এসবের কোনো উত্তর কি আছে শারিবার কাছে? সে চোখের থেকে হাত সরিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকায়। পীতেম থেকে শারিবার মধ্যেকার এই একশো বছরে বাজিকর স্থিতি পেয়েছে। এখন আর তাকে সহজে কেউ উচ্ছেদ করতে পারবে না, একথা এখন সব বাজিকরই বোঝে। আবার যদিও মাত্র কয়েক বছর আগেই ওমরের কবন্ধ যে অপরাধে এই নদীতে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, আজ যদি, শারিবা সেই মালতীকেই বিয়ে করে তবে নিশ্চয়ই আর সেরকম হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তার প্রথম কারণ বাজিকরেরা স্থিতি পেয়েছে, আর দ্বিতীয় কারণ ভায়রো যে ব্যবস্থাকে প্রাণপণ শক্তিতে আঁকড়ে রেখেছিল, তার মৃত্যুর পর বড় দ্রুত ভেঙে পড়ছে সেই ইমারত। বিরোধ বাড়ছে দিগর এবং দিগরবহির্ভূত মানুষদের মধ্যে। সব দিগরবহির্ভূত মানুষেরা বাজিকরদেরও সমর্থন চায়। শারিবা কালই ইয়াসিনকে বলবে সেইসব মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে যারা ভায়রো, আজুরা ও অন্যান্য ভূস্বামীর হিসাববহির্ভূত জমি দখলের চক্রান্ত করছে। এইভাবেই স্থায়িত্ব আসবে।
শারিবা শান্ত হয়। কিন্তু তারপরেই তার ইন্দ্রিয় প্রখর হয়। ঘাসের জঙ্গলের কাছে একটি ঘনীভূত ছায়া শুধু ছায়াই নয়, মনুষ্য আকৃতি বিশিষ্ট। এই অত্যন্ত অনাবৃত প্রাকৃতিক পরিবেশে এই সঞ্চরণশীল ছায়া দেখে সে শিহরিত হয়। প্রথমেই তার লুবিনি বর্ণিত রহুর কথা মনে হয় সে স্থির হয়ে অপেক্ষা করে।
ছায়াশরীর ঘাসের ঝোপের আবছা আড়াল ছেড়ে উন্মুক্ত বেলাভূমিতে আসে ও সমর্পণের ভঙ্গিতে মাটিতে বসে। শারিবা মালতীকে চিনতে পারে। মালতী এমন রুদ্ধ আবেগে কাঁদে যে শারিবার উঠে গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে সাহস হয় না। মালতী এইভাবে দীর্ঘ সময় কাঁদে।
তারপর একসময় শারিবা ধীরে ধীরে মালতীর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, তার মাথায় হাত রাখে। মালতী আতঙ্কিত চিৎকারে নদীতীরের স্তব্ধতা খান খান করে।
শারিবা তাকে দু-হাতে ধরে ও বলে, মালতী আমি শারিবা।
মালতী বিস্ফারিত চোখে তাকে দেখে, থরথর করে দেহ কাঁপে তার, সে নিমজ্জমান মানুষের মতো শারিবাকে দু-হাতে আঁকড়ে ধরে।
অনেকক্ষণ এভাবে থাকার পর শারিবা তাকে ঠিকভাবে বসায়। বলে, তুমি চিলালা ক্যান?
ডর লাগিছিল। ভাবলাম সি বুঝি হামার মাথাৎ হাত রাখে।
পাগল।
মানুষ মরলে কুথায় যায়?
মাটিৎ মিশা যায়।
সাচা? আর কেছু থাকে না?
থাকে, যি মানুষ মরে, অন্য মানুষের মনে থাকে সি। ইয়াই হামার জানা।
তবি যি মানষে কয়—
আর কিছু জানা নাই হামার।
তাই!
ইখানে আসিছিলা ক্যান?
সকালে কথাডা ক-লেন, মন যে বড় উতলা হল। তাই ভাবছিলাম চেংড়ার বাপের মন বুঝি। জীবনটা তো কাটাবা হবে।
সিটাই ভাববার কথা। ওমরকে তো ভুল কছি না। ওমর থাকুক মোসর মমানে।
মালতী একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে।
শারিবা বলে, আর কোনো কথা আছে মনে?
মালতী বলে, আমার চেংড়া?
শারিবা বলে, আমার চেংড়া হবে।
শারিবা উঠে দাঁড়িয়ে মালতীকে হাত ধরে তোলে, তারপর দুজনে গ্রামের দিকে ফিরতে থাকে।