান্তর করেছে।
ভার্সিটিতে যেদিন পরীক্ষার ফল বের হলো, বাড়িতে বেজায় খুশিতে আমার নিরক্ষর মা আবারো বললেন, মেয়ে নয় ও আমার ছেলে। কিন্তু যখন শিক্ষিত কোনও মানুষ আমাকে মনে করিয়ে দিতে চায় যে আমি মেয়েমানুষ এবং সেরকম আচরণ করতে, তখনই আমার নিরক্ষর মায়ের কথা মনে করে তোমাদের জন্য বড় আফসোস হয় যে, তার তুলনায় বড় বড় ডিগ্রির সার্টিফিকেট সত্ত্বেও তোমরা কত অল্পশিক্ষিত! মার কথা ভেবে বিশ্বাস করি যে, বড় বড় কলেজে গেলেই শুধু শিক্ষিত হওয়া যাবে না। শিক্ষার আলো, শুধু শিক্ষায় নয়, তার বোধের আলো দ্বারা প্রথমে উদ্ভাসিত হয়। বোধ। যা, আমার মায়ের আছে প্রচুর। যা তোমার মধ্যে তুলনায় যৎসামান্যই।
মনে রেখো, প্রদীপের তলায় থাকে বিশাল অন্ধকার। এই সুশিক্ষিত সমাজেও আজ বোধের যে বিশাল শূন্যতা; তোমাদের মতো বুদ্ধিমানদের বোধের অবক্ষয় বোঝাতে বোঝাতে জ্ঞানী-গুণীদের ভাণ্ডারও ফুরিয়ে যাবে। কারণ তোমরা যে জ্ঞানপাপী। জ্ঞানপাপীদেরকে বোঝানো আর সমুদ্রে মুক্তো খোঁজা সমান কাজ। এরপর থেকে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে, এটা করি, সেটা করি। করতে করতে সেই কাজও ফুরিয়ে যায়। ভাবি, আর কি নিয়ে ব্যস্ত থাকা যায়! বন্ধু খুঁজে বেড়াই। ভালো বন্ধু, যাদের সাথে কথা বলা যায়। যারা আমার সমমনা।
তাদেরই উৎসাহে নারীবাদ, সাহিত্য এসব নিয়ে অনুসন্ধানে লিপ্ত হলাম। সেজন্যে লাইব্রেরিতে যাই। এখানে-সেখানে বিভিন্ন ছোটখাট অনুষ্ঠানে যাই। এভাবেই পরিচয় হয় একগুচ্ছ মেয়ের সঙ্গে যে মেয়েগুলো বেকার সময় কাটাতে ঘুরে বেড়ায় দোকানে, রাস্তায়, পার্কে। কেনে যা কেনার প্রয়োজন নেই। কিনে কিনে ঘর ভরে। ভরে গেলে, জায়গার অভাবে আবর্জনার স্তূপে তা ফেলে দিয়ে আসে। ঘরকন্না এই মেয়েগুলো প্রায় সবাই শিক্ষিত। এদের মধ্যে গৃহিণী এক মেয়ে আইন বিশেষজ্ঞ। বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে এক সি.পি.এ.। কেউ সেলস্ গার্ল। স্বামীর সংসার করতে গিয়ে ওরা সবাই বিসর্জন দিয়েছে। ওদের পেশা এবং পেশার ভালোবাসা। কেউ স্বেচ্ছায়, অধিকাংশই অনিচ্ছায়। এদের মধ্যে একটা মেয়ে ছিল যে ছয় ঘরের বেতনে চাকরি করতো একটি বিশাল ল ফার্মে। সুন্দরী, স্মার্ট, প্রতিশ্রুতিশীল। স্বামী তাকে চার চারটি সন্তান উপহার দিয়ে তাকে গৃহবন্দি করে রাখার উত্তম বন্দোবস্ত করে রেখেছে।
মৃণাল জেগেছিল শতবর্ষ আগে যখন আধুনিকতার অভাব ছিল। আর শতবর্ষ পরে, প্রবাসের এবং দেশের বিপুল অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি যে, আমাদের আজকের মেয়েরা নিজে নিজে জাগে না, ওদেরকে কেউ জাগাতে পারে না। পারবে না মুক্ত করতে পুরুষের দাসত্ব থেকে। নাহিদকে ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও সংসারী হতে হলো, আমেরিকার মতো জায়গায়। তিনটে সন্তান মানুষ করছে সে। কিন্তু কাজে গেল ওর স্বামী। শিক্ষিত মেয়েরা সার্টিফিকেটের যে কি অপচয় করে এর উদাহরণের কি কোনও শেষ আছে? শিক্ষিত গৃহিণীদের ঘরে যত যাই, ততই অবাক হই। এরাই আত্মঘাতী; এরাই সংরক্ষণশীল। শিক্ষিত মেয়েরা বরং বিশ্বাস করে নারীর স্থান গৃহে। স্রেফ সামাজিক কুসংস্কার। স্রেফ ধর্মান্ধতা, যা অজুহাতে রূপান্তরিত হয়। বুঝি, ভার্সিটি পাস মেয়েদেরকে তোমরা কেন বিয়ে করো। যেন ওরা তোমাদের জন্যে শিক্ষিত সন্তান উপহার দিতে পারে। নয় কি? তার মানে এই যে, ঘরে শিক্ষিত স্ত্রী থাকলে, সন্তানও শিক্ষিত হবে। তাদের মধ্যে শিক্ষিত মেয়েরা যাবে স্বামীর ঘরে ফের শিক্ষিত সন্তান তৈরি করতে। যাদের মধ্যে থেকে মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি যাবে ভবিষ্যতে শিক্ষিত সন্তান তৈরি করতে, ছেলেরা যাবে কাজে। অর্থাৎ চক্রটা বৃত্তাকার।
তোমার সন্দেহকে সেবার প্রত্যাখ্যান করলাম। ছেলে বন্ধুগুলোকে নিয়ে এলাম বাড়িতে। তুমি বাধা দিয়ে বললে, শেফালী-রিতু-সেতু ওরা নেই কেন? এই প্রশ্নের ফলে আমার জগৎ আরো সীমিত হতে থাকলো। বাড়িতে একদিন এক অনুষ্ঠানে মুখের ওপর অপমান করে বসলে বয়স্ক প্রবীণদাকে। সে এক বিব্রতকর পরিস্থিতি। প্রবীণদা বয়োজ্যেষ্ঠ এক কবি, যিনি লুকিয়ে করিডোরে সিগ্রেট ফুঁকছিলেন। তুমি তাকে তক্ষুণি বের করে দিলে। প্রবীণদা, ভয়ে দৌড়ে বের হতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ব্যথা। পেলেন। ভারি বিব্রতকর এক পরিস্থিতি, তাকে আমি এ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। প্রবীণদার ডান পাটা ভেঙে গিয়েছিল। শুধু আমার অনুরোধে তিনি এ নিয়ে উকিল-আদালত করেননি। তা না হলে কি ঝামেলায় তুমি জড়াতে তোমার কোনও ধারণাই নেই। আমি তাও সইলাম। আর তখন আমার পেটে আবার তিন মাসের ভ্রূণ। তুমিও জানতে না। আমি চলে গেলাম ওম্যানস্ ক্লিনিকে। গর্ভপাত করিয়ে বাড়ি ফিরলাম। এরপর থেকে প্রিতুকে গল্পের ছলে তৈরি করি, মা ছাড়া পৃথিবীর জন্য। কারণ আমি জানি এ সংসার ছেড়ে আমাকেই যেতে হবে। আমি চলে গেলেও, প্রিতুকে তুমি দেবে না এবং এ দেশের কোর্টও তা দেবে না। আমি প্রিতুকে কোনও নিষ্ঠুরতার যুদ্ধে দাঁড় করাতে রাজি নই। নই, কোনও প্রতিযোগিতার যুদ্ধে। আগে আমি বাঁচবো। তারপর প্রিতুকে এমন মনোভাব নিয়ে, মনে মনে এগোতে থাকলাম মুক্তির চিন্তায়। বিবাহ বিচ্ছেদ এবং মৃণালের মতোই সংসার ছেড়ে, দূরে কোথাও চলে যাওয়ার। শুরু হলো উঁকিলের সঙ্গে কাগজপত্র নিয়ে। ডিভোর্সের ঝুট-ঝামেলা। লাভ-লোকসানের হিসেব তো বটেই।