এই দু-বছর বাজিকরপাড়াতেও যে কী বিপুল পরিবর্তন হয়েছে, তার খবর শারিবার পুরোপুরি জানা ছিল না। শুধু নমোশূদ্রদের লোভী পুরুষরাই মালতীকে জ্বালাতন করে না, বাজিকরদের জোয়ান ছেলেরাও করে। শারিবার ঘনঘন মালতীর ঘরে যাতায়াতে দু-একজন নজর রাখে এবং আকারে ইঙ্গিতে দু-চার কথা বলে। শারিবা সতর্ক হয়।
তারপর তাকে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে হয়। যে কটা সামান্য টাকা সে নিয়ে এসেছিল, তা খরচ হয়ে গেছে প্রায়।
যাওয়ার আগের দিন সে মালতীর সঙ্গে দেখা করতে আসে।
সে বলে, কাল চলি যামো, ঠিক করিছি।
কাল?
হাঁ।
ফের কবে আসপেন?
এখন কই কেংকা?
মালতী চুপ করে থাকে।
শারিবাই আবার বলে, এটা কথা ক-বার চাছি।
ক-ন।
কি বা আবার ভাবেন তুমি—
ক-ন।
ই চেংড়া ছাবাল নিয়া কতদিন এংকা একা থাকবা তাই ভাবি।
করমো কি?
ই ভাবে তো মেয়ামানষে থাকবা পারে না।
রূপায় কি?
রূপায় তো এটাই, বিহা কর।
মালতী হাসে, ম্লান হাসি। তারপর তার চোখে জল আসে। মুখ আড়াল করতে সে ভেতরে ঢুকে যায়।
শারিবা দ্বিধায় পড়ে যায়। কথাটা বলে কি ভুল করলাম? সে ভাবে। সে অনেকক্ষণ একা বসে থাকে। মুসলমানি ও হিন্দুয়ানিতে বিভক্ত বাজিকরেরা রহুকে বিস্মৃত হয়ে গেছে, একথা এবার সে গভীরভাবে ভেবেছে। হতাশার হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য সে আর রহু চণ্ডালের হাড় খুঁজবে না, একথা বোঝে শারিবা। অনেক চিন্তা করেও সে বুঝতে পারে না, এতে বাজিকরের ভালো হল কি খারাপ হল।
শহরে হানিফের সহায়তায় সে একটা চাকরির দরখাস্ত করেছিল। সরকারি বাসের ক্লিনারের চাকরি। দরখাস্তের যে জায়গায় ধর্মের কথা লেখা আছে, সেখানে কি লেখা হবে সে নিয়ে বড় সমস্যা হয়েছিল। হানিফ পরামর্শ দিয়েছিল, যা হোক একটা লিখে দিতে হয়, হিন্দু নয় মুসলমান। কেন যেন শারিবা রাজি হয়নি। বলেছিল, লিখেন—বাজিকর। বাজিকর! এমন আবার ধর্ম হয় নাকি? হয় না? নাহলে কেন এত লাঞ্ছনা? দরখাস্ত লেখক বলেছিল, এতে চাকরি হবে না। হয়ও নি, সে যে-কোনো কারণেই হোক না কেন।
এখন শারিবা এত তীব্র দ্বন্দ্বে ভোগে। রহুকে যারা রক্তের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছিও সেই দনু, পীতেম, জামির এরা কি বাজিকরের পৃথক অস্তিত্ব রক্ষা করতে চেয়েছিল, না চেয়েছিল বাজিকর সবার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাক? রূপা কিংবা ইয়াসিন ঠিক কাজ করেছে, না পৃথক অস্তিত্বের দম্ভ নিয়ে শারিবা ঠিক কাজ করছে? এইসব সমস্যার সমাধান এখন খুবই জরুরি। তার বয়স এখন। বত্রিশ-তেত্রিশ হবে। এখনো পর্যন্ত সে বিয়ে করেনি, ঘরসংসার করেনি, তার সমাজে এবং পুরো গ্রামসমাজেই আশ্চর্যের বটে। লুবিনি তাকে বলত বুঢ়া’, বলত সে নাকি পীতেমের থেকেও বৃদ্ধ। অথচ এই বার্ধক্য লুবিনিই সঞ্চারিত করেছে তার মধ্যে। শারিবা শুধু বৃদ্ধ নয়, শারিবা প্রাচীন। তাই শারিবা আলোছায়ায় সঞ্চরমাণ বহুর মতো বিষণ্ণ। ৪)
দীর্ঘ সময় বসে থাকার পরে যখম মালতী ঘর থেকে বার হয় না, তখন শারিবা মনস্থির করে ফেলে। সে মালতীকে আঘাত করেছে, এতে সে স্থির নিশ্চয় হয়, দুঃখ ও লজ্জা পায়। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, মালতী আমি উঠি।
মালতী দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়, তার চোখ সিক্ত। শারিবা তার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চিন্তা করে, আমার সঙ্কোচ বোধ করার কি আছে। আমি অত্যন্ত দরকারি একটা কথা বলেছি। সে সোজাসুজি তাকায় মালতীয় চোখে। বলে, যদি বেথা দিয়া থাকি তুমাক, তবি মাপ করি দিবা। কেন্তু যি কথাটা কলাম সিটা ভাববার।
মালতীর চোখ আবার উপচে পড়ে। সে কিছুই বলতে পারে না, কোনো কথা নয়।
৬৩.
সারাদিন শারিবা থাকে একটা ঘোরের মধ্যে। সে কাল শহরে চলে যাবে, আবার কি ফিরে আসবে এই মানুষগুলোর মধ্যে? বাজিকরদের সঙ্গে যোগসূত্র রাখার আর কি কোনো দরকার আছে? শা-জাদিও রূপাকে সে কী বলে যাবে? শরমীকে কী বলবে? শরমী তাকে বিয়ের জন্য বড় বেশি চাপ দিচ্ছে।
রাতের অন্ধকার নামলে শারিবা পাতালু নদীর দিকে চলতে শুরু করে। আজ আকাশে চাঁদ আছে। পৃথিবী রহস্যময়। অনেকক্ষণ নদীর পাড়ে সে একা বসে থাকে। তারপর একসময় ফিরবার জন্য সে উঠে দাঁড়ায়, তারপর অন্যকিছু চিন্তা করে গ্রামে ফেরার বদলে নদীর বাঁওড়ের দিকে এগোয়।
নিস্তব্ধ বাঁওড়ের চারপাশে একমাত্র হাওয়ার শব্দ। চাঁদের আলোয় দীর্ঘ গাছ এবং নিচের ঝোপঝাড়ে আলোছায়ার লুকোচুরি। নদীর পাড় থেকে ঘাসের জঙ্গল উঠে গেছে একদিকে। আধামানুষ সমান ঘাসের জঙ্গল। সেখানে সঞ্চরণশীল ছায়ার দিকে শারিবা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। লুবিনি এই ছায়ার মধ্যে ঢুকে বসে আছে। এখন সে ভাবে, তবে কি রহু তৃপ্ত? বাজিকরদের আর কিছু না হোক স্থিতি হয়েছে। আর কোনো বাজিকর কোনোদিন এই গ্রাম ছেড়ে নতুন করে রাস্তায় বেরোবার কথা ভাববে না। এখন তার যা কিছু ভাবনা তা এই দরিদ্র হতশ্রী কুঁড়েঘরগুলোকে কেন্দ্র করে, এতে শারিবার আর কোনো সংশয় থাকে না। কিন্তু শারিবার রক্তের অস্থিরতা কাটে না কেন? কেন লুবিনির কঁপা কাঁপা হাত তাকে এখনো অনেক কিছু দেখাতে চায়? সে আলোছায়ার দিকে তাকিয়ে পীতেমের মার খাওয়া দেখে, পেমার আর্তনাদ শোনে, নমনকুড়ির বন্যার জল ক্রমশ বেড়ে উঠে সর্বনাশ হতে দেখে, নৌকার গলুইয়ের উপর রক্তাক্ত জামিরকে দেখে। সে দেখে লুবিনিকে ধর্ষিতা হতে, হাতির পায়ের চাপে ঘর ভাঙছে, শিশু মরছে। পলায়নপর বাজিকর গোষ্ঠীকে সে দেখে জল কাদা ভেঙে পাতালু নদীর তীর ঘেঁষে ছুটতে। সে দেখে সেই ভীবৎস রাত, যখন তার ভাই সাপের কামড়ে মারা যায়। আরো কত জানাঅজানা দৃশ্য সে সম্মোহিতের মতো দেখে। তারপর সবশেষে ওমরের ছিন্ন মুণ্ড যখন আকাশপথে তার দিকে ছুটে আসতে থাকে তখন সে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে। দু-হাতে মুখ ঢেকেও রেহাই পায় না সে। ওমরকে সে বলতে শোনে, শারিবা তুই হামা বাচাবু বলিছিলি!