পাড়ার মধ্যে পথ চলতে শারিবা ওমরের ঘরখানার সামনে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। ঘরের দাওয়ায় বছর তিনেকের একটি শিশু খেলছে। আসার দিনই রূপার কাছে সবার খোঁজখবর নিতে গিয়ে সে শুনছিল ওমরের মা বছরখানেকের হল মারা গেছে। এই শিশুটিকে দেখে সে কিছুই চিন্তা করত না যদি না পরক্ষণেই মালতী ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসত। মালতীকে দেখে শারিবা স্থাণু হয়ে যায়। যায়।
মালতীকে এখন তপস্বিনীর মতো দেখায়। তার একমাথা রুক্ষ চুল, দিঘির মতো বিশাল চোখ ও সমস্ত শরীরে কৃচ্ছসাধনের জন্য একটা টানটান তীক্ষ্ণতা।
মালতী শারিবাকে দেখে, কোনো কথা বলে না। খেলতে খেলতে শিশুটি উঠোনে নেমে এসেছিল। শারিবা তার মাথা স্পর্শ করে, শিশু অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। তারপর শারিবা আবার রাস্তা ধরে চলতে শুরু করে।
হাঁটতে হাঁটতে সে মোহরে আকালুর দোকানে আসে। আকাল তাকে মালতীর বৃত্তান্ত বলে।
হ্যাঁ, শিশুটি ওমরেরই ছেলে। মালতীর বাপ-মা চেষ্টা করেও তার আর বিয়ে দিতে পারেনি। প্রথমত, বাজিকরের ছোঁয়া মেয়েকে বিয়ে করার লোকের অভাব। আর দ্বিতীয়ত, মালতী কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি হয়নি। তারপর মালতীর বাপ মরে। এতদিন যদিবা কোনোমতে চলছিল, কিন্তু এখন ভাইদের সংসারে মালতী তার শিশুকে নিয়ে সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। তাছাড়া, মালতীর মতো মেয়ের কাছে পুরুষমানুষ গোপনে আসতে চাইবে, এও তো স্বাভাবিক। কিন্তু মালতী তার জীবনের প্রধান ঘটনাগুলোর কোনো স্বাভাবিক ব্যাখ্যা পায়নি কারো কাছ থেকে। কাজেই একদিন সন্ধার পর তিক্তবিরক্ত হয়ে সে এক ব্যক্তিকে দায়ের কোপ মারে।
ঘটনাচক্রে সে ব্যক্তি বাইশ দিগরের অন্তর্ভূক্ত, যা মালতীর বাপ ছিল না।
এতে ভীষণ গণ্ডগোল হয়। ভায়রো যদিও ছিল না, তাই বলে দিগর একবারে ভেঙে যায়নি। মালতীর ভাইদের উপর চাপ আসে নানারকমের। সুযোগ বুঝে ভাইবউরাও এই কাঁটা উপড়ে ফেলার ব্যবস্থা করে। মালতীর বড় ভাইয়ের মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হয়েছিল। কিন্তু দুই দুই ঘর পাত্রপক্ষ মালতীর অজুহাতে কথাবার্তা বেশিদূর এগোতে দেয়নি।
কাজেই মালতীকে ঘর ছেড়ে আসতে হয়। কাউকে কিছু না জানিয়ে সে ওমরের জীর্ণ ঘরখানা দখল করে। খবর পেয়ে ইয়াসিন এসে তাকে বলেছিল, একি বেপার? তুমি এঠি থাকবা কেংকা?
মালতী এ ঘর তার স্বামীর ঘর হিসাবে দাবি করেছিল, তাতে বাজিকরপাড়ায় বিস্ময়ের ঢেউ বয়ে যায়।
কিন্তু ইয়াসিন আবার ঝামেলার ভয় করেছিল। সে মালতীর দাদাদের কাছেও গিয়েছিল। তারা এ সম্পর্কে ভালোমন্দ কোনো কথাই বলেনি। ইয়াসিন তারপর দিগরের মাতব্বরদের কাছে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানেও ভাঙন শুরু হয়েছে। এসব ছুটকো ব্যাপার নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামাতে বিশেষ রাজি ছিল না। মালতী সেই থেকে এখানেই আছে।
শারিবা বলে আছে তো, খায় কি? খোয়ায় কি চেংড়াটা?
ক্যান কাম করে। মালতী স্থাষের কাম জানে, খোলানের কাম জানে। আর খুব পয়-পরিষ্কার। যারোজগার করে মা-বেটা দুজনার চলি যায় কোনো মতে। আর সবাই যখন পাকুড়পাতা, নাজনাপাতা খায়, সেও তাই খায়।
দোকান থেকে ওঠার সময় এক প্যাকেট বিস্কুট কেনে শারিবা।
আকালু বলে, মালতীর কাছে যাবি?
শারিবা বলে, আজ নয়, কাল।
পরদিন শারিবা মালতীর বাড়ি যায়। মালতী ঘরে ছিল না। আগের দিনের মতো তার ছেলে দাওয়ায় খেলছিল।
শারিবা দাওয়ায় একপাশে বসে তাকে কাছে ডেকে নেয়। অপরিচিত মানুষ দেখে শিশুর চোখে আতঙ্ক হয় একটু। তাছাড়া সে পুরুষমানুষের সাহচর্যে অভ্যস্ত নয়। শারিবা পকেট থেকে বিস্কুট বের করে তার মুখে দেয়।
কি নাম তুমার?
শিশুর ভয় কাটে না। এক অপরিচিত মানুষের কোলের মধ্যে বন্দী সে।
শারিবা বলে ভয় কিরে বেটা? খা, বিস্কুট খা।
মালতী পুকুরঘাট থেকে ফিরে দেখে তার ছেলে শারিবার কোলে বসে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। ছেলেকে আদর করলে কোন মা না সন্তুষ্ট হয়। কিছু না বলে সে ঘরে ঢুকে যায় এবং এক টুকরো খেজুরপাতার চ্যাটাই নিয়ে বেরিয়ে আসে।
মাটিং বসলেন, দাদা?
আরি ঠিক আছে।
শারিবা চ্যাটাইটা মালতীর হাত থেকে নিয়ে তার উপরে বসে। বলে, ছেলা তো তুমার খুবই চালাক।
মালতী হাসে। ঘাড় বেঁকিয়ে শারিবাকে তার দিকে তাকাতে হয়, কেননা মালতী দাঁড়িয়েছে দরজার কাছে, তার সঙ্গে কোনাকুনি, সামনাসামনি নয়।
শারিবা তার পরেও ছেলের সাথেই কথা বলে, মালতীর সাথে কি যে কথা বলা যায়, তা সে ভেবেই পায় না, একটা অপরাধবোধ তার ভেতরে কাজ করে, যা সে কখনো ভুলতে পারে না। ওমরকে সে বাঁচাবে বলেছিল, কিন্তু বাঁচাতে পারেনি।
ওঠার সময় মালতী নিয়মমতো আবার আসার কথা বলে। নিয়মমতো শারিবাও ‘আচ্ছা বলে।
পরদিন শারিবা আকালুর দোকান থেকে আরার বিস্কুটের পাকেট কিনলে আকালু চোখ নাচিয়ে বলে, ক্যারে শারিবা?
শারিবা আহত হয় ও লজ্জা পায় সে কোনো কথা বলে না, হাত বাড়িয়ে একটা বিস্কুটের প্যাকেট তুলে নেয় শুধু।
আকালুই আবার বলে, মালতী কিন্তু হাঁসুয়ার কোপ মারে শারিবা, সে খ্যাল রাখে।
শারিবা এবার বিরক্ত ও অপমানিতও বোধ করে। সে বলে, তোর অনেক পয়সা হচ্ছে নারে আকালু?
কি কথায় কি কথা!
ঠিক কথা। শারিবাক্ চেনো না তুই?
ছাড় সে উসব কথা, মজা করলাম। কথাডা কি বিহাসাদি কি বুঢ়া বয়সে করবু? তোর বাপ বলিছিল—
এভাবে পরপর তিন-চারদিন শারিবা বিস্কুট নিয়ে মালতীর বাড়ি যায়। মালতীর ছেলেটি তার খুব নেওটা হয় ও মালতীও খানিকটা সহজ হয় তার কাছে।